ঈদ শপিং

লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ০৫ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:০৩:৪৬ রাত

এক

সেই সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছেন মিসেস আফরিন। ঈদের কেনাকাটা করতে যাবো যাবো করে আজ চার দিন হয়ে গেলো। কিন্তু এ পোগ্রাম, ও পোগ্রাম করীম সাহেবের সব সময় কেড়ে নিলো। তবে আজ সকালে তিনি ওয়াদা করে গিয়েছিলেন, যে করেই হোক আজ দুপুরের মধ্যেই বাসায় ফিরবেন। কিন্তু ব্যাবসায়িক ব্যস্ততা তাকে আজও বাসায় ফিরালো রাত ২টায়। অনেক চেষ্টা করেও তাই আজ তিনি বউয়ের হাসি মুখের সন্ধান পাচ্ছেন না। যাই হোক, মিসেস আফরিন যখন শুনলেন আগামী তিন দিন তিনি অফিসে যাচ্ছেন না, পুরো তিনটা দিনকে কেনাকাটার জন্য উৎসর্গ করেছেন, তখন কিছুটা স্বাভাবিক হলেন।

লাল রংয়ের বি এম ডাব্লিও’তে ছড়ে এ মার্কেট ও মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা চলে করীম-আফরিন দম্পতির। কেনাকাটার কি আর শেষ আছে? বড়লোকদের কেনাকাটার চিত্রই ভিন্ন। দোকানে প্রবেশ করার পর যার যেটা পছন্দ হলো তাই প্যাকেটিং করা হয়। দরকষাকষির তো প্রশ্নই উঠে না। দোকান থেকে বের হওয়ার সময় হয়তো দেখা গেল হাজার পঞ্চাশেক বিল উঠেছে। সেলস ম্যানদের আরো দুই-তিন হাজার বখশিশ দিয়ে অন্য দোকানে পা বাড়ানোটাই তখন প্রাধান্য পায়। এই যেমন আজ তাদের চার বছর বয়সী একমাত্র কন্যা ইনা তার জন্য একটা ড্রেস পছন্দ করলো। নিউমার্কেট থেকে কিনলে হয়তো তার দাম চার হাজারের বেশি হবে না। কিন্তু বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের একটি দোকান থেকে যখন এটি করীম সাহেবের জন্য প্যাকিং করা হলো তখন দাম গুনা হলো মাত্র আঠারো হাজার টাকা। তাতে কি! মেয়ের পছন্দ! আঠারো হাজার কেন? এক লাখ টাকাতেও তিনি তা কিনতে রাজি। তাই স্যালসম্যানকে আরো দুই হাজার টাকা বখসিস সহ মোট বিশ হাজার টাকা পরিশোধ করে তারা পা বাড়ালেন অন্য দোকানে।

এভাবে কেনাকাটায় ব্যস্ত দুটো দিন তারা পার করলেন। কিন্তু মিসেস আফরিনের দুঃখ যেন শেষ হলো না। পাশের বাসার ভাবী তার চেয়ে বেশি দামে শাড়ি কিনেছে। এ দুঃখ ছাপা দিয়ে ঈদ করা কী তার পক্ষে সম্ভব!! করীম সাহেব তাকে সান্তনা দিলেন। কিন্তু কোন সান্ত্বনাই যেন তার দুঃখকে দূর করার জন্য যথেষ্ট ছিল না!

পরের দিন তারা আবার চুটলেন মার্কেটপানে। প্রথমেই যে দোকানে ঢুকলেন, সেখানে সবচেয়ে কম দামা যে শাড়িটি আছে তার মূল্য মাত্র ৩০হাজার টাকা। মিসেস আফরিনের একটা শাড়ি পছন্দ হলো। কিন্তু আফসোস! এ শাড়িটি তার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। কারন এই মাত্র শাড়িটি এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীর জন্য কিনে নিয়েছেন। বলে রাখা ভালো- শাড়িটি পছন্দের কারন আসলে ছিল তার মূল্য। মিসেস আফরিন যখন দেখলেন, তারা শাড়িটির মূল্য বাবদ এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা পে করেছে, তখনই শাড়িটি তার পছন্দ হয়ে যায়। আড় চোখে এ পছন্দের কথা জানালেন তার স্বামীকে। করীম সাহেব ম্যানেজারের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, যে শাড়িটি একটু আগে সেল হয়েছে তার চেয়ে ভালো কোয়ালিটির শাড়ি আছে কিনা? মিষ্টি হেসে ম্যানেজার সাহেব জবাব দিলেন-নিশ্চয়ই আছে। পাশে ফিরে বললেন- এই পলাশ! স্যারকে স্পেশাল ভি আই পি আইটেম দেখাও। পলাশ নামের স্যালস ম্যান এক পিচ শাড়ি করীম আফরিন দম্পতির সামনে হাজির করে বললো- এ কোয়ালিটির শাড়ি বাংলাদেশের আর কোথাও পাবেন না স্যার। বিশ পিচ এনেছিলাম। এখন মাত্র দুই পিচ বাকি আছে। দাম জানতে চাইলে স্যালস ম্যান জানালো মাত্র দুই লক্ষ আশি হাজার টাকা। ব্যাস, হয়ে গেলো! আর কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। ওয়ার্ডার দিল, শাড়ি প্যাকেট করার। বিল পে করে খুশি মনে গুলশানের বাসায় ফিরে এলেন মিসেস আফরিন।

দুই

মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে সাইফুল। পড়ে ভার্সিটিতে। সব দিক দিয়ে সচেতন ছেলেটি যে কোন কিছু কিনতে বাবার আয়ের দিকে লক্ষ্য রাখে। তিন বছর ধরে একই পাঞ্জাবী দিয়েই ঈদ সেরেছে সে। এবার মনে ইচ্ছা জাগলো নতুন একটি পাঞ্জাবী কেনার। আজ তারাবীর নামায শেষ করে যখন সে মসজিদ থেকে বের হলো তখন সময় প্রায় রাত দশটা। পকেটে করে কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল সে। ইচ্ছা ছিল নামায শেষ করে যদি পারে একটি পাঞ্জাবী কিনবে। মার্কেটে প্রবেশ করতেই একটি পাঞ্জাবীর দিকে চোখ আটকে গেলো তার। পকেটে আছে দেড় হাজার টাকা। পছন্দের পাঞ্জাবীটি ভালো করে দেখার আগেই সে দেখে নিচ্ছে তার গায়ে লাগানো মূল্য টোকেনটি। দেখেই যেন শরীরে কাঁপুনী সৃষ্টি হলো তার। মূল্য মাত্র তিন হাজার টাকা! পছন্দের জিনিসটিকে আর দেখার ক্ষমতাও যেন তার রইলো না। স্যালসম্যান জানতে চাইলো- পছন্দ হয়েছে কিনা? ঢোক গিলে সাইফুল জবাব দিলো- আরো কিছু দেখি! এ বলে দ্রূত পায়ে সেখান থেকে বের হয়ে গেলো। স্যালসম্যান বলতে লাগলো- এর চেয়ে ভালো মাল আছে। দেখাবো? তার কথার কোন জবাব না দিয়ে সাইফুল তার পথে হাঁটা শুরু করলো। কয়েকটি দোকান ঘুরেও যখন বাজেট মিলাতে পারলো না, তখন বাসায় এসে নিজের পুরাতন পাঞ্জাবীটা ভালোকরে দেখে নিলো সে। মনে মনে মুচকী হেসে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে নিজে নিজেই বললো- সমস্যা নেই। হুইল পাউডার দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ইস্ত্রী করে ফেললে এবারও এটা গায়ে দিয়ে ঈদ করা যাবে।

তিন

পুলিশ বক্সের পাশে জুতা পালিশের বাক্স নিয়ে বসে আছে মফিজ মিয়া। সন্ধ্যার পর থেকে এই পর্যন্ত কোন কাস্টমারের দেখা মেলেনি। ঈদে তো সবাই নতুন জুতা কিনতেই ব্যস্ত। কে আর আসবে পুরনো জুতা সেলাই করতে! ঈদের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। বউকে একটা শাড়ি কিনে দেয়ার বড় শখ মফিজ মিয়ার। শেফালি অবশ্য যে বাসায় কাজ করে ওই বাসা থেকে দু-একটি পুরাতন কাপড় পায় প্রতিবছরই। তবুও নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে বউয়ের জন্য একটি নতুন শাড়ি কেনায় যে কত আনন্দ! সারা বছর তো আর পারে না। যদি ঈদ উপলক্ষ্যেও বউকে একটি শাড়ি কিনে না দিতে পারে----!!! কিন্তু ব্যবসার যা অবস্থা! কিভাবে কী করবে সে! মফিজ মিয়ার ধ্যান ভেঙ্গে সেখানে এসে দাঁড়ালেন একজন স্কুল শিক্ষক। আব্দুল আজিজ সাহেব আজকেই স্কুল থেকে বেতন আর ঈদ বোনাসটা উঠালেন। হিসাব নিকাশ করে দেখেছেন পরিবারের সবার ঈদের জামা জুতো কিনে দেওয়ার পর যে টাকা হাতে থাকবে ওটা দিয়ে কোন মতেই আগস্ট মাস চলবে না। তাই বড্ড চিন্তায় আছেন তিনি। হাঁটছিলেন রাস্তা দিয়ে। ফুটপাত থেকে কম দামে কাপড় কিনে যদি কিছু টাকা বাঁচানো যায়! হঠাৎই টের পেলেন পায়ের স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে গেছে। এক হাতে ছেঁড়া স্যান্ডেলটা নিয়ে তাই এসে দাঁড়ালেন মফিজ মুচির সামনে। “সেলাই করে তলা লাগিয়ে পালিশ করে দেব, একদাম পঞ্চাশ টাকা পড়বে স্যার”- বলল মুচি মফিজ। আজিজ সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, “না না, এত কিছুর দরকার নেই। শুধুমাত্র ছেঁড়া অংশটি সেলাই করে দাও”। “তাই দিলে হয় নাকি! ঈদের দিন বলে কথা। একদম নতুনের মতো করে নেন। ঠিক আছে চল্লিশ ট্যাকাই দেন”। আজিজ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের কেউ দেখে ফেলতে পারে! ঈদের সিজনে জুতো সেলাই করাচ্ছেন, কী লজ্জ্বা! তাই চতুর্দিকে তাকালেন তিনি। নাহঃ পরিচিত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কখন কে এসে হাজির হয় কে জানে! তাই মুচির কাছ থেকে এক জোড়া জুতা নিয়ে পায়ে দিয়ে বললেন-আপনি কাজ করেন। আমি একটু ঘুরে আসি।

চার

বস্তিতে মাসিক পাঁচশ টাকায় ঘর ভাড়া করে থাকে হান্নান। ঠেলা গাড়ির চালক সে। স্ত্রী প্রতিবন্দী, আগে এক বাসায় কাজ করতো। সেখানে একবার এক অগ্নি দূর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে এখন আর কাজ করে খেতে পারে না। তাই হান্নানের একক আয়ের উপরই পরিবারের ভরন পোষন নির্ভর করে। ছোট ছেলেটি এবার বায়না ধরেছে ঈদে তাকে নতুন জামা কিনে দিতে হবে। হান্নান যে টাকা আয় করে তা দিয়ে পরিবারের সবার দু বেলা ভাত খেতেই কষ্ট হয়। আবার নতুন জামা! কিন্তু আদরের ছোট ছেলেটিকে এখন কী করে বুঝাবে। ও যে কিছুতেই বুঝতে চাইছে না! আজ চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ। হান্নান অনেক কষ্ট করে ১০০টাকা ধার করলো। সন্ধ্যার পর রওয়ানা দিল ফুটপাতের নীল আকাশের নীচে খোলামেলা স্টোরে। একটা জামা কেনার জন্যে। কিন্তু হায়! একশ বিশ টাকার কমে কোন জামাই পেলো না। অনেক ঘোরাঘোরি ও দরকষাকষির পরেও কোন লাভ হলো না। অবশেষে এক বিক্রেতাকে অনেক অনুরোধ করে বিশ টাকা বাকিতে ১০০টাকা দিয়ে জামা কিনে ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখে জামার জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার ছেলে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন সে নতুন জামা হাতে পেলো, তখন তার সে কী যে খুশি!!! তার খুশি দেখে চোখ অশ্রুসিক্ত হলো হান্নানের।

পাঁচ

জগতের এ ভাঙ্গা-গড়া, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা’র নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে প্রকৃতি। দিন যায়, মাস যায়, ঋতু চক্রে সময় পাক খায়। জন্মগ্রহণ করে নতুন মানুষ। আবার দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিতে হয় মানুষকে। প্রকৃতির হাতের উপর দিয়েই চলে এ লীলাখেলা। তবে প্রকৃতির স্নেহের ছায়ায় থাকার সময় কারো কারো লক্ষাধিক টাকার কাপড়েও আয়েশ মেটে না আবার কারো কারো এক দেড়শ টাকার কাপড় জোগাড় করাও কষ্টসাধ্য হয়। কিন্তু প্রকৃতি থেকে বিদায় নেয়ার সময় এ বৈষম্য আর থাকে না। তখন সবাইকে যেতে হয় একই রকম সাদা পোষাকে।

বিষয়: বিবিধ

২৪৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File