আমি হেমন্তের বাংলা দেখিয়াছি
লিখেছেন লিখেছেন নিমু মাহবুব ২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:৩২:১৩ সকাল
সদ্য বিবাহিত বর ভোর-বিহানে শশুর মশাইকে দেখে যেমন শরমে কুটিকুটি হয়ে যায় তেমনি রাঙ্গা হাসি হেসে প্রভাতে ধরণীর বুকে উঁকি দেয় লাল সূর্য্য। মাঝ বয়সী ধানের পাতায় কুমারী মেয়ের মত শিশির কণার নাচন। তাতে ছন্দ দোলা দেয় ভাবুক কবি মনে। গাঁয়ের বধুর কোমল পা মাড়িয়ে যায় শবনম সিক্ত দুর্বাঘাস। তাতে ভিজা ঘাসে এঁকে যায় পায়ের মানচিত্র। খোয়াড় থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁস গুলো চৈচৈ করে ছুটে যায় পুকুরে। বিস্তীর্ণ আমন ধানের ক্ষেত তো নয় যেন প্রকৃতির আপন মায়ায় ছড়ানো এক সবুজ গালিচা। তারই মাঝে মাঝে সরু কিংবা আঁকাবাঁকা আইল। আইল ধরে কোন এক দুরন্ত বালিকা পানি আনতে যায় পাশের বাড়ির নলকূপ থেকে। খরগোশের মত চতুর ঘাসফড়িং গুলো ভয়ে লুকায় ধান গাছের আড়ালে।
বিবর্ণ দুপুরে রাস্তার পাশে গাছের সাথে বাঁধা কয়েকটি গরু। নিশ্চিন্তে শুয়ে, আলস্যে জাবর কাটছে অবোধ পশুরা। তাদের পিঠের উপর নির্ভয়ে বিচরণ করছে ধানশালিকের দল। খুটে খাচ্ছে আটালি গরুর গা থেকে। আর কিচিরমিচিরে মাতিয়ে তুলছে পরিবেশ। বিরস দুপুরটা তাতে বারবার চমকিত হচ্ছে। তাদের মত আনন্দে, সুখে বুঝি আর কেউ নেই।
পড়ন্ত বিকেল। চারদিকে সুনসান নিরবতা। নবযৌবনা আমন ধানের ক্ষেতে হঠাৎ ঢেউ খেলে যায় একছিলকে মৃদুমন্দ বাতাস। ধান ক্ষেতের সবুজ গালিচার উপর এ যেন সাগরের বুকে উর্মিমালার প্রতিচ্ছবি। পুষ্করণীর স্থির পানিতে ফুটেছে কলমি ফুল। এলোমেলো হাওয়ার স্পর্শে মাঝে মাঝে ছন্দে দোলে সে মায়াবী কুসুম। তাতে তার উপর বসে থাকা হলদে রঙের ফড়িংটা কিছুদূর উড়ে গিয়ে আবার এসে বসে। মধ্যার্ণভোজের পরে কর্মচঞ্চল গ্রাম্যবধুরা মিলিত হয় কোন এক বাড়ির প্রশস্ত উঠোনে।সাংসারিক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না আর রসিকতার ছলাকলায় মুখর হয়ে উঠে পড়ন্ত বিকেল। তাদের সাথে যেন একাত্বতা ঘোষণা করে টিনের চালের নিচের পায়রা গুলো। ডেকে উঠে বাকবাকুম-বাকবাকুম। কেউবা আবার নকশিকাঁথায় ফুল তোলে শৈল্পিক সৌন্দর্য্যে।
কর্মহীন যুবকেরা মেতে উঠে হাডুডু বা অন্য কোন গ্রামীন খেলায়।মুরুব্বিরা বাজারের এক কোণে বসে জমায় গাজীকালু বা চম্পাবতির পুঁথির আসর। একজন সুর করে পড়ে। বাকিরা শুনে আর মাঝে মাঝে সুর মিলায়। যেন অনেক বাঁশির একই সুর। কখনো হাসান-হোসেনের দুঃখে ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস। দুঃখটা যেন ঠিক তাদেরই।
পড়ন্ত বিকেলের রূপালী সূর্য্যের রঙ ক্রমেই স্বর্ণালী আভায় রূপ নেয়। তারপর হয়ে যায় ড্রাগনের চোখের মত লাল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। কর্মব্যস্ত পাখিরা ফিরে আসে নীড়ে।বাঁশঝাড় কিংবা ঘন পল্লব শোভিত কোন গাছে বসে জমায় কলকাকলির হাট। পাখিদের কলরব তো নয় যেন প্রকৃতির পায়ে বাজে নূপুরের নিক্কণ। রাখাল বালকেরা গরু নিয়ে ফিরে আসে গোয়ালে। অদূরে বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে উড়ে যায় একপালি সাদা সারস। সন্ধ্যা পেরিয়ে নেমে আসে রাত।সাথে নিয়ে আসে নির্জনতা। আকাশের বুকে ফোকলা হাসি দিয়ে হাজির হয় রাতের পাহারাদার- চাঁদমামা। চাঁদের জোছনায় তৈলাক্ত হয়ে চিকচিক করে নারিকেল পাতা। কখনো চাঁদের পরিবর্তে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার অমাবশ্যা। চারদিকে অন্ধকারের সমুদ্র। অন্ধকারে ঝোপঝাড়ে মিটমিট করে জ্বলে জোনাক পোকারা।আর কালো আকাশে তারার মেলা।আল্লাহ তায়া’লা বুঝি আপন মনে আকাশকে সাজিয়েছেন আলোকসজ্জায়। কবি হলে হয়তো বলতাম, ‘গগণে তারা, ভুবনে জোনাক পোকা’। রাতের নিরবতা ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে।প্রকৃতি যেন ঝিঁঝিঁপোকার ছদ্মবেশে মাতম করছে হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীর শোকে।
সময় বৃদ্ধ যাযাবর পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। রাতের শেষে ভোর হয়। খোপের মোরগ ডেকে উঠে কুক্কুরু কু কুক্কুরু কু। ঘোষণা করে নতুন প্রভাতের আগমনী বার্তা। শুরু হয় নতুন দিন নতুন স্বপ্ন।এমনি করে ফিরে ফিরে আসে বাংলার হেমন্তকাল।প্রকৃতির দান যেখানে সীমাহীন। বাংলা আমার, আমার হেমন্ত খোদার সেরা দান।
click this link
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন