আমাদের মিলু
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান হোসাইন ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১০:৫০:০৪ রাত
খালি গায়ের লিকলিকে এক টোকাই ছেলে। সারাক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। বস্তির ওলিগলি, দুই রেললাইনের পাশাপাশি ফাঁকটুকু তার ও তার বন্ধুদের খেলার মাঠ। ময়লার স্তুপ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পুরোনো ফুটবলের অংশবিশেষ অথবা ফেটে যাওয়া কোনো এক টেনিস বলই হচ্ছে তার ও বন্ধুদের খেলার উপকরণ। তাকে দেখলেই বোঝা যায় যে, মানুষের কঙ্কালগুলো শরীরের ভিতর কিভাবে বেঁকে আছে। পথে-ঘাটে চলতে চলতে মজার কিছু চোখে পড়লেই কৌতুহলের সাথে তা প্রত্যক্ষ করে। পথের ধারে কোন ফলের গাছ দেখলেই ঢিল ছুঁড়ে মারে। এভাবেই সে সারাটা দিন কাটায়। তার কাছে নাকি এই জীবনটাকেই ভালো লাগে। নেই কোনো শত্রু, নেই কোনো চিন্তা। ঘুরছে, খেলছে, ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখলেই মনে হবে যেন তার মতো সুখী মানুষ বুঝি আর কেউ নেই। কিন্তু না, এই সুখের মাঝেই যে বয়ে বেড়াচ্ছে কথা না বলতে পারার এক দু:সহ বেদনাদায়ক যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা তাকে ঠেলে দিচ্ছে অবহেলিত এক সমাজের দিকে।
হ্যাঁ, এই টোকাই ছেলেটিই হচ্ছে আমাদের মিলু। যে কিনা জন্ম থেকেই বোবা। বাল্যকালেই সে তার বাবা-মাকে হারিয়েছে। আর তখন থেকেই সে তার দু:সম্পর্কের এক খালার কাছে রেললাইনের পাশেই এক বস্তিতে অতি কষ্টে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে এতটুকু বড় হয়েছে। বয়স হয়তো ৯ কি ১০। আর এই বয়সেই সে তার মনের ভিতর কথা না বলতে পারার যে কষ্ট পুষে চলেছে তা নিজ থেকে ভোলার চেষ্টা করে অনুভব করতে পেরেছে বাংলার মায়ের ভাষার অমৃত স্বাদ, অনুভব করতে পেরেছে দেশের জন্য জীবন দেওয়া রক্তের মর্যাদা। যে স্বাদ ও মর্যাদা পেয়েছিল আমাদের রফিক, জব্বার, সালামসহ আরো অনেক মায়ের গর্বিত সন্তানেরা। তাই তো রাতে ঘুমানোর আগেই মিলু সিদ্ধান্ত নিল, আগামীকাল যে করেই হোক ফুল সংগ্রহ করে ঘুম থেকে উঠে সে সবার সাথে শহীদ মিনারে ফুল দিবে।
সূর্য উঠতে এখনও কিছুক্ষণ বাকী। আকাশে হালকা কুয়াশা। অল্প অল্প শীত। সুবহে সাদিকের আলোতে আকাশ হাসছে। মায়ের শিয়রের কাছ থেকে চুপি চুপি পা টিপে ঘুম থেকে উঠে পড়ল মিলু। আর দেরি করা যাবে না। এক্ষুনি বের হয়ে যেতে হবে। এক লাফে রেললাইন পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল। রেললাইনের ওপারে মস্ত বড় এক খাঁদ। সে খুব সাবধানে খাদ পেরিয়ে ডাঙায় উঠে আসলো। ডাঙাটা আসলে বনজঙ্গলে অন্ধকারাচ্ছন্ন। তার উপর এখনো পুরোপুরি সূর্যের আলো ফুটেনি। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে মনে হচ্ছে যেন মিলুকে কেউ ভয় দেখাচ্ছে। মিলুও একটু একটু ভয় পাচ্ছে। এরপরও মিলু থামছে না। তাকে যে আজ যে করেই হোক ফুল জোগাড় করতেই হবে। ছুটে চলা মিলুর পায়ে হঠাৎ কীসের যেন কাঁটা বিধলো। সে উবু হয়ে বসে পা থেকে কাঁটাটা সরিয়ে নিল আর তখনই অনুভব করতে লাগলো কাঁটার ভয়ানক যন্ত্রণা। কিন্তু এই যন্ত্রণাই যেন তার মনকে আরো উৎসাহিত করলো আর যন্ত্রণাটা যেন তাকে বলে উঠলো, ‘বসে থাকলে চলবে না, যাও মিলু যাও। তোমাকে যে করেই হোক ঐ উঁচু কৃষ্ণচূড়ার ডালে ফুটন্ত লাল টকটকে ফুলগুলো তোমাকে পেড়ে আনতেই হবে।’ তাই মিলু দেরি না করে এই যন্ত্রণা নিয়ে গাছে উঠে পড়লো আর ফুলগুলোকে পকেটে পুরে নেমে আসলো। গাছ থেকে নামার পর সে তার হাতের ফুটন্ত টগবগে কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁটাবিদ্ধ পায়ের যন্ত্রণা ভুলে গেল এবং বড় একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললো। তারপর সে তাড়াতাড়ি ডাঙাটি পেরিয়ে ফুলগুলো নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে দ্রুত দৌড়াতে লাগলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় মিলু শত শত মানুষের মিছিলের মাঝে হারিয়ে গেল। এরপর সে ভিড়ের মাঝে সবার হাতে দেখতে পেল কারো হাতে রক্তজবা, কারো হাতে লাল গোলাপ আবার কারো হাতে রজনীগন্ধা, গাঁদা সহ অসংখ্য ফুলের সমারোহ। সবার ঠোঁটে প্রভাতফেরির গান। ধীরে পায়ে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে চলেছে সবাই। মিছিলে পা মিলিয়ে সেও চলেছে সবার সাথে শহিদ মিনারে ফুল দিতে। সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে চলেছে- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?
কিন্তু আমাদের মিলু? তার গলা দিয়ে কথা তো ফোটে না, শুধু শব্দ হয় আঁ আঁ আঁ আঁ।
বিষয়: বিবিধ
৮৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন