দোয়া-মোনাজাতের সুফল.............. ? (২য় পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন শহীদ ভাই ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ১২:২১:০৮ দুপুর

১ম পর্ব লিখেছেন ব্লগার স্বাধীনতা I Don't Want To See I Don't Want To See

২য় পর্ব

দোয়া- মহান রাব্বুল আলামীনের প্রতি বান্দার দীনতা, হীনতা ও বিনয় প্রকাশের একটি বিশেষ মাধ্যম। এর মাধ্যমে বান্দা নিজেকে মহান স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। বস্তুত সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মুখাপেক্ষী। সকল কল্যাণ ও উপকার যেমন তার কাছ থেকে আসে তেমনি বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্টও একমাত্র তিনিই দূর করতে পারেন। তাঁর হাতেই সব ক্ষমতা। তিনি সকল শক্তির আঁধার। এ জন্য মহামহিম সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর সামনে বিনয় ভরে নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করা এবং তার কাছে শক্তি-সামর্থ্য চাওয়া বান্দার জন্য পূর্ণতার পরিচায়ক। এর মাধ্যমে বান্দার নিজস্ব অবস্থান উন্নত হয়। দিল থেকে অহংবোধ দূর হয় এবং মর্যাদা সমুন্নত হয়।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে বিভিন্ন বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। বান্দা যাতে দোয়ার মাধ্যমে তাঁর শরণাপন্ন হয়। তাকে স্মরণে রাখে। সর্বোপরি তাঁর অসীম রহমত লাভে ধন্য হতে পারে।

আল্লাহর কাছে চাওয়ার মধ্যে কোনো লাজ-লজ্জা বা শরমের কিছু নেই। এটা হীনম্মন্যতারও বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং এটাই হলো প্রাচুর্যের চাবিকাঠি,সব এবাদতের সারকথা। বস্তুত এবাদতের উদ্দেশ্য হলো নিজের অহংবোধ মিটিয়ে রাব্বুল আলামিনের কাছে সমর্পিত হওয়া। আর এতেই রয়েছে বান্দার অজস্র সম্মান ও মর্যাদা। তাই দোয়া অনুগত্য বা দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ। আর আল্লাহ তায়ালা বান্দার এমন বিনম্র মনোভাবকে খুব পছন্দ করেন। বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাঁর নিজের প্রয়োজন ও অভাবের কথা তুলে ধরে তখন আল্লাহ তায়ালা খুব খুশি হন।

আবূ যর রাযি.-এর সূত্রে ইমাম মুসলিম রহ. কতৃক বর্ণিত এক হাদীসে কুদসীতে এসেছে, ٍ ‘হে আমার বান্দারা, তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট তবে যাকে আমি হেদায়েত করেছি সে ছাড়া। অতএব তোমরা আমার কাছে হেদায়েত তলব করো, আমি তোমাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দেব। হে আমার বান্দারা, তোমরা সবাই ক্ষুধাতর্, তবে যাকে আমি অন্ন দিয়েছি সে ছাড়া। অতএব তোমরা আমার কাছেই খাদ্য চাও, আমি তোমাদেরকে খাওয়াব। হে আমার বান্দারা, তোমরা সবাই বস্ত্রহীন তবে যাকে আমি বস্ত্র পরিয়েছি সে ছাড়া। অতএব আমার কাছেই তোমরা পরিধেয় তলব করো, আমি তোমাদেরকে পরিধান করাব’(মুসলিম)।

পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বিষয়ের আসবাব রেখেছেন। সৌভাগ্যের জন্য তিনি আসবাব রেখেছেন। দুর্ভাগ্যের জন্যও আসবাব রেখেছেন। তিনি আসবাব তৈরি করেছেন। এবং আসবাবের সাথে প্রভাব যুক্ত করে দিয়েছেন। আর দোয়া হলো সে রকম একটি আসবাব। সে উপকরণসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত উপকরণ। অকূল সমুদ্রে নিমজ্জমান ব্যক্তি যেমন আত্মরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। খড়কুটা যা কিছু পায় তাই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। সম্ভাব্য সব ধরনের উপকরণ অবলম্বন করে। তেমনি বান্দার জন্য যেকোনো বিপদের মূহূর্তে দোয়ার বর্ম আঁকড়ে ধরা আবশ্যক। এর মাধ্যমে সে দ্রুত বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। নিমজ্জমান ব্যক্তি যেমন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে না, তেমনি বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যও বিপদমুক্তির জন্য দোয়া না করে, বৈধ কোনো উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করে নিশ্চিন্তে বসে থাকা সমীচীন নয়।

দোয়া যেহেতু বান্দার প্রকৃত অবস্থান ফুটিয়ে তোলে এবং তার আত্মঅহমিকা দূর করে তাই বান্দার দোয়া আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়। কল্যাণ অর্জন ও অকল্যাণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে দোয়ার চেয়ে কার্যকর অস্ত্র আর দ্বিতীয়টি নেই। এজন্য দোয়া হলো সবধরনের কল্যাণ, মঙ্গল ও বরকতের হাতিয়ার। আল্লাহ তায়ালা কোরআনের অনেক আয়াতে বান্দাকে দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

‘হে আমার বান্দারা, তোমরা আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’। (সূরা আল গাফের : ৬০)।

দোয়ার তাৎপর্য হলো ইহ ও পারলৌকিক বিভিন্ন প্রয়োজনে আল্লাহ তায়ালার শরণাপন্ন হওয়া। দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার বিশেষ যোগসূত্র তৈরি হয়। আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য ও তার প্রতি বিশ্বাস প্রকাশ পায়। আল্লাহর প্রতি আস্থাশীলতা এবং তার মহান শক্তির উপর নির্ভরতার প্রত্যয় বান্দার অন্তরে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়। সারকথা হলো, দুআ এমন একটি এবাদত যা একদিকে বান্দার দীনতা, হীনতা, অক্ষমতা ও বিনয়ের প্রকাশ ঘটায়, অপর দিকে আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব, সর্বব্যাপী ক্ষমতা ও দয়া-মায়ার প্রতি সুগভীর বিশ্বাস গড়ে তুলে। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি দোয়া করা। আমাদের কাজ হবে প্রার্থনা করতে থাকা। দেওয়া না দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহর। তাই বাহ্যিকভাবে কিছু না পেলেও, দোয়া কখনো ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। কেননা দোয়ার মাধ্যমে আমাদের এবাদত ও ছওয়াব অর্জন হয়, যা আখেরাতের বিশেষ পাথেয় হবে।

আবূ দাউদ ও তিরমিযীতে সাহাবি নু‘মান ইবনে বাশীরের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘দোয়াই হলো এবাদত’। আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে : ‘দোয়ার চেয়ে আল্লাহ সুবহানাহুর কাছে উত্তম কোনো বস্তু নেই’(ইবনে মাযাহ, হাসান)।

আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে কুদসীতে এসেছে, ‘ বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তার সঙ্গে তেমন আচরণ করি। সে আমাকে যখন ডাকে আমি তখন তার সঙ্গেই থাকি’(মুসলিম)। উবাদা ইবনে সামেত রাযি.-এর সূত্রে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘ পৃথিবীর বুকে কোনো মুসলমান যখন আল্লাহর কাছে কোনো দোয়া করে আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে তাকে সে বস্তু দান করেন অথবা ওই বিষয়ের সমপর্যায়ের কোনো বিপদ সরিয়ে নেন। তবে শর্ত হলো গোনাহ বা আত্মীীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দোয়া না হতে হবে’। (তাহাবী, সহীহ)।

দোয়া-প্রার্থনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছেই। নবী, রাসূল, ফেরেশতা, ওলি-আওলিয়া, পীর-মুর্শিদ ও মাজার ইত্যাদির কাছে দোয়া করা চলবে না। বরং তা পরিষ্কার শিরক ও আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ। আল্লাহ তাআলা বলেন :

‘ আর নিশ্চয় মসজিদগুলো আল্লাহরই জন্য। কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না’। (সূরা আল জিন : ১৮)।

দোয়া-প্রার্থনা ও এবাদত-আরাধনার পাত্র একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তাই আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে কখনোই শরিক করা যাবে না। অন্য কারও কাছে দোয়া-প্রার্থনা করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ আর যে আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে, যে বিষয়ে তার কাছে প্রমাণ নেই; তার হিসাব কেবল তার রবের কাছে। নিশ্চয় কাফেররা সফলকাম হবে না’। (সূরা আল-মুমিনূন : ১১৭)।

যে বা যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করবে, তারা নিজদের ওপর সবচে’ বড় জুলম করবে যার পরিণতি হবে অনন্ত জাহান্নাম, মর্মন্তুদ আযাব।

দোয়ার উত্তম সময়

এক. সিজদা অবস্থায় অধিক পরিমাণে দোয়া করা উচিত। হাদীসে এসেছে : ‘সেজদারত অবস্থায় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী থাকে। তাই সেজদারত অবস্থায় বেশি বেশি দোয়া করো’ (মুসলিম)।

অন্য এক হাদীসে এসেছে : ‘ শুনে রাখো, রুকূ বা সেজদাবস্থায় তেলাওয়াত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। তাই রুকূ অবস্থায় তোমরা তোমাদের রবের স্তুতি জ্ঞাপন করো আর সেজদাবস্থায় খুব দুআ করো। কেননা সেজদা অবস্থা দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়’ (মুসলিম)।

দুই. আযান ও একামতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া কবুলের মুহূর্ত। আনাস রা. হতে বর্ণিত : ‘আযান ও একামাতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না’ (তিরমিযী)।

তিন. রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দোয়া করা। সহীহ বুখারীতে আছে : ‘ রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। এরপর বলেন, কে আছে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে আমার কাছে প্রার্থনা করবে আমি তাকে দান করব। কে আছে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব’ (বুখারী)।

চার. শুক্রবারের বিশেষ সময়ে দোয়া করা। আবু হুরায়রা রাযি. হতে বর্ণিত ‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার জুমার দিনের কথা আলোচনা করে বলেন, ‘এদিনে এমন একটি মূহূর্ত আছে যখন নামাজী বান্দা আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চায় আল্লাহ তাকে তা দেন’ (বুখারী ও মুসলিম)।

জুমার দিনে দোয়া কবুলের এ মূহূর্তটি নির্দিষ্ট করে বলতে গিয়ে ওলামায়ে কেরাম নানা মত প্রকাশ করেছেন। তবে গ্রহণযোগ্য মত হলো, তা আছরের পরের শেষ সময়। হাদীসগ্রন্থ সুনানে আবূ দাউদে এসেছে, ‘ জুমার দিনে বারোটি প্রহর তথা সময় রয়েছে। এ সময়ে কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাইলে আল্লাহ তাকে তা দেন। তোমরা জুমার দিনের শেষ প্রহর তথা আছরের শেষ সময়ে এ প্রহরটিকে অনুসন্ধান করো’ (আবূ দাউদ)।

দোয়া কবুলের আরো কিছু সময় হলো লাইলাতুল কদর, আরাফার দিন, হাজরে আসওয়াদের কাছে, বৃষ্টি বর্ষণের সময় ও নামাজের পর।

দোয়া কবুলের শর্ত

এক. পরিশুদ্ধ বিশ্বাস অর্থাৎ নির্ভেজাল ও খালেস তাওহীদ বুকে ধারণ করে দোয়া করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :

‘ অতঃপর তোমরা আল্লাহকে ডাকো দীনকে তার জন্যই একনিষ্ঠ করে, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে (সূরা গাফির : ১৪)।

হাদীসে কুদসীতে এসেছে :

‘হে বনী আদম! তুমি যদি জমিনভর্তি গুনাহ নিয়েও আমার কাছে আস এবং সাক্ষাৎ করো এমতাবস্থায় যে তুমি আমার সাথে কোনো কিছু শরিক করো না, তাহলে আমিও জমিনভর্তি মাগফিরাত নিয়ে তোমার কাছে হাজির হব’ (তিরমিযী, হাসান)।

দুই. খাবার-দাবার ও পোশাক পরিচ্ছদে হারাম বর্জন করে চলা : আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ

সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘ হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, এবং পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু তিনি কবুল করেন না। আর আল্লাহ তায়ালা রাসূলদেরকে যে বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন মুমিনদেরকেও সে বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভাল বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি সম্যক জ্ঞাত’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৫১)।

তিনি আরো বলেন : ‘হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তাঁরই এবাদত কর’ (সূরা আল-বাকারা : ১৭২)। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ সফর থেকে আসা ধূলায় আবৃত-এলোকেশী ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে আকাশের দিকে হাত প্রলম্বিত করে বলে, ইয়া রাব্বি! ইয়া রাব্বি! অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিচ্ছদ হারাম এবং হারামের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে তার ভরণপোষণ। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে? (মুসলিম)।

তিন. জাগ্রত-হৃদয় ও পোক্ত-আশা নিয়ে দোয়া করা। আবু হুরাইরা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন : ‘দোয়া অবশ্যই কবুল হবে এর দৃঢ বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহকে ডাকো। আর জেনে রাখো, আল্লাহ তায়ালা কোনো গাফেল ও উদাসীন হৃদয়ের দোয়া কবুল করেন না’ (তিরমিযী, হাসান)।

দোয়া করার আদবসমূহ

দোয়ার শর্তের পাশাপাশি এর কিছু আদবও রয়েছে। যদি আমরা শর্ত ও আদবসমূহ রক্ষা করে দোয়া করি তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করবেন। আমাদেরকে শূন্য হাতে ফেরত দেবেন না। তাহলে এবার আসুন জেনে নেই দোয়ার আদবগুলো কি:

এক. পবিত্র অবস্থায় দুআ করা; কেননা দোয়া হলো যিকির। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি, এমনকি, সালামের উত্তর দেয়ার জন্য একটি দেয়ালে হাত রেখে তায়াম্মুম করেছেন এবং বলেছেন : ‘ পবিত্রতা ছাড়া আল্লাহর যিকির করা আমার কাছে পছন্দনীয় নয়’ (ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ)।

দুই. দুহাত ওঠিয়ে প্রার্থনার দোয়া করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

‘ নিশ্চয় তোমাদের রব অতি লজ্জাশীল ও মেহেরবান। তাই তাঁর বান্দারা যখন তাঁর কাছে হাত ওঠায় তিনি তাদেরকে শূন্য হাতে ফেরত দিতে লজ্জা পান’ (আবু দাউদ)।

বিনয় ও একাগ্রতার সঙ্গে দোয়া করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ ও তার শাস্তি থেকে বাঁচার প্রবল আগ্রহ নিয়ে দোয়া করা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

‘তোমরা তোমাদের রবকে ডাক অনুনয়-বিনয় করে ও চুপিসারে’ (সূরা আল-আরাফ : ৫৫)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন : ‘তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করে এবং তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে আশা ও ভীতির সঙ্গে আর তারা থাকে আমার প্রতি বিনীত’ (আল-আম্বিয়া : ৯০)।

তিন. জোরালোভাবে তাগিদের সাথে দোয়া করা। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘তোমাদের কেউ যখন দোয়া করবে দৃঢ় তাগিদের সাথে করবে। আর কখনো এরূপ বলবে না যে হে আল্লাহ! আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে দিন। কেননা আল্লাহকে বাধ্যকারী কেউ নেই’ (বুখারী)।

চার. দোয়ায় আল্লাহর হামদ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ পেশ করা : হাদীসে এসেছে :

‘একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন এক ব্যক্তি দোয়া করছে কিন্তু সে দোয়াতে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, সে তাড়াহুড়ো করেছে। অতঃপর সে আবার প্রার্থনা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অথবা অন্যকে বললেন, যখন তোমাদের কেউ নামাজ পড়ে তখন সে যেন আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও তার গুণগান দিয়ে শুরু করে। অতঃপর রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করে। এরপর যা ইচ্ছা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে’ (আবূ দাউদ ও তিরমিযী)।

পাঁচ. আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর মহৎ গুণাবলী দ্বারা দুআ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দরতম নামসমগ্র। অতএব তোমরা তাঁকে সেসব নাম দিয়ে ডাকো’ (সূরা আল-আরাফ : ১৮০)।

ছয়. হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়ার শব্দমালা ব্যবহার করে দোয়া করার চেষ্টা করা। বিশেষ করে যেগুলোতে ইসমে আজম রয়েছে বলে বর্ণনায় এসেছে। সহীহ ইবনে হাব্বানে আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা থেকে এক বর্ণনায় এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে এই বলে দোয়া করতে শুনলেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আল্লাহ। আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আপনি অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী, যিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আর কেউ নেই তাঁর সমকক্ষ’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘লোকটি আল্লাহর কাছে ওই নামের মাধ্যমে সওয়াল করেছে যার মাধ্যমে সওয়াল করলে আল্লাহ তাআলা দেন। যার মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘তুমি আল্লাহর কাছে তাঁর ইসমে আজমের মাধ্যমে প্রার্থনা করেছ’ (আবুদাউদ, সহীহ)।

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে। আনাস রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বসা ছিলেন। এক ব্যক্তি নামাজরত ছিল, অতঃপর সে এই বলে দোয়া করল, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি- এ কথার উসীলায় যে, সকল প্রশংসা আপনার, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আপনি দানশীল, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, হে মহামহিম ও মহানুভব! হে চিরঞ্জীব ও সর্ব সত্তার ধারক, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রার্থনা শুনে বললেন, ‘তোমরা কি জান, সে কিসের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দোয়া করল’? সাহাবিগণ বললেন,‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন’। তিনি বললেন, ‘যার হাতে আমার আত্মা তাঁর কসম। সে আল্লাহর ইসমে আজম দিয়ে দোয়া করেছে। যে ব্যক্তি এ নামের মাধ্যমে দোয়া করবে তার দোয়া তিনি কবুল করবেন। যে ব্যক্তি এ নামের মাধ্যমে তার কাছে কিছু প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাকে দেবেন’(আহমদ, হাসান)।

শুধু বিপদাপদ বালা-মুসিবতের সময়ই নয়, বরং দোয়া হবে একজন মুমিনের সব সময়ের সঙ্গী। হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাযি. আনহু বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘ কঠিন অবস্থা ও সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা যেন দুআ কবুল করেন এ আগ্রহ যার থাকবে সে যেন বিপদহীন অবস্থায় বেশি বেশি দুআ করে’ (তিরমিযী, হাসান)।

দোয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ হওয়া উচিত। অথচ আমরা দোয়ার প্রতি যথার্থ গুরুত্ব দিই না। এটা সত্যিই দুঃখজনক ব্যাপার। নামাজের পূর্বে, নামাজের অভ্যন্তরে, নামাজর পরে আমরা কি দোয়া করতে অভ্যস্ত? বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বৈঠকে আমরা কি দুআ করি? দুআর মাধ্যমে কি আমাদের অনুষ্ঠানাদি শুরু এবং শেষ করি। নিভৃতে, একাকী, গভীর রাতে, ফজরের পূর্বে, রাতের শেষাংশে আমরা কি দোয়া করতে অভ্যস্ত? দোয়া কি কেবল বিপদাপদের জন্যই? না, কখনো না।

আল্লাহর কাছে মিনতি করে দোয়াকারীরা আজ কোথায়? অশ্রুবিসর্জিত নয়নে দোয়াকারীরা আজ কোথায়? যেদিন মুসলমানদের ঈমান শক্ত ছিল, দৃঢ় ছিল; যেদিন মুসলমানদের যাহের-বাতেন তাকওয়া-পরহেজগারীতে ভরপুর ছিল, সে দিন তো কবুল হওয়ার একীন নিয়ে, দৃঢ় প্রত্যাশা নিয়ে মুসলমানগণ দোয়া করতেন। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের দোয়া কবুল করতেন। সাহাবি সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস তো মুস্তাজাবুদ্দাওয়াহ (যার দোয়া কবুল করা হয়) বলেই খ্যাতি পেয়েছিলেন।

সাঈদ ইবন যায়েদ রাযি.-এর ঘটনা শুনুন। জনৈকা মহিলা মিথ্যা দাবি করে বলল যে, তিনি তার জমিনের একাংশ অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছেন। সাঈদ ইবনে যায়েদ রাযি.- যিনি বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবীর একজন- তাঁকে এ ব্যাপারে বলা হলে তিনি বললেন, ‘এটা কি করে সম্ভব! আমি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি না-হকভাবে এক বিঘত জমিনও আত্মসাৎ করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে সপ্ত জমিনের বেড়ি পরিয়ে দেবেন। এরপর তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ যদি এই মহিলা মিথ্যা বলে থাকে তবে তার চোখ অন্ধ করে দিন। তার ঘরেই তার কবর রচনা করুন। অতঃপর মহিলা অন্ধ হয়ে গেল এবং তার বাড়ির কূপে পড়ে মারা গেল।

এমন অনেকেই রয়েছে যারা বলে, দোয়া করে কি লাভ। দোয়া তো কতোই করলাম। কই, কোনোটাই তো কবুল হলো না! যারা এরূপ বলে তাদের ভেবে দেখা উচিত, তারা কি দোয়া কবুলের শর্ত পূরণ করে দোয়া করছে? না কি দোয়া কবুলের পথে নানাবিধ আবর্জনা ও প্রতিবন্ধকতা রেখেই দোয়া করে চলেছে। আসলে দোয়া কবুলের শর্ত আদবসমূহ পূর্ণ করে দোয়া করলে অবশ্যই তা কবুল হওয়ার কথা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে যথার্থরূপে দুআ করার তাওফিক দান করুন।

বিষয়: বিবিধ

৩২৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File