ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্ক

লিখেছেন লিখেছেন শহীদ ভাই ১৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:৫৩:৫৭ সকাল

একটি জাতির পরাজয় এবং বিপর্যয়ের কারণ নানাবিধ।

তবে শুরুটি হয় জনগণের চেতনায়।

হাত-পায়ে যত শক্তিই থাক, মগজ হুশ হারালে দেহও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। তেমনি অবস্থা একটি জাতির। অতীতে মুসলমানগণ যখন বিজয়ের পর বিজয় আনছিল এবং বিশ্বশক্তি রূপে দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করছিল তখন তাদের তেল-গ্যাস ছিল না, বিশাল জনশক্তিও ছিল না। হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসাও ছিল না। শত শত কলেজ বিশ্বাবিদ্যালও ছিল না। কিন্তু উম্মাহর জীবনে তখন পুর্ণ হুশ ছিল, নিজেদের বাঁচার মূল মিশন নিয়ে পরিপূর্ণ সচেতনতাও ছিল। সে হুশ এবং সে সচেনতার মূল ভিত্তিটি ছিল ঈমান এবং কোরআনী জ্ঞান। কিন্তু আজ সে হুশ নেই, জীবনের মিশন নিয়ে সে সচেতনতাও নাই। সে বোধ যে শুধু সাধারণ মুসলমানদের জীবন থেকে তা হারিয়ে গেছে তা নয়, আলেম রূপে যারা পরিচিত হারিয়ে গেছে তাদের জীবন থেকেও। ফলে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসারি রূপে বেড়ে উঠার বদলে নানা ভাষা, নানা দেশ, নানা মজহাব ও নানা ফেরকার পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠাটিই মুসলমানদের জীবনের মূল প্রায়োরিটি পরিণত হয়েছে। ফলে পৃথিবীতে আজ ৫৫টির বেশী মুসলিম দেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে, কিন্তু কোথাও উড়ছে না ইসলামের পতাকা। কুফরি আইন-কানূন, সূদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, পতিতাবৃত্তি এসবও মুসলিম দেশের অলংকারে পরিণত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে স্বৈরাচার ও রাজতন্ত্র। পদদলিত হচ্ছে মানবিক অধিকার।

ইসলামের এ সুস্পষ্ট পরাজয়ের পরও মুসলমানদের মাঝে মাতম নেই। তা নিয়ে ভাবনা ও আলোচনাও নাই। নেতৃবর্গ ব্যস্ত পরিবার, দল ও জাতির এজেণ্ডা নিয়ে। এবং জনগণ ব্যস্ত নিজ নিজ এজেণ্ডার বাস্তবায়ন নিয়ে। জনগণের ধর্মপালন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন-কানূন নিয়েও যে আল্লাহতায়লার সুস্পষ্ট এজেণ্ডা আছে এবং সে এজেণ্ডার বাস্তবায়নে মুসলমানের যে ঈমানী দায়বদ্ধতা আছে -সে হুশও তাদের নেই। বরং বিচ্যুতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, বিস্মৃতির পাশাপাশি প্রশ্ন তোলা হচ্ছে মহান আল্লাহর এজেণ্ডা ও তার বাস্তবায়নের ন্যায্যতা নিয়ে। বিতণ্ডা উঠেছে খোদ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে। অনেকেরই দাবী, কোরআন নাযিলের লক্ষ্য ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ব্যক্তির ইসলাহ ও আত্মীক পরিশুদ্ধি। অথচ তারা ভূলে যান, পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত নাযিল হয়েছে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের তাগিদ দিতে। সাহাবী কেরামদের জানমালের বিপুল অংশ ব্যয় হয়েছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এবং রাষ্ট্রে আল্লাহর এজেণ্ডা বাস্তবায়নে। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবী সে কাজে শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সাঃ) যুদ্ধের পর যুদ্ধ সংগঠিত করতে হয়েছে, নিজেকে সেসব যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে এবং নিজেকে আহতও হতে হয়েছে। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো আল্লাহতে পূর্ণ আত্মসমর্পন। আর যে কোন বিদ্রোহ ও অবাধ্যতাই হলো কুফরি। সেটি যেমন মুসলমানের ব্যক্তি জীবনে তেমনি সামজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। ব্যক্তির জীবনে তো পরিশুদ্ধি আসে এরূপ জিহাদে ও ত্যাগের পথে। যেখানে সে জিহাদ ও ত্যাগ নাই সেখানে নামায-রোযা, হজ-যাকাত বাড়লেও পরিশুদ্ধি বাড়ে না। বরং মুসলিম দেশ তখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নয় দুর্নীতিতে। “সামেয়’না ওয়া তায়া’না” অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম শুনলাম এবং মেনে নিলাম –আত্মার এমন ধ্বনি মূলত পরিশুদ্ধ আত্মার। মুসলিম সমাজে সেটি বিলুপ্তি হয়েছে। বরং “শুনলাম এবং বিদ্রোহ করলাম” –সেটিই আজ নীতিতে পরিণত হয়েছে। সে বিদ্রোহের উপরই প্রতিষ্ঠিত আজকের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সংবিধান, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি।

ফলে মুসলিম দেশে মহা-পরাক্রমশালী আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বদলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানুষের সার্বভৌমত্ব।

নর্দমায় গিয়ে পড়েছে শরিয়তী আইন, খেলাফতী শাসন ও বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্ব।

ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিতর্কটি শুরু হয়েছে মূলত ইসলাম-পালন নিয়ে মতের ভিন্নতা থেকে। সবাই যেমন ইসলামকে একই ভাবে দেখে না, তেমনি ধর্মকর্মও সবাই একই ভাবে করে না। ইসলাম বলতে অনেকেই বুঝে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, আখেরাত, বিচারদিন, ফিরেশতা ও আসমানী কিতাবের উপর ঈমান এবং নামায-রোযা-হজ-যাকাত পালন। তাদের চিন্তার গণ্ডিতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা যেমন নেই, তেমনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ নেই, কোরবানীও নেই। আল্লাহর শরিয়তী বিধান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হলো কি হলো না তা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই, আগ্রহও নেই। তাদের ধর্ম-পালন স্রেফ নামায-রোযা-হজ-যাকাত পালনে সীমিত। বহুশত বছর ধরে মুসলিম দেশগুলিতে এরাই ধর্মপ্রাণ মুসলমান বলে প্রশংসিত হয়ে আসছে। তাদের ইসলামকে বলা হয় মডারেট ইসলাম। অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা বিশ্বাসী তাদেরকে চিত্রিত করা হয় মৌলবাদী বা চরমপন্থি মুসলমান রূপে। তাদের ইসলামকে বলা হচ্ছে পলিটিকাল ইসলাম। বাংলাদেশের সেক্যুলারিষ্টরা তাদেরকে জঙ্গিবাদী রূপে অভিহিত করছে এবং তাদের ইসলামকে বলছে জঙ্গি ইসলাম। স্বৈরাচার অধিকৃত প্রতিটি মুসলিম দেশে তাদেরকে রাজনৈতিক শত্রু রূপে দেখা হয়। তাদের উপর যে শুধু রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আছে বা জেল-জুলুম হচ্ছে তা নয়, তাদের হত্যায় কোন রূপ বিচার অনুষ্ঠানের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করা হয় না।

ইসলামের আংশিক অনুসরণকারি আজ ঘরে ঘরে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ হজে যায়। বাংলাদেশে তাবলিগের জামায়াতের ইজতেমাতেও তিরিশ লাখের বেশী হাজির হয়। দেশে দেশে এরূপ বহু এজতেমা হচ্ছে¸ নির্মিত হচ্ছে হাজার হাজার মসজিদ ও মাদ্রাসা। লিখিত হচেছ লক্ষ লক্ষ বই। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লোক নেই। বরং বিরোধীতা শুরু হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে। বলা হচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ ও কোরবানী পেশের বিষয়টি ঈমানদার হওয়ার জন্য শর্ত নয়। অনেকে বলছেন, আল্লাহতায়ালা দেখেন মুমিনের ঈমান, এবং তার আক্বিদা, নামায-রোযা-হজ-যাকাতের ন্যায় ইবাদত। এ মতের প্রচারে শুধু যে সেক্যুলার রাজনীতিবিদ ও বু্দ্ধিজীবীগণ ময়দানে নেমেছে তা নয়, ময়দানে নেমেছে বহু হাজার আলেম, অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, এমন কি তথাকথিতহ ইসলামি আন্দোলনের বহু নেতা-কর্মীও। সবচেয়ে বড় বিভ্রাট ঘটেছে ধর্মপালনের এ ক্ষেত্রটিতে। শ্রী চৈতন্য ভাববাদী গান গেয়ে বাংলায় ইসলামের দ্রুত প্রসার রুখে দিয়েছিলেন। মানুষ তখন গানের মধ্যে শুধু আনন্দ নয়, ধর্মও খুঁজতো। যীশু খৃষ্টের প্রতি ভালবাসার গানই খৃষ্টান ধর্মের মূল কথা। দল বেঁধে সে গান গাওয়াতের তাদের মনের প্রশান্তি। সেখানে হারাম-হালালের বালাই নেই। পাপ যত বিশাল ও জঘন্যই হোক তাতে শাস্তির ভয় নেই, সে পাপের প্রায়শ্চিত্য ঈসা (আঃ) বহু আগেই করে গেছেন। খৃষ্টানদের কাজ হলো শুধু গীর্জায় গিয়ে তার ভক্তিতে গান গাওয়া। চিকিৎসার নামে ঝাড়-ফুঁকের মধ্যেও যেমন অজ্ঞ মানুষের কিছুটা তৃপ্তি বোধ থাকে, তেমনি তৃপ্তিবোধ রয়েছে এমন ধর্মপালনেও। সেটি যে কতটা সত্য-নির্ভর তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনাও নেই। ধর্ম পালনেরর সে পথ শেখানোর সে কৌশলটি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের সেক্যুলারগণও। তাই তারা লালন শাহ ও হাসন রাজার ভাববাদী গানের খোঁজ করছে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মানের আন্দোলন যতই তীব্রতা পাচ্ছে, সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে ততই বাড়ছে এসব গানের গুরুত্ব। নিছক মুসলিম সেক্যুলারিস্টই নয়, এদের পিছনে অমুসলিমদেরও বিপুল অর্থ, শ্রম ও মেধা ব্যয় হচ্ছে। ব্রিটেন, ফ্রাণ্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলির শত শত কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের সাথে বিশাল বিণিয়োগ করছে ভারতও। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করার মধ্যেই তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। তারা জানে, সভ্যতা কখনোই খানকায় গড়ে উঠে না। কোন মসজিদ- মাদ্রাসায়ও বিশ্বশক্তি নির্মিত হয় নয়। এজন্য চাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মান। এজন্যই তাদের টার্গেট মসজিদ-মাদ্রাসা বা খানকা নয়। বরং সেগুলির নির্মানে তারা অর্থ দিচ্ছে, নিজ দেশে তারা বহু মূল্যবান জমিও দিচ্ছে। তারা বদ্ধপরিকর ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মান প্রতিহত করায়। সে লক্ষে তারা লাগাতর প্রচারনা, সামরিক হামলা ও ড্রন হামলার স্ট্রাটেজী গ্রহণ করেছে। শয়তান জানে, ইসলামী রাষ্ট্রই এ জমিনে মহান আল্লাহর ফিরেশতা নামিয়ে, তখন বিশ্বশক্তিতে পরিনত হয় মুসলিম রাষ্ট্র। সভ্যতার দ্বন্দে এমন রাষ্ট্রই তাদের প্রকৃত প্রতিপক্ষ। অথচ তেমন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করা গেলে তখন সামনে কোন প্রতিদ্বন্দীই থাকে না। সেক্যুলার মুসলিম রাষ্ট্রগুলি নামে মুসলমান হলেও কার্যতঃ তাদের মিত্র। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মান রুখার সে স্ট্রা্টেজীকে সামনে নিয়েই ইসলামের মৌলবাদ নির্মূলের নামে গড়ে উঠেছে বিশাল আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “উদখুলু ফি সিলমে কা’ফ্ফা”, অর্থঃ ইসলামে প্রবেশ করো পরিপূর্ণ রূপে। অর্থাৎ যেখানেই আল্লাহর হুকুম, সেখানেই সে হুকুম প্রতিপালনে অবনত হও। আল্লাহর বিধানকে তাই নিছক নামায-রোযা-হজ-যাকাতে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নাই। আত্মীক পরিসুদ্ধি শূন্যে ঘটে না, সে লক্ষ্য পূরণে পরিসুদ্ধি আনতে হয় সমাজ ও রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রে তখন নৈতিক স্বাস্থ্যসম্পন্নতা আসে। তবে সে জন্য রাষ্ট্রকেও কোরআনী বিধানের আঁওতায় আনতে হয়। কিন্তু সে উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হয় যদি আদালতে কুফরি আইন প্রতিষ্ঠা পায় এবং সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর উপর আস্থা বিলুপ্ত হয়। অথচ বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে। দেশটির সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও তাঁর সার্বভৌমত্ব যেমন বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি আদালতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ব্রিটিশ-প্রণীত পেনাল কোড। ফলে দেশটিতে সূদ, মদ, জুয়া, পতিতাবৃত্তির ন্যায় নানাবিথ পাপাচার ও অপরাধও নিষিদ্ধ নয়।

ইনশাল্লাহ্ চলবে...............




বিষয়: বিবিধ

১১১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File