রাষ্ট্রীয় গণহত্যা নিয়ে দেশীয় মিডিয়ার ভয়ঙ্কর লুকোচুরি
লিখেছেন লিখেছেন অনিরুদ্ধ অমায়িক ০২ মার্চ, ২০১৩, ০৪:৫৩:৫৯ বিকাল
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রের নির্দেশে নিকৃষ্টতম গণহত্যার ঘটনা ঘটে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গেলে দিনব্যাপী দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে প্রায় ৬২ জামায়াত-শিবির কর্মীসহ সাধারণ
মানুষকে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জামায়াত কর্মীদের হাতেও নিহত হয়েছেন পুলিশসহ কয়েকজন। সঙ্গত কারণেই এই ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার খবর নিয়ে বিশ্বের তাবত্ গণমাধ্যমে তোলপাড় হলেও অসম্ভব রকমের ব্যতিক্রম ছিল এদেশের কথিত প্রগতিশীল গণমাধ্যমগুলোর আচরণ। পুলিশি গণহত্যা নিয়ে দেশের টিভি মিডিয়া, পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ পরিবেশনে দৃষ্টিকটু পক্ষপাত দেখে মর্মাহত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকে আমার দেশ অফিসে ফোন করে জানান, তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
পাঠকদের এমন মনোভাবের প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার সারা দিন প্রচারিত বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদপত্র এবং গতকাল প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর ‘সংবাদ উপস্থাপনা’র (নিউজ ট্রিটমেন্ট) ধরন ও প্রতিবেদনে ভাষার প্রয়োগ বিশেল্গষণে উঠে এসেছে ভয়াবহ এক চিত্র। কোনো এক রহস্যজনক কারণে ইতিহাসের নৃশংসতম রাষ্ট্রীয় এই গণহত্যার খবরকে গুরুত্বহীন করে উপস্থাপনের নগ্ন চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি গণমাধ্যম ছাড়া বাকি সবগুলোতেই। এছাড়া পুলিশের গণহত্যাকে বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডব বলে সব গণমাধ্যমই সরকারকে বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।
সংবাদ পরিবেশনে তথ্য লুকোচুরির প্রবণতা এত মারাত্মক ছিল যে, কোনো সচেতন মানুষের মনে এ প্রশ্ন উত্থাপিত স্বাভাবিক—‘এর মাধ্যমে কি এই গণহত্যাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে?’
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোনো কোনো গণমাধ্যমে দিনের ১৪-১৫তম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে এই গণহত্যার খবর! অন্যদিকে প্রায় সব মাধ্যমই পুলিশি গণহত্যার এ দায় চাপিয়ে দিয়েছে হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর।
গতকালের প্রায় সব পত্রিকা এই নৃশংসতাকে ‘জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব’ বলে উল্লেখ করেছে। পুলিশের গুলিতে কোনো বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন, এমন বক্তব্য কোনো পত্রিকায়ই দেখা যায়নি। সবাই লিখেছে, পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের সময় ‘অতজন’ নিহত হয়েছে।
আবার নিহতের সংখ্যা কম দেখানোর এক প্রাণান্তকর চেষ্টা লক্ষ করা গেছে পত্রিকাগুলোয়। রাত ১০টার মধ্যেই অনলাইন পত্রিকা নতুনবার্তাডটকম ৬২ জন নিহতের খবর দিলেও পরের দিনের অধিকাংশ পত্রিকা এ সংখ্যা ৪০-এর নিচে রেখেছে, এমনকি কেউ কেউ ৩৩ জনও বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে। অথচ আমেরিকার বিখ্যাত ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা এ সংখ্যা ৪৪ বলে উল্লেখ করেছে। দেশীয় পত্রিকার মধ্যে শুধু আমার দেশ দিয়েছে ৫৬ জনের মৃত্যুর খবর।
তবে মোট নিহতের সংখ্যা নিয়ে এসব পত্রিকা লুকোচুরি করলেও লক্ষণীয় বিষয় হলো, জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের বাইরে যারা নিহত হয়েছেন (৫ জন পুলিশ ও দুই আওয়ামী লীগ কর্মী) তাদের সংখ্যা উল্লেখে গরমিল নেই! অর্থাত্ লুকোচুরিটা শুধু হয়েছে জামায়াত-শিবিরের নিহতদের ক্ষেত্রে।
আরেকটা ব্যাপার, জামায়াতের হাতে আ.লীগ কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনা প্রতিটি পত্রিকা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। কেউ কেউ জামায়াতের সহিংসতা ফুটিয়ে তোলার জন্য নাটোরে আওয়ামী লীগ কর্মীকে পিটিয়ে মারার ওপর আলাদা সংবাদ পরিবেশন করেছে। পাঁচ পুলিশ সদস্য মারার জন্যও সরাসরি জামায়াতকে দোষী করা হয়েছে। দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর এ সংক্রান্ত সংবাদটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্যারা দুটি হুবহু তুলে দেয়া হলো। পাঠক সতর্কভাবে ‘বোল্ড করা’ লাইনগুলো পড়ুন—“গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে তিন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত-শিবির। সেখানে সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের দুই কর্মীও নিহত হন। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় নিহত হয়েছেন জামায়াত-শিবিরের চার কর্মীসহ পাঁচজন। ঠাকুরগাঁওয়ে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ছাত্রদল, যুবদল ও ছাত্রশিবিরের তিন কর্মীসহ চারজন নিহত হয়েছেন। সাতক্ষীরায় সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন জামায়াত-শিবিরের চার নেতা-কর্মী এবং জামায়াত-শিবিরের হামলায় মারা গেছেন ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় নিহত হয়েছে এক কলেজছাত্র ও এক কিশোর। দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে নিহত হয়েছেন একজন। নাটোরের লালপুরে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে শিবির। কক্সবাজার সদর ও পেকুয়া উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হয়েছেন এক মাদরাসাছাত্রসহ দুজন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় সংঘর্ষে পুলিশের এক কনস্টেবল ও শিবিরের এক কর্মী নিহত হয়েছেন। বাঁশখালীতে দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ হয়ে দুজন মারা গেছেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় নিহত হয়েছেন এক নির্মাণশ্রমিক। নোয়াখালীতে গুলিতে নিহত হয়েছেন দুজন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে গুলিতে নিহত হয়েছেন শিবিরের এক কর্মী। এ ছাড়া সেখানে ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে এক প্রকৌশলীকে হত্যা করে জামায়াত-শিবির। বগুড়ায় নিহত একজন।”
লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, উদ্ধৃতির প্রতিটা জায়গায় জামায়াত-শিবিরের হাতে নিহত কয়েকেজনের ক্ষেত্রে ‘হত্যা করেছে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ‘পিটিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত-শিবির’, ‘এক প্রকৌশলীকে হত্যা করে জামায়াত-শিবির’ ইত্যাদি। অথচ জামায়াত-শিবির-যুবদল-ছাত্রদলের কর্মীদের হত্যার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ‘পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে’ নিহত হয়েছেন। কোথাও বলা হয়েছে, ‘গুলিতে নিহত হয়েছেন’। কিন্তু গুলিটা কে করেছে, পুলিশ নাকি জামায়াত-শিবির-যুবদল, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে নগ্নভাবে।
এ সংবাদটিকে গতকালের প্রায় সবক’টি পত্রিকার গণহত্যা সংক্রান্ত সংবাদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচনা করলেই সঠিক চিত্রটা অনুমান করা যাবে।
তবে পাঠকের স্পষ্ট ধারণার জন্য আমরা নিচে আরও কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের বৃহস্পতিবারের গণহত্যা সংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম ও উপস্থাপনার ধরন তুলে ধরব।
প্রথম আলো : বৃহস্পতিবার প্রথম আলো অনলাইনে প্রাসঙ্গিকভাবেই ট্রাইব্যুনাল ও সাঈদীসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ থেকে খুঁটিনাটি সংবাদের ছিল ছড়াছড়ি। তবে এসব সংবাদ এত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলেও রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে গণহত্যার শিকার হওয়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সংবাদ পরিবেশনে তাদের অনীহা মারাত্মকভাবে চোখে পড়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পরও তারা সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা লিখেছে ৩৫। সংবাদটির শিরোনাম ছিল, ‘গাইবান্ধায় তিন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা : দেশব্যাপী জামায়াতের ব্যাপক সহিংসতা, নিহত ৩৫ঠ।’ পরের দিনের (গতকাল) পত্রিকায় একই সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব : সাঈদীর ফাঁসি, সহিংসতায় নিহত ৩৭’। সংবাদের ভেতরের খবর কেমন তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনলাইন ও হার্ডকপি, দুই সংস্করণে নিহতদের সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার (৬২) চেয়ে কম দেখিয়েছে প্রথম আলো।
তবে দেশের ভেতরে গণহত্যার শিকার হওয়া জামায়াতের লোকজনের খোঁজ-খবর পত্রিকাটি ঠিকমত না রাখলেও বিশ্বের আনাচে-কানাচে কোথায় সাঈদীর রায়ের পর উল্লাস হয়েছে, সেসব সংবাদ অত্যন্ত যত্নসহ সংগ্রহ করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। এরকম কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম হলো—‘সাঈদীর শাস্তিতে নিউইয়র্কে বাঙালিদের উল্লাস’, ‘সাঈদীর সাজায় উল্লসিত ইউরোপের প্রবাসীরা’, ‘আনন্দে উদ্বেল শাহবাগ, কাল সমাবেশ’, ‘সাঈদীর রায়ে পিরোজপুরে আনন্দ মিছিল।’
ইত্তেফাক : পত্রিকাটির শিরোনাম ছিল—‘১৪ জেলায় ব্যাপক সহিংসতা, চার পুলিশসহ নিহত ৩৯’। নাটোরে আ.লীগের এক কর্মী জামায়াতের হাতে নিহতের সংবাদটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলাদা এক কলাম সংবাদ ছেপেছে। তবে পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী হত্যার ঘটনাগুলোকে ‘সংঘর্ষে নিহত’ বলে চালিয়ে দিয়েছে।
ডেইলি স্টার : তারা শিরোনাম দিয়েছে—‘সন্ত্রাসের বিস্ফোরণ : জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে দাঙ্গায় কমপক্ষে ১৫ জেলায় ৩৩ জন নিহত’। শিরোনামের মতো সংবাদের ভেতরেও সেদিনের সহিংসতাকে ‘জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস’ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, পত্রিকাটি শিরোনামে ‘রায়ট’ বা ‘দাঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। সাধারণত আন্তঃগোষ্ঠী বা আন্তঃজাতি সহিংসতাকে ‘দাঙ্গা’ বলা হয়।
সমকাল : তাদের শিরোনাম ছিল—‘সহিংস জামায়াত, নিহত ৩৯’। এটি পড়ে যে কেউ ধারণা করবে সহিংসতায় নিহত সবাই বোধহয় জামায়াতের হাতে মারা গেছে। যদিও রিপোর্টের ভেতরে পাঁচজন পুলিশ ও দুজন আ.লীগ কর্মীকে হত্যার জন্য জামায়াতকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। বাকিদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে তারা ‘সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন’।
যুগান্তর : ‘সারাদেশে সহিংসতায় নিহত ৪২’ শিরোনামের সংবাদে একমাত্র যুগান্তরই ব্যতিক্রমীভাবে বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-পুলিশের সংঘর্ষের সময় ‘গুলিবিনিময়’ (দু’পক্ষের গোলাগুলি) এবং অন্যদের মতো ‘জামায়াতের তাণ্ডব’ হয়েছে বলে জানিয়েছে। তবে তারা পুলিশের বন্দুক তাক করা ছবি ছাপালেও বিক্ষোভকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রের এমন কোনো ছবি ছাপেনি। গতকালের অন্যান্য জাতীয় পত্রিকায়ও সহিংসতার কয়েকশ’ ছবি ছাপা হয়েছে। তবে কোথাও বিক্ষোভকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, এমনকি একটি ধারালো (দেশি অস্ত্র) অস্ত্রও দেখা যায়নি। টিভি চ্যানেলগুলোতে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির দৃশ্য দেখালেও এমন কোনো ফুটেজ প্রচার হতে দেখা যায়নি।
কালের কণ্ঠ : পত্রিকাটি সহিংসতা নিয়ে দুটি রিপোর্ট করেছে। শিরোনামগুলো হলো—‘সাঈদীর ফাঁসির রায়, সারাদেশে ৩৯ লাশ’ ও ‘জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক সহিংসতা, পুলিশের গুলি’।
জনকণ্ঠ : তাদের শিরোনাম হলো—‘দেশজুড়ে জামায়াতী তাণ্ডব : বলি ৩৮’। জামায়াতকে লক্ষ্য করে তাদের সংবাদের ভাষা—‘ওদের সশস্ত্র হামলা থেকে রেহাই পায়নি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওদের সঙ্গে সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থানে ঝরে গেল ৩৮ তাজা প্রাণ’। সংবাদটি পড়ে মনে হবে যারা মারা গেছে, তাদের সবাইকে জামায়াত হত্যা করেছে।
এছাড়াও বাংলাদেশ প্রতিদিন, মানবজমিন, সকালের খবর, আমাদের সময়, ইনকিলাব, যায়যায়দিনসহ প্রায় সব জাতীয় পত্রিকার সংবাদের ভাষ্য ছিল প্রায় একইরকম। ব্যতিক্রম ছিল শুধু আমার দেশ, নয়া দিগন্ত ও সংগ্রাম পত্রিকা।
অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো রাষ্ট্রীয় এ গণহত্যাকে ধামাচাপা দিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে ছিল। এক প্রভাবশালী সরকারি নেতার মালিকানাধীন অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ২৪ডটকম হত্যাকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৩৫ জন। তাদের এ সংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম হলো—‘দেশজুড়ে জামায়াতি তাণ্ডব, বহু হতাহত’। সংবাদের ভেতরেও একচেটিয়াভাবে সংঘর্ষের জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করার মতো আরেকটি ব্যাপার হলো, নিহত পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংখ্যা অন্যান্য পত্রিকার মতো বিডিনিউজও ঠিকমত উল্লেখ করেছে। বাদ পড়েছে শুধু জামায়াত-শিবিরের নিহতদের অর্ধেক! প্রকৃত সংখ্যা প্রায় ৬২ জন (নতুনবার্তাডটকম সূত্রে)।
এছাড়াও অন্য একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। সেটি হলো, বিকাল থেকেই অন্যান্য গণমাধ্যম সারাদেশে নিহতের মোট সংখ্যা জানাচ্ছিল। কিন্তু বিডিনিউজ রাত অনেক হওয়ার পর মোট সংখ্যা উল্লেখ করে সংবাদ পরিবেশন করেছে, তাও শিরোনামে নয়। তার আগে এলাকাভিত্তিক নিহতদের খবর বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ করে। হয়তোবা তারা এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড যে ঘটছে, সেটি পাঠককে জানাতে দ্বিধা করছিল!
বাংলানিউজ২৪ডটকম-এর খবর পরিবেশনের ধরনে বিডিনিউজ-এর চেয়ে তেমন ভিন্ন কিছু ছিল না। নিহতের সংখ্যাটা শুধু একটু বেশি ছিল। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে তাদের এ সংক্রান্ত প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল—‘দেশজুড়ে শিবিরের তাণ্ডব, ৩ পুলিশসহ নিহত ৪৪’।
এবার টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদের দিকে তাকানো যাক। বৃহস্পতিবারের গণহত্যার সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোর মতোই দেশের টিভি চ্যানেলগুলোও মারাত্মক পক্ষপাতমূলক অবস্থান নেয়। নির্বিচারে পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবির, যুবদল-ছাত্রদল নেতাকর্মীদের হত্যা করার এ যজ্ঞকে তারা ‘জামায়াতি তাণ্ডব’, ‘জামায়াতি সহিংসতা’ বলে দিন-রাত প্রচার করেছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, নিহতের সংখ্যা কম দেখিয়ে এবং পুলিশ-বিজিবির নৃশংস অ্যাকশনের দৃশ্য সেন্সর করে ঘটনাটিকে গুরুত্বহীন করার প্রচেষ্টা। সন্ধ্যার পরপরই কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় নিহতের সংখ্যা ৩০-৩৫ বলে সংবাদ প্রকাশ করলেও কোনো কোনো টিভি চ্যানেল এ সময় ১০ থেকে ১৫ জনের নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে গেছে। রাত ১০টার দিকে আমার দেশসহ একাধিক অনলাইনে নিহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক বলে তার বিবরণ দিলেও সারারাত বেশিরভাগ টিভিতে এ সংখ্যা ৩০-এর ওপরে ওঠেনি। এ ঘটনাকে হালকা করে উপস্থাপনের আরেকটি কৌশল ছিল, সহিংসতার খবরকে তালিকার একেবারে শেষের দিকে স্থান দেয়া।
প্রথমে সরকারের এক মন্ত্রীর মালিকানাধীন সংবাদভিত্তিক বেসরকারি চ্যানেল ‘সময় টিভি’র সন্ধ্যা ৬টায় প্রচারিত বুলেটিনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ২৪ মিনিটের এ বুলেটিনে সহিংসতার খবরটি প্রচারিত হয় ১০ নম্বর সংবাদ হিসেবে! অথচ বিভিন্ন জায়গায় ততক্ষণে ৩০-এর অধিক বিক্ষোভকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অবশ্য সময় টিভি তাদের সংবাদে ১৬ জন নিহতের তথ্য জানায়। এ সংবাদটির আগে স্থান পাওয়া কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম—‘রায়ের পর পিরোজপুরে আনন্দ উল্লাস’, ‘আইনমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সন্তোষ’, ‘স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সন্তোষ’, ‘শোলাকিয়ার ইমামের সন্তোষ’, ‘বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সন্তোষ’ ইত্যাদি। অর্থাত্ চ্যানেলটির কাছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত ১৬ জন (বাস্তবে আরও বেশি) মানুষের জীবনের চেয়ে একজনের ফাঁসির সংবাদে কোথাকার অন্য একজনের বিকৃত উলল্গাসের সংবাদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল!
আরটিভির সন্ধ্যা পৌনে ৭টার খবরে বিজ্ঞাপন বিরতির পর ১৪ নম্বর সংবাদ হিসেবে দেশব্যাপী সহিংসতায় ২৯ জন নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়। এর আগের সংবাদগুলোর মধ্যে রায়ের পর গুটিকয়েক লোকের বিকৃত উল্লাসের একাধিক খবরসহ একটি বেসরকারি কোম্পানির আইপিও লটারি অনুষ্ঠানের খবরও রয়েছে।
এনটিভির সন্ধ্যার খবরের ৭ম আইটেম ছিল সহিংসতার সংবাদ। এতে ২৭ জন নিহতের তথ্য জানানো হয়। সংবাদের ভাষাও অন্যদের মতোই।
এভাবে এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, চ্যানেল আই, দেশটিভি, বাংলাভিশন, একাত্তর টিভি, ইটিভিসহ প্রায় সব টিভি চ্যানেল একইরকম গুরুত্বহীনভাবে এ গণহত্যার খবর প্রচার করে।
তবে এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি। সন্ধ্যা ৬টার সংবাদে তারা গণহত্যার খবরকে দ্বিতীয় সংবাদের গুরুত্ব দেয়। রাত ১০টার সংবাদে তারা সহিংসতার খবরকে প্রধান আইটেম করে। এতে ব্যাপক পরিমাণে পুলিশের গুলি করার কথা বলা হয়। ৩৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় এই চ্যানেলটি।
শিশির আবদুল্লাহ, আমার দেশ
কপি পেস্ট
লিঙ্ক : Click this link
বিষয়: বিবিধ
১২৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন