এক সময়কার ইসলামের উর্বর ভূমি এখন চরম অনুর্বরঃ পুনরায় উর্বর করতে প্রয়োজন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:০৩:২৯ রাত
যতটুকু জানা যায় বাংলাদেশে ইসলামের প্রথম আগমন ঘটে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ) এর আমলে (৬৩৪-৪৪ খৃ.)। রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৬০৬-৬৪৭ খৃ.) আরব দেশ থেকে একটি ছোট্ট প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। তাঁদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও চারিত্রিক গুণমাধুর্য স্থানীয় জনগণকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এর বহু বছর পর মাত্র অল্প কয়েকজন সৈন্য নিয়ে প্রায় বিনা বাধায় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর মাধ্যমে এখানে মুসলিম রাজশক্তির উথান ঘটে।
জনাব আবুল মনসুর সাহেবের মতে, বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রবর্তনের প্রায় তিনশ' বছর আগে এখানে ইসলাম জনতার ধর্মরূপে গৃহীত হয়ে গিয়েছিল। বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয় থেকে এখানে ইসলাম প্রচারের ধারণাকে এ সংক্রান্ত অনেক গবেষকই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা অকাট্য দলিল-প্রমাণ দ্বারা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, খিলজীর বঙ্গভূমিতে আসার তিনশ বছর পূর্ব থেকে এখানে বহু মুসলিম বণিক, আওলিয়া-সাধক, মুবাল্লিগদের অস্তিত্ব ছিল। তারা এ ভূখন্ডে ইসলাম প্রচার করতেন। তবে তাদেরকে কঠোর বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হয়েছিল। মুসলিম রাজশক্তির উথানের পর এ বাধা খানিকটা কমলেও দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রেই মুসলমান শাসকদের দেখা যায়নি ধর্ম প্রচারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে। বরং আলেম ওলামাদের মাধ্যমেই ধর্ম প্রচার থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনের ভীত মজবুত হয়েছিল।
তবে হাতে গোনা দু একজন ছাড়া (যেমন-আকবর) সকল মুসলিম শাসকই নিজে ইসলাম যতটুকুই পালন করুক না কেন ইসলামের প্রসারে রেখেছিল পরোক্ষ অবদান। যার ফলে ইসলামের প্রসার হতে থাকে দূর্দান্ত গতিতে। বৃটিশ শাসনামলে বিভিন্ন আদমশুমারীর রিপোর্ট তাই সাক্ষ্য দেয়। ফলে, যে নওমুসলিম ১২৭২ সালে হিন্দুদের তুলনায় ছিল সংখ্যালঘু, ১৯১১ সালে তারা শতকরা বায়ান্নর সংখ্যাধিক্যের জাতিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
মুসলিম ইতিহাসের প্রথম যুগে যে কয়েকজন ইসলাম প্রচারকের এদেশে আবির্ভাব হয়েছিল বায়েজীদ বোস্তামীর নাম তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রকৃত নাম আবু ইয়াজিদুল বোস্তামী। ইরানের বোস্তাম শহরে তাঁর জন্ম। ৮৭৫ সালে বোস্তামে তাঁর মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামে কোন সময় তাঁর আগমন হয় তা জানা যায় না। ডক্টর এনামুল হক চট্টগ্রামস্থ তাঁর দরগাহকে ‘স্মারক সমাধি' বলে অভিহিত করেছেন।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলাদেশে আগমনের (১২০২ খৃ.) পূর্বে যে কয়জন ওলী- আওলীয়া ধর্ম প্রচারক এদেশে এসেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে শাহ সুলতান বলখী, মাহি সাওয়ার , শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী, বাবা আদম শহীদ, শাহইনয়ামতুল্লাহ বুৎ শিকন (র প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মুসলিম রাজশক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার কারনে বাংলার মাটি ইসলামের এক উর্বর ভূখন্ডে পরিণত হয়। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় ধর্মীয় রুপলেখা। বিভিন্ন আইন কানুন বিশেষ করে মুসলিম পারিবারিক আইনগুলো পরিচালিত হতো ইসলামী বিধান অনুসারে। সমাজে দাঁড়ি টুপি ও হিজাবের ব্যপক প্রচলন দেখা দেয়। বাংলার জমিনে ইসলামের উর্বরা শক্তি এতই বেশি ছিল যে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা হারালেও এর অনেক কিছুই টিকে থাকে। ব্রিটিশ সরকারেরও সাহস হয়নি এ উর্বর ভূমিতে খুব বেশি আগাছা উৎপন্ন করার। যার ফলে তারা ব্যপক ইসলাম বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম পারিবারিক আইনে হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস করে নি।
কিন্তু দূর্ভাগ্য! নানা রকম দন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে মুসলমানরা এখন নিজেরা নিজেদের এমন ক্ষতি করছে, যা করতে ব্রিটিশরাও ব্যর্থ হয়েছে।
এ মাটিকে ইসলামের উর্বর ভূমিতে পরিণত করতে যে আলেম ওলামার অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদের মধ্যে হযরত শাহজালালের (রহঃ) ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তালিকা তৈরী করেন- বাংলার কোন কোন অঞ্চলে এখনো একজন মুসলমানও নেই বা ইসলামের আলো এখনো ছড়ায় নি; কোন কোন অঞ্চলে হাতে গোনা দু একজন মাত্র মুসলমান আছেন; কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরা অমুসলমান জমিদারদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন। এসব অঞ্চলে তিনি ইসলামের প্রসারের জন্য প্রতিনিধি প্রেরন করেন। আমার জন্মস্থান চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় হযরত শাহরাস্তি বাগদাদী (রহঃ) কে। তাঁর নামেই পরবর্তীতে এই উপজেলার নামকরন করা হয়।
উনাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যে অনুর্বর ভূমিকে তাঁরা উর্বর করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সে উর্বর ভূমিই আজ আমাদের দলাদলির কারনে অনুর্বর। আজ কোন অভিযোগ ছাড়াই মাথায় টুপি, মুখে দাঁড়ি দেখে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়। মুসলিম মা বোনেরা হিজাব সহকারে বের হলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে হয়রানী করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। অথচ অশালীন পোষাকের ব্যপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নাই। রাষ্ট্রীয় ভাবে জাতীকে ধর্মহীন করার এক চক্রান্ত আজ চলছে। পাঠ্যপুস্তকে এমনকি ইসলামের শিক্ষা বিষয়ক বই পুস্তকেও শিরকী শিক্ষা দিয়ে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইসলাম প্রচারের কাজে যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদেরকে ঠুনকো অভিযোগে অথবা কোন অভিযোগ ছাড়াই শুধু মাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে জেলখানাগুলোকে পরিপূর্ন করা হচ্ছে। যেসব মিডিয়া ইসলামের পক্ষে কথা বলে, সেগুলো বন্ধ করার ষঢ়যন্ত্র চলছে। সারাদেশে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে অশ্লীল অনুষ্ঠান গুলোর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সহযোগীতা করা হলেও যারা এ দিনে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করছিল তাদের কিছু কর্মীকে করা হয় গ্রেফতার। দেশের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা বললে আজ মামলা হয়; কিন্তু বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা বললে তাকে শহীদী খেতাবে ভূষিত করা হয়। যখনই কোন দূর্ঘটনা ঘটে, তখনই কোন তদন্ত ছাড়াই সরাসরি দোষ চাপানো হয় ইসলাম পন্থীদের ঘাড়ে। আর গ্রেফতার করা হয় গণহারে। মোবাইলে ইসলামী সংগীত রাখতেও এখন অনেকে ভয় পায়। টুপি, দাঁড়ি বা হিজাব সহ বাহিরে যাওয়াও আজ ঝুঁকিপূর্ন।
মোটকথা বাংলার এ জমীন আজ ইসলামের জন্য এক অনুর্বর ভূখন্ড। ব্যপক আগাছা জন্মেছে এতে। এ আগাছা এক দিনে জন্মে নি। আমরা নিজেদের মধ্যে অমৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে দাঙ্গা হাংগামায় লিপ্ত। আমাদের খেয়ালই নেই- আমাদের নিজেদের মধ্যাকার অনৈক্যের সুযোগে বিরোধীরা আগাছা জন্মাচ্ছে আমাদের জমিতে। তারা অনুর্বর করে ফেলেছে আমাদের ভূখন্ডকে। তারা যখন এসব কাজে ব্যস্ত, তখন আমরা ব্যস্ত- সোজা হয়ে শোয়া জায়েয নাকি বাঁকা হয়ে শোয়া জায়েয; নবিজীকে দাঁড়িয়ে সালাম দিব নাকি বসে সালাম দিব এ জাতীয় অমৌলিক বিষয় নিয়ে দাঙ্গা হাংগামায়। অবশেষে আজ আমরা সংখ্যাগরিষ্ট হবার পরেও নির্যাতিত-লাঞ্চিত।
এখনও সময় আছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হতাশ হতে নিষেধ করেছেন।
“তোমরা হতাশ হয়োনা, চিন্তিত হয়োনা, তোমরা যদি মুমিন হও তাহলে তোমরাই বিজয়ী হবে” ।(আল- ইমরানঃ১৩৯)
তাই আমাদের হতাশ হলে চলবে না। আমরা এখনো চরম সংখ্যা গরিষ্ট। শুধুমাত্র ঐক্যবদ্ধ না থাকাতে আজ আমরা অনেক দূর্বল। যার সুযোগ নিচ্ছে বিরোধীরা। এত নির্যাতনের পরও যদি আমরা এটা না বুঝি তাহলে এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!!!
আমরা চাই মুসলমানরা ঐকবদ্ধ হোক। ঐক্য বলতে আমরা বুঝাতে চাচ্ছি না যে মাজহাব, দল সব কিছু বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটা হয়তো এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। বরং ঐক্য বলতে বুঝাতে চাই কালেমায় বিশ্বাসীদের মাঝে ঐক্য।
মানুষের মাঝে মতানৈক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। এটা থাকবেই। সাহাবাদের মধ্যেও ছিল। তবে আমরা যারা এক আল্লাহকে সিজদাহ করি, তাদের মাঝে যতই দ্বিমত থাকুক না কেন, আমাদের প্রধান বিষয় এক। আর তা হচ্ছে আমরা এক আল্লাহর গোলাম। তাই এ বিষয়টিকে সামনে রেখে আমাদের উচিৎ ইসলাম বিরোধীদের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা।
সম্প্রতি আমরা কিছু আশার আলো দেখছি।
ইসলাম পন্থীরা আজ ঐকবদ্ধ হতে শুরু করেছে। আর এতে করেই চেয়ার কেঁপে উঠেছে বাতিল শক্তির। কিছু উলামায়ে ছুঁ দের দিয়ে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এ ঐক্যকে ভাংগার। ইসলাম পন্থীরা যাতে কোন ভাবেই ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করছে না। তাই আমাদের আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে এ ব্যপারে। আমাদের অনৈক্যের কারনে আমরা আমাদের যে সম্মান ও সম্পদ হারিয়ে ফেলেছি, ঈমানের শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা আবারও ফিরে পেতে চাই সে সম্পদ, সে সম্মান।
বিষয়: বিবিধ
২৯৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন