ডঃ পিয়াস করিমঃ শহীদ মিনার থেকে জাতীয় মসজিদে
লিখেছেন লিখেছেন তারকা ১৮ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:৩২:১৯ রাত
ডঃ পিয়াস করিম। এ নামটি খুব বেশি দিন আগে থেকে জানতাম না। আমার মনে হয় বাংলাদেশের অনেকেই জানতেন না। কয়েক বছর ধরে টকশো-র কল্যানে তাঁর নাম বাংলাদেশের মানুষ জেনেছে। জীবিত হিসাবে তিনি একটি বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন। সে বিশ্বাস যে কত দৃঢ় এবং পোক্ত তা বিশ্বাসীরা আঁচ করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে খুব ভাল মত বুঝা সম্ভব না হলেও তাঁর বিশ্বাসের জায়গাটিকে খুব শক্তিশালী বলে আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেছি। আমার মনে হয়েছে তিনি আসলে সমাজ বিজ্ঞানের যে থিওরী ছাত্রদেরকে পড়িয়েছেন, সেটা হৃদয় থেকেই পড়িয়েছেন। আর সে থিওরীর সাথে সাংঘর্ষিক কার্যক্রম লক্ষ্য করে তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে অকপটে থিওরী প্রকাশ করেছেন টেলিভিশনের পর্দায়। যদিও আপাত দৃষ্টিতে সেগুলোকে তাঁর আদর্শিক অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে কমবুদ্ধির লোকগুলো মনে করে নিতে পারেন। তাই তিনি কথা বলতে গিয়ে যখনই বুঝতেন যে, তাঁর এই থিওরী ব্যাখ্যার কারনে মোটা বুদ্ধির লোকগুলো তাঁর অবস্থান নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করবে, তখনই তিনি বলতেন, আমি অমুক আদর্শের ধারক বা পক্ষের লোক না হয়েও শুধুমাত্র সমাজবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসাবে এ কথাগুলো বলছি। বুঝতাম, তাঁর শিক্ষার ব্যাপারে কত অগাধ বিশ্বাস।
তাঁর টকশো থেকেই জেনেছি, তিনি বাম রাজনিতির সাথে যুক্ত ছিলেন। একজন বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবি হিসাবে এটা সহজেই ঠাওর করা যায় যে, মৃত্যুর পর তাঁর লাশ শহীদ মিনারে কিছু সময়ের জন্য রাখা হবে। কারন এমনটাই করা হয়ে আসছে নিয়মিত। এটাও মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাম ঘরানার একজন বুদ্ধিজীবির লাশের জানাযা জাতীয় মসজিদে হওয়ার কথা কেউ চিন্তায়ও আনেনা। কিন্তু ইতোমধ্যেই তাঁর কথা ও বিশ্বাস তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসা বৃদ্ধি করেছে। পরিবার পরিজন, সহকর্মী সহযোদ্ধাদের মধ্যেও এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, উনার লাশ শুধু শহীদ মিনারের উপযোগী নয়, বরং জাতীয় মসজিদে তাঁর জানাযা হওয়ার দাবী রাখে। কারন ধর্মপ্রান মুসলমানরা তাঁর সত্যবাদীতা, সাহসিকতা, কর্মের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে প্রকাশের কারনে তাঁর জানাযায় আসতে নিঃসন্দেহে দাবী পেশ করবেন, যাদের বেশিরভাগ মানুষ তাঁর লাশ দেখতে শহীদ মিনারে যাওয়ার মত আকর্ষন অনুভব করবেন না। সে জায়গা থেকেই পরিবার এবং সহযোগী বুদ্ধিজীবিদের পক্ষ থেকে তাঁর লাশ শহীদ মিনারে রাখা এবং ফাইনালি বায়তুল মোকাররমে জানাযা করার পর দাফন করার সিদ্ধান্ত নেয়। বায়তুল মোকাররমে জানাযা হবে এটা জেনে আমি মনে মনে আল্লাহর মহিমার কথা স্মরন করেছি। আল্লাহ একটা মানুষকে এভাবেই আলোর দিকে নিয়ে আসতে পারেন। কারন, আমার বিশ্বাস, গত দুইটি বছরে ডঃ পিয়াস করীম যেসব কথা বলেছেন, তা না বললে হয়ত, একজন বাম ঘরানার মানুষ হিসাবে তাঁর জানাজা বায়তুল মোকাররমে করার ব্যাপারে চিন্তাও করা যেত কিনা কিনা সন্দেহ হয়। আর করা হলেও মানুষ সে জানাযায় কতটুকু উপস্থিত হত সেটাও সন্দেহের বিষয়।
নির্দিষ্ট কিছু কারনে মরহুমের দাফন করতে কয়েকদিন সময় নেয়া দরকার হল। তাকে জুময়াবার তথা শুক্রবার দাফনের জন্য সিদ্ধান্ত হল। ইতোমধ্যেই যারা তাঁর অকপটে সত্যের পক্ষে কথা বলাকে সহ্য করতে পারেননি এবং সেক্যুলার ও বামদের সাজানো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পক্ষে হুবহু কথা না বলে সমাজ বিজ্ঞানী হিসাবে সমাজ বিজ্ঞানের থিওরী মোতাবেক কথা বলাতে তাঁর আদর্শিক অবস্থানের ব্যাপারে সংশয় করেছেন, যারা তাঁর “আমি অমুক থিওরীর ধারক না হয়েই এ কথাগুলো বলছি” কথাটুকুকে কানের মধ্যে ঢোকাতে পারেননি তাদের ধারক সেক্যুলার ও বাম কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে মরহুমের লাশ শহীদ মিনারে নিতে বাধা দেয়ার জন্য ঘোষনা দেয়া হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদ মিনারের অবস্থান হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে লাশ রাখার নিয়ম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নানান কথা বলতে থাকলেন- “আবেদন পাইনি”, “আবেদন আসলে তারপর চিন্তা করা হবে”, উনার লাশ নিয়ে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হোক তা চাইনা” প্রভৃতি। ডঃ পিয়াস করীমের সহকর্মিরা নাগরিক সমাজের পক্ষে থেকে সংবাদ সম্মেলন করে মরহুমের মৃতদেহ সর্বসাধারনের শেষবারের মত দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য শুক্রবার সকাল দশটায় শহীদ মিনারে রেখে পরে জুময়ার নামাজের পরে বায়তুল মোকাররমে জানাযা শেষে দাফনের সিদ্ধান্ত জানানো হল। ধর্মপ্রান অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মতামত দিতে থাকলেন- শহীদ মিনারে লাশ না নেয়ার জন্য, শহীদ মিনারে তাঁর লাশ না নেয়াটাকেই হয়ত আল্লাহ পছন্দ করছেন প্রভৃতি।
আমার কাছে খুব আকর্ষনীয় হয়ে উঠল ব্যাপারটি। আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। আগেই বলেছি, বাম ঘরানার এক বুদ্ধিজীবির জানাযা বায়তুল মোকাররমে হওয়াটাই দাবীর অংশ হয়ে উঠবে- ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য মহিমার অংশ ছিল। এক সময় এসে ঢাবি কর্তৃপক্ষও সেক্যুলার ও বাম সংগঠনগুলোর সাথে একাত্বতা প্রকাশ করল এবং মৃতদেহ শহীদ মিনারে নেয়ার অনুমতি দিলনা। অতএব, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হল- মরহুমের নিজ বাড়িতেই সর্বসাধারনের শেষ দেখার জন্য রাখা হবে এবং বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জানাযা হবে। আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানার কাজটি অনেকটাই শেষ হল আমার। আমি মরহুমের জন্য দোয়া করলাম- আল্লাহ যেন সত্যিকারার্থেই এ ব্যাক্তিকে কবুল করেন, মাগফিরাত দান করেন। কারন আমার বিশ্বাস- আল্লাহ একজন বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবির লাশকে শহীদ মিনারে ফেলে রাখার জায়গা থেকে টেনে এনে জাতীয় মসজিদে জানাযার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন; এটা চাট্টখানি কথা নয়!
আমি জুময়ার নামাজ সাধারনত এলাকার মসজিদে পড়ি। কিন্তু জানাযায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যেই বায়তুল মোকাররমে জুময়ার নামাজ পড়তে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আশ্চর্য হলাম- খতিব তিন তিনবার ডঃ পিয়াস করীমের জন্য হাত তুলে দোয়া করলেন, সেই সাথে সকল মুসিল্লিরা। বাংলা খুতবা শেষ করে হঠাত হাত তুললেন, ফরজ শেষ করে আরেকবার, জানাযা নামাজ শেষ করেই সংগে সঙ্গে আরেকবার। আমি আবারও আশ্চর্য হলাম আর আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। জুময়ার নামাজের পরে মসজিদে জানাযা নামাজ হলে কখনও কখনও জুময়ার ফরজের পরে আবার কখনও কখনও জুময়ার ফরজ পরবর্তী সুন্নত নামাজ শেষে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। দেখলাম, ইমাম সাহেব জুময়ার নামাজের পরে ঘোষনা দিলেন, “অবশিষ্ট সুন্নত নামাজের পরে জানাযা হবে, যারা যারা ইচ্ছুক জানাযায় অংশ নেবেন”। সাধারনত দেখা যায়, জুময়ার ফরজের পরে অনেকে বাসায় গিয়ে সুন্নত নামাজ পড়েন। যারা মসজিদে শেষের দিকে দাঁড়ায় তাদের অনেকেই এ কাজ বেশী করেন। খেয়াল করলাম, আজ ফরজ শেষে দুই চারজন ছাড়া কেউ চলে যাচ্ছেনা। সবাই সুন্নত নামাজ মসজিদেই পড়লেন। সুবহানাল্লাহ, এ মানুষগুলো জানাযার নিয়ত করেই তাহলে রয়ে যাচ্ছেন এবং এই বিশাল সংখ্যক মানুষের বিরাট একটি অংশ আমার মত আসলে জানাযায় অংশ নেয়ার উদ্দেশেই নিজের লোকালয়ের মসজিদ ছেড়ে এ মসজিদে এসেছেন।
জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হল। মরহুমের মৃতদেহ মসজিদের দক্ষিণ গেইটে রাখার ঘোষনা হল। সেখানে সবাই তাঁকে দেখতে পারবেন। লক্ষ্য করলাম, মসজিদের ভেতর থেকে প্রায় সবাই দক্ষিণ গেইটের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। বিশাল জনমানুষের স্রোত সেদিকে। যদিও সাধারনত উত্তর গেইট দিয়ে সচরাচর বেশীর ভাগ মানুষ বের হয়। কিন্তু আজ এ অন্য রকম দৃশ্য। হাটছি আর হাতের মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও ধারন করায় আরেক ভাইকে সহযোগিতা করছি। আশে পাশের মানুষের কথা খেয়াল করলাম। অনেকেই বলছেন- এতো মানুষ! অনেকে বলছেন- শহীদ মিনারে অনুমতি না দেয়ায় ভালই হয়েছে, তাতে জানাযাতে মনে হচ্ছে লোক আরো বেড়ে গেছে। কফিনের পাশে যেতেই পারা যাচ্ছিল না। এতো ভীড়! অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরে যখন প্রায় কাছে গিয়েছি ততক্ষনে অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। কফিন কাধে করে লাশবাহী আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের গাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেছে তাঁর শুভাকাংখিরা। কাফনে মোড়ানো শ্রদ্ধেয় ডঃ পিয়াস করিমের মৃতদেহ চলে গেলে একেবারে সামনে দিয়ে। আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম- আল্লাহ তাকে মাগফিরাত নসীব করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হয়ত আল্লাহর ইচ্ছেই ছিল, এ ব্যক্তিকে তিনি কাছে টেনে নেবেন। আর সেজন্যই লক্ষ্য লক্ষ্য নামাজি মানুষ তাঁর জন্য আজ জানাযায় উপস্থিত হয়েছেন, দোয়া করেছেন।
বিষয়: বিবিধ
২১৭০ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ উত্তম ফয়সালা কারী
তিনি মানুষের মনের কথা সুস্পষ্ট ভাবেই বলতেন। সাধারন মানুষ তাকে তাই নিজের মতই ভেবেছেন। শহিদ মিনারের তথাকথিত এলিট দের হাতে পড়েন নি তিনি। যেমন সারাজিবন হুমায়ুন আহমদ কে গালাগালি দিয়ে তার লাশ দখল করা হয়েছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন