জিযিয়াঃ মানবতা বিরোধী?! নাকি মানবহিতৈষী?!
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ১২ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:৪৬:৪৮ সকাল
ইসলাম মুখে মানবতাবাদের কথা বললেও বাস্তবে তার উল্টো। যারা ইসলামিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা বলে থাকে ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম হলে অমুসলিমরা তাদের পূর্ন ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তার আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য জিনিস-জিযিয়া। ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের শুধুমাত্র মুসলমান না হবার অপরাধে এক বিরাট করের বোঝা মাথায় নিতে হবে, যার নাম জিযিয়া। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, জিযিয়া যাকাতের পরিপুরক। মুসলিমদের যাকাত দিতে হয়, কিন্তু অমুসলিমদের যাকাত দিতে হয়না বলে যাকাতের পরিবর্তে তাদের জিযিয়া কর দিতে হয়।যুক্তিটি সম্পূর্ন খোঁড়া। কারন যাকাত দিতে হয়, যদি নিজ খরচের পর সারা বছর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ন বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমপরিমাণ মূল্যের অন্য সম্পদ জমা থাকে, কেবল তাহলেই। আর জিযিয়া দিতে হয়- ধনী গরীব সবাইকেই। আর তা শুধুমাত্র একটা অপরাধের কারনে-তারা অমুসলিম।
বিভিন্ন কাঠমোল্লাদের অস্পষ্ট বক্তব্যের প্রভাবে এবং ইসলাম সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অভাবে- নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলেও এ কথাগুলো মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এবং এমন ধারনা সৃষ্টি হবার পেছনে আমি সবচেয়ে বেশি দায়ী করবো কাঠমোল্লাদের। কারন এ জিযিয়ার কথাটাকে তারা কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষন ছাড়াই গলা পাটিয়ে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে- অমুসলিমদেরকে জিযিয়া দিয়ে থাকতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের এসব অস্পষ্ট ও আংশিক বক্তব্যের প্রভাবে ভালো মনের মুসলিমদের মনেও ইসলাম সম্পর্কে মানবতা বিরোধী একটা চিন্তা জাগ্রত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। মহান আল্লাহ তাওফিক দিলে আজ এ নিয়ে খানিকটা আলোচনা করতে চাই।
জিযিয়া হলো মূলত সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতিজনিত কর।এন্সাইক্লোপেডিয়া ওব ইসলামে বলা হয়েছে, ‘The Zazia as a tax on the free from military service’. ইসলামিক রাষ্ট্রে দেশ, দেশের সীমানা এবং জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হলে ঐ রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রতিটি মুসলিম যুবকের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলকভাবে দেশ ও জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য প্রতিটি মুসলিম যুবককেই যুদ্ধ করতে হবে। কেউ এতে অসম্মতি জানালে তাকে গ্রেফতার করা হবে। তবে অমুসলিমদের যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তাই তারা যদি যুদ্ধে যেতে না চায়, তবে তাদের একটি কর প্রদান করতে হবে, যার নাম জিযিয়া। এ করের বিনিময়ে মুসলিমরা নিজেদের জানমাল রক্ষার মতই তাদের প্রতি অনুগত অমুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে বাধ্য থাকবে। তাই জিযিয়া কেবলমাত্র সেসব যুবকের উপরই ধার্য্য হবে যারা উপার্জনক্ষম এবং যুদ্ধে যাবার ক্ষমতা রাখে। আর যদি তাদের কেউ মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়, এবং সেনাপ্রধান তাকে বিশ্বস্ত বলে মনে করে, তবে তার উপর জিযিয়া প্রযোজ্য হবেনা। শুধু তাই নয়, হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর সময় অমুসলিমরা যদি রাষ্ট্রের কোন কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত হত তবে তাদের যিযিয়া মউকুফ করে দেয়া হতো।পক্ষান্তরে মিশরীয় মুসলিম কৃষকদের যখন সৈন্য বিভাগে যোগদান থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হল তখন তাদের উপর খ্রীষ্টান অধিবাসীদের মতোই এই কর ধার্য করা হয়েছিল’ । [The Preaching of Islam; P-63]
যুদ্ধে যাবার ক্ষমতা যাদের নাই, অর্থাৎ নারী, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্দী- তাদের উপর কোন প্রকার জিযিয়া ধার্য হবেনা।
শুধুমাত্র যুদ্ধে যেতে সক্ষম যুবকের উপরই জিযিয়া ধার্য হবে।
এবং এটি একটি নামেমাত্র কর। ইসলামী খেলাফতকালে যখন জিযিয়া আদায় করা হতো, আমার তখনকার সাথে বিভিন্ন তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তীতে ইনশাআল্লাহ দেখবো বর্তমানযুগে জিযিয়া কত হতে পারে?
কাউন্ট হেনরি বলেছেন, ‘ইসলামের নীতি ছিল এই যে, যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করত, তাদের ধন-প্রাণ এবং সন্মানের হেফাজত করা হতো। কিন্তু যারা নিজেদের পৈত্রিক ধর্মে থাকতে চাইত তাদের উপর জিজিয়া নামে এক মামুলি কর চাপিয়ে এরুপ ব্যবহার করা হতো, যেরুপ মুসলিমদের প্রতি করা উচিত। আর ধর্মীয় ব্যাপারেও তাদের ওপর কোন বলপ্রয়োগ করা হতো না’। [আওরঙ্গজেবঃ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম; ১৭০ পৃষ্ঠা]
ভারতে জিজিয়া শব্দের পরেই যে নামটি উচ্চারিত এবং সমালোচিত হয় তিনি হলেন 'আওরঙ্গজেব'। সুলতানী আমলে জিজিয়া কর ছিল, আকবর তা বন্ধ করে দেন। পরে আওরঙ্গজেব জিজিয়া পুনর্বলবৎ করেন। আবার হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর চালু করার কারণে তিনি অনেক সমালোচিত হয়ে আসছেন। অনেকেই তাঁকে হিন্দু বিদ্বেষী বলে থাকেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আওরঙ্গজেব হিন্দুদের উপর থেকে প্রায় ৮০ টি কর তুলে দিয়েছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর Mughal Administration পুস্তকের পঞ্চম অধ্যায়ে ৬৫ করের কথা উল্লেখ করেছেন। A Vindication of Aurangzib বইয়ের ১৩০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে – ‘When Aurangzib abolished about eighty taxes, no one thanked for his generosity, but when he imposed only one tax, no heavy at all, people began to show their displeasure’.
ইসলামিক রাষ্ট্রে মুসলিমরা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক অনেক প্রকার কর দিতে বাধ্য থাকে। যেমন-
১) যাকাতঃ যাকাত যাদের উপর ফরজ, তারা যদি তা আদায় না করে, তবে ইসলামিক সরকার সেসব নামধারী মুসলমানদের উপরও চরম কঠোরতা অবলম্বনে বাধ্য হবে।
হযরত আবু বকর (রা) বলেনঃ আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার সাথে লড়াই করবো। কারণ যাকাত হচ্ছে সম্পদের হক।
নামাজ আদায় করা যেমন অবশ্য কর্তব্য, যাকাত আদায় করাও অবশ্য কর্তব্য।যাকাত আদায় না করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
মুসলিমদের যাকাতের ক্ষেত্রে যখন এই অবস্থা, তখন ইসলামীরাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিসাব পরিমান সম্পদ থাকলেও তাদের থেকে যাকাত আদায় করা হবেনা।
২) উশরঃ মুসলমানদেরকে নিজ জমির উতপাদিত ফসলের উপরও একটা কর বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করতে হয়, যার নাম উশর। অথচ অমুসলিমরা এ কর থেকেও মুক্ত।
মালিক (রঃ) বললেন : প্রচলিত সুন্নত হইল, অমুসলিম আহলে কিতাব নারী ও শিশুদের ওপর জিযিয়া ধার্য হইবে না। যুবকদের নিকট হইতেই কেবল জিযিয়া আদায় করা হইবে। কারণ স্বীয় অঞ্চলে বসবাস করা এবং শত্রু হইতে রক্ষা করার ভিত্তিতেই তাহাদের উপর জিযিয়া ধার্য করা হইয়াছিল। অমুসলিম বাসিন্দাদের পশুপাল, ফল এবং কৃষিক্ষেত্রে কোনরূপ যাকাত ধার্য করা যাইবে না। এমনিভাবে অমুসলিম নাগরিকদিগকে তাহাদের পৈতৃক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে দেওয়া হইবে এবং তাহাদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাইবে না।
আহলে কিতাব এবং অগ্নি উপাসক অর্থাৎ অমুসলিম বাসিন্দাদের পশুপাল, ফল এবং কৃষিক্ষেত্রে কোনরূপ যাকাত ধার্য করা যাইবে না। অর্থাৎ এরা কোন যাকাত দিবে না। বিনিময়ে মুসলিমরা ২.৫% যাকাত দেবে। যে যাকাত নারী থেকে শুরু করে বৃদ্ধও দিতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। ইসলামী সমাজে যাকাত না দিলে কঠোর শাস্তি রয়েছে।
(বিস্তারিত-মুয়াত্তা মালিক :: যাকাত অধ্যায়)
৩) মুসলিমদেরকে ফিতরা প্রদান করতে হয়
৪) বিভিন্ন সাদকা মুসলিমদের উপরই কেবল ধার্য হইবে। অমুসলিমদের উপর নামে মাত্র জিযিয়া ছাড়া অন্য কোন কিছু ধার্য করা যাবেনা।
যতদিন তাহারা (অমুসলিমগণ) ইসলামীরাষ্ট্রের সন্ধিকৃত এলাকায় বসবাস করিবে, তাহাদের উপর জিযিয়া ব্যতীত আর কিছুই ধার্য হইবে না।
(মুয়াত্তা মালিক :: যাকাত অধ্যায়)
আজকালকার মূর্খ মুসলিম, বিভ্রান্ত কিছু গবেষক, নাস্তিক ও বামরামেরা সুরা তাওবার কথা টেনে এনে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন এ বলে যে, এই সুরায় অমুসলিমদের জোরপূর্বক হত্যার কথা বলা হয়েছে। আসলে এ আয়াতগুলোর তাফসীর পড়লে এবং এ সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার ডাঃ জাকির নায়েকের যুক্তিপূর্ন বক্তৃতা শুনলে বিষয়েগুলো একেবারে ক্লিয়ার হয়ে যায়। এই আয়াতগুলি সেসময়ের আরবে সন্ধিরত মুশরিকরা যখন সন্ধি-শর্ত ভঙ্গ করে,তখন তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ যুদ্ধের ডাক দেন। আর সেটা শুধু সে সময়ের মুশরিকদের উপরেই প্রযোজ্য ছিলো, কারন তারা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেছিল।
যেমন কিছু আয়াতে বলা হয়েছে – নবীর দরজায় করাঘাত ব্যতীত ঢুকো না। সেইসব আয়াত এখন অকার্যকর। কারণ সেগুলো শুধু সে সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।
অপব্যাখ্যাকারীদের মনে রাখা উচিৎ, কুরআন বলে–
দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ২৫৬)
যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না৷ আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন৷ (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত-৮)
আল্লাহ তোমাদেরকে শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করছেন যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেছে, বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করেছে৷ যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাই জালেম৷ (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত-৯)
অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার কর্তব্য তো কেবল সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়া মাত্র। বানী পৌঁছে দিয়ে শক্তি-প্রয়োগ চলে না।আমাদের এর বেশি কাজ নেই , শক্তি প্রয়োগ পরের কথা। তবে কেউ আক্রমণ করলে প্রতিহত করা ইসলামে দায়িত্ব। (সূরা নাহল, আয়াত-৮২)
তোমার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান কর প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও ভাল উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সাথে আলোচনা কর উত্তম পন্থায়। (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)
এবার আসুন, জিযিয়া করের হার কত হবে, সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
জিজিয়া করের হার সম্পর্কে কুরআনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।বলা হয়েছে , জিযিয়া কর আদায় কর।যেহেতু কুরআনে উল্লেখ নেই , সেহেতু হাদিসে দেখতে হবে।আমরা মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনে দেখতে পাই – তিনি অমুসলিম সবল অধীনস্থদের উপর কী পরিমাণ হারে জিযিয়া আদায় করেছেন।
“আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ নুফায়লী (র.)...মু'আয (রা) থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মু'আয (রা)-কে ইয়ামনে প্রেরণ করেন, তখন তাঁকে এরূপ নির্দেশ দেন যে, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিকট হতে এক দীনার অথবা এক দীনার মূল্যের মু'আফিরী নামক কাপড়, যা ইয়ামনে উৎপন্ন হয় (তা জিযিয়া হিসাবে গ্রহণ করবে)।” (সুনান আবু দাউদ: কর, খাজনা, অনুদান ও প্রশাসনিক দায়িত্ব অধ্যায়। হাদিস নং ৩০৩৮)
বর্তমানে দীনার বলে কিছু নেই।এটি সেসময়ের একটি অর্থব্যবস্থা।তাহলে , আমরা জানবো কিভাবে এক দীনারের মূল্য কেমন ? এখানে সামান্য অর্থনীতির জ্ঞান প্রয়োগ করা যেতে পারে- ক্রয়ক্ষমতার সমতা তত্ত্বের (Purchasing power parity theory) মাধ্যমে।এক্ষেত্রে দুই ধরনের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে – মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়।এটা অধ্যাপক গুস্টাভ ক্যাসলের আবিষ্কৃত একটি পদ্ধতি।এই পদ্ধতিতে সেসময়ের যেকোনো একটি পণ্যমূল্যকে – সেসময়ের কত পরিমাণ অর্থে পাওয়া যেত , আর এখন কত টাকায় পাওয়া যায় – এদের মধ্যে বিশ্লেষণ করেই – বর্তমান সময়ের সাথে , সেসময়ের অর্থের তুলনা করা সম্ভব।
কিছু হাদিসে আমরা মুহাম্মদ সাঃ এর সময়কার কিছু জিনিসের মূল্য দীনারে উল্লেখ করতে দেখি।
সুনানে নাসাঈ শরীফ :: কাসামহ্ অধ্যায় : অধ্যায় ৪৫ :: হাদিস ৪৮০৫-এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আমলে ছোট বড় মিলিয়ে ১০০ উটের মূল্য ৮০০ দিনার পর্যন্ত হতো।
এর উপর ভিত্তি করে আমরা বর্তমান বাজারে দীনারের মূল্য সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
একশত উটনীর মূল্য= ৮০০ দীনার হলে
একটির গড় মূল্য = ৮ দীনার।
সে সময় আরব দেশে উট অত্যন্ত সহজলভ্য ছিলো।
এবার আসুন, আমরা দেখে নেই- বর্তমান বাজারে উটের মূল্য কত?
১ ) http://www.kgbanswers.co.uk/how-much-money-in-pounds-is-a-camel-in-saudi-arabia-worth/1967215 - এদের মতে ৫০০ ডলার।
২ ) http://www.theguardian.com/travel/2007/apr/22/escape.shoppingtrips.unitedarabemirates - এদের মতে ৩০০ ইউরো থেকে শুরু যা ৪১২ ইউএস ডলার।
এ লিংকগুলোতে কুরবানীর উটের দাম দেখানো হয়েছে। তাই উটের দাম সচরাচর এর চাইতে কম হয়।তাছাড়াও যে সোর্সের মাধ্যমে আমরা ১০০ উটের মূল্য ৮০০ দিনার বললাম, সেখানে ছোট বড় উট মিলিয়ে ১০০ উট ছিল। এমনকি সেখানে ৩০টি ছিলো এক বছর বয়সী, এবং ৩০টি ছিলো ২ বছর বয়সী। ছোট বড় মিলিয়ে ১০০ উটের দাম ৮০০ দিনার বলা হয়েছে।
তাই এক দুই বছর বয়সী উটের দাম এতো হয়না। উপরোক্ত লিংকগুলোতে প্রাপ্ত বয়স্ক, স্বাস্থ্যবান উটের দাম বলা হয়েছে। তাও কুরাবনীর সময়কালের, যখন উটের চাহিদার কারনে দাম অনেক বেড়ে যায়। এতসব বিবেচনা করে আমরা ধরে নিলাম-
সেযুগে ভালো উটের দাম ছিলো প্রায় ৮ দীনার ।
আর এ যুগে ভালো উটের দাম - ৪০০ ডলার।
সুতরাং ৮ দিনার=৪০০ ডলার
অতএব ১ দিনার= ৪০০/৮=৫০ ডলার
এটা বাৎসরিক জিজিয়া । তাহলে মাসিক জিজিয়া হবে = ৫০/১২=৪.১৭ ডলার।
একজন কর্মক্ষম যুবক নিজের নিরাপত্তা, যুদ্ধের ময়দানে জান বাজি রাখার ঝুঁকি থেকে মুক্তি, পঙ্গুত্ব বরনের সম্ভাবনা থেকে মুক্তি এবং অন্যান্য সকল প্রকার কর থেকে মাত্র ৪.১৭ ডলারের বিনিময়ে মুক্তি পাচ্ছে। আর যারা নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্দি; তারা বিনা খরচেই পাচ্ছে এসব সুবিধা।
এবার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করুন- রাষ্ট্র যদি ইসলামী আইনে চলে, তবে অমুসলমানদের প্রতি কেমন অত্যাচার করা হবে !!!!
ইসলামী রাষ্ট্রে বাহিরের শত্রু কর্তৃক ঐ রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের উপর আক্রমন হলে মুসলিমদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হয়ে যায়, জীবন বাজি রেখে হলেও ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের জান মাল ও সম্পদের হেফাজত করা। মজার ব্যাপার হলো- অমুসলিমরা যদি নিজেদের সম্পদ রক্ষায় কোন ভূমিকা পালন না করে আত্মরক্ষার্থে লুকিয়ে পড়ে, তবুও তাদের কিছু বলা যাবেনা। কারন জিযিয়া তাদের রক্ষনাবেক্ষনের সম্পুর্ন দায়িত্ত্ব মুসলিমদের মাথায় উঠিয়ে দিয়েছে।
''আমি তাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এর জিম্মিদের (অর্থাৎ জিম্মাধীন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়) বিষয়ে ওয়াসিয়াত করছি যে, তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার যেন পুরা করা হয়। (তারা কোন শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে) তাদের পক্ষাবিলম্বে যেন যুদ্ধ করা হয়, তাদের শক্তি সামর্থ্যের অধিক জিযিয়া (কর) যেন চাপানো না হয়।'' [সহীহ বুখারি (ইফা) অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ) । নাম্বার: ৩৪৩৫]
কাইস ইবন হাফস (র)...............আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে- যে ব্যক্তি কোন যিম্মিকে ( যাদের উপরে জিজিয়া নেয়া হবে) হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না। আর জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দুরত্ব থেকে পাওয়া যাবে। (সহিহ বুখারী :: খন্ড ৪ :: অধ্যায় ৫৩ :: হাদিস ৩৯১)
জিযিয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট হল এটা শুধুমাত্র মুসলিম কর্তৃক বিজিত রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।যুদ্ধ শেষ করার সদিচ্ছার প্রমান হিসাবে এটা প্রদান করা হত। সে কারনে মদিনার অমুসলিমরা কখনোই জিযিয়া দিতনা। এখনকার আধুনিক রাষ্ট্রগুলি যেহেতু সাধারন মানুষ দ্বারা তৈরী, তাই এখনকার রাষ্ট্রগুলির কোনটিতে ইসলামিক আইন চালু হলেও সেক্ষেত্রে জিযিয়া প্রযোজ্য হবে বলে আমার মনে হয়না।
এছাড়াও জিযিয়ার বিনিময়ে সকল প্রকার নিরাপত্তা পাবার হক্বদার অমুসলিম নাগরিকরা। তাই মুসলিমরা তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের নিকট থেকে জিযিয়া হিসেবে গৃহীত সমুদয় অর্থ ফিরিয়ে দিতে হবে।
আবু বকর রাঃ এর খিলাফতকালে খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং উমার রাঃ এর সময় আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ এর নেতৃত্বে মুসলিমদের অসাধারণ সব বিজয় আল্লাহ্ দান করেন রোমানদের বিপক্ষে। হিমস ছিলো এশিয়ান অঞ্চলে রোমান খৃষ্টানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। আবু উবাইদাহ ৬৩৪ সালে হিমস জয় করেন। জয়ের পর মুসলিমরা জিজিয়ার বিনিময়ে অমুসলিমদের সকল অধিকার নিশ্চিত করলো।
হিমসবাসী দেখলো সমঅধিকার ও ইনসাফের শাসন কাকে বলে। তবে বছরখানিকের মাথায় রোমান সম্রাট বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলিমদের চুড়ান্ত আঘাত করতে আসে। কৌশলগত কারণে মুসলিমবাহিনী হিমস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মোকাবেলার কৌশল নেয়।
হিমস ছাড়ার আগে মুসলিমবাহিনী বিগত সময়ের সকল জিজিয়া ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় হিমস শহরের খৃষ্টাননেতাদের। বিস্মিত হয় নগরবাসী, এও কি কখনো সম্ভব? খৃষ্টাননেতারা জিজ্ঞেস করলো, “যা আপনারা নিয়েছেন তা আবার ফেরত দিচ্ছেন কেনো?”
আবু উবাইদাহ উত্তর করলেন, “তোমাদের কাছ থেকে জিজিয়া আমরা নিয়েছিলাম ইসলাম নির্ধারিত কিছু শর্তের বিপরীতে, যার ভেতর ছিলো তোমাদের নিরাপত্তা প্রদান। আজ আমরা তোমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। আর তাই এই জিজিয়া নিজেদের কাছে রাখার কোন অধিকারও আল্লাহ্ আমাদের দেননি।
কৃতজ্ঞ চোখগুলোর সামনে দিয়ে চুলচেরা হিসাবে সকল জিজিয়া ফেরত দিয়ে মুসলিমবাহিনী হিমস ছাড়লো। আবু উবাইদাহ রাঃ একই নির্দেশ দিলেন অন্যান্য কমান্ডারদেরও। এভাবে সিরিয়ার যে সকল স্থান মুসলিমবাহিনী ত্যাগ করলো, তাদের সবার জিজিয়া ফেরত দেয়া হলো। কিন্তু লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো যে, খ্রিস্টানরা আফসোস করে মুসলিমদের বললো, স্বজাতির নিপীড়নের চেয়ে তাদের কাছে বরং বিজাতীয় মুসলিমের শাসনই বেশী প্রিয়।
জিযিয়া আদায়ের ব্যাপারে কোনপ্রকার কঠোরতাও অবলম্বন করা যাবেনা।
আব্দুল মালেক ইবনে ওমর বলেন, বনু ছাকিফ গোত্রের এক ব্যাক্তি বলেছেন যে, সেই ব্যাক্তিকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি এলাকার যিযিয়া কর আদায়ের জন্য পাঠানো হয়। যাওয়ার সময় হযরত আলী (রাঃ) সেই কর্মচারীকে বলে দিলেন, কোন অমুসলিম জিম্মিকে এক দিরহাম আদায়ের জন্য চাবুক মারবে না। তাদের খাদ্যশস্য ও ফসল বিক্রি করবে না। তাদের শীত ও গ্রীষ্মের পোশাক নিলামে বিক্রি করবে না। তাদের কোন পশু হস্তগত করবে না। এমনকি যিযিয়া হিসেবে পাওনা দিরহাম আদায় করার জন্য শাস্তিস্বরূপ কাউকে খাড়া করিয়ে রাখবে না। তখন সেই কর্মচারী বলল, হে আমিরুল মু’মিনিন তাহলে তো আপনার কাছ থেকে যেভাবে খালি হাতে যাচ্ছি ঠিক সেই ভাবেই আমাকে মদিনায় ফিরে আসতে হবে। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তা’আলা তোমার মঙ্গল করুন। সংখ্যালঘুদের উপর আমরা কোন অত্যাচার করতে পারি না, তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা পুরন না করে আমরা ওদের কাছে যিযিয়া চাইতে পারি না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ যদি তাদের কাছে থাকে তবেই আমরা যিযিয়া আদায় করতে পারি। তুমি খালি হাতে ফিরে আসো অসুবিধা নেই, কিন্তু জুলুম অত্যাচার করে যিযিয়া আদায়ের অনুমতি তোমাকে কিছুতেই দেয়া যাবেনা।
পরিশেষে বলতে চাই, জিযিয়া সম্পর্কে অল্প জানলে একজন ব্যক্তি ইসলামকে মনে করবে সাম্প্রদায়িক। আর বিস্তারিত জানলে সেও বলতে বাধ্য হবে- ইসলাম একে তো সাম্প্রদায়িক নয়ই, উপরন্তু ইসলাম ইসলামিক রাষ্ট্রে অমুসলিমদেরকে দেয় মুসলিমদের চেয়েও অধিক সুযোগ সুবিধা।
বিষয়: বিবিধ
৩৪৭৭ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জিজিয়া শুধু নয় ইসলামের সকল বিধান নিয়েই কিছু লোক জানতে বা বুঝতে চেষ্টা করেনা স্রেফ অন্ধ সমালোচনা করে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনাকে ধন্যবাদ।
জিযিয়া সম্পর্কে অল্প জানলে একজন ব্যক্তি ইসলামকে মনে করবে সাম্প্রদায়িক। আর বিস্তারিত জানলে সেও বলতে বাধ্য হবে- ইসলাম একে তো সাম্প্রদায়িক নয়ই, উপরন্তু ইসলাম ইসলামিক রাষ্ট্রে অমুসলিমদেরকে দেয় মুসলিমদের চেয়েও অধিক সুযোগ সুবিধা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন