বিন্দুর ছেলে-পাঁচ
লিখেছেন লিখেছেন ঝিঙেফুল ০৪ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৮:০৩:৩৫ রাত
ঠাকুরঝি দেখিতে বোকার মতন ছিলেন, কিন্তু সেটা ভুল। তিনি যেই দেখিলেন, নিঃসন্তান ছোটবৌর অনেক টাকা, তিনি তখ্খনি সেই দিকে ঢলিলেন, এবং প্রতি রাত্রে স্বামী প্রিয়নাথকে একবার করিয়া ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন, তোমার জন্যই আমার সব গেল। তোমার কাছে মিছিমিছি পড়ে না থেকে এখানে থাকলে আজ আমি রাজার মা। আমার এমন সোনার চাঁদ ফেলে কি আর ঐ কাল ভূতের মত ছেলেটাকে ছোটবৌ—, বলিয়া একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসের দ্বারা ঐ কাল ভূতের সমস্ত পরমায়ুটা নিঃশেষে উড়াইয়া দিয়া ‘গরীবের ভগবান আছেন’ বলিয়া উপসংহার করিয়া চুপ করিয়া শুইতেন। প্রিয়নাথও মনে মনে নিজের বোকামির জন্য অনুতাপ করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িতেন। এমনি করিয়া এই দম্পতিটির দিন কাটিতেছিল এবং ছোটবৌর প্রতি ঠাকুরঝির স্নেহ-প্রীতি বন্যার মত ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল।
আজ দুপুরবেলা তিনি বলিতেছিলেন, অমন মেঘের মত চুল ছোটবৌ, কিন্তু কোনদিন বাঁধতে দেখলুম না। আজ জমিদারের বাড়ির মেয়েরা বেড়াতে আসবে, এস, মাথাটা বেঁধে দিই।
বিন্দু বলিল, না ঠাকুরঝি, আমি মাথায় কাপড় রাখতে পারিনে, ছেলে বড় হয়েচে—দেখতে পাবে।
ঠাকুরঝি অবাক হইয়া বলিলেন, ও আবার কি কথা ছোটবৌ? ছেলে বড় বলে এ”স্ত্রী মানুষ চুল বাঁধবে না? আমার নরেন্দরনাথ ত শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আরো ছ’মাস বছরেকের বড়, তাই বলে কি আমি মাথা-বাঁধা ছেড়ে দেব!
বিন্দু বলিল, তুমি ছাড়বে কেন ঠাকুরঝি, নরেন বরাবর দেখে আসচে, ওর কথা আলাদা। কিন্তু অমূল্য হঠাৎ আজ আমার মাথায় খোঁপা দেখলে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। হয়ত চেঁচামেচি করবে, না কি করবে—ছি ছি, সে ভারি লজ্জার কথা হবে!
অন্নপূর্ণা হঠাৎ সেইদিক দিয়া যাইতেছিলেন, বিন্দুর দিকে চাহিয়া সহসা দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিলেন, তোর চোখ ছলছল করচে কেন রে ছোটবৌ? আয় ত, গা দেখি!
বিন্দু এলোকেশীর সামনে ভারি লজ্জা পাইয়া বলিল, কি রোজ রোজ গা দেখবে! আমি কি কচি খুকি, অসুখ করলে টের পাব না?
অন্নপূর্ণা বলিলেন, না, তুই বুড়ি। কাছে আয়, ভাদ্দর আশ্বিন মাস, দিনকাল বড় খারাপ।
বিন্দু বলিল, কক্ষণ যাব না। বলচি কিছু হয়নি, বেশ আছি তবু কাছে আয়!
অন্নপূর্ণা বলিলেন, দেখিস, ভাঁড়াস নে যেন! বলিয়া সন্দিগ্ধ-দৃষ্টিতে চাহিতে চাহিতে চলিয়া গেলেন।
এলোকেশী বলিল, বড়বৌর যেন একটু বায়ের ছিট্ আছে, না?
বিন্দু একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, ঐ-রকম ছিট্ যেন সকলের থাকে ঠাকুরঝি!
এলোকেশী চুপ করিয়া রহিল।
অন্নপূর্ণা কি একটা হাতে লইয়া সে পথেই ফিরিয়া যাইতেছিলেন, বিন্দু ডাকিয়া বলিল, দিদি, শোন শোন, খোঁপা বাঁধবে?
অন্নপূর্ণা ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইয়া এলোকেশীকে বলিলেন, আমি কত বলেচি ঠাকুরঝি, ওকে বলা মিছে। অত চুল তা বাঁধবে না, অত কাপড় গয়না তা পরবে না, অত রূপ তা একবার চেয়ে দেখবে না। ওর সব ছিষ্টিছাড়া মতিবুদ্ধি । ছেলেও হচ্চে তেমনি। সেদিন অমূল্য আমাকে কি বললে জানিস ছোটবৌ! বলে, কাপড় জামা পরে কি হয়? ছোটমারও অত আছে, পরে কি?
বিন্দু সগর্বে মুখ তুলিয়া হাসিয়া বলিল, তবে দেখ দিদি, ছেলেকে দশের একজন করে তুলতে হলে মায়ের এইরকম ছিষ্টিছাড়া মতিবুদ্ধির দরকার কি না! যদি ততদিন বেঁচে থাক দিদি, তা হলে দেখতে পাবে, দেশের লোকে দেখিয়ে বলবে, ঐ অমূল্যর মা। বলিতে বলিতেই তাহার চোখদুটি সজল হইয়া উঠিল।
অন্নপূর্ণা তাহা দেখিতে পাইয়া সস্নেহে বলিলেন, সেইজন্যই ত তোর ছেলের সম্বন্ধে কোন কথা আমরা কইনে । ভগবান তোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন, কিন্তু ঐ ছেলে বড় হবে, দশের একজন হবে, অত আশা আমরা মনে ঠাঁই দিইনে।
বিন্দু আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, কিন্তু ঐ একটি আশা নিয়ে আমি বেঁচে আছি দিদি। বাপ্রে! সহসা তাহার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়া উঠিল। সে লজ্জিত হইয়া জ়োর করিয়া হাসিয়া বলিল, না দিদি, ও আশায় যদি কোনদিন ঘা পড়ে ত আমি পাগল হয়ে যাব।
অন্নপূর্ণা নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তিনি ছোটজায়ের মনের কথাটা যে জানিতেন না, তাহা নহে, কিন্তু তাহার আশা-আকাঙ্ক্ষার এমন উগ্র প্রতিচ্ছবি কোনদিন নিজের মধ্যে এমন স্পষ্ট করিয়া উপলব্ধি করেন নাই। আজ তাঁহার চৈতন্য হইল, কেন বিন্দু অমূল্য সম্বন্ধে এমন যক্ষের মত সজাগ, এমন প্রেতের মত সতর্ক! নিজের পুত্রের এই সর্বমঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণীর মুখের দিকে চাহিয়া অনির্বচনীয় শ্রদ্ধার মাধুর্যে তাঁহার মাতৃহৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তিনি উদ্গত অশ্রু গোপন করিবার জন্য মুখ ফিরাইলেন।
ঠাকুরঝি বলিলেন, তা হোক ছোটবৌ, আজকে তোমার—
বিন্দু তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিল, হাঁ ঠাকুরঝি, আজ দিদির মাথাটা বেঁধে দাও—এ-বাড়িতে ঢুকে পর্যন্ত কখন দেখিনি। বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া চলিয়া গেল।
দিন পাঁচ-ছয় পরে একদিন সকালবেলা বাটীর পুরাতন নাপিত যাদবের ক্ষৌরকর্ম করিয়া উপর হইতে নামিয়া যাইতেছিল, অমূল্য আসিয়া তাহার পথরোধ করিয়া বলিল, কৈলাসদা, নরেনদার মত চুল ছাঁটতে পার?
নাপিত আশ্চর্য হইয়া বলিল, সে কি-রকম দাদাবাবু!
অমূল্য নিজের মাথার নানাস্থানে নির্দেশ করিয়া বলিল, দেখ, এইখানে বারো আনা, এইখানে ছ আনা, এইখানে দু আনা, আর এই ঘাড়ের কাছে এক্কেবারে ছোট ছোট। পারবে ছাঁটতে?
নাপিত হাসিয়া বলিল, না দাদা, ও আমার বাবা এলেও পারবে না।
অমূল্য ছাড়িল না। সাহস দিয়া কহিল, ও শক্ত নয় কৈলাসদা, এইখানে বারো আনা, এইখানে ছ আনা—
নাপিত নিষ্কৃতি-লাভের উপায় করিয়া বলিল, কিন্তু আজ কি বার? তোমার ছোটমা হুকুম না দিলে ত ছাঁটতে পারিনে দাদা!
অমূল্য বলিল, আচ্ছা দাঁড়াও, আমি জেনে আসি। বলিয়া এক পা গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আচ্ছা, তোমার ছাতিটা একবার দাও, না হলে তুমি পালিয়ে যাবে। বলিয়া জোর করিয়া সে ছাতিটা টানিয়া লইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। ঝড়ের মত ঘরে ঢুকিয়া বলিল, ছোটমা, শিগগির একবার এস ত?
ছোটমা সবেমাত্র স্নান সারিয়া আহ্নিকে বসিতেছিল, ব্যস্ত হইয়া বলিল, ওরে ছুঁসনে, ছুঁসনে, আহ্নিক কচ্চি।
আহ্নিক পরে ক’রো ছোটমা, একবারটি বাইরে এসে হুকুম দিয়ে যাও, নইলে চুল ছেঁটে দেয় না, সে দাঁড়িয়ে আছে।
বিন্দু কিছু আশ্চর্য হইল, তাহার চুল ছাঁটাইবার জন্য চিরদিন মারামারি করিতে হয়, আজ সে কেন স্বেচ্ছায় চুল ছাঁটিতে চাহিতেছে, বুঝিতে না পারিয়া সে বাহিরে আসিতেই নাপিত কহিল, বড় শক্ত ফরমাস হয়েচে মা, নরেনবাবুর মত বারো আনা, ছ আনা, তিন আনা, দু আনা, এক আনা, এমনি করে ছাঁটতে হবে, ও কি আমি পারব!
অমূল্য বলিল, খুব পারবে। আচ্ছা দাঁড়াও, আমি নরেনদাকে ডেকে আনি, বলিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। নরেন বাড়ি ছিল না, খানিক খোঁজাখুঁজি করিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, সে নেই, আচ্ছা নাই থাকল, ছোটমা, তুমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখিয়ে দাও—বেশ করে দেখো—এইখানে বারো আনা, এইখানে ছ আনা, এইখানে দু’আনা আর এইখানে খুব ছোট।
তাহার ব্যগ্রতা দেখিয়া বিন্দু হাসিয়া বলিল, আমি এখন আহ্নিক করব যে রে!
আহ্নিক পরে করো, নইলে ছুঁয়ে দেব।
বিন্দুকে অগত্যা দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল।
নাপিত চুল কাটিতে লাগিল। বিন্দু চোখ পিটিয়া দিল। সে সমস্ত চুল সমান করিয়া কাটিয়া দিল। অমূল্য মাথায় হাত বুলাইয়া খুশি হইয়া বলিল, এই ঠিক হয়েচে। বলিয়া লাফাইতে লাফাইতে চলিয়া গেল।
নাপিত ছাতি বগলে করিয়া বলিল, কিন্তু মা, কাল এ-বাড়ি ঢোকা আমার শক্ত হবে।
বামুনঠাকরুন ভাত দিয়া ডাকাডাকি করিতেছিল; বিন্দু রান্নাঘরের একধারে বসিয়া বাটিতে দুধ সাজাইতে সাজাইতে শুনিতে পাইল, অমূল্য বাড়িময় কাকার চুল আঁচড়াইবার বুরুশ খুঁজিয়া ফিরিতেছে। খানিক পরেই সে কাঁদিয়া আসিয়া বিন্দুর পিঠের উপর ঝুঁকিয়া পড়িল—কিচ্ছু হয়নি ছোটমা। সব খারাপ করে দিয়েছে—কাল তাকে আমি মেরে ফেলব।
বিন্দু আর হাসি চাপিতে পারিল না। অমূল্য পিঠ ছাড়িয়া দিয়া রাগে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, তুমি কি কানা? চোখে দেখতে পাও না?
অন্নপূর্ণা কান্নাকাটি শুনিয়া ঘরে ঢুকিয়া সমস্ত শুনিয়া বলিলেন, তার আর কি, কাল ঠিক করে কেটে দিতে বলব।
অমূল্য আরো রাগিয়া গিয়া বলিল, কাল কি করে বারো আনা হবে? এখানে চুল কৈ?
অন্নপূর্ণা শান্ত করিবার জন্য বলিলেন, বারো আনা না হোক, আট আনা দশ আনা হতে পারবে।
ছাই হবে। আট আনা দশ আনা কি ফ্যাশন? নরেনদাকে জিজ্ঞেস কর, বারো আনা চাই।
সেদিন অমূল্য ভাল করিয়া ভাত খাইল না, ফেলিয়া ছড়াইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।
অন্নপূর্ণা বলিলেন, তোর ছেলের টেরি বাগাবার শখ হ’ল কবে থেকে রে?
বিন্দু হাসিল, কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর হইয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, দিদি, তুচ্ছ কথা, তাই হাসচি বটে, কিন্তু ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে—সব জিনিসের শুরু এমনি করেই হয়।
অন্নপূর্ণা আর কথা কহিতে পারিলেন না।
দুর্গাপূজা আসিয়া পড়িল। ও-পাড়ার জমিদারদের বাড়ি আমোদ-আহ্লাদের প্রচুর আয়োজন হইয়াছিল। দুইদিন পূর্ব হইতেই নরেন তাহার মধ্যে মগ্ন হইয়া গেল। সপ্তমীর রাত্রে অমূল্য আসিয়া ধরিল, ছোটমা, যাত্রা হচ্ছে দেখতে যাব?
ছোটোমা বলিলেন, হচ্চে, না হবে রে?
অমূল্য বলিল, নরেনদা বলেচে, তিনটে থেকে শুরু হবে।
এখন থেকে সমস্ত রাত্তির হিমে পড়ে থাকবি? সে হবে না। কাল সকালে তোর কাকার সঙ্গে যাস, খুব ভাল জায়গা পাবি।
অমূল্য কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, না পাঠিয়ে দাও। কাকা হয়ত যাবেন না, নয়ত কত বেলায় যাবেন।
বিন্দু বলিল, তিনটে-চারটের সময় যাত্রা শুরু হলে চাকর দিয়ে পাঠিয়ে দেব, এখন শো।
অমূল্য রাগ করিয়া শয্যার এক প্রান্তে গিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া রহিল।
বিন্দু টানিতে গেল, সে হাত সরাইয়া দিয়া শক্ত হইয়া পড়িয়া রহিল। তার পর কিছুক্ষণের নিমিত্ত সকলেই বোধ করি একটু ঘূমাইয়া পড়িয়াছিল। বাহিরের বড় ঘড়ির শব্দে অমূল্যর উদ্বিগ্ন-নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল, সে উৎকর্ণ হইয়া গণিতে লাগিল, একটা—দুটো—তিনটে—চারটে—ধড়ফড় করিয়া সে উঠিয়া বসিয়া বিন্দুকে সজোরে নাড়া দিয়া তুলিয়া দিয়া বলিল, ওঠ ওঠ ছোটমা, তিনটে চারটে বেজে গেলো—বাহিরের ঘড়িতে বাজিতে লাগিল—পাঁচটা—ছটা—সাতটা—আটটা—অমূল্য কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, সাতটা আটটা বেজে গেল, কখন যাব? বাহিরের ঘড়িতে তখনও বাজিতে লাগিল—নটা—দশটা—এগারটা—বারটা; বাজিয়া থামিল। অমূল্য নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিয়া শুইল। ঘরের ও-ধারের খাটের উপর মাধব শয়ন করিতেন, চেঁচামেচিতে তাঁহারও ঘুম ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল।
উচ্চাহাস্য করিয়া তিনি বলিলেন, অমূল্য, কি হ’ল রে!
অমূল্য লজ্জায় সাড়া দিল না। বিন্দু হাসিয়া বলিল, ও যে করে আমাকে তুলেচে, ঘরে-দোরে আগুন ধরে গেলেও মানুষ অমন করে তোলে না। অমূল্য নিস্তব্ধ হইয়া আছে দেখিয়া তাহার দয়া হইল; সে বলিল, আচ্ছা যা, কিন্তু কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করিস নে।
তার পর ভৈরবকে ডাকিয়া আলো দিয়া পাঠাইয়া দিল। পরদিন বেলা দশটার সময় যাত্রা শুনিয়া হৃষ্টচিত্তে অমূল্য ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কাকাকে দেখিয়াই বলিল, কৈ, গেলেন না আপনি?
বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, কেমন দেখলি রে?
বেশ যাত্রা, ছোটমা। কাকা, আজ সন্ধ্যার সময় আবার চমৎকার খেমটার নাচ হবে।
কলকাতা থেকে দু’জন এসেচে, নরেনদা তাদের দেখেচে, ঠিক ছোটমার মত—খুব ভাল দেখতে—তারা নাচবে, বাবাকেও বলেচি।
বেশ করেচ, বলিয়া মাধব হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
রাগে বিন্দুর সমস্ত মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল—তোমার গুণধর ভাগ্নের কথা শোন।
অমূল্যকে কহিল, তুই একবারও আর ওখানে যাবি না—হারামজাদা বজ্জাত! কে বললে আমার মত, নরেন?
অমূল্য ভয়ে ভয়ে বলিল, হাঁ সে দেখেচে যে।
কৈ নরেন? আচ্ছা, আসুক সে।
মাধব হাসি দমন করিয়া বলিলেন, পাগল তুমি! দাদা শুনেছেন, আর গোলমাল করো না। কাজেই বিন্দু কথাটা নিজের মধ্যে পরিপাক করিয়া রাগে পুড়িতে লাগিল।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে অমূল্য আসিয়া অন্নপূর্ণাকে ধরিয়া বসিল, দিদি, পূজা-বাড়িতে নাচ দেখতে যাব। দেখে, এখনি ফিরে আসব।
অন্নপূর্ণা কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বলিলেন, তোর মাকে জিজ্ঞেস কর গে!
অমূল্য জিদ করিতে লাগিল, না দিদি, এখ্খনি ফিরে আসব, তুমি বল, যাই।
অন্নপূর্ণা বলিলেন, না রে না, সে রাগী মানুষ, তাকে বলে যা।
অমূল্য কাঁদিতে লাগিল, কাপড় ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল—তুমি ছোটমাকে বলো না।।আমি নরেনদার সঙ্গে যাই—এখনি ফিরে আসব।
অন্নপূর্ণা বলিলেন, নরেনের সঙ্গে যদি যাস ত—
অমূল্য কথাটা শেষ করিবারও সময় দিল না, এক দৌড়ে বাহির হইয়া গেল।
ঘণ্টা-খানেক পরে অন্নপূর্ণার কানে গেল, বিন্দু খোঁজ করিতেছে। তিনি চুপ করিয়া রহিলেন।খোঁজাখুঁজি ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। তখন তিনি বাহিরে আসিয়া বলিলেন, কি নাচ হবে, নরেনের সঙ্গে তাই দেখতে গেছে,—এখনি ফিরে আসবে, তোর কোন ভয় নেই।
বিন্দু কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে যেতে বলেছে, তুমি?
অমূল্য যে সম্মতি না লইয়াই গিয়াছে, এ কথা অন্নপূর্ণা ভয়ে স্বীকার করিতে পারিলেন না, বলিলেন, এখনি আসবে।
বিন্দু মুখ অন্ধকার করিয়া চলিয়া গেল। খানিক পরে অমূল্য বাড়ি ঢুকিয়া যাই শুনিল ছোটমা ডাকিতেছে, সে গিয়া তাহার পিতার শয্যার একধারে শুইয়া পড়িল।
প্রদীপের আলোকে বসিয়া চোখে চশমা আঁটিয়া যাদব ভাগবত পড়িতেছিলেন, মুখ তুলিয়া বলিলেন, কি রে অমূল্য?
অমূল্য সাড়া দিল না।
কদম আসিয়া বলিল, ছোটমা ডাকছেন, এস।
অমূল্য তাহার পিতার কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল, বাবা, তুমি দিয়ে আসবে চল না।
যাদব বিস্মিত হইয়া বলিলেন, আমি দিয়ে আসব? কি হয়েছে কদম?
কদম বুঝাইয়া বলিল।
যাদব বুঝিলেন, এই লইয়া একটা কলহ অবশ্যম্ভাবী। একজন নিষেধ করিয়াছে, একজন হুকুম দিয়াছে। তাই অমূল্যকে সঙ্গে করিয়া ছোটবধূর ঘরের বাহিরে দাঁড়াইয়া ডাকিয়া বলিলেন, এইবারটি মাপ কর মা, ও বলচে আর করবে না।
সেই রাত্রে দুই জায়ে আহারে বসিলে বিন্দু বলিল, আমি তোমার উপর রাগ কচ্চিনে দিদি, কিন্তু এখানে আমার আর থাকা চলবে না—অমূল্য তা হলে একেবারে বিগড়ে যাবে। আমি যদি মানা না করতুম, তা হলেও একটা কথা ছিল; কিন্তু নিষেধ করা সত্ত্বেও, এত বড় সাহস ওর হল কি করে, তখন থেকে আমি শুধু এই কথাই ভাবচি। তার ওপর বজ্জাতি বুদ্ধি দেখ! আমার কাছে যায়নি, এসেছে তোমার কাছে; বাড়ি ফিরে যাই শুনেচে আমি ডাকচি, অমনি গিয়ে বঠ্ঠাকুরকে সঙ্গে করে এনেচে। না দিদি, এতদিন এ-সব ছিল না—আমি বরং কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকব সেও ভাল, কিন্তু এক ছেলে—ব’য়ে যাবে, তাকে নিয়ে সারা জীবন আমি চোখের জলে ভাসতে পারব না।
অন্নপূর্ণা উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলেন, তোরা চলে গেলে আমিই বা কি করে একলা থাকি বল্!
বিন্দু ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সে তুমি জান। আমি যা করব, তোমাকে বলে দিলুম। বড় মন্দ ছেলে ঐ নরেন।
কেন, কি করলে নরেন? আর মনে কর, ওরা যদি দুটি ভাই হ’ত, তা হলে কি কত্তিস?
বিন্দু বলিল, আজ তা হলে চাকর দিয়ে হাত-পা বেঁধে জলবিছুটি দিয়ে বাড়ি থেকে দূর করে দিতুম। তা ছাড়া, ‘যদি’ নিয়ে কাজ হয় না, দিদি—ওদের তুমি ছাড়।
অন্নপূর্ণা মনে মনে বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, ছাড়া না ছাড়া কি আমার হাতে ছোটবৌ? যে ওদের এনেচে, তাকে বল গে। আমাকে মিথ্যে গঞ্জনা দিসনে।
এ-সব কথা বঠ্ঠাকুরকে বলব কি করে?
যেমন করে সব কথা বলিস—তেমনি করে বল গে।
বিন্দু ভাতের থালাটা ঠেলিয়া দিয়া বলিল, ন্যাকা বুঝিয়ো না দিদি, আমারো সাতাশ-আটাশ বছর বয়স হতে চলল। এ বাড়ির দাসী-চাকর নিয়ে কথা নয়, কথা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে—তুমি বেচেঁ থাকতে এ-সব কথায় কথা বলতে গেলে বঠ্ঠাকুর রাগ করবেন না?
অন্নপূর্ণা বলিলেন, রাগ নিশ্চয়ই করবেন, কিন্তু আমি বললে আমার আর মুখ দেখবেন না। হাজার হই আমরা পর, ওরা ভাই-বোন—সেটা দেখিস না কেন? তা ছাড়া আমি বুড়ো মাগী, এই তুচ্ছ কথা নিয়ে নেচে বেড়ালে লোকে পাগল বলবে না?
বিন্দু ভাতের থালাটা হাত দিয়া আরো খানিকটা ঠেলিয়া দিয়া গুম হইয়া বসিয়া রহিল।
অন্নপূর্ণা বুঝিলেন, সে কেবল ভাশুরের ভয়ে চুপ করিয়া গেল। বলিলেন, হাত তুলে বসে রইলি—ভাতের থালাটা কি অপরাধ করলে?
বিন্দু হঠাৎ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
অন্নপূর্ণা তাহার ভাব দেখিয়া আর জিদ করিতে সাহস করিলেন না।
শুইতে গিয়া বিন্দু বিছানায় অমূল্যকে দেখিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, সে গেল কোথায়?
অন্নপূর্ণা বলিলেন, আজ দেখচি আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্চে—যাই, তুলে দিই গে।
না না, থাক, বলিয়া বিন্দু মুখ অন্ধকার করিয়া চলিয়া গেল।
অর্ধেক রাত্রে, বিন্দুর সতর্ক নিদ্রা অন্নপূর্ণার ডাকে ভাঙ্গিয়া গেল।
কি দিদি?
অন্নপূর্ণা বাহির হইতে বলিলেন, দোর খুলে তোর ছেলে নে। এত বজ্জাতি আমার বাবা এলেও সইতে পারবে না।
বিন্দু দোর খুলিয়া দিতেই তিনি অমূল্যকে সঙ্গে করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই বলিলেন, ঢের হারামজাদা ছেলে দেখেচি ছোটবৌ, এমনটি দেখিনি। রাত্তির দুটো বাজে, একবার চোখে পাতায় কত্তে দিলে না। এই বলে খিদে পেয়েচে, এই বলে মশা কামড়াচ্চে, এই বলে জল খাব, এই বলে বাতাস কর—না ছোটবৌ, আমি সমস্তদিন খাটিখুটি, রাত্রিতে একটু ঘুমোতে না পেলে ত বাঁচিনে।
বিন্দু হাসিয়া হাত বাড়াইতেই অমূল্য তাহার ক্রোড়ের ভিতর গিয়া ঢুকিল এবং বুকের উপর মুখ রাখিয়া এক মিনিটের মধ্যে ঘুমাইয়া পড়িল।
মাধব ওদিকে বিছানা হইতে পরিহাস করিয়া কহিলেন, শখ মিটল বৌঠান?
অন্নপূর্ণা বলিলেন, আমি শখ করিনি ভাই, উনিই নিজ়ে মারের ভয়ে ওখানে গিয়ে ঢুকেছিলেন। তবে আমারও শিক্ষা হ’ল বটে। আর কি ঘেন্নার কথা ঠাকুরপো, আমাকে বলে কিনা তোমার কাছে শুতে লজ্জা করে।
তিনজনেই হাসিয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা বলিলেন, আর না, যাই একটু ঘুমোই গে, বলিয়া চলিয়া গেলেন।
দিন-দশেক পরে বিন্দুর বাপ-মা তীর্থযাত্রার সঙ্কল্প করিয়া মেয়েকে একবার দেখিবার জন্য পালকি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। বিন্দু বড় জায়ের অনুমতি লইয়া দু-তিন দিনের জন্য অমূল্যকে লুকাইয়া বাপের বাড়ি যাইবার জন্য উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময় বই বগলে করিয়া ইস্কুলের জন্য প্রস্তুত হইয়া অমূল্য আসিয়া উপস্থিত হইল।
অনতিপূর্বে সে বাহিরে পথের ধারে একটা পালকি দেখিয়া আসিয়াছিল; এখন হঠাৎ পায়ের দিকে নজর পড়িতেই সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, পায়ে আলতা পরেচ কেন ছোটমা?
অন্নপূর্ণা উপস্থিত ছিলেন, হাসিয়া ফেলিলেন।
বিন্দু বলিল, আজ পরতে হয়।
অমূল্য বার বার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, গায়ে এত গয়না কেন?
অন্নপূর্ণা মুখে আঁচল দিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
বিন্দু হাসি চাপিয়া বলিল, কবে তোর বৌ এসে পরবে বলে আমাদের কাউকে কিছু পরতে নেই রে! যা, ইস্কুলে যা।
অমূল্য সে কথা কানে না তুলিয়া বলিল, দিদি অত হাসচে কেন? আমি ত আর ইস্কুলে যাব না—তুমি কোথায় যাবে
বিন্দু বলিল, তাই যদি যাই, তোর হুকুম নিতে হবে নাকি?
আমিও যাব, বলিয়া সে বই লইয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, ও যে অত সহজে ইস্কুলে যাবে, মনে করিনি। কিন্তু কি সেয়ানা দেখেছিস, বলে আলতা পরেচ কেন? গায়ে অত গয়না কেন? কিন্তু আমি বলি নিয়ে যা—নইলে ফিরে এসে তোকে দেখতে না পেলে ভারি হাঙ্গামা করবে।
বিন্দু বলিল, তুমি কি মনে করেচ দিদি, সে ইস্কুলে গেছে? কক্ষণো না। কোথায় লুকিয়ে বসে আছে, দেখো, ঠিক সময়ে হাজির হবে।
ঠিক তাহাই হইল। সে লুকাইয়া ছিল, বিন্দু অন্নর্পূণার পায়ের ধূলা লইয়া পালকিতে উঠিবার সময় কোথা হইতে বাহির হইয়া তাহার আঁচল ধরিয়া দাঁড়াইল। দুই জায়েই হাসিয়া উঠিলেন।
অন্নর্পূণা বলিলেন, যাবার সময় আর মারধর করিস্ নে, নিয়ে যা।
বিন্দু বলিল, তা যেন গেলুম দিদি, কিন্তু কোথাও যে আমার এক-পা নড়বার জো নাই, এ ত বড় বিপদের কথা!
অন্নর্পূণা বলিলেন, যেমন করেচিস, তেমনি হবে তো! অমূল্য, থাক না তুই দু’দিন আমার কাছে।
অমূল্য মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, তোমার কাছে থাকতে পারব না। বলিয়া আগেই সে পালকিতে গিয়া বসিল।
-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিষয়: বিবিধ
১৯৫৫ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন