৬ই ডিসেম্বরঃ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিদনাময় দিন।সেদিনকার নেতৃত্বদানকারী দুই কট্ররপন্থী এখন ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক।

লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:১৬:১৮ রাত

আজ ঐতিহাসিক "বাবরি মসজিদ ধ্বংস" দিবস।



১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় নির্মিত ষোড়শ শতকের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুরা। এ ঘটনায় ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হয় হাজার হাজার লোক, যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম।

ইসলামকে আদর্শগতভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা চলে আসছে সে আদি কাল থেকেই। বাবরী মসজিদ ধ্বংসও এ জাতীয় ঘটনারই বহিঃপ্রকাশ।

দাঙ্গায় যেসকল মুসলিম ভাই শহীদ হয়েছেন, মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের শাহাদাতের সর্বোত্তম মর্যাদা কামনা করছি।

একটু চিন্তা করে দেখুন তো, যদি মুসলমানরা এমন কোন ঘটনা ঘটাতো তাহলে মিডিয়া ও তথাকথিত সুশীলদের অবস্থা কেমন হতো!!!!

যাই হোক, বাবরি মজসিদ ধ্বংসে প্রথম কোদাল উত্তোলনকারী বলবীর সিং এখন আর বলবীর সিং নেই। সে এখন মুহাম্মদ আমীর।

ভারতের উত্তর প্রদেশে মুজাফফরনগর জেলার ফুলাত থেকে প্রকাশিত “ আরমুগানে দাওয়াত ” পত্রিকায় ২০০৫ সালের জুন সংখ্যায় তিনি এ সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন পত্রিকাটির রিপোর্টার আহমদ আওয়াহ। সাক্ষাৎকারটি নিম্নে প্রদত্ত হলঃ

আপনি আপনার খানদানের পরিচয় দিন।

হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ জেলার একটি গ্রামে আমার অধিবাস। ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর এক রাজপুত পরিবারে আমার জন্ম। জন্মসূত্রে আমার নাম বলবীর সিং।

আমার পিতা একজন কৃষক হবার সাথে সাথে একটি প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন এবং মানুষকে ভালোবাসা ছিল তার ধর্ম।কারও উপর জুলুম-নিপীড়ন ছিল তা যে ধরণেরই হোক-তার মনবেদনার কারণ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়কার হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। তিনি তা খুবই মর্মবেদনার সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং সে সময়কার ব্যাপক মুসলিম হত্যাকে দেশের জন্য বড় ধরণের কলংক মনে করতেন। অবশিষ্ট মুসলমানদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি খুবই সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁর স্কুলে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখতেন।

আপনি কিভাবে বাবরী মসজিদ ধ্বংসকারী দলে যোগ দিলেন?

গ্রামের স্কুল থেকে পাশ করে আমি হাইস্কুলে ভর্তি হই। ম্যাট্রিক পাশ করে পানিপথে গিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। মুম্বাইয়ের পর পানিপথ ছিল শিবসেনাদের সবচেয়ে মজবুত কেন্দ্র। বিশেষ করে যুবক শ্রেণী এবং স্কুলের লোকেরা শিবসেনাদের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। ওখানে থাকা অবস্থায় অনেক শিবসৈনিকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে এবং শিবসেনার পানিপথ শাখায় আমার নাম লেখাই।

শিবসেনার পক্ষ থেকে পানিপথের ইতিহাস তুলে ধরে সেখানকার যুবকদের মধ্যে মুসলমানদের বিশেষ করে সম্রাট বাবর ও অপরাপর মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে বিরাট ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হত।

অবশ্য আমার পিতা যখন জানতে পারলেন যে, আমি শিবসেনায় নাম লিখিয়েছি, তখন তিনি আমাকে খুব বুঝান। তিনি আমাকে ইতিহাসের সূত্র ধরে বুঝাতে চেষ্টা করেন, সম্রাট বাবর বিশেষ করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের ন্যায় ও ইনসাফ এবং অমুসলিমদের সঙ্গে কৃত আচরণের কাহিনী তিনি আমাকে শোনান এবং আমাকে বলেন, ইংরেজরা ভুল ও বিকৃত ইতিহাস আমাদেরকে পরস্পরের সঙ্গে লড়াই বাঁধাবার এবং দেশকে দূর্বল করার জন্য সৃষ্টি করেছে। তিনি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়কার জুলুম-নিপীড়ন, হত্যা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলী শুনিয়ে আমাকে শিবসেনার যাবতীয় কর্মকান্ড থেকে ফিরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার পিতার সে চেষ্টা বিফলে যায়। তার কোন কথাই আমার উপলব্ধিতে প্রতিক্রিয়া করেনি। আমি দৃঢ়ভাবেইতখন বাবরী মসজিদ ধ্বংসকারী সেই দলের সাথে যোগ দেই।

ফুলাত থাকাকালে বাবরী মসজিদ ধ্বংস করার ক্ষেত্রে আপনার অংশগ্রহণের কথা শুনিয়ছিলেন। এবার একটু বিস্তারিতভাবে তা আমাদেরকে বলুন।

ঘটনাটি হচ্ছে-১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আদভানীর রথযাত্রায় আমাকে পানিপথের কর্মূচি সফল করার জন্য বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। রথযাত্রায় ঐসব দায়িত্বশীল নেতৃবর্গ আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আমি শিবাজির নামে শপথ গ্রহণ করি যে, যাই কিছু ঘটুক না কেন, আর কেউ কিছু করুক আর নাই করুক, আমি একাই গিয়ে রাম মন্দিরের উপর থেকে জুলুম করে চাপিয়ে দেয়া ( মসজিদরূপ ) অমকাঠামো ( বাবরী মসজিদ ) ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবই। এই যাত্রায় আমার কর্মতৎপরতার দরুণ আমাকে শিবসেনার যুব শাখার সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

আমি আমার যুব টিম নিয়ে ৩০ অক্টোবর অযোধ্যায় যাই। পথিমধ্যে পুলিশ আমাদেরকে ফয়েজাবাদে থামিয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও আমি এবং আমার কিছু সাথী কোন প্রকারে গা বাঁচিয়ে অযোধ্যায় গিয়ে পৌঁছি। কিন্তু পৌঁছুতে কিছুটা দেরী হয়ে যায়। এর আগেই গুলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফলে বহু চেষ্টা করেও আমি বাবরী মসজিদের কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। এতে আমার শরীরে ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুণ আরও জ্বলে উঠে। আমি আমার সাথীদেরকে বারবার বলছিলাম, এরকম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। রামের জন্মভূমিতে আরব লুটেরাদের কারণে রামভক্তদের উপর গুলি চলবে, এ কেমন অন্যায় ও জুলুম!

আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছিলাম। কখনও মনে হচ্ছিল যে, আমি এর প্রতিবাদে আত্মহত্যা করি। সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল।

আমি সেদিনের জন্য খুবই অস্থির ছিলাম, যেন আমার সুযোগ মিলে যায় আর আমি নিজ হাতে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারি। এভাবে একদিন-দু’দিন করে সেই অপয়া দিনটি এসে পড়ল-যেদিনটাকে আমি সেসময় খুশির দিন ও আনন্দের দিন ভাবতাম। আমি আমার কতিপয় আবেগদীপ্ত সাথীকে নিয়ে ১৯৯২ সালের ১ ডিসেম্বর অযোধ্যায় যাই।

আমার সাথীদের মধ্যে সোনীপথের নিকটবর্তী জাটদের একটি গ্রামের যোগীন্দর পাল নামক এক যুবকও ছিল। সে ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার পিতা ছিল একজন বিরাট জমিদার। জমিদার হলেও তিনি মানুষকে খুব ভালবাসতেন। তিনি তার একমাত্র পুত্রকে অযোধ্যা যেতে বাঁধা দেন। তার বড় চাচাও তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কারও বাঁধা মানেনি।

আমরা ৬ ডিসেম্বরের আগের রাতে বাবরী মসজিদের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছি এবং বাবরী মসজিদের সামনে কিছু মুসমানের বাড়ীর ছাদে রাত কাটাই।

আমার বারবার মনে হত-না জানি আমাদেরকে ৩০ অক্টোবরের মত আজও এই শুভ(!) কাজ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। কয়েকবারই মনে হয়েছে, লীডার না জানি কি করে!

আমাদের সঞ্চালক আমাদেরকে শৃঙ্খলার সাথে থাকতে বললেন। উমা ভারতী জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন এবং করসেবকদের আগুনবৎ উত্তেজিত করে তুললেন। আমি তার ভাষণ শুনতে শুনতে ঘরের ছাদ থেকে নেমে আসলাম এবং কোদাল হাতে বাবরী মসজিদের দিকে অগ্রসর হলাম।

আমার মনস্কামনা পূরণের সময় এসে গেল। আমি বাবরী মসজিদের মাঝের গম্বুজটির উপর কোদাল দিয়ে সর্বপ্রথম আঘাত হানলাম এবং ভগবান রামের নামে জোরে জোরে জয়ধ্বণি দিলাম। এরপর পুরো মসজিদ ভাঙ্গতে সবাইকে নিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল।

মসজিদ ভাঙ্গতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত হলাম। এরপর সেখানে রামলীলা লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আমরা আমাদের বাড়ী ঘরে ফিরে এলাম। সাথে করে নিয়ে এলাম বাবরী মসজিদের দু’টুকরো করে ইট, যা আমরা খুশি মনে আমাদের পানিপথের সাথীদের দেখালাম। তারা আমাদের পিঠ চাপড়ে আমাদের কৃতিত্বে আনন্দ প্রকাশ করল। শিবসেনার দফতরেও দুটো ইট রেখে দেয়া হয়।

এরপর এক বিরাট সভা হয়। সকলেই তাদের বক্তৃতায় অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে আমার উচ্ছসিত প্রশংসা করে যে, আমাদের পরম গর্ব যে, পানিপথের নওজোয়ান শিব সৈনিক রামের প্রতি ভক্তিপ্রযুক্ত সর্বপ্রথম কোদাল চালিয়েছিল।

আমি আমার বাড়ীতে গিয়েও অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে একথা বলেছিলাম। কিন্তু আমার পিতাজী একথা শুনে খুবই অসন্তুষ্ট হন এবং এ ব্যাপারে তার গভীর দুঃখের কথা জানিয়ে আমাকে পরিষ্কার বলে দেন, এখন আর এই ঘরে আমি আর তুমি দু’জন থাকতে পারি না। তুমি থাকলে আমি বাড়ী ছেড়ে চলে যাব। নইলে তুমি আমার বাড়ী ছেড়ে চলে যাবে। মালিকের ঘর যে ভেঙ্গেছে, আমি তার মুখ দেখতে চাই না। আমার মৃত্যু পর্যন্ত তুমি তোমার মুখ কখনও আমাকে দেখাবে না।

আমি ধারণা করতেও পারিনি-এমনটা ঘটবে। আমি আব্বাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম এবং পানিপথে যে সম্মান এই কাজের দরুণ পেয়েছি, তা তাকে বললাম। কিন্তু তিনি বললেন, এ ধরণের জালিমদের দরুণ এদেশ ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে। অবশেষে রাগে-ক্ষোভে তিনি বাড়ী ছেড়ে যেতে উদ্যত হলেন।

আমি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললাম, আপনি বাড়ী ছেড়ে যাবেন না। আমি নিজেই আর এ বাড়ীতে থাকতে চাই না- যেখানে একজন রামমন্দির ভক্তকে জালিম মনে করা হয়। এরপর আমি বাড়ী ছেড়ে চলে এসে পানিপথে থাকতে লাগলাম।

এবার আপনার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাই।

ভাই আহমদ, আমার আল্লাহ্‌ কত মেহেরবান ও দয়ালু! তিনি চাননি যে, আমি জুলুম ও শিরকের অন্ধকারে হাবুডুবু খাই। তাইতো তিনি আমাকে ইসলামের নূর ও হেদায়াত দ্বারা ধন্য করেছেন। আমার মত চরম জালিম- যে কিনা তার পবিত্র ঘরকে শহীদ করেছে, তাকে তিনি নিজ অনুগ্রহে দয়া করে হেদায়াত দান করেছেন।

ঘটনা হয়েছিল কি, আমার বন্ধু যোগীন্দর বাবরী মসজিদের কিছু ইট মাইক দিয়ে ঘোষণা দেয় যে, ইটগুলো রামমন্দিরের ওপরকার অবকাঠামো বাবরী মসজিদের। সৌভাগ্যক্রমে তা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। সমস্ত হিন্দু ভাইয়েরা এসে যেন এর উপর পেশাব করেন। আর কি! ঘোষণা হতেই ভীড় লেগে গেল। যেই আসত ঘৃণা ভরে এর উপর পেশাব করে যেত।

এবার মসজিদের যিনি মালিক তাঁর শান প্রদর্শনের পালা। চার-পাঁচ দিন পর যোগীন্দরের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল। সে পাগল হয়ে গেল এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ থাকতে শুরু করল। পরনে আদৌ কাপড় রাখত না। সম্মানিত জমিদার রঘুবীর সিং চৌধুরীর একমাত্র পুত্র ছিল সে। পাগলামীর পর্যায়ে সে বারবার তার মাকে কাপড় খুলে অসভ্য ইঙ্গিত করত। তারপর ঐ অবস্থায় মাকে জড়িয়ে ধরত।

তার পিতা এতে খুবই পেরেশান হয়ে পড়েন। ছেলের সুচিকিৎসার জন্য বু সাধু-সন্ন্যাসী ও আলেম-উলামা দেখান। বার বার মহান মালিকের কাছে মাফ চাইতে থাকেন। দান-খয়রাত করতে থাকেন। কিন্তু তার অবস্থার উপশ না হয়ে বরং উত্তরোত্তর খারাপই হতে থাকে।

একদিন জমিদার রঘুবীর সিং বাইরে যেতেই যোগীন্দর তার মাকে জড়িয়ে ধরে। মা চিৎকার করতে শুরু করলে মহল্লাবাসী ছুটে এসে তাকে রক্ষা করে। এরপর থেকে যোগীন্দরকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়।

যোগীন্দরের পিতা ছিলেন খুবই সম্মানিত লোক। তিনি এই ঘটনার কথা শুনে ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এমন সময় একলোক তাকে বলল যে, এখানে সোনীপথে ঈদ্গাহের পাশে একটি মাদ্রাসা আছে। ওখানে একজন বড় মাওলানা সাহেব এসে থাকেন। একবার গিয়ে তাঁর সঙ্গে আপনি দেখা করুন। এতে যদি কিছু না হয়, তারপর যা হয় করবেন।

তাদের পরামর্শ নিয়ে তিনি সোনীপথ যান। গিয়ে জানতে পারেন মাওলানা সাহেব মাসের পয়লা তরিখে আসেন। তা শুনে চৌধুরী সাহেব খুবই হতাশ হন এং ঝাঁড়-ফুক করনেওয়ালা কাউকে পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করেন। জানা গেল-মাদ্রাসার জিম্মাদার ক্বারী সাহেব ঝাড়-ফুঁক করে থাকেন। কিন্তু তিনিও মাওলানা সাহেবের সঙ্গে সফরে বেরিয়ে গেছেন।

এরপর ঈদ্গাহর নিকটস্থ জনৈক দোকানদার তাকে মাওলানার দিল্লীর ঠিকানা দেন এবং এ কথা জানান যে, আগামী পরশু বুধবার হযরত মাওলানা এখানে ( বুওয়ানা, দিল্লী ) আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

চৌধুরী সাহেব তখন তার ছেলেকে শেকলে বেঁধে বুওয়ানার ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে যান। ইমাম সাহেব তাকে বলেন যে, অবস্থা খারাপ হবার দরুণ ৬ ডিসেম্বরের আগে হরিয়ানার বহু ইমাম ও মুদাররিস এখান থেকে ইউপিতে নিজেদের বাড়ীঘরে চলে গিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এক মাস পর্যন্ত ফিরে আসেননি। এজন্য মাওলানা সাহেব এ মাসের ১ তারিখে এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন এবং বলেন যে, মুসলমানরা এসব অমুসলিম ভাইদেরকে যদি ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং ইসলাম, আল্লাহ্‌ ও মসজিদের পরিচয় তুলে ধরতেন, তাহলে এ ধরণের দূর্ঘটনার জন্ম হত না। তিনি বলেন যে, এদিক দিয়ে বাবরী মসজিদের শাহাদাতের জন্য দায়ী আমরা মুসলমানরাও। আর এখনও যদি আমাদের হুঁশ হয় এবং আমরা যদি দাওয়াতের হক আদায় করে থাকি, তাহলে এই মসজিদ যারা ভেঙ্গেছেন, তারাই মসজিদ নির্মাতা হতে পারেন, হতে পারে তারাই মসজিদ আবাদকারী। ঠিক এ ধরণের প্রেক্ষাপটে আমাদের রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলতেন, “ হে আল্লাহ্‌! আমার জাতিকে হেদায়াত দান করুন। কেননা তারা জানে না ”।

যোগীন্দরের পিতা চৌধুরী রঘুবীর সিং যখন বুওয়ানার ইমাম সাহেবের গিয়ে পৌঁছলেন-সে স্ময় তাঁর পীর সাহেবের বক্তৃতার খুব প্রভাব ছিল। তিনি চৌধুরী সাহেবকে বললেন, আমি ঝাড়-ফুঁক করতাম। মিন্তু আমাদের হযরত আমাকে এ কাজ করা থেকে থামিয়ে দিয়েছেন। কেননা, এ কাজে অনেক সময় শরীয়তের বরখেলাপ হয়ে যায় এবং মহিলাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে হয়। আর আপনার ছেলের উপর তো কোন যাদু কিংবা জ্বিন-ভূতের আছরও নেই, বররং এ তো সেই মালিকের আজাবের ফল। তাই আমার কিছু করার সাহস হচ্ছে না। তবে আপনার জন্য একটি সুযোগ আছে। আমাদের বড় হযরত আগামী পরশু বুধবারে এখানে আসছেন। আপনি তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করুন এবং আপনার কথা তাকে বলুন। আপনার ছেলে আশা করি ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাকে একটি কাজ করতে হবে, তা হল-আপনার ছেলে যদি ভাল হয়ে যায় তবে আপনাকে মুসলমান হতে হবে। চৌধুরী সাহেব বললেন, আমার ছেলে ভাল হয়ে গেলে আমি সবকিছু করার জন্য তৈরী আছি।

বুধবার সকাল আটটায় চৌধুরী রঘুবর সিং যোগীন্দরকে নিয়ে বুওয়ানায় পৌঁছেন। দুপুর বেলা যোহরের আগেই মাওলানা সাহেবের আগমন ঘটে। শেকলে বাঁধা যোগীন্দর সম্পূর্ণ দাঁড়ানো ছিল। চৌধুরী সাহেব কাঁদতে কাঁদতে মাওলানা সাহেবের পায়ের উপর পড়ে যান এবং বলতে থাকেন, মাওলানা সাহেব! আমি এই আহাম্মকটাকে খুবই ঠেকাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে পানিপথে এক কুচক্রী দলের চক্রান্তে পড়ে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গতে গিয়েছে। মাওলানা সাহেব! আমার উপর দয়া করুন। আমাকে মার্জনা করিয়ে দিন। আমার ঘর বাঁচান।

মাওলানা সাহেব তাকে মাথা তুলতে বলেন এবং পুরো ঘটনা শোনেন। তারপর মাওলানা সাহেব চৌধুরী সাহেবকে বলেন যে, সমগ্র জাহান চালানেওয়ালা সর্বশক্তিমান আল্লাহর ঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে তারা এত বড় পাপ করেছে এবং এত বড় জুলুম করেছে যে, যদি তিনি গোটা বিশ্ব চরাচর ধ্বংস করে দেন, তাহলে তা যথার্থ হবে। এতো বরং কমই হয়েছে যে, এই পাপের বোঝা কেবল একাকী এ ছেলের উপর পড়েছে। আমরাও সেই সর্বশক্তিমান মালিকেরই বান্দা এবং একদিক দিয়ে এই বিরাট পাপের ভাগী আমরাও। আর তা এই দিক দিয়ে যে, আমরা তাদেরকে বোঝাবার হক আদায় করিনি-যারা বাবরী মসজিদ শহীদ করেছে। এখন আমাদের আয়ত্তে আর কিছু নেই। আমরা কেবল এতটুকু করতে পারি যে, আপনি সেই মালিকের সামনে কাঁদেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান। আর আমরাও ক্ষমা চাই।

তখন চৌধুরী সাহেব পুনঃ মাওলানা সাহেবের পায়ের উপর পড়ে গেলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, হুজুরজী! আমার যদি সেই ক্ষমতাই থাকতো, তাহলে কি আমাকে এইদিন দেখতে হত? আপনি মালিকের আপনজন। যা কিছু করার আপনিই করুন।

মাওলানা সাহেব তখন তাকে বললেন, আপনি আমার কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। এখন যে চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা আমি বলছি, তা আপনার গ্রহণ করা উচিত। এবার তিনি সম্মত হলেন।

মাওলানা সাহেব মসজিদে গেলেন। নামায পড়লেন। অল্প সময়র জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে বয়ান করলেন এবং দুআ করলেন। আর মাওলানা সাহেব সকলকেই চৌধুরী সাহেবের জন্য দুআ করতে বললেন।

প্রোগ্রাম শেষ হবার পর মসজিদে নাস্তা হল। নাস্তা থেকে ফারেগ হয়ে মসজিদ থেকে বের হতেই আল্লাহর কী মেহেরবাণী দেখুন যোগীন্দর তার পিতার পাগড়ী মাথা থেকে টেনে তাঁর উলঙ্গ শরীর ঢাকল এবং দিব্যি সুস্থ মানুষের ন্যায় তার পিতার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সকলেই এ দৃশ্য দেখে আনন্দিত হল। বুওয়ানার ইমাম সাহেবের তো খুশির অন্ত ছিল না। চৌধুরী সাহেব এতে যারপরনাই আনন্দিত হলেন এবং তিনি যেন প্রাণ ফিরে পেলেন।

তখন বুওয়ানার ইমাম সাহেব চৌধুরী সাহেবকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং তাকে এও বললেন যে, যেই মালিক তাকে ভাল করে দিয়েছেন, যদি আপনি ওয়াদা মাফিক মুসলমান না হন, তাহলে সে আবার এর চেয়ে বেশী মারাত্মক পাগল হয়ে যেতে পারে। তখন চৌধুরী সাহেব ইসলাম গ্রহণের জন্য তৈরী হলেন এবং ইমাম সাহেবকে বললেন, মাওলানা সাহেবের ঋণ আমার সাত পুরুষ পর্যন্ত শোধ করতে পারবে না। আপনি যেখানে চান আমাকে বিক্রি করতে পারেন।

হযরত মাওলানা সাহেব যখন শুনলেন যে, ইমাম সাহেব তার সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে এ ধরণের ওয়াদা নিয়েছিলেন, তিনি ইমাম সাহেবকে বুঝালেন যে, এ ধরণের কাজ ঠিক নয়। কেননা এটা ইহতিয়াতের পরিপন্থী।

এরপর চৌধুরী সাহেবকে যখন মসজিদের দিকে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল, তখন যোগীন্দর বলল, আমাকে তো আপনার আগে মুসলমান হতে হবে এবং বাবরী মসজিদ পুনর্বার অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। তারপর তারা উভয়েই খুশি মনে ওযু করলেন। তাদের কালেমা পড়ানো হল। পিতার নাম মুহাম্মদ উসমান এবং পুত্রের নাম মুহাম্মদ উমর রাখা হল। এরপর তারা খুবই খুশি মনে নিজেদের গ্রামে ফিরেন।

তাদের গ্রামে একটি ছোট মসজিদ ছিল। তারা মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ইমাম সাহেব স্থানীয় মুসলমানদেরকে তাদের মুসলমান হওয়ার কথা জানিয়ে দিলেন। ফলে একজন দু’জন করে গোটা এলাকায় এ খবর ছড়িয়ে পড়ল।

এমনি করে এ সংবাদ হিন্দুদের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তখন আলাকার প্রতাপশালী হিন্দুরা এ নিয়ে মিটিং করেন এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাদের দু’জনকেই রাতের বেলা মেরে ফেলতে হবে। অন্যথায় তারা কত লোকের ধর্ম নষ্ট করে দিবে কে জানে। তাদের এই মিটিংয়ে একজন গোপন নওমুসলিম উপস্থিত ছিলেন। তিনি ইমাম সাহেবকে গোপনে তাদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। ফলে আল্লাহর মেহেরবাণীতে রাতের অন্ধকারে বাপ ও ছেলেকে গ্রাম থেকে সরিয়ে দেয়া হল। তারা ফুলাত গিয়ে পৌঁছেন। পরে তাদেরকে ৪০ দিনের জন্য তাবলীগ জামাতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর আমীর সাহেবের পরামর্শে যোগীন্দর তিন চিল্লা দেয়। পরে যোগীন্দরের মা-ও মুসলমান হয়ে যান।

এখন তারা বেশ সুখ-শান্তির সাথে দিল্লীতে সপরিবারে বসবাস করছেন। গ্রামের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ী বিক্রি করে তারা দিল্লীতে একটি কারখানা দিয়েছেন।

জনাব! আমি আপনার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী জানতে চেয়েছিলাম। আপনি যোগীন্দর ও তার পরিবারের মুসলমান হবার কাহিনী শোনালেন। যদিও তা খুবই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর। কিন্তু আমি আপনার ইসাম গ্রহণের কাহিনী জানতে চাই যে, কিভাবে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন?

ভাইজান! আসলে আমার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এ ঘটনা থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। এজন্য আমি এ অংশ শুনালাম। এখন পরবর্তী অংশও শুনুন।

১৯৯৩ সালের ৯ মার্চ আমার পিতা অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বাবরী মসজিদের শাহাদাত এবং তাতে আমার অংশগ্রহণ তাকে খুবই আঘাত দিয়েছিল। তিনি প্রায়ই আমার মাকে বলতেন, মালিক আমাকে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম দিলেন না কেন? আমি যদি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিতাম, তাহলে অন্তত জুলুম-নিপীড়ন সহ্যকারীদের মধ্যে আমার নাম থাকত। তিনি আমাদেরকে জালিম-নিপীড়নকারী কওমের মাঝে কেন জন্ম দিলেন? তিনি তার পরিবারের লোকদেরকে ওসীয়ত করেছিলেন, আমি মারা গেলে আমার লাশের খাটিয়ার ( আরতির ) কাছে যেন বলবীর না আসে। তিনি আরও ওসীয়ত করেন, প্রথা ও রেওয়াজ মাফিক আগুনে যেন আমাকে পুড়ানো না হয়। হিন্দুদের শ্মশানেও যেন না নেয়া হয়। বরং আমাকে মুসলমানদের মত কাফন দাফন করবে। পরিবারের লোকেরা তাঁর অন্তিম ইচ্ছা মত সবকিছু করেন।

আটদিন পর আমি আমার পিতার মৃত্যুর খবর পাই। এতে আমার মন ভেঙ্গে যায়। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা আমার কাছে জুলুম মনে হতে থাকে এবং গর্বের পরিবর্তে আফসোস হতে থাকে। আমার দিল যেন হঠাৎ অন্যরকম হয়ে যায়।

ওদিকে আমি বাড়ী গেলে আমার মা আমার পিতার কথা স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন যে, এমন দেবতার মত বাপকে তুই কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললি! তুই কতটা নীচ ও হীন জাতের মানুষ! মায়ের এ ধরণের আচরণের কারণে আমি বাড়ী থেকে বের হয়ে এলাম এবং এরপর বাড়ী যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।

এরপর জুন মাসে মুহাম্মদ উমর ( যোগীন্দর ) তাবলীগ জামাত থেকে ফিরে এল। সে পানিপথে আমার সঙ্গে দেখা করলো এবং তার পুরো ঘটনা আমাকে বললো। বিগত দু’মাস থেকে আমার মন সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকত, না জানি কোন আসমানী বালা মুসীবত আমার উপর এসে পড়ে। পিতার দুঃখ ও মনোকষ্ট এবং বাবরী মসজিদের শাহাদাতের দরুণ আমার মন সবসময় সন্ধিগ্ধ থাকত। মুহাম্মদ উমরের কথা শুনে আমি আরও বেশী পেরশান হয়ে পড়লাম। তখন ঊমর ভাই আমাকে পরামর্শ দিলেন-২৩ জুন তারিখে সোনীপথে যখন মাওলানা সাহেব আসবেন, আমি যেন তাঁর সাথে গিয়ে অবশ্যই দেখা করি। আরও ভাল হবে যদি তাঁর সঙ্গে আমি কিছুদিন থাকি।

আমি প্রোগ্রাম বানালাম। কিন্তু পৌঁছুতে আমার কিছুটা দেরী হয়ে গেল। উমর ভাই আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং মাওলানা সাহেবকে আমার অবস্থা সম্পর্কে সব বলেছিলেন। আমি সেখানে গেলে মাওলানা সাহেব আমাকে সাগ্রহে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন, আপনার সাথে থেকে এই গুনাহ করার জন্য যোগীন্দিরের সঙ্গে যদি সর্বময় মালিক এরূপ করতে পারেন, তাহলে আপনার সংগেও একইরূপ ব্যবহার করা হতে পারে। আর মালিক যদি এই জগতে শাস্তি নাও দেন, তবুও মৃত্যুর পর চিরস্থায়ী জীবনে যে শাস্তি মিলবে, আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না।

মাওলানা সাহেবের কাছে একঘন্টা থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আসমানী বালার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। তাই আমার মুসলমান হওয়া দরকার।

মাওলানা সাহেব দু’দিনের জন্য বাইরে কোন সফরে যাচ্ছিলেন। আমি সেই দু’দিন তাঁর সাথে থাকার আকাঙ্খা ব্যক্ত করলাম। তিনি খুব খুশী হয়েই অনুমতি দিলেন।

একদিন হরিয়ানা, এরপর দিল্লী ও খোর্জার সফর ছিল। দু’দিন পর তিনি ফুলাত ফিরে এলেন। এ দু’দিনে ইসলামের সত্যতা আমার হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে যায়। তাই আমি ইসলাম গ্রহণের জন্য তৈরী হয়ে যাই।

আমি উমর ভাইকে আমার ইচ্ছার কথা বললাম। তিনি খুব খুশী হয়ে মাওলানা সাহেবকে তা জানালেন।

আলহামদুলিল্লাহ, ২৫ জুন-১৯৯৩ ইং বাদ জোহর আমি ইসলাম গ্রহন করলাম।

মাসআলা-মাসায়েল শিখার জন্য মাওলানা সাহেব আমাকে কিছুদিন ফুলাত থাকার পরামর্শ দিলেন। আমি আমার স্ত্রী ও ছোট বাচ্চাদের মজবূরীর কথা বললে তিনি বাড়ীর ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি কয়েক মাস ফুলাত এসে থাকলাম এবং আমার স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কাজ করতে লাগলাম। তিনমাস পর আলহামদুলিল্লাহ আমার স্ত্রীও মুসলমান হয়ে গেলেন।

আপনার মায়ের কি হল?

আমি আমার মাকে আমার মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে জানালে তিনি খুব খুশী হন এবং বলেন, তোর বাপের আত্মা এতে শান্তি পাবে। এরপর আমি আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দেই। আমার মা ঐ বছরই মুসলমান হন।

এখন আপনি কী করছেন?

বর্তমানে আমি একটি জুনিয়র হাইস্কুল পরিচালনা করছি। স্কুলে ইসলামী শিক্ষার সাথে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার ব্যবস্থা আছে।

শুনেছি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন জায়গায় অনাবাদী মসজিদগুলো পুনরায় আবাদ করার চেষ্টা করছেন?

হ্যাঁ, উমর ভাইয়ের সাথে মিলে একত্রে আমরা প্রোগ্রাম বানিয়েছি যে, আল্লাহর ঘর শহীদ করে আমরা যে বিরাট গুনাহ করেছি, তার কাফফারা হিসেবে বিরান মসজিদগুলো আবাদ করব এবং নতুন নতুন মসজিদ বানাবো। আমরা দু’জন মিলে আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিব। আমি বিরান মসজিদগুলো আবাদ করব আর উমর ভাই নতুন নতুন মসজিদ বানাতে চেষ্টা চালাবেন এবং এ ব্যাপারে আমরা একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করব। এভাবে আমরা আমাদের জীবনে শত শত মসজিদ বানাবার এবং সেগুলোকে ভরপুর করবার কর্মসূচী হাতে নিয়েছি।

আলহামদুলিল্লাহ, ২০০৪ সালের ৬ নভেম্বর এই পাপী ১৩ টি বিরান ও অধিকৃত মসজিদ হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লী ও মীরাট সেনানিবাস এলাকায় আবাদ করেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে উমর ভাই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছেন। এ যাবত তিনি বিশটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং একুশতম মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছেন।

আমরা উভয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবরী মসজিদের প্রত্যেক শাহাদাত বার্ষিকীতে ( ৬ ডিসেম্বর ) একটি বিরান ও অনাবাদী মসজিদে অবশ্যই নামায শুরু করব। আলাহামদুলিল্লাহ, আমরা আজ পর্যন্ত কোন বছরেই এটা করতে ব্যর্থ হয়নি। অবশ্য শ’র লক্ষ্য পূরণ এখনও অনেক দূরে। আশা করি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলো আবাদ হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রে উমর ভাই অনেক আগেই লক্ষ্য অর্জনে আমার চেয়ে এগিয়ে আছেন। আর আসলে আমার কাজও তো তারই ভাগে পড়ে। কেননা, আমায় অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার মাধ্যম তো মূলত তিনিই।

পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

সকল মুসলমানের কাছে আমার একটি নিবেদন, তা হল- নিজের জীবনের লক্ষ্য কী, তা জানি এবং ইসলামের প্রচারকে আমানত মনে করে একে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার কথা ভাবি। আর অমুসলিম ভাইয়েরা কেবল ইসলামের প্রতি দুশমনীর কারণে তার থেকে বদলা নেবার বা প্রতিশোধ নিতে উদ্যত না হই। বরং তাকে উপলব্ধি করার এবং বুঝার চেষ্টা করি।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাবরী মসজিদ শাহাদাতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক শিবসেনা ও বজরং দলের সকল হিন্দু সদস্য যদি এটা জানতেন যে, ইসলাম কী? মুসলমান কাকে বলে? কুরআনুল কারীম কী? মসজিদ আসলে কী? তাহলে সকলেই মসজিদ ভাঙ্গার পরিবর্তে মসজিদ বানাবার কথাই ভাবতেন। আর তখন বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার চিন্তাই মাথায় আসত না। আমি আমার প্রবল প্রত্যয় থেকে বলছি, বালথ্যাকারে, উইরে কুটিয়ার, উমা ভারতী ও অশোক সিংঘলের মত নেতৃস্থানীয় লোকেরাও যদি ইসলামের হাকীকত, ইসলামের প্রকৃত সত্য ও মর্মবাণী জানতে পারেন এবং জানতে পারেন যে, ইসলাম ( কেবল মুসলমানদের নয় ) পৃথিবীর সকল মানুষের ধর্ম, তাহলে তাদের প্রত্যেকেই নিজ খরচে বাবরী মসজিদ পুনর্বার নির্মাণ করাকে নিজেদের সৌভাগ্য ভাববেন।

বলতে দ্বিধা নেই, কিছু লোকতো এমন আছে-যারা মুসলমানদের প্রতি শত্রুতায় বিখ্যাত, কিন্তু এখন এক কোটি হিন্দুর মধ্যে এমন লোক এক লক্ষ্যও হবে না। বরং সত্য বলতে কি, বহু হিন্দু আমার পিতার মত-যারা মানবতার বন্ধু এবং ইসলামী রীতিসমূহকে তারা অন্তর দিয়েই পছন্দ করেন। আমার পিতা কি স্বভাবগতভাবে মুসলমান ছিলেন না? কিন্তু মুসলমানরা তাকে দাওয়াত না দেবার কারণে তিনি কুফরী অবস্থায় মারা গেছেন। দাওয়াতের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অলসতা ও অবহেলার দরুণ আমার এমন নিষ্ঠাবান বাপ আজ দোযখে চলে গেছেন। মাওলানা সাহেব সত্যই বলেছেন, আমরা যারা বাবরী মসজিদ শহীদ করেছি, তারা না জানার কারণে এবং মুসলমানদের না চিনবার দরুণ এমন জুলুম করেছি। আমরা অজানা ও অজ্ঞতার দরুণ এ ধরণের জুলুম করেছি। কিন্তু মুসলমানেরা জেনে বুঝে তাদেরকে হেদায়াত না করে তাদের দোযখে যাবার উপলক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন। রাতে যখন আমার পিতার কুফরী অবস্থায় মারা যাবার কথা মনে হয়, তখন আমার ঘুম পালিয়ে যায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ আমার ঘুম আসে না। হায়! মুসলমানদের যদি এই ব্যাথার অনুভূতি হত!

বহুত শুকরিয়া। আপনার জীবন আল্লাহর হাদী নামক সিফাত এবং ইসলামের আলোর স্পষ্ট নিদর্শন। আলহামদুলিল্লাহ।

নি;সন্দেহে আমার জীবন আমি ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছি। আর আমার এ কাহিনী পড়ে সবার দিল খুলবে এবং সবাই দ্বীনের দাবী পূরণে সচেষ্ট হবেন-এ কামনা করছি। আল্লাহ্‌ তায়ালা সবাইকে হেদায়াত দান করুন এবং কামিয়াব করুন। ( আমীন )

সংগৃহীত। মাসিক আদর্শ নারী, নভেম্বর-২০১



বিষয়: বিবিধ

৪৭৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File