বিন্দুর ছেলে-আট
লিখেছেন লিখেছেন ঝিঙেফুল ০৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৩:৪৮:৪৩ দুপুর
বাড়ির সুমুখ দিয়া ইস্কুল যাইবার পথ। প্রথম কয়েকদিন অমূল্য ছাতি আড়াল দিয়া এই পথেই গিয়াছিল, আর দু’দিন ধরিয়া সেই লাল রঙের ছাতাটি আর পথের একধার বাহিয়া গেল না। চাহিয়া চাহিয়া বিন্দুর চোখ ফাটিয়া জল পড়িতে লাগিল, তবুও সে চিলের ছাদের আড়ালে বসিয়া তেমনি একদৃষ্টে পথের পানে চাহিয়া বসিয়া রহিল। সকালে নটা-দশটার সময় কত রকমের ছাতি মাথায় দিয়া কত ছেলে হাঁটিয়া গেল; ইস্কুলে ছুটির পর কত ছেলে সেই পথে আবার ফিরিয়া আসিল; কিন্তু সেই চলন, সেই ছাতি, বিন্দুর চোখে পড়িল না। সে সন্ধ্যার সময় চোখ মুছিতে মুছিতে নামিয়া আসিয়া নরেনকে আড়ালে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, হাঁ নরেন, এই ত ইস্কুলে যাবার সোজা পথ, তবে কেন সে এদিক দিয়ে আর যায় না?
নরেন চুপ করিয়া রহিল।
বিন্দু বলিল, বেশ ত রে, তোরা দুটি ভাই গল্প করতে করতে যাবি-আসবি—সেই ত ভাল।
নরেন তাহার নিজের ধরনে অমূল্যকে ভালবাসিয়াছিল, চুপি চুপি বলিল, সে লজ্জায় আর যায় না মামী, ঐ হোথা দিয়ে ঘুরে যায়।
বিন্দু কষ্টে হাসিয়া বলিল, তার আবার লজ্জা কিসের রে? না না, তুই বলিস তাকে, সে যেন এই পথেই যায়।
নরেন মাথা নাড়িয়া বলিল, কক্ষণ যাবে না মামী! কেন যাবে না জান?
বিন্দু উৎসুক হইয়া বলিল, কেন?
নরেন বলিল, তুমি রাগ করবে না?
না।
তাদের বাড়িতে বলে পাঠাবে না?
না।
আমার মাকেও বলে দেবে না?
বিন্দু অধীর হইয়া বলিল, না রে না, বল্—আমি কাউকে কিছু বলব না।
নরেন ফিসফিস করিয়া বলিল,—থার্ডমাস্টার অমূল্যর আচ্ছা করে কান মলে দিয়েছিল।
একমুহূর্তে বিন্দু আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, কেন দিলে? গায়ে হাত তুলতে আমি মানা করে দিয়েচি না?
নরেন হাত নাড়িয়া বলিল, তার দোষ কি মামী, সে নূতন লোক। আমাদের চাকর এই হেবো শালাই বজ্জাত, সে এসে মাকে বলেচে। আমার মা-টিও কম বজ্জাত নয়, মামী, সে মাস্টারকে বলে দিতে বলে দিয়েচে, থার্ডমাস্টার অমনি আচ্ছাসে কান মলেচে,—
কি রকম করে জান মামী,—এই রকম করে ধরে বিন্দু তাহাকে তাড়াতাড়ি থামাইয়া দিয়া বলিল, হেবো কি বলে দিয়েচে?
নরেন বলিল, কি জান মামী, হেবো টিফিনের সময় আমার খাবার নিয়ে যায় ত, সে ছুটে এসে বলে, কি খাবার দেখি নরেনদা? মা শুনে বলে, অমূল্য নজর দেয়।
অমূল্যর কেউ খাবার নিয়ে যায় না?
নরেন কপালে একবার হাত ঠেকাইয়া বলিল, কোথা পাবে মামী, তারা গরীব মানুষ, সে পকেটে করে দুটি ছোলা-ভাজা নিয়ে যায়, তাই টিফিনের সময় ওদিকের গাছতলায় নুকিয়ে বসে খায়।
বিন্দুর চোখের উপর ঘরবাড়ি সমস্ত সংসার দুলিতে লাগিল; সে সেইখানে বসিয়া পড়িয়া বলিল, নরেন তুই যা।
সেরাত্রে অনেক ডাকাডাকির পর বিন্দু খাইতে বসিয়া কোনমতেই হাত মুখে তুলিতে পারিল না, শেষে অসুখ করিতেছে বলিয়া উঠিয়া গেল। পরদিনও প্রায় উপবাস করিয়া পড়িয়া রহিল, অথচ কাহাকেও কোন কথা বলিতেও পারিল না, একটা উপায়ও খুঁজিয়া পাইল না। তাহার কেবলি ভয় করিতে লাগিল, পাছে কথা কহিলেই তাহার নিজের অপরাধ আরও বাড়িয়া যায়। অপরাহ্নে স্বামীর আহারের সময় অভ্যাসমত কাছে গিয়া বসিয়া অন্যদিকে চাহিয়া রহিল। কোনরূপ ভোজ্য পদার্থের দিকে কাল হইতে সে চাহিয়া দেখিতেও পারিল না।
ঘরে বাতি জ্বলিতেছে, মাধব নিমীলিত চোখে চুপ করিয়া পড়িয়া ছিলেন, বিন্দু আসিয়া পায়ের কাছে বসিল। মাধব চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, কি?
বিন্দু নতমুখে স্বামীর পায়ের একটা আঙুলের নখ খুঁটিতে লাগিল।
মাধব স্ত্রীর মনের কথাটা অনুমান করিয়া লইয়া আর্দ্র হইয়া বলিলেন,—আমি সমস্তই বুঝি বিন্দু, কিন্তু আমার কাছে কাঁদলে কি হবে? তাঁর কাছে যাও।
বিন্দু সত্যই কাঁদিতেছিল—বলিল, তুমি যাও।
আমি গিয়ে তোমার কথা বলব, দাদা শুনতে পাবেন না?
বিন্দু সে কথার জবাব না দিয়া বলিল—আমি ত বলচি, আমার দোষ হয়েচে—আমি ঘাট মানচি, তুমি তাঁদের বল গে।
আমি পারব না, বলিয়া মাধব পাশ ফিরিয়া শুইলেন।
বিন্দু আরও কতক্ষণ আশা করিয়া বসিয়া রহিল, কিন্তু মাধব কোন কথাই আর যখন বলিলেন না, তখন সে ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল; স্বামীর ব্যবহারে তাহার বুকের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একটা প্রস্তর-কঠিন ধিক্কার যোজন-ব্যাপী পর্বতের মত একনিমেষের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া গেল। আজ সে নিঃসংশয়ে বুঝিল, তাহাকে সবাই ত্যাগ করিয়াছে।
পরদিন প্রাতঃকালেই যাদব ছোটবধুর যাইবার অনুমতি দিয়া একখানি পত্র পাঠাইয়া দিলেন। বিন্দুর পিতা পীড়িত, সে যেন অবিলম্বে যাত্রা করে। বিন্দু সজল-চোখে গাড়িতে গিয়া উঠিল।
বামুনঠাকরুন গাড়ির কাছে আসিয়া বলিলেন, বাপকে ভালো দেখে শিগগির ফিরে এসো মা।
বিন্দু নামিয়া আসিয়া তাঁহার পদধূলি লইতেই তিনি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া পড়িলেন।
বিন্দুকে এমন নত, এমন নম্র হইতে কেহ কোনদিন দেখে নাই। পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইয়া বিন্দু কহিল,—না মেয়ে, যাই হোক, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে, বয়সে বড়—আশীর্বাদ কর, যেন আর ফিরতে না হয়, এই যাওয়াই যেন আমার শেষ যাওয়া হয়।
বামুনমেয়ে তদুত্তরে কিছুই বলিতে পারিলেন না—বিন্দুর শীর্ণ ক্লিষ্ট মুখখানির পানে চাহিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।
এলোকেশী উপস্থিত ছিলেন, খনখন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ও কি কথা ছোটবৌ? আর কারো বাপ-মায়ের কি অসুখ হয় না?
