ঢাকা পলিটেকনিকে একের পর এক অপকর্ম ছাত্রলীগের

লিখেছেন লিখেছেন তিতা করল্লা ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ১২:৩৫:০৪ দুপুর

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের মদদে একের পর এক অঘটন ঘটছে। তেজগাঁও, সাতরাস্তা ও বেগুনবাড়ী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। তাদের মদদে গত এক বছরে অন্তত ১০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন রাহিদ নামের এক ছাত্র।

পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়ার দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় ইনস্টিটিউটে ভাঙচুর করা হয় এবং শিক্ষকদের ওপর চালানো হয় হামলা। সেদিন ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হলেও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হল ছাড়েনি।

ছাত্রলীগের এসব অপকর্মে বেকায়দায় পড়েছে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। তবে এবারের ঘটনায় জড়িত অন্তত ১০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগ বছরে কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতা আর টাকার ভাগ নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েকটি গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরেই ঘটছে হামলা-পাল্টাহামলা। ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। পরিচয় গোপন করে ছাত্রলীগে ঢুকেছে শিবির ও ছাত্রদলের কিছু কর্মী। ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছে ছাত্রলীগের একাংশ। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রয়েছে কোণঠাসা অবস্থায়।

সূত্র জানায়, ৬ জানুয়ারি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়ার দাবিতে ভাঙচুর এবং শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় কিছু শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। ঘটনার পর ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা করে পরদিন সকালের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও তাদের অনুসারী কিছু শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসে থেকে যায়। পরে ৮ জানুয়ারি ছাত্রাবাস খালি করে তালা ঝুলিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ১৫০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তদন্ত কমিটিও গঠন করে কর্তৃপক্ষ।

তদন্ত কমিটির প্রধান ইলেকট্রিক বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর আবুল কাশেম জানান, দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষায় বিভিন্ন বিভাগের ৫৫ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। তাদের মধ্যে সিভিল বিভাগের নাজমুল হোসেন ও সাকিলা ইয়াসমিনকে পাস করানোর জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অধ্যক্ষকে চাপ দেয়। কর্তৃপক্ষ এ দাবি না মানায় তারা হামলা ও ভাঙচুর চালায়। তদন্তে এসব জানা গেছে। ওই হামলায় মেকানিক্যাল বিভাগের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান, ইলেকট্রিক বিভাগের শিক্ষক মোক্তার আহমেদ ও সিভিল বিভাগের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আহত হন।

সূত্র জানায়, ফজলুল হক ও নাজমুল হোসেন নামের দুজনকে ওই হামলায় নেতৃত্বদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে সাকিলা ইয়াসমীন ও সাবিনা ইয়াসমীন নামের দুই ছাত্রীও ছিল। আরো ছয়জনকে হামলায় জড়িত হিসেবে শনাক্ত করেছে কমিটি। এ ১০ জনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত বৃহস্পতিবারই সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি।

ঢাকা পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ ড. রফিকুল ইসলাম মীর গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। স্থানীয় এমপি আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে আলোচনা করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' অধ্যক্ষ অভিযোগ করেন, হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় ১৫০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও আসামিরা ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।

যত অভিযোগ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। আশপাশের খালি জায়গা দখল করে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছে তারা। এ ছাড়া স্থানীয় বটতলা মার্কেটে দোকানপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে। এসবের নেপথ্যে কাজ করছেন কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা। পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক ছাড়াও নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শাহিন গ্রুপ, পলিটেকনিক কলেজের সহসভাপতি এ আর ডি জয় গ্রুপ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল মিঝি গ্রুপ এবং কমলেশ মুখার্জি কমল গ্রুপ।

২০১১ সালের ১০ মে জাকিরকে সভাপতি, জয়কে সহসভাপতি ও কমল গ্রুপের সদস্য মাসুমকে সাধারণ সম্পাদক করে পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। জাকির গ্রুপের রাহিদ খুন হওয়ার পর ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ (উত্তর) পলিটেকনিক ছাত্রলীগের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে তিন-চার মাস পর সেখানে ছাত্রলীগ আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে।

জানা যায়, ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০০৭ সালে লতিফ হলের পূর্ব শাখার সুপার অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া ও তাঁর সহকারীকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় জেএমবি কমান্ডার জান্দালসহ ইনস্টিটিউটের আরো কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল।

ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা কৌশলে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের ছায়ায় থেকে ইনস্টিটিউটটি নিয়ন্ত্রণ করছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্যাম্পাসে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। এর মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ব্যাপক ভাঙচুর ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২৬ সেপ্টেম্বর সাতরাস্তার মোড় এলাকায় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ও ট্রাক শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের নেপথ্যে ছিল স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি। সেখানকার শ্রমিক নেতা হারুনুর রশিদ বলেন, 'তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের সম্পাদক জাকিরকে সভাপতি করার পর থেকে পলিটেকনিকের ছাত্ররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অনেক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে।'

জানা গেছে, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রতিটি গ্রুপের নেতাদের নামেই ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে থানায় একাধিক মামলা আছে। তবে প্রভাবের কারণে প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইলিয়াস হোসেন অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিই। ছাত্রলীগ বা কারা আসামি- এটা বিবেচ্য বিষয় নয়।'

ঢাকা পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, 'সেদিনের (৬ জানুয়ারি) ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত ছিল না। তুচ্ছ ঘটনাকে ইস্যু করে বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকাল ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা করিয়েছেন। এমন কোনো পরিস্থিতি সেদিন তৈরি হয়নি।' ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'এসব ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।'

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগের সভাপতি জাকির হোসেনের গ্রুপের কর্মী ছিল রাহিদুল ইসলাম রাহিদ। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব ইসলাম মাসুমের কর্মীরা রাহিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। ডাইনিংয়ে বিনা পয়সায় খাওয়ার প্রতিবাদ করায় তাঁর ওপর হামলা করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ সেপ্টেম্বর রাহিদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রাহিদের বাবা মোসলেহ উদ্দিন বাদী হয়ে রাকিব ইসলাম মাসুমসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। আসামিদের মধ্যে আছে সুমন, হিমেল, মেহেদী, ফারদিন, নিঙ্ন, সম্রাট, মাহফুজ, সরোয়ার সুমন, মনির, মামুন প্রমুখ। পরে মামলাটি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়।

রাহিদের বাবা মোসলেহ উদ্দিন জানান, আসামিরা বিভিন্ন্ন সময় মামলা প্রত্যাহারের জন্য তাঁকে চাপ দিয়ে বলেছে, 'আপনি আমাদের কিছুই করতে পারবেন না।' পরে তাঁকে 'ক্ষতিপূরণ' নিয়ে চুপচাপ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে আসামিরা রাহিদের বাবাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছে বলেও জানান তিনি। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সম্প্রতি জাকির ও মাসুম সমঝোতার মাধ্যমে এক হয়েছেন। রাহিদ হত্যা মামলার তদন্তে তাই কোনো পক্ষেরই সহায়তা মিলছে না।

তবে রাহিদ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিতে গিয়ে আসামিদের নাম-ঠিকানার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। আসামিরা কোন বিভাগের, কোন বর্ষের ছাত্র, তা লেখা হয়েছে এজাহারে। কিন্তু তাদের সেমিস্টার, বর্ষ ও বিভাগ মিলছে না।'

কালেরকন্ঠ, ১৪ জানুয়ারী ২০১৩

Click this link

বিষয়: রাজনীতি

৯০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File