বীরবিক্রম শহীদ রফিকুলের পরিবার সরকার প্রদত্ত সকল সুবিধা থেকে আজো বঞ্চিত

লিখেছেন লিখেছেন তিতা করল্লা ২২ জানুয়ারি, ২০১৩, ১২:৩১:৪০ দুপুর

আশ্রাফ উদ্দিন ফারুক (দৌলতখান) ভোলা : স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আর বীরদর্পে সম্মুখ যুদ্ধে আত্মোৎস্বর্গকারী শহীদ রফিকুল ইসলামের অবহেলিত পরিবার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞার যেন এক বেদনাদায়ক উদাহরণ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শেষাবধি জীবন উৎসর্গ করেন শহীদ হাবিলদার রফিকুল ইসলাম বীরবিক্রম। মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন ৩ নং সেক্টর কমান্ডার ও বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরামের সভাপতি এবং সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল এ কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন পদাতিক দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৩৫ সালে ভোলার দৌলতখান উপজেলাধীন চর খলিফা ইউনিযনের এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম। তার পিতার নাম সেকান্দর আলী ও মায়ের নাম মাছুমা খাতুন।

পরবর্তী সময়ে বাবা-মায়ের সাথে পার্শ্ববর্তী চরপাতা ইউনিয়নের লেজপাতা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন শহীদ রফিকুলের পরিবার। জন্ম ও বসবাস সূত্রে ভোলার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও ভোলাবাসীদের কাছে বলতে গেলে, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪২ বছরেও তার পরিচয় অনেকটা প্রচ্ছন্ন হয়েই আছে। এমনকি রহস্যজনকভাবে প্রায় ৩ যুগ ধরে ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অথবা ঐতিহাসিক নথিপত্রে স্থান পায়নি মুক্তি সংগ্রামে জীবন দানকারি এই বীর শহীদের নাম পরিচয়। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শহীদ রফিকুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের প্রচেষ্টায় তৎকালীন দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আলম সরদারের তত্ত্বাবধানে দৌলতখানের মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত নথিপত্রে উঠে আসে দৌলতখানের এই বীর মুক্তিসেনার নাম।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের চারদিন মাত্র বাকি। এমনি এক রক্তঝরা দিনে জয়দেবপুর থেকে সরাসরি পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলে শহীদ হাবিলদার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন সেনা ইউনিট। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা এলাকায় এসে হাবিলদার রফিকুলের সামরিক ইউনিটের সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর শেষ বুঝা-পড়ার এক মুহূর্তে তাদের হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে শহীদ রফিকুলের সেনা টিম। পার্ক বাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে অগত্যা ধুলায় লুটিয়ে পড়ে শহীদ রফিকুল ইসলামের ক্ষত-বিক্ষত দেহ। মুহূর্তের মধ্যে নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যান হাবিলদার রফিকুল ইসলাম। শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা আজো জানতে পারেনি হতভাগ্য এই বীর শহীদের পরিবার ও অন্যরা।

মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণের পরে ৪ বছরের শিশু মোঃ ফিরোজ আলমকে নিয়ে দুর্বিসহ জীবন শুরু হয় শহীদ রফিকুল ইসলামের বিধবা স্ত্রী মমতাজ বেগমের। রফিকুলের শাহাদাত পরবর্তী দীর্ঘ ৪২ বছরের পুরো সময়কালটাই ছিল স্ত্রী মমতাজ আর পুত্র ফিরোজ আলমের জীবনের অব্যক্ত যন্ত্রণা আর সিমাহীন লাঞ্ছনার প্রতিচ্ছবি। স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিধবা স্ত্রী মমতাজ বেগম ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানান, স্বাধীনতাত্তোর প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় কেটেছে তাদের অনাহার-অর্ধাহার আর রোগ-শোকের বিরামহীন ঝড়ের মাঝে। একদিকে আর্থিক দৈন্যদশা, অন্যদিকে দরদী কোন পৃষ্ঠপোষকের অভাবে একমাত্র পুত্র ফিরোজ আলমকে অতি কষ্টে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করাতে পারলেও ভাগ্যাহত সন্তানকে তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেননি। পুত্র ফিরোজ আলমের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, সে প্রাইমারি শিক্ষা পর্বটাও ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর পুষ্টিহীনতার কারণে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। বয়স হওয়ার পর থেকে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরোজ আলম। সামান্য পৈতৃক সম্পত্তি চাষাবাদ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটু সুখে থাকার স্বপ্নও বার বার হোঁচট খেয়েছে সমাজের অবজ্ঞা আর অবহেলার কাছে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখতেই শহীদ পুত্র ফিরোজ আলম পিতৃহীন অসহায় পরিবারটিকে সুন্দরভাবে দাঁড় করাবার জন্য অভিভাবকহীন সংগ্রামে নিজেই নেতৃত্ব হাতে তুলে নেয়। অনেক দৌর-ঝাঁপ করে অবশেষে ১৯৯২ সনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে ঢাকায় সেনা কুঞ্জে শহীদ রফিকুল ইসলাম বীরবিক্রমের বিধবা পত্নি মমতাজ বেগম পুত্র ফিরোজ আলমকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সরকার প্রদত্ত ১০ হাজার টাকার চেক ও বীরবিক্রম সনদ শহীদের পক্ষে গ্রহণ করেন তার বিধবা স্ত্রী ও পুত্র ফিরোজ আলম। সনদপত্রে প্রদত্ত নাম্বার ০৪৮। বাংলাদেশ গেজেট নোটিফিকেশন নং-৮/২৫ডি-১/৭২-১৩৭৮, তারিখ ঃ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ ইং।সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারা জানান, সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল নাসিম সেনাকুঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ রফিকুল ইসলাম বীরবিক্রমের স্ত্রী-পুত্রের পরিচয় জানতে পেরে আবেগ আপ্লুত হয়ে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে যুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণ করেন। জেনারেল নাসিমের পায়ে পাক-সেনাদের হাতে গুলীবিদ্ধ হয়ে তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, সে সময় বীরবিক্রম রফিকুল ইসলাম তাকে সীমান্তের ওপারে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। একপর্যায়ে জেনারেল নাসিম তাদেরকে নিজ বাসায় নিয়ে আতিথেয়তা করেন। শহীদ বীরবিক্রমের হতভাগ্য পরিবারে বিগত ৪১ বছরে এইটুকুই তাদের পরম পাওয়া।

শহীদ পুত্র ফিরোজ আলম ক্ষোভ ও অভিযোগের সুরে জানান, মুক্তি সংগ্রামে যেসব শহীদরা বীরবিক্রম খেতাব পেয়েছেন তাদের জন্য সরকার থেকে বরাদ্দকৃত প্লট, ফ্ল্যাট, তাদের পরিবারের পুনর্বাসন ইত্যাদিসহ বহুবিধ লোভনীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার কথা ঘোষণা করা হলেও আজ পর্যন্ত তারা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। সরকারের এই সমস্ত ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা পেতে শহীদ বীরবিক্রম রফিকুল ইসলামের অবহেলিত পরিবারের আর কত সময় লাগবে- এটাই এখন সকলের জিজ্ঞাসা।

বিষয়: বিবিধ

৯৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File