উচ্চমূল্যে ভিসা বিক্রি মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানিতে বড় বাধা
লিখেছেন লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ০৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:০২:০১ সকাল
প্রবাসীদের পাঠানো টাকা দিয়েই দেশের চাকা সচল থাকে। প্রবাসীরা প্রতি বছর যা রেমিট্যান্স পাঠায় তা বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর সম্মিলিত ঋণের চেয়েও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই বেশি রেমিট্যান্স আসে দেশে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির হার আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে দিন দিন, অথবা যেভাবে এই সংখ্যা বাড়ার কথা ছিল সেভাবে বাড়ছে না। এর অনেক কারণের মধ্যে আছে যথাযথ সরকারি উদ্যোগের অভাব, প্রবাসীদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, কিছু ভারতীয় প্রবাসীর বাংলাদেশীদের সম্পর্কে দুর্নাম রটানোসহ বিভিন্ন কারণ। এর মধ্যে আরও একটি বড় কারণ রয়েছে। তা হলো উচ্চমূল্যে ভিসা বিক্রি।
ভিসা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। প্রায় সবগুলো ভিসাই মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলো বিনামূল্যে প্রদান করে। কিন্তু বিভিন্ন দালাল আর মাধ্যম, উপ-মাধ্যমের হাত ঘুরে ভিসাগুলোর মূল্য বেড়ে যায়। দালালদের হাত ঘুরতে ঘুরতে এসব ভিসার দাম পড়ে ১ লাখ থেকে শুরু করে ৫ লাখ ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। যা একজন গরিব মানুষের পক্ষে জোগাড় করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। অনেকেই ধার-কর্জ করে এসব ভিসা নিয়ে বিদেশে আসেন। পরে দালালদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে ঝগড়াঝাটি হয়। তাও পরে কফিলের কানে গেলে তারা বাংলাদেশী ভিসা আর দিতে চায় না। যে টাকা দিয়ে ভিসা কিনে বিদেশে এসেছে, চাকরি করে সেই টাকা তুলে আনতে কারও দুই বছর, কারও তিন বছর লেগে যাচ্ছে।
প্রবাসীরা একটু আন্তরিক হলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিসার মূল্য অনেক কমানো যায়। এতে আরও বেশি লোক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আসার সুযোগ পেতে পারে। কীভাবে প্রবাসীরা চাইলে ভিসার মূল্য কমাতে পারে তা বুঝতে হলে একটু বিস্তারিতভাবেই এ সম্পর্কে আলোচনার দরকার আছে। প্রথমেই ভিসা সম্পর্কে বলি। এখানে মানুষ আনা হয় হয়তো কোনো কোম্পানিতে অথবা কোনো ব্যক্তির অধীনে। প্রত্যেকটা আবার দুই প্রকার হতে পারে। ১ নং যেটাকে এখানে ফ্রি ভিসা বলা হয়। আর ২ নং হলো যেটাকে এখানে এঙ্গেইজ ভিসা বলা হয়। ফ্রি ভিসার অর্থ হলো ভিসাধারীকে কফিল অর্থাত্ স্পন্সরের কাজ করতে হবে না। সে তার ইচ্ছামতো যেখানে ইচ্ছা কাজ করতে পারবে। এরকম ভিসাগুলোর দাম বেশি। কারণ এসব ভিসার বেলায় অধিকাংশ সময় কফিলেরা টাকা খায়। এরকম ভিসার অর্থ হলো কোনো স্পন্সর অর্থাত্ কফিল সরকারের কাছ থেকে তার কোম্পানির জন্য বা তার বাড়ির জন্য বা বাগানের জন্য যতজন মানুষ আনার অনুমতি পায়, তার মধ্যে কিছু মানুষকে দিয়ে তার কাজ সেরে আর কিছু মানুষকে বাইরে কাজ করার অনুমতি দেয়া। বোঝাই যাচ্ছে সেটা সে নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে পারবে না।
আর এঙ্গেইজ (চুক্তিবদ্ধ) ভিসার অর্থ হলো কফিলের অধীনেই ভিসাধারীকে কাজ করতে হবে, কোম্পানিতে বা বাড়িতে অথবা বাগানে। অর্থাত্ যে কাজের জন্য তাকে আনা হয়েছে সেই কাজ করতে হবে। এরকম সবগুলো ভিসাই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। তবে এসব ভিসায় যার মাধ্যমে মানুষ আসবে সেই তারা (মাধ্যম) ভিসার টাকা নেয়। মাধ্যম একাধিক মানুষ হতে পারে। যত মাধ্যম বেশি হবে তত ভিসার দামও বেশি হবে। অথবা মাধ্যম কম হলেও কেউ টাকা বেশি নিলে ভিসার দাম বেশি হয়। এই মাধ্যমগুলো বিভিন্ন দেশের হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশী মানুষ আসবে তাই এক বা একাধিক মাধ্যম সেখানে বাংলাদেশী হবেই। সেই মাধ্যমগুলো যদি ইচ্ছা করে তাহলে ভিসার দাম অনেক কম রাখতে পারে। কারণ আগেই বলেছি এঙ্গেইজ (চুক্তিবদ্ধ) ভিসা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। শুধু মাধ্যম হিসেবে যারা কাজ করে তারাই টাকা খায়। তারা যদি সবাই বাংলাদেশী হয় তাহলে ভিসা বিনামূল্যে পাওয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দেশের মানুষও মাধ্যম হিসেবে থাকে, তাহলে সেই অন্য দেশির কাছ থেকে যত টাকা দিয়ে ভিসা কিনতে হয়েছে শুধু তত টাকা নেয়া যেতে পারে যে নতুন আসবে তার কাছ থেকে। বাড়তি টাকা না নিলেই হয়। তাতে ভিসার দাম অনেক কমে যাবে।
ভিসা পেতে মাধ্যম থাকতেই পারে। কারণ একজনের উছিলায় আরেকজন আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে তারা যদি একটু আন্তরিক হয়, যদি তারা মনে করে যে আমি ভিসা বিনামূল্যে পাই, তাহলে তা বিনামূল্যেই দেশের আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে দেব, আর যদি টাকা দিয়ে ভিসা কিনতে হয়, তাহলে যত টাকা দিয়ে কিনেছি তার চেয়ে বেশি নেব না, তাহলেও ভিসার দাম অনেক কমে যাবে। এতে আরও বেশি করে মানুষ বিদেশে আসতে পারবে। দেশের উপকার হবে। জনগণের উপকার হবে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এ বিষয়ে প্রবাসীদের এগিয়ে আসা উচিত। প্রবাসীদের মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় অনেক সমিতি আছে, অনেক সংগঠন আছে। এসব সংগঠনের মাধ্যমে যদি একটু সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, একটু বোঝানো যায়, তাহলে সেটা হবে এই মুহূর্তে দেশের জন্য সবচেয়ে উপকারী।
যারা এঙ্গেইজ (চুক্তিবদ্ধ) ভিসাতে আসে, তারা নির্দিষ্ট কাজ নিয়ে আসে। আর যারা ফ্রি ভিসাতে আসে তারাও কোনো না কোনো কাজ জোগাড় করে নেয়। কিন্তু এর মধ্যে ভিসার দালালি করে কিছু টাকা ইনকাম করার ইচ্ছা থাকে অনেকের মধ্যে। দেশের স্বার্থে এই ইচ্ছা ত্যাগ করা উচিত। মনে করতে হবে আমি দুই-একজন মানুষ বিদেশে আনার চেষ্টা করব তবে এর জন্য টাকা নেব না। যদি ভিসা টাকা দিয়ে কিনতে হয় তাহলে শুধু আসল মূল্য নেব, লাভ নেব না। এভাবে যদি সবার মধ্যে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কিছু করার ইচ্ছা তৈরি হয়, তাহলে আরও বেশি মানুষ বিদেশে আসতে পারবে।
প্রবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেম বেশি এটা অনেকেই দাবি করেন। কথাটা সত্যও হয়তো। তবে দেশপ্রেমের দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রমাণ তো রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিনামূল্যে বা কমমূল্যে কিছু মানুষকে ভিসা দেয়ার চেষ্টাই হবে দেশপ্রেমের সবচেয়ে উত্তম প্রমাণ। এখানে আবারও বলে রাখি, অন্য কোনো দেশের প্রবাসী কারও কাছ (মাধ্যম) থেকে যদি ভিসা কিনে নিতে হয় সে ক্ষেত্রে যত টাকা দিয়ে ভিসা কিনতে হয়েছে শুধু তত টাকা নেয়া যেতে পারে, এর চেয়ে বেশি যেন না নেয়া হয়, তাহলেও ভিসার মূল্য অনেক কমে যাবে। প্রবাসী সব বাংলাদেশীর উচিত এই সঙ্কল্প করা যে আমি অন্তত দশজন মানুষ কমমূল্যে বা বিনামূল্যে বিদেশে আনব।
জনশক্তি রফতানিতে বাধা হিসেবে আরও একটি কারণ ওপরে বলেছি। তা হলো বাংলাদেশী প্রবাসীদের সম্পর্কে ভারতীয়দের নেতিবাচক প্রচারণা। ভারত অনেক বড় রাষ্ট্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মানুষও বেশি। এবং তারা বাংলাদেশীদের তুলনায় কিছুটা ওপরের লেভেলে কাজ করে। বিশেষ করে কেরালার প্রবাসীরা মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বড় বড় ব্যবসা করে। সেই ভারতীয়রা সব সময় বাংলাদেশীদের সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা, উল্টা-পাল্টা কথা প্রচার করে আরবিদের কান ভারী করে তুলে। যাদেরকে আমরা বন্ধু বলে মুখে ফেনা তুলছি সেই তারাই দেশে এবং প্রবাসে আমাদের ক্ষতি করার তালে থাকে সব সময়। এসব অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে।
এর চেয়েও বেশি দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই যে বাংলাদেশীরাও অনেক সময় একজন আরেকজনের দুর্নাম করে কফিলের কাছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই কারণে অনেক কফিল বাংলাদেশী মানুষ আনতে চায় না। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে অশিক্ষিত মানুষ বেশি। এদের মধ্যে অনেকেই বুঝতে পারে না যে একজন আরেকজনের বদনাম করার মধ্যে দেশের ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। এই ব্যাপারে প্রবাসীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত আছেন, তারা এগিয়ে এসে বোঝাতে পারেন যে, আমাদের মধ্যে অনেক সময় ছোটখাটো বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দিতেই পারে। তাই বলে আমরা সেটা কফিলের কানে তুলব কেন? এতে দেশের সম্পর্কে আরবিদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। তার চেয়ে বরং আমাদের বিষয়গুলো আমরা নিজেরাই সমাধান করে নেব। এভাবে প্রবাসে আমরা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অনেক উপকার করতে পারি। শুধু একটু সচেতনতা দরকার।
লেখক : ব্লগার, কলামিস্ট ও কাতার প্রবাসী
দৈনিক আমারদেশ ৯/৪/২০১৪
বিষয়: বিবিধ
১২৬৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে সরকারি উদ্যোগে েযেহেতু সম্ভব নয় তাই বেসরকারি উদ্যোগে এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি খুলার চেষ্টা করা উচিত। সরকারের উপর ভরসা করলে এই কাজ আর হবেনা। অন্ততপক্ষে সকলে মিলে চাঁদা দিয়ে একটি ফান্ড তৈরি করে প্রয়োজনিয় আইনগত সহায়তার চেস্টা করা যেতে পারে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন