শুধু দানের ফযিলতের ওয়াজ করেই ক্ষান্ত আমাদের বেশিরভাগ আলেমঃ দানের ফযিলত নিয়ে তাদের যত টেনশন, হালাল উপার্জনের ব্যপারে মনে হয় তার অর্ধেকটুকুও নেই।
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ২৭ মে, ২০১৩, ১১:২০:৪১ সকাল
হালাল মাল, ইবাদাত কবুলের অন্যতম শর্ত। সাহাবায়ে কেরামগন যাদের উপার্জন হালাল হবার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন তাদের জন্য দু’আ করতেও অসম্মতি জানাতেন।
প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বসরার প্রশাসক ও আমীর আবদুল্লাহ ইবনে আমীরকে তার অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যান। ইবনু আমির বলেনঃ ইবনু উমার, আপনি আমার জন্য একটু দু’আ করুন না! ইবনু উমার তার জন্য দু’আ করতে অসম্মত হন। কারন তিনি ছিলেন আঞ্চলিক প্রশাসক। আর এ ধরনের মানুষের জন্য হারাম, অবৈধ, জুলুম, অতিরিক্ত কর, সরকারি সম্পদের অবৈধ ব্যবহার ইত্যাদির মধ্যে নিপতিত হওয়া সম্ভব। এ কারনে ইবনু উমার (রাঃ) উক্ত আমীরের জন্য দু’আ করতে অস্বীকার করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলতে শুনেছিঃ “ওজু গোসল ছাড়া কোন সালাত কবুল হয় না, আর ফাঁকি, ধোঁকা ও অবৈধ সম্পদের কোন দান কবুল হয় না”। আর আপনি তো বসরার গভর্নর ছিলেন। (সহীহ মুসলিম ১/২০৪, নং ২২৪)
যেখানে সাহাবীরা এমন লোকের জন্যও দু’আ করতে অসম্মতি জানিয়েছেন যার উপার্জনের ব্যাপারে উনারা সন্দিহান ছিলেন, সেখানে আমাদের দেশের কিছু কিছু আলেমকে দেখা যায় সরাসরি এমন সব লোকের জন্য দু’আ করতে যাদের অবৈধ উপার্জনের ব্যাপারে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত। আলেম সমাজের এ কাজের পিছনে একটা যুক্তিও থাকতে পারে-সে লোকটি অনেক দান করে, তাই তাকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এ যদি হয় তাদের ধারনা তাহলে আমি বলতে চাই আল্লাহর কাজ কি এ সব অবৈধ অর্থের জন্যে আটকে থাকবে???!!! আর এতে করে কি তাদের দানকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে নাকি তাদের অবৈধ উপার্জনকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। তারা তো এতে উৎসাহী হয়ে আরো বেশি অবৈধ উপার্জনের পথে পা বাড়াবে! কারন সাধারন মানুষের এমনকি আলেম সমাজেরও অর্থের উৎস সম্পর্কে কোন চিন্তা নেই। সবাই টাকা পেলেই খুশি। তাই লোকের বাহাবা পাবার জন্য আরো বেশি দান করতে হবে। আরো বেশী স্মার্টলী চলতে হবে। তাই অবৈধ উপার্জনের মাত্রাও বাড়াতে হবে!!
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-
হে মানুষেরা, আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (বৈধ) ছাড়া কোন কিছুই কবুল করেন না। আল্লাহ মুমিনগনকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নবী ও রাসূলগনকে দিয়েছেন(বৈধ ও পবিত্র উপার্জন ভক্ষন করা)। তিনি (রাসূলগনকে নির্দেশ দিয়ে) বলেছেনঃ হে রাসূলগন, তোমরা পবিত্র উপার্জন থেকে ভক্ষন কর এবং সৎকর্ম কর, নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর তা আমি জানি।(আল মুমিনূন-৫১) (আর তিনি মুমিনগনকে একই নির্দেশ দিয়ে বলেছেন) হে মুমিনগন, আমি তোমাদের যে রিযিক প্রদান করেছি তা থেকে পবিত্র রিযিক ভক্ষন কর(সূরা বাকারা-১৭২)। এরপর তিনি একজন মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি (হজ্জ, উমরা ইত্যাদি পালনের জন্য, আল্লাহর পথে) দীর্ঘ সফরে রত থাকে, ধূলি ধূসরিত দেহ ও এলোমেলো চুল, তার হাত দুটি আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে দু’আ করতে থাকে, হে প্রভু! হে প্রভু!! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দু’আ কিভাবে কবুল হবে!(সহীহ মুসলিম ২/৭০৩, নং ১০১৫)
এই ব্যক্তি দু’আ কবুল হবার অনেকগুলো আদব ও নিয়ম পালন করেছে। যেমন-
-সে মুসাফির অবস্থায় দু’আ করেছে এবং বিভিন্ন হাদীস হতে জানা যায় যে মুসাফিরের দু’আ কবুল হয়।
-সে দু’আ করার সময় বিনয়, আকুতি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে।
-সে হাত তুলে দু’আ করেছে; যা দু’আর একটি গূরুত্বপূর্ন আদব।
কিন্তু দু’আ কবুলের এতগুলো শর্ত পূরণ করার পরও তার দু’আ কবুল হবে না কারন সে হারাম উপার্জন থেকে খেয়েছে, পান করেছে ও পরিধান করেছে।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-
বৈধ ও হালাল জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোন প্রকার ইবাদত আল্লাহর নিকট উঠানো হয় না। (সহীহ বুখারী ২/৫১১,নং ১৩৪৪; ৬/২৭০২, নং ৬৯৯৩ এবং সহীহ মুসলিম ২/৭০২, নং ১০১৪)
দুর্ভাগ্য আজ আমাদের। আমাদের সমাজে হাজার হাজার টাকা খরচ করে দুয়ার অনুষ্ঠান করা যেন এক প্রকার প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেউ চিন্তাও করে না-এ টাকার উৎস কি? বরং যাদের অবৈধ ইনকাম বেশি, তুলনামূলকভাবে তাদেরকেই বেশি দেখা যায় ঝাঁকজমকভাবে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে দু’আর অনুষ্ঠান করতে।
খুব বেশি দুঃখ লাগে তখন, যখন দেখি আমাদের আলেম সমাজ তাদের ইনকামের অবৈধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পরেও তাদের পোগ্রামে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের গুনকীর্তন করে।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন-
“মানুষের মধ্যে এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ নির্বিচারে যা পাবে তাই গ্রহণ করবে। হালাল সম্পদ গ্রহণ করছে না হারাম সম্পদ গ্রহণ করছে তা বিবেচনা করবে না”। (সহীহ বুখারী ২/৭২৬, নং- ১৯৫৪)
হাদীসের ভাস্য অনুযায়ী অবৈধ উপার্জনকারীর সকল কর্ম, সকল প্রার্থনা অর্থহীন হবার পাশাপাশি তার অবৈধ উপার্জনের জন্য আখিরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি।
আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অবৈধভাবে কোন মুসলিমের কোন সম্পদ আত্মসাৎ করবে তার জন্য আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম নিশ্চিত করে দিবেন এবং তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করা হবে”। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলোঃ হে আল্লাহর রাসূল, যদি সামান্য কোন জিনিস অবৈধভাবে গ্রহণ করে? তিনি উত্তরে বলেনঃ যদি ‘আরাক’ গাছের একটুকরো খন্ডিত ডালও কেউ অবৈধভাবে গ্রহন করে তাহলে তারও এই শাস্তি। (সহীহ মুসলিম ১/১২২, নং ১৩৭)
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি কেউ কাউকে জুলুম করে থাক বা ক্ষতি করে থাক তাহলে জীবদ্দশায় তার নিকট থেকে ক্ষমা ও মুক্তি নেবে। কারন আখিরাতে টাকা পয়সা থাকবে না, তখন অন্যায়কারীর নেক আমলগুলি ক্ষতিগ্রস্তকে প্রদান করা হবে। যখন নেক আমল থাকবে না তখন ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির পাপগুলি অন্যায়কারীর কাঁধে চাপিয়ে তাকে জাহান্নামে ফেলা হবে। (সহীহ বুখারী ৫/২৩৯৪, নং- ৬১৬৯)
আরেক হাদীসে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ “তোমরা কি জান কপর্দকহীন অসহায় দরিদ্র কে?” আমরা বললামঃ “আমাদের মধ্যে যার কোন অর্থ সম্পদ নেই সেই কপর্দকহীন দরিদ্র”। তিনি বললেনঃ “সত্যিকারের কপর্দকহীন দরিদ্র আমার উম্মতের ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি নেককর্ম নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ বা অর্থ অবৈধভাবে গ্রহণ করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কারো রক্তপাত করেছে। তখন তার সকল নেককর্ম এদেরকে দেয়া হবে। যদি হক আদায়ের পূর্বেই নেককর্ম শেষ হয়ে যায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তিদের পাপ তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হবে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম ৪/১৯৯৭, নং ২৫৮১)
অতএব যারা কোন ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের সম্পদ অবৈধভাবে গ্রহণ করে তাদের উপার্জন হারাম।সচেতন মানুষের বিশেষ করে আলেম সমাজের উচিৎ এজাতীয় লোকদের সামাজিকভাবে বয়কট করা। তাহলে অন্যরা আর এজাতীয় উপার্জনের প্রতি আগ্রহী হবেন না।
হারাম উপার্জন থেকে তাওবার জন্য প্রথমে গভীরভাবে অনুতপ্ত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সকল প্রকার অবৈধ উপার্জন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তৃতীয়ত, যাদের নিকট থেকে অবৈধভাবে সম্পদ গ্রহণ করা হয়েছে তাদেরকে বা তাদের উত্তরাধিকারীগনকে তা ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমা নিতে হবে।–এ তৃতীয় শর্তটিই সবচেয়ে কঠিন। এতে অক্ষম হলে অবৈধভাবে উপার্জিত সকল অর্থ ও সম্পদ যাদের সম্পদ তাদের নামে বিলিয়ে দিতে হবে। বেশি করে তাদের জন্য দু’আ করতে হবে। বেশি করে আল্লাহর কাছে কাঁদতে হবে যেন তাদের এই হক আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। সর্বোপরি খুব বেশি করে সাওয়াবের কাজ করতে হবে, যেন পাওনাদারদের দেয়ার পরেও নিজের কিছু থাকে। সর্বাবস্থায় আল্লাহর দরবারে নিজের অসহায়ত্ব, আকুতি ও বেদনা পেশ করে সদা সর্বদা তাওবা করতে হবে। সাহাবী ও তাবেয়ীগন বলেছেন, এসব কিছুর পরও তার আখিরাতের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। (রাহে বেলায়াত; ডঃ খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর; পৃ. ৯৬)
আমাদের সমাজের বেশিরভাগ আলেমদেরকেই দেখা যায় দানের ফযিলত সম্পর্কে ওয়াজ করতে। কিন্তু এ দানের উৎস কেমন হতে হবে সে বিষয়ে খুব কম আলেমই আলোচনা করে থাকেন।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে আমার পরম শ্রদ্ধেয় চাঁদপুরের ঐতিহাসিক বেগম জামে মসজিদের সাবেক খতিব সাহেবের কথা। কয়েক বছর আগে উনি ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। -আমিন। উনি দানের ক্ষেত্রে হালাল উপার্জনের ব্যপক গূরুত্ব দিতেন। হারাম উপার্জনের সম্পদ দান করার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন সময় বলতেন, হারাম মাল দান করলে ডাবল গুনাহ। একে তো সে হারাম জিনিস উপার্জন করেছে। আর অন্যদিকে এ হারাম সম্পদ সে আল্লাহর রাস্তায় দান করে বেয়াদবী করেছে।
এ বিষয়ে সাহাবী ও তাবেয়ীগন একমত যে জুলুম, অত্যাচার, দুর্নীতি, ফাঁকি বা অন্য কোন প্রকার অবৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে বা বৈধ সম্পদের মধ্যে এরুপ অবৈধ সম্পদ সংমিশ্রিত করে তা দিয়ে যদি কেউ হজ্জ, উমরা, দান, মসজিদ নির্মান, মাদ্রাসা নির্মান, জনকল্যানমূলক কর্ম, আত্মীয়স্বজন ও অভাবী মানুষদের সাহায্য ইত্যাদি নেক কর্ম করে তাহলে তাতে তার পাপই বৃদ্ধি হবে। কোন প্রকার সাওয়াবের অধিকারী সে হবে না। এমনকি এ ধরনের জুলুম প্রবঞ্চনা, দুর্নীতি বা অবৈধ উপার্জনের অর্থে তৈরী কোন মসজিদ, মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা ব্যবহার করতেও তাঁরা নিষেধ করেছেন। (মুসান্নাফু আব্দুর রাজ্জাক৫/২০। ইবনু রাজাব, জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, পৃষ্ঠা ১২৩-১২৯। রাহে বেলায়াত, পৃষ্ঠা ৯০)
আইন করে অবৈধ উপার্জন বন্ধ করা কষ্টকর। একাজটি সহজে করতে পারেন সচেতন ইসলাম প্রিয় ব্যক্তিবর্গ ও আলেম সমাজ, বিশেষ করে মসজিদের ইমামগন। তাঁরা যদি সচেতন হোণ, যাদের অবৈধ উপার্জন সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করেন, তাদের উৎসবাদিতে অংশগ্রহণ না করেন, এবং ইসলামিক প্রতিষ্ঠানে তাদের কোন প্রকার দান গ্রহণ না করেন, তাহলে অটোমেটিক্যালিই মানুষ অবৈধ উপার্জনের পথ পরিহার করবে ইনশাআল্লাহ।
অবৈধ উপার্জন ইবাদাত কবুলের পথে এক ভয়ংকর বাধা। হাদিসের ভাস্যমতে অনেক ইবাদাত করার পরেও শুধুমাত্র এ কারনে বহু লোককে জাহান্নামী হতে হবে। তাই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি- হে আল্লাহ! হারাম খাবার, পানীয় ও টাকা পয়সা থেকে আমাদের মুক্ত রাখ।–আমিন।
বিষয়: বিবিধ
২২৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন