আল তাবারী কি কোন হাদীস গ্রন্থ ?

লিখেছেন লিখেছেন শাফিউর রহমান ফারাবী ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০১:০৭:২১ দুপুর

মানুষ কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে নাস্তিকদের জুড়ি নাই। আপনারা দেখবেন নাস্তিকরা সব সময় দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে কম জানা মুসলমানদের কে বিভ্রান্ত করে। যেটা হাদীসগ্রন্থ না সেটাও নাস্তিকরা অবলীলায় সাধারন মুসলমানদের মাঝে হাদীসগ্রন্থ বলে চালিয়ে দেয়। আর ফলশ্রুতিতে সাধারন মুসলমানরা নাস্তিকদের সেই কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে। বাংলা অন্তর্জালে দীর্ঘদিন ধরে নাস্তিকরা আত তাবারী নামক একটি ইতিহাস গ্রন্থ কে হাদীস গ্রন্থ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আপনারা কি জানেন তাবারী বা আত তাবারী বা আল তাবারী যে নামেই আমরা এই গ্রন্থটিকে ডাকি না কেন এটা কোন হাদীস গ্রন্থ নয়। তাবারী হচ্ছে একটা ইতিহাস গ্রন্থ। কিন্তু অনলাইনে নাস্তিকরা কি চমৎকার ভাবেই না দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কাছে এই তাবারী নামক একটা ইতিহাস গ্রন্থ কে হাদীস গ্রন্থ বলে চালিয়ে যাচ্ছে। ৩১০ হিজরির দিকে ইবনে জরীর আল তাবারী নামক একজন মুসলিম স্কলার এই তাবারী নামক একটি ইতিহাস গ্রন্থ লিখেন। এই তাবারী গ্রন্থের পূরা নাম হল تاريخ الرسل والملوك Tarikh al-Rusul wa al-Muluk, তবে সাধারনত একে Tarikh al-Tabari/তারিখ আল তাবারী নামেই ডাকা হয়।

এই তাবারী ইতিহাস গ্রন্থে যেই সব বর্ননা এসেছে তার কোনটাই হাদীস নয়। হাদীস শাস্ত্রের কোন কিতাবে তাবারী নামক কোন গ্রন্থও নেই। এই তাবারীর ভুলভাল ইতিহাস লেখার প্রতিবাদ করেই ইবনে কাসীর "আল বিদান ওয়ান নেহায়া” নামক আরেকটি ইতিহাস গ্রন্থ লিখেন। অর্থ্যাৎ তাবারী বা আল বিদান ওয়ান নেহায়া এগুলি কোনটাই হাদীস গ্রন্থ নয়। এগুলি হচ্ছে সব ইতিহাস গ্রন্থ। তারাবী গ্রন্থের ভুমিকায় ইবনে জরীর আল তাবারী নিজেই বলেছেন-

“ Let the reader be aware that whatever I mention in my book is relied on the news that were narrated by some men. I had attributed these stories to their narrators, without inferring anything from their incidents ....



“ If a certain man gets horrified by a certain incident that we reported in our book, then let him know that it did not come from us, but we only wrote down what we received from the narrators. "

অর্থাৎ আমি ভালো-খারাপ সকল ব্যক্তির কাছে যা বর্ণনা পেয়েছি তার সব এখানে তুলে ধরেছি, এর থেকে জ্ঞানীরা সব যাচাই বাছাই করে নিবে .

অর্থাৎ জরীর আল তাবারী তিনি তাঁর এই তাবারী গ্রন্থে যা কিছু বর্ণনা পেয়েছেন, তা কোনোরকম যাচাই- বাঁচাই ছাড়াই তা সংগ্রহ করেছিলেন। এতে উনার তাবারী গ্রন্থটি একটি বৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থ হলেও কোন নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে তা বিবেচিত হয়না। সুতরাং তাবারির যে-সব কথা বা যে কোনো ইতিহাসভিত্তিক বর্ণনা, যদি কোন হাদিসের বিপরীত হয় তা কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না। ইবনে জরীর আল তাবারী বিভিন্ন রাবীর কাছ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সম্পর্কিত অনেক বর্ননা সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সম্পর্কিত তাবারীর সেই সংগৃহিত বর্ননা গুলি হাদীসের মাপ কাঠিতে উত্তীর্ন হতে পারি নি। আর তাই তাবারীকে কোন হাদীস গ্রন্থ বলা হয় না। তাবারী হচ্ছে মূলত একটা ইতিহাস গ্রন্থ। আর যেই উইকিপিডিয়ার কথা বলে নাস্তিকরা মুখে ফেনা উঠাই ফেলায় সেই উইকিপিডিয়ায় পর্যন্ত বলা হয়েছে যে তাবারী হচ্ছে একটা ইতিহাস গ্রন্থ। আপনারা এই লিংক http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_the_Prophets_and_Kings এ যেয়ে তাবারী যে একটা ইতিহাস গ্রন্থ সে সম্পর্কে জানতে পারবেন।

বাইবেলে হযরত দাউদ আলাইহিস সাল্লম, হযরত লুত আলাইহিস সাল্লাম, হুযরত সুলায়মান আলাইহিস সাল্লাম সম্পর্কে অনেক অনৈতিক কথা বার্তা রয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে নবী রাসূলগন হলেন নিস্পাপ। আল কোরআনেই নবী রাসূলদের নিস্পাপ থাকার কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাই বাইবেলে নবী রাসূলদের সম্পর্কে যে অনৈতিক কথা গুলি এসেছে এর সবগুলিই যে ইহুদী খৃস্টানদের বানোয়াট এতে কোন সন্দেহ নাই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাইবেলে নবী রাসূলদের সম্পর্কে যে অনৈতিক কথা গুলি এসেছে ঠিক তাবারীতেও এই বর্ননা গুলি এসেছে। আর তাই তাবারী গ্রন্থে লেখা অনেক ইতিহাস যে ভুল এতে কোন সন্দেহ নাই।

তাওরাত-যাবুর-ইঞ্জিল ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ হলেও এই ধর্মগ্রন্থ গুলির বর্ণনার কোনো সুত্র বা সনদ নেই। লুক-মথির পত্র এগুলো কি আসলেই তাদের পত্র, নাকি অন্যের বানানো কিতাব এটা ইয়াহুদী-খ্রিস্টানরা প্রমাণ করতে পারবে না। এইজন্য দেখা যায় রোমান ক্যাথলিকরা যে বাইবেল পড়ে, প্রোটেস্টেন্ট খৃস্টানরা তাকে বাইবেল বলে মানে না। আর ইহুদীরা তো বাইবেলের অল্ড টেস্টমেন কে স্বীকারই করতে চায় না। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ হল তালমুদ।

কিন্ত আপনারা যারা হাদিসের কিতাব পড়েছেন, তারা দেখেছেন হাদিস বর্ণনার আগে কিছু নাম দেয়া থাকে। অর্থাৎ হাদিসটি গ্রন্থবদ্ধ হওয়ার আগে কারা হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তাদের নাম। আর উনাদেরকেই বলা হয় রাবী। এবার রিজাল শাস্ত্রের কিতাব খুললেই আপনি রাবীদের জীবনী পাবেন। রাবীরা কেমন লোক ছিলো, সেটাও জানতে পারবেন। এভাবে রিজাল শাস্ত্রের কিতাবগুলিতে প্রায় ৫ লক্ষ রাবীর জীবনী সংকলিত হয়েছে।

এইজন্যই মুহাদ্দিসরা বলেন, “সনদ হচ্ছে দ্বীনের অন্যতম স্তম্ভ। যদি সনদ না থাকে, তবে যার যা মন চায়, সে তা-ই বলবে।” আর তাবারী গ্রন্থে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সম্পর্কিত যেই বর্নানাগুলি এসেছে সেগুলি সনদের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারে নাই। আর তাই তাবারী হল শুধুমাত্র একটা ইতিহাস গ্রন্থ কোন হাদীস গ্রন্থ নয়। এই নাস্তিকরা প্রায়ই তারিখ আল তাবারী কে একটা হাদিস গ্রন্থ বলে তাবারী থেকে বিভিন্ন বর্ননা নিজের মত করে দিয়ে মুসলমানদের কে বিভ্রান্ত করছে। তাই নাস্তিকদের দেয়া তাবারী গ্রন্থের কোন কথাই আপনারা আর বিশ্বাস করবেন না। ইসলামের সীরাত গ্রন্থ গুলি হচ্ছে সীরাতে ইবনে ইসহাক, সীরাতে ইবনে হিশাম প্রভৃতি। আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী জানব বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ থেকে। কখনই তাবারী থেকে নয়। মুসলিম স্কলাররা অনেক আগেই তাবারী নামক এই ইতিহাস গ্রন্থ কে পরিতাজ্য ঘোষণা করেছেন। ইবনে জরীর আল তাবারি নামে দুই জন প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। একজন কট্রর শিয়াপন্থী অপরজন হক্বপন্থী। তারিখে তাবারি হকপন্থী আলিমেরই লেখা। তবে তিনি তাঁর এই গ্রন্থে যা- কিছু বর্ণনা পেয়েছেন,কোনোরকম যাচাই- বাঁচাই ছাড়াই সংগ্রহ করেছেন। এতে গ্রন্থটি বৃহৎ ইতিহাসগ্রন্থ হলেও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। সুতরাং তাবারির যে-সব বর্ণনা বা যে কোনো ইতিহাসভিত্তিক বর্ণনা, তা যত শক্তিশালী-ই হোকনা কেনো, কোন হাদিসের বিপরীত হলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না ।

বাংলাদেশের নাস্তিকদের গুরু অভিজিৎ রায় উনার লেখা ফেইসবুক নোট ও ব্লগে প্রায়ই এই কথাটা বলেন যে তাবারীই নাকি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সম্পর্কে জানার সবচেয়ে ভাল উৎস ! নাস্তিকরা বলতে চাচ্ছে যে বুখারী মুসলিম তিরমিযী সীরাতে ইবনে ইসহাক, সীরাতে ইবনে হিশাম এখন থেকে বাদ দিয়ে আমরা মুসলমানরা এখন থেকে ইসলাম জানব তাবারী নামক একটা ইতিহাস গ্রন্থ থেকে !

সীরাতে ইবনে ইসহাক বা সীরাতে ইবনে হিশাম যার তার কাছ থেকে বর্ণনা নিয়ে লেখা হয় নি। মোটামুটি সনদের একটা ধারাবাহিকা রক্ষা করা হয়েছে এই সীরাত গ্রন্থ গুলিতে। কিন্তু তাবারীতে যা কিছুই করা হয় নি। আর তাই তাবারীকে অনেক আগেই মুসলিম স্কলাররা বাদ দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি ইতিহাস জানার জন্য তাবারীর চেয়ে আল বিদান ওয়ান নিহায়া উত্তম। বাইবেলে একটি কাহিনী বর্নিত আছে যে দাউদ আলাইহিস সাল্লাম নাকি উনার সেনাপতি উরিয়ার স্ত্রী বত্শেতবা বিনতে ইলিয়ামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতে এক অসম যুদ্ধে উরিয়াকে প্রেরণ করে তারপর উরিয়া নিহত হলে বত্শেরবা কে নাকি হযরত দাউদ আলাইহিস সাল্লাম পরবর্তীতে বিয়ে করেন। হযরত দাউদ আলাইহিস সাল্লাম নাকি নারী লিপ্সু ছিল এসব কথাও বাইবেলে লেখা আছে। নাউযুবিল্লাহ। কিন্তু পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বলা আছে যে সকল নবী রাসূলরা হল নিস্পাপ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে হযরত দাউদ আলাইহিস সাল্লাম কে নিয়ে লেখা এই মিথ্যা কিচ্ছা কাহিনীটা আত তাবারীতেও বর্ণিত আছে। তাই তাবারীর অনেক কথাই যে পরিতাজ্য এতে কোন সন্দেহ নাই। সীরাত গুলি লেখা হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকাল হবার পর ১০০ বছর পর। আর সীরাতে ইবনে হিশাম, ইবনে ইসহাক এও কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় যা সহী হাদীস গুলির সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী সম্পর্কিত কোন তথ্য যদি সহীহ হাদীস বা আল কোরআনের বিপরীত হয় তাইলে তা পরিতাজ্য।

বিষয়: বিবিধ

২৩৮৩ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

182505
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:২৫
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : আপনার সচেতন মূলক লেখাটার জন্য আপনাকে অসংখ্য মোবারকবাদ।
182507
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:৩৮
সজল আহমেদ লিখেছেন : যাযাকাল্লাহু খাইরান।
182515
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:৪৬
প্রবাসী যাযাবর লিখেছেন : সুন্দর ও মূল্যবান তথ্য তুলে ধরার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
182545
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:৫৬
ইমরান ভাই লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে
182548
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:০০
আমি আহমেদ মুসা বলছি লিখেছেন : ধন্যবাদ
182566
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:৪০
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : মূল্যবান তথ্য দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সহীহ হাদীস ও আল কোরআনের বিপরীত যে কোন বক্তব্য অবশ্যই পরিতাজ্য।
182569
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৮
ফেরারী মন লিখেছেন : ধন্যবাদ বিষয়টা পরিস্কার করার জন্য। Rose Rose
182585
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:০৭
আল্লাহর সন্তুষ্টি লিখেছেন : মানুষ কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে নাস্তিকদের জুড়ি নাই। আপনারা দেখবেন নাস্তিকরা সব সময় দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে কম জানা মুসলমানদের কে বিভ্রান্ত করে। যেটা হাদীসগ্রন্থ না সেটাও নাস্তিকরা অবলীলায় সাধারন মুসলমানদের মাঝে হাদীসগ্রন্থ বলে চালিয়ে দেয়। আর ফলশ্রুতিতে সাধারন মুসলমানরা নাস্তিকদের সেই কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে


182794
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৫৩
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : যাযাকাল্লাহু খাইরান।
১০
182871
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ এই জরুরি তথ্যটি দেওয়ার জন্য। আমাদের দেশে সিহাহ সিত্তা বলা হয় ছয়টি প্রধান হাদিস সংকলনকে। যদিও মুহাদ্দিসগন বুখারি ও মুসলিম কেই সহিহ বলে বলেন বাকি চারটিকে পুর্নাঙ্হ সহিহ বলেননা। তথাপি আমাদের বেশিরভাগ মাওলানা সাহেবরা লিখার বা বক্তৃতার সময় মিশকাত সহ অন্যান্য গ্রন্থের বরাত বেশিদেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File