বিন্দু জবাব দিল না, মুখ ফিরাইয়া চোখ মুছিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল,—তোমাকেও নমস্কার করি ঠাকুরঝি—চললুম আমি।
ঠাকুরঝি বলিলেন, যাও দিদি, যাও। আমি ঘরে রইলুম, সমস্তই দেখতে শুনতে পারব।
বিন্দু আর কথা কহিল না, কোচম্যান গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
অন্নপূর্ণা বামুনঠাকরুনের মুখে এ কথা শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, ইতিপূর্বে কোন দিন বিন্দু অমূল্যকে ছাড়িয়া বাপের বাড়ি যায় নাই—আজ এক মাসের উপর হইল, সে একবার তাহাকে চোখের দেখা দেখিতে পায় নাই—তাহার দুঃখ অন্নপূর্ণা বুঝিলেন।
রাত্রে অমূল্য বাপের কাছে শুইয়া আস্তে আস্তে গল্প করিতেছিল।
নীচে প্রদীপের আলোকে কাঁথা সেলাই করিতে করিতে অন্নপূর্ণা সহসা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিলেন, ষাট! ষাট! যাবার সময় বলে গেল কিনা এই যাওয়াই যেন শেষ যাওয়া হয়! মা দুর্গা করুন, বাছা আমার ভালয় ভালয় ফিরে আসুক।
কথাটা শুনিতে পাইয়া যাদব উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, আগাগোড়াই কাজটা ভাল করনি বড়বৌ! আমার মাকে তোমরা কেউ চিনলে না!
অন্নপূর্ণা বলিলেন, সেও ত একবার দিদি বলে এল না! তার ছেলেকেও ত সে জোর করে নিয়ে যেতে পারত, তাও ত করলে না! সেদিন সমস্তদিন খাটুনির পর ঘরে ফিরে এলুম—উলটে কতকগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দিলে!
যাদব বলিলেন, আমার মায়ের কথা শুধু আমি বুঝি! কিন্তু বড়বৌ, এই যদি না মাপ করতে পারবে, বড় হয়েছিলে কেন? তুমিও যেমন, মাধুও তেমনি, তোমরা ধরে-বেঁধে বুঝি আমার মায়ের প্রাণটা বধ করলে!
অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
অমূল্য বলিল, বাবা, ছোটমা কেন আসবে না বলেচে?
অন্নপূর্ণা চোখ মুছিয়া বলিলেন, যাবি তোর ছোটমার কাছে?
অমূল্য ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
না কেন রে? ছোটমা তোর দাদামশায়ের বাড়ি গেছে, তুইও কাল যা!
অমূল্য চুপ করিয়া রহিল। যাদব বলিলেন, যাবি অমূল্য?
অমূল্য বালিশে মুখ লুকাইয়া পূর্বের মত মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, না।
কতকটা রাত্রি থাকিতেই যাদব কর্মস্থানে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেন। দিন পাঁচ-ছয় পরে এমনি এক শেষরাত্রে তিনি প্রস্তুত হইয়া অন্যমনস্কের মত তামাক টানিতেছিলেন।
অন্নপূর্ণা বলিলেন, বেলা হয়ে যাচ্ছে।
যাদব ব্যস্ত হইয়া হুঁকাটা রাখিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন,—আজ মনটা বড় খারাপ বড়বৌ, কাল রাত্রে আমার মা যেন ঐ দোরের আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছিলেন! দুর্গা! দুর্গা! বলিয়া তিনি বাহির হইয়া পড়িলেন।
সকালবেলা অন্নপূর্ণা ক্লান্তভাবে রান্নাঘরে কাজ করিতেছিলেন, ও-বাড়ির চাকর আসিয়া সংবাদ দিল, বাবু কাল রাতে ফরাসডাঙ্গায় চলে গেছেন—মা’র নাকি বড় ব্যামো। স্বামীর কথাটা স্মরণ করিয়া অন্নপূর্ণার বুক কাঁদিয়া উঠিলে—কি ব্যামো রে?
চাকর বলিল, তা জানিনে মা, শুনলুম কি-রকম অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে কি-রকম শক্ত অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েচে।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া যাদব খবর শুনিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, কত সাধ করে সোনার প্রতিমা ঘরে আনলুম বড়বৌ, জলে ভাসিয়ে দিলে? আমি এখনি যাব।
দুঃখে আত্মগ্লানিতে অন্নপূর্ণার বুক ফাটিতেছিল; অমূল্যর চেয়েও বোধ করি তিনি ছোটবৌকে ভালবাসিতেন। নিজের চোখ মুছিয়া, তিনি স্বামীর পা ধুইয়া দিয়া জোর করিয়া সন্ধ্যা করিতে বসাইয়া দিয়া, অন্ধকার বারান্দায় আসিয়া বসিয়া রহিলেন। খানিক পরেই বাহিরে মাধবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অন্নপূর্ণা প্রাণপণে বুক চাপিয়া ধরিয়া, দুই কানে আঙুল দিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া রহিলেন।
মাধব রান্নাঘরে অন্ধকার দেখিয়া, এ ঘরে ফিরিয়া আসিয়া অন্ধকারে অন্নপূর্ণাকে দেখিয়া শুষ্কস্বরে বলিল, বৌঠান, শুনেচ বোধ হয়?
অন্নপূর্ণা মুখ তুলিতে পারিলেন না।
মাধব কহিল, অমূল্যর যাওয়া একবার দরকার, বোধ করি শেষ সময় উপস্থিত হয়েচে।
অন্নপূর্ণা উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুকারিয়া উঠিলেন। যাদব ও-ঘর হইতে পাগলের মত ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন,—এমন হয় না মাধু! আমি বলছি হয় না! আমি জ্ঞানে-অজ্ঞানে কাউকে দুঃখ দিইনি, ভগবান আমাকে এ-বয়সে কখনো এমন শাস্তি দেবেন না।
মাধব চুপ করিয়া রহিল।
যাদব বলিলেন, আমাকে সব কথা খুলে বল্—আমি গিয়ে মাকে ফিরিয়া আনবো—তুই উতলা হস্নে মাধু—গাড়ি সঙ্গে আছে?
মাধব বলিল, আমি উতলা হইনি দাদা, আপনি নিজে কি-রকম কচ্চেন?
কিছুই করিনি। ওঠ বড়বৌ, আয় অমূল্য—
মাধব বাধা দিয়া বলিল, রাত্রিটা যাক না দাদা।
না না, সে হবে না—তুই অস্থির হ’সনে মাধু—গাড়ি ডাক্, নইলে আমি হেঁটে যাব।
মাধব আর কিছু না বলিয়া গাড়ি আনিলে চারজনেই উঠিয়া বসিলেন। যাদব বলিলেন, তার পরে?
মাধব কহিল, আমি ত ছিলুম না—ঠিক জানিনে। শুনলুম, দিন-চারেক আগে খুব জ্বরের ওপর ঘন ঘন মূর্ছা হয়, তার পরে এখন পর্যন্ত কেউ ওষুধ কি এক ফোঁটা দুধ অবধি খাওয়াতে পারেনি। ঠিক বলতে পারিনে কি হয়েচে, কিন্তু আশা আর নেই।
যাদব জোর দিয়া বলিয়া উঠিলেন, খুব আছে, একশ’বার আছে। মা আমার বেঁচে আছেন। মাধু, ভগবান আমার মুখ দিয়ে এই শেষ বয়সে মিথ্যে কথা বার করবেন না—আমি আজ পর্যন্ত মিথ্যে বলিনি।
মাধব তৎক্ষণাৎ অবনত হইয়া অগ্রজের পদধূলি মাথায় লইয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিল।
-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিষয়: বিবিধ
২৩৫৩ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন