হারব এখন ল্যাংড়া

লিখেছেন লিখেছেন নিমু মাহবুব ০১ জুন, ২০১৫, ০৯:০৯:২৯ রাত



এই দিনদুপুরে প্রকৃতি কিঞ্চিত অন্ধকার। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের আধিপত্য।লাইটিং হচ্ছে কিনা তা দিনের আলোতে বুঝা যাচ্ছেনা। ঝুমঝুম নূপুরের শব্দে কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি হচ্ছে।হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে।আর তাতে বৃষ্টির ফোটা গুলো জানালার সাদা কাঁচে লেগে এ্যাঁকেবেঁকে মনোরম এক আলপনা তুলে নিচে গড়িয়ে পড়ছে।বাইরে সুপারি গাছেরা ছন্দে ছন্দে দোল খাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির বনামূল্যে এই অমূল্য শোভার সুধা সামান্যতমও শান্তিও এনে দিতে পারেনি হাসপাতালের বেডে শোয়া হারবের মনে।ডক্টর বলেছে পা টা কেটেই ফেলতে হবে।লেংড়া হয়ে যাবে সে। ভাবতেই তার দু’চোখ বেয়ে গরম আর নোনতা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চোখের পাতা মুদলেই অতিত কাহিনী বর্তমান হয়ে ফিরে আসে।

হারবের দাদারা ছিলেন তিন ভাই। বড় ভাই মফিজ উ্ল্লাহ, মেঝো ভাই এমদাদ উ্ল্লাহ আর ছোট ভাই মুহাম্মদ উ্ল্লাহ।তৃতীয় বারের মত মেঘনা তাদের চর কাদিরার ভিটেটাও গিলে খেয়ে ফেল্লে নতুন চর ঝাউডগীতে এসে তিন ভাই থিতু হয়ে নতুন আশার বীজ বুনে।তিন ভাইয়ের মধ্যে এমদাদ ছিল কিছুটা চালাক-চতুর।মফিজ আর মুহাম্মদ চাষ-বাস করতো।এমদাদ পড়া-লেখা করতো দূরের কারামতিয়া মাদরাসায়।খেয়ে না খেয়ে পড়ার খরচ যোগান দিত অন্য দু’ ভাই। নতুন চরের পলি সিক্ত জমির মাটি বেশ উর্বর। ফলে কয়েক বছরেই সচ্ছল হয়ে উঠে তারা। বেশ কিছু টাকা জমে তাদের হাতে। তা দিয়ে চরের চার বিঘা জমি কিনে তিন ভাই। কথা ছিল তিন ভাই সমান অংশ পাবে। ভাগ-বাটোয়ারাও হয় সে মতে।যেহেতু এমদাদ ছিল বুদ্ধিমান আর পড়ালেখা জানা লোক তাই জমির কাগজ-পত্র দেখা-শুনার দায়িত্ব তার উপরই পড়ল।সে কৌশলে দুই বিঘা নিজ নামে রেজিট্রি করে নিল।আর বাকি দু’বিঘা অন্য দুই ভাইয়ের নামে।মফিজ আর মুহাম্মদ কিছুই টের পেল না তখন।দিন রাতের পালা বদলে বছর আসে বছর যায়। এলাকাটা চর থেকে গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে তিন জনের আলাদা সংসার হল। হয়ে গেল আলাদা বাড়ি।ছেলেপুলে নাতি-নাতনি বৃদ্ধি পেল সবার।

হঠাৎ একদিন এমদাদ দু’বিঘা জমি দাবি করে বসল। প্রমাণ হিসেবে হাজির করল রেজিট্রিকৃত দলিল। অহি-নকূল সম্পর্কের যাত্রা সেখানেই।সালিশের পর সালিশ বসে। গ্রামের মাতব্বর ফেল, গ্রাম সরকার ফেল।অবশেষে মামলা চেয়্যারম্যান কোর্টের ফাইলে বন্ধি। বিবাদের কোন সুরাহা নেই।বিবাদ রূপ নেয় বিদ্বেষে।বিদ্বেষ চলতে থাকে বংশানুক্রমে।

এরই মধ্যে মফিজ উল্লাহ দুনিয়ার জীবনে ইস্তফা দেয়।তার বড় ছেলে আবু আবদুল্লাহ পড়ালেখা করে ভালো চাকুরি পেয়েছে। তার ছেলেমেয়েরাও শহুরে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।তার বউ ছোট বাচ্চাদের নিয়ে একাই বাড়িতে থাকে।চোর-ডাকাতদের উৎপাত বেড়েছে গ্রামে। তাই আবু আব্দুল্লাহর বউ একটা কুকুর পোষে বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য।

এমদাদ উল্লাহর মেঝো ছেলে আবুল খায়েরের সেঝো ছেলে হারব। গ্রামের দুষ্টু লোকদের সরদার সে।গুন্ডামিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে সে।আবু আবদুল্লাহর বউয়ের পোষা কুকুরটি বড় হলে তাকে মেরে ফেলাকে নিজের এক রকম কর্তব্য হিসেবে স্থির করেছে হারব।আবদুল্লাহর বউয়ের পোষা কুকুরটির বয়স এক কিম্বা দেঢ় বছর হলেই হারব কুকুরটিকে বিষ অথবা সুই খাইয়ে মেরে ফেলে।মাঝখানে অস্ত্র মামলায় ফেঁসে গিয়ে দেশান্তরী হয় সে। মধ্যপ্রাচ্যে বেছে নেয় প্রবাস জীবন।বছর পাঁচেক কাটিয়ে আবার ফিরে আসে দেশে।আবদুল্লাহর বউয়ের পোষা কুকুরটিও এর মধ্যে বেড়ে উঠে।হারবের চোখ কুকুরের উপর।

এই কুকুরটিকেও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে।বাজার থেকে তিনটা স্বর্ণমুখি সুঁইচ আর একটা মাঝারো মাপের লোপ কিনে আনে হারব।সুই গুলো ঢুকিয়ে দেয় লোপের বিতর। পরদিন ভোরে কৌশলে কুকুরটিকে সে লোপ খেতে দেয় সে। না, একটা সুঁইচও কুকুরটির গলায় বিধেনি।সব গুলো চলে গেছে কুকুরের পেটে। পরদিন কুকুরটি বাড়ির পাশের ধানক্ষেতের আইলে মলত্যাগ করে।তিনটে সুই-ই বের হয়ে যায় মলের সাথে।রাতে পাশের বাড়ির পুকুর থেকে মাছ চুরি করে সে পথে দিয়ে ফিরছিল হারব। অজান্তেই কুকুরের সেই মলের উপর পা পড়ল তার। দুইটা সুঁই তার পায়ের গোড়ালিতে আর একটা সুঁই বিধলো পায়ের পাতায়।উহ!উহ!! করে পা মচকিয়ে পড়ে গেল হারব। একটা সুঁই পায়ের গোড়ালির ভেতর ঢুকে ভেঙ্গে গেল।তীব্র ব্যাথা পায়ে নিয়ে কোন রকমে বাড়ি ফিরল হারব।ব্যাথা ক্রমে অসহ্য যন্ত্রণায় রূপ নিচ্ছে।পায়ের পাতা ফুলে মাগুর মাছের মত হয়ে গেল। পরদিন গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার শরিয়াকে ডেকে আনা হয়। শরিয়া ডাক্তার হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে অভিজ্ঞতাবলে দুইটা সুঁই বের করে আনে। কিন্তু একটা সুঁইয়ের ভাঙ্গা অংশ ভেতরে ভেঙ্গে থেকেই যায়। বের করতে পারেনা ডাক্তার।ডাক্তার অভয় দেয় ক্ষতস্থান পেকে পুঁজের সাথে বের হয়ে যাবে ভাঙ্গা অংশটি।কিছু ঔষধ-বড়ি দিয়ে বিদায় হয় শরিয়া ডাক্তার।

সময় বৃদ্ধ যাযাবর পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ যায় দুই সপ্তাহ যায়।সপ্তাহরা মাসে রূপ নেয়। ক্ষতস্থানে পুঁজ হয় পুঁজ বের হয়ে যায়।আবার পুঁজ হয়। কিন্তু সুঁইয়ের ভাঙ্গা অংশ আর বের হয়না। ইতিমধ্যে শরিয়া আরো কয়েকবার এসে তদবির করে গেছে।উন্নতির কোন আভাস নেই।মনে হচ্ছে ক্ষতস্থানটা আরো জায়গা দখল করছে।ক্রমে বড় হচ্ছে ক্ষতস্থান।সারাদিন বিছানায় পড়ে কাতরায় হারব।

শরিয়া ড়াক্তার এখন আর আসেনা। সে বুঝতে পারছে এই পচন সারিয়ে তোলা তার কম্ম নয়।তাই ইস্তফা দিয়েছে সে।

দিন আসে দিন যায়। দিন শেষে রাত হয়। রাতের অন্ধকার মাড়িয়ে ফিরে আসে নতুন ভোর।নতুন ডাক্তার আসে। নতুন ঔষধ সেবন করে হারব। ব্যর্থকাম হয়ে ডাক্তার আসা বন্ধ করে ।এবার আসে কবিরাজ। লতা-পাতার পথ্য দেয় সে।বাইত্তা বনের লতা বেঁধে দেয় ক্ষতস্থানে।কিন্ত হারবের ক্ষতস্থানের পচন কারো কথাই শুনেনা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে ক্ষতস্থান।আস্তে আস্তে পায়ের পাতা সহ পুরো গোড়ালিতে পচন ধরে গেছে। অবশেষে রেজাউল মাস্টারের পরামর্শে হারবকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হতাশ না হতে পরামর্শ দিলেন ডাক্তার কিন্তু কোন আশার বাণীও তিনি শোনাতে পারলেন না। ডাক্তার বললেন পায়ের পচে যাওয়া অংশ এখনই না কেটে ফেললে পচন পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পরিবারের অনুমতি নিয়ে একদিন হারবের পায়ের পচা অংশ রানের নিচ থেকে কেটে ফেললেন ডক্টর। লেংড়া হয়ে গেল হারব।

রাতে ঘুমালেই হারব স্বপ্ন দেখে কুকুরেরা তাকে ভেংচি কাটছে আর হাসছে।কখনো কখনো সপেদ দাঁত দেখিয়ে কেমন যেন ভয় দেখাচ্ছে।আর তাতে আতঙ্কে হারবের ঘুম টুটে যা......।

Click this link

বিষয়: বিবিধ

১৩৯১ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

323939
০১ জুন ২০১৫ রাত ০৯:৩৮
এ,এস,ওসমান লিখেছেন : আলহামদুল্লিলাহ। ভাল লাগলো।
যেমন কর্ম তেমন ফল।
০১ জুন ২০১৫ রাত ০৯:৫০
265446
নিমু মাহবুব লিখেছেন : মন্তব্যের জন্য মুবারাকবাদ। Hope to see you at another post. Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose Rose Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose Rose Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Rose Rose Rose @};
০১ জুন ২০১৫ রাত ১০:০৪
265462
এ,এস,ওসমান লিখেছেন : ইংশাল্লাহ।
323948
০১ জুন ২০১৫ রাত ০৯:৫৭
আফরা লিখেছেন : বিষ খাইলে ক্রিয়া তো হবেই । কেমন আছেন ভাইয়া ?অনেক দিন পরে আসলেন ।

ধন্যবাদ ভাইয়া ।
০১ জুন ২০১৫ রাত ১০:২৭
265492
নিমু মাহবুব লিখেছেন : আলহামদুল্লিাহ।
ব্লগটা এখন আগের মত জমেনা তো!!!
ধন্যবাদ Good Luck Good Luck Good Luck
323995
০২ জুন ২০১৫ রাত ০১:০১
অবাক মুসাফীর লিখেছেন : ব্লগটা আবার জমবে ইনশা আল্লাহ! আর সেটা আমাদের ছাড়া, আই মিন, আপনারা সিনিয়ার ব্লগারদের ছাড়া সম্ভব না... এট্টু খাড়ান, মন্তব্‌য করতেছি...!
324013
০২ জুন ২০১৫ রাত ০৩:২৫
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : প্রিয়তে রাখলাম। ধন্যবাদ।
০২ জুন ২০১৫ সকাল ০৮:৪৮
265641
অবাক মুসাফীর লিখেছেন : ~:> ভয় পাইছি...
324028
০২ জুন ২০১৫ সকাল ০৮:৪৮
অবাক মুসাফীর লিখেছেন : বিশাল ইতিহাস, প্রতিশোধ, ক্লাইম্‌যাক্স, ট্রাজেডী, টুইস্ট সবই আছে... কিন্তু প্রেম নাই... প্রেম আনা দরকার...

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File