রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর সালাত ও সালাম পাঠ করা মু’মিনের এক অপরিহার্য কর্তব্য

লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ২৮ মে, ২০১৩, ১১:২০:২৮ রাত

বাংলাভাষায় বিভিন্ন আরবী শব্দের ফার্সী প্রতিশব্দের ব্যাপক প্রচলনের প্রভাবে আমরা অনেক সময় শব্দটির মূল আরবী কি তা জানিও না। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘সালাত’। মুসলিম জীবনের অন্যতম দুইটি ইবাদাত সালাত নামে পরিচিত। প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ, যাকে আমরা ‘নামায’ বলে থাকি। আর দ্বিতিয়টি হচ্ছে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর ‘সালাত’ প্রেরন করা; যা আমাদের কাছে ‘দুরুদ’ নামে পরিচিত।

ভাষাবিদদের মতে, সালাত শব্দের অর্থ রহমত ও বরকতের জন্য দু’আ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা। ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাতকে (নামায) ‘সালাত’ নামকরণের কারন এই ইবাদাতের মূল হচ্ছে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা, তাঁর করুণা ও ক্ষমা ভিক্ষা করা।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর ‘সালাত’ প্রেরন করার অর্থ তাঁকে মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করা, তাঁর জন্য রহমত, ক্ষমা ও মর্যাদার দু’আ করা।

মহান আল্লাহও তাঁর ফিরিশতাদের সাথে নিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর সালাত প্রদান করেন এবং তিনি ঈমানদারদেরকেও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর সালাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।

“নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগন নবীর উপর ‘সালাত’ প্রদান করেন। হে বিশ্বাসীগন, তোমরাও তাঁর উপর ‘সালাত’ ও ‘সালাম’ প্রেরন কর”। (সূরা আহযাবঃ ৫৬)

এ আয়াত নাযিলের পর সাহাবারা চিন্তায় পড়ে গেলেন, কিভাবে সৃষ্টির সেরা নবীদের নেতা, মানব জাতির মুক্তির দূতের জন্য দু’আ করবেন! সাহাবারা আগে থেকেই রাসূল (সাঃ) কে সালাম দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কিভাবে তাঁর জন্য সালাত প্রেরন করবেন, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অবশেষে তাঁরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছেই জানতে চাইলেন, কিভাবে তাঁর জন্য দু’আ করা যায়?

হযরত কা’ব বিন আজুরা (রাঃ) বলেনঃ

যখন উপরের আয়াতটি নাযিল হলো, তখন সাহাবীগন বললেনঃ হে আল্লাহর নবী, আমরা কিভাবে আপনার উপর সালাত প্রেরন করবো? তখন তিনি তাদেরকে দুরুদে ইব্রাহিম শিক্ষা দিলেন। (আহমদ, নং-১৭৬৬৭)

এভাবে আরো অনেক সাহাবীই এ আয়াত নাযিল হবার পর রাসূল (সাঃ) এর কাছে তাঁকে সালাত প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন এবং তিনি তাঁদের সকলকেই ‘দুরুদে ইব্রাহিম’ শিক্ষা দিয়েছেন। ভাষার ক্ষেত্রে সামান্য কমবেশ আছে।

বিশ্বনবীকে আল্লাহ সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। আমরা উনাকে সালাত ও সালাম প্রদান না করলে উনার কোন লাভ বা ক্ষতি নেই। তবে উনার প্রতি সালাত ও সালাম প্রদান করা আমাদের দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনেও মহান আল্লাহ আমাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের জন্য যা করেছেন, আমরা জীবন বিলিয়ে দিলেও তাঁর সামান্যতম প্রতিদান দিতে পারবো না। কারন আমরা হয়তো আমাদের পার্থিব সংক্ষিপ্ত জীবনটা বিলিয়ে দিলাম, কিন্তু তিনি তো আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক অনন্ত জীবনের সফলতার পথ দেখাতে তাঁর মহান জীবনকে উতসর্গ করেছেন। তাই তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরন করা আমাদের এক অপরিহার্য দায়িত্ব।

মহান আল্লাহ এত রহমান যে, আমরা আমাদের দায়িত্বটা পালন করলেও তিনি আমাদের অফুরন্ত সাওয়াব দিবেন বলে হাদীস হতে যানা যায়।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“তোমরা আমার উপর সালাত পাঠ কর; কারন যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে আল্লাহ তাকে ১০ বার সালাত(রহমত) করবেন”।(সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত, নং ৩৮৪)

হযরত আবু বুরদা ইবনু নিয়ার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“যদি কেউ অন্তর থেকে ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে একবার সালাত পাঠ করে, আল্লাহ সেই সালাতটির বিনিময়ে তার ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, ১০টি সাওয়াব লিখবেন এবং ১০টি গুনাহ ক্ষমা করবেন”। (নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৬/২১)

আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি,

“যখন তোমরা মুয়াজ্জিনকে (আযান দিতে) শুনবে তখন সে যা যা বলে তোমরাও তা বলবে, এরপর তোমরা আমার উপর সালাত পাঠ করবে; কারন যে আমার উপর সালাত পাঠ করবে আল্লাহ তাঁকে একটি সালাতের বিনিময়ে ১০ বার সালাত (রহমত, মর্যাদা, বরকত) প্রদান করবেন। এরপর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর কাছে ওসীলা প্রার্থনা করবে; ওসীলা জান্নাতের এমন একটি মর্যাদার স্থান যা শুধুমাত্র আল্লাহর একজন বান্দাই লাভ করবেন, আমি আশা করি আমিই তা লাভ করব। যে ব্যক্তি আমার জন্য ওসীলা প্রার্থনা করবে তাঁর জন্য শাফায়াত প্রাপ্য হবে।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত, নং ৩৮৪)

অন্য হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেছেনঃ

কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিশতাগন তাঁর উপর সত্তর বার সালাত (রহমত ও দু’আ) করবেন। অতএব কোন বান্দা চাইলে তা বেশি করে করুক অথবা কম করে করুক”। (মুসনাদে আহমদ ২/১৭২, ১৮৭)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর সালাত পাঠকারীর আরো একটি বড় পুরষ্কার হলো যে তা উনার কাছে পাঠানো হয়। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে যানা যায়, কোন মুসলিম দুনিয়ার যে প্রান্ত থেকেই সালাত পাঠ করুক না কেন, তা মদীনা মুনাওয়ারায় রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে তাঁর রওযা মুবারাকায় পৌঁছানো হবে। কোন কোন হাদীসে এমনও বলা হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সালাত পাঠকারীর জন্য দু’আ করবেন।

আউস বিন আউস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম দিন শুক্রবার। এদিনেই আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এদিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, এদিনেই সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, এদিনেই কিয়ামত হবে। কাজেই এই দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে সালাত পাঠ করবে, কারন তোমাদের সালাত আমার কাছে পেশ করা হবে”।

সাহাবীগন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, “আপনি তো (কবরের মাটিতে) বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, মিশে যাবেন, কিভাবে তখন আমাদের সালাত আপনার নিকট পেশ করা হবে?”

তিনি বললেনঃ “মহান আল্লাহ মাটির জন্য নিষিদ্ধ করেছেন নবীদের দেহ ভক্ষন করা”
। (সুনানুন নাসাঈ ৩/৯১, নং ১৩৭৪)

আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

কেউ আমার উপর একবার সালাত (দূরুদ) প্রেরন করলে আমি তাঁর উপর ১০বার সালাত (দু’আ) করি। দ্বিতীয় বর্ননায়ঃ কেউ আমার উপর সালাত প্রেরন করলে তা আমার কাছে পৌঁছানো হয় এবং আমি তাঁর উপর সালাত প্রেরন করি”। (তাবারানী, আল-মু’জাম আল-আউসাত ২/১৭৮, ১৬৪২)

সালাত পাঠকারীর জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শাফায়াত লাভের সুভাগ্য হবে বলে হাদীসে ঘোষনা দেয়া হয়েছে।

হযরত আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্নীত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

"যে ব্যক্তি সকালে আমার উপর দশবার সালাত পাঠ করবে এবং সন্ধ্যায় দশবার আমার উপর সালাত পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত লাভের সৌভাগ্য তাঁর হবে"। (মাজমাউয় যাওয়ায়িদ ১০/১২০)

হাদিসটির সনদ গ্রহণযোগ্য বলে মোহাদ্দিসরা মত প্রকাশ করেছেন। (রাহে বেলায়াত, পৃষ্ঠা ১৬০)

দু’আ কবুলের জন্য দু’আর সঙ্গে সালাত পাঠ করা উচিৎ।

হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্নীত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“সকল দু’আ পর্দার আড়ালে থাকবে (আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না) যতক্ষন না নবীর উপর সালাত পাঠ না করবে”। ( আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ ৫/৫৪-৫৮, নং ২০৩৫)

হযরত উমার (রাঃ) থেকেও অনুরুপ হাদীস বর্নীত হয়েছে। (তিরমিযী ২/ ৩৫৬, নং ৪৮৬)

প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী মুহাদ্দিস আবু সুলাইমান আব্দুর রহমান বিন সুলাইমান আদ দারানী বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তার কোন হাজত পেশ করতে চায়, বা কোন প্রার্থনা করতে চায় তার উচিৎ, সে যেন দু’আর শুরুতে নবীয়ে রাহমাতের (সাঃ) এর উপর সালাত পাঠ করে দু’আ শুরু করে, এরপর তাঁর প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে পেশ করে এবং শেষে পুনরায় সালাত পাঠের মাধ্যমে তার দু’আ শেষ করে। কারন নবিজীর (সাঃ) উপর সালাত আল্লাহ কবুল করবেন, আর আশা করা যায়, আল্লাহ সালাতের মধ্যবর্তী প্রার্থনাও দয়া করে কবুল করে নেবেন”।

সালাত বা দূরুদ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি আমাদের আরেকটি কর্তব্য তাঁর প্রতি সালাম জানানো।

আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“আল্লাহর কিছু ফিরিশতা আছেন যারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ান, আমার উম্মতের সালাম তাঁরা আমার কাছে পৌঁছে দেন”। (সুনানুন নাসাঈ, কিতাবুস সাহউ, নং ১২৮২)

হযরত আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“কৃপন ঐ ব্যক্তি যার নিকট আমার উল্লেখ করা হলেও সে আমার উপর সালাত পাঠ করলো না”। (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৫১)

যে মজলিসে আল্লাহর স্মরণ হয় না এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দূরুদ পড়া হয় না, হাদীসে সে মজলিসের সমালোচনা করা হয়েছে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্নীত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“যখন কিছু মানুষ একটি মজলিসে বসে, কিন্তু সেই মজিলসে তারা আল্লাহর স্মরন করে না এবং তাদের নবীর (সাঃ) উপর সালাত (দূরুদ) পাঠ করে না তাহলে এ মজলিসটি তাদের জন্য আফসোস ও ক্ষতির কারন হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের শাস্তি দিবেন আর ইচ্ছা করলে তাদের ক্ষমা করবেন।

অন্য বর্ননায় আছে-

“তারা জান্নাতে গেলেও উক্ত মজলিস তাদের দুঃখ ও আফসোসের কারন হবে, কারন যে সাওয়াব থেকে তারা বঞ্চিত হবেন তার জন্য তারা দুঃখ ও আফসোস করবেন”। (তিরমিযী কিতাবুদ দাওয়াত ৫/৪৬১, নং ৩৩৮০)

মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দিন- আমিন।

বিষয়: বিবিধ

৩১৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File