বিন্দুর ছেলে-চার
লিখেছেন লিখেছেন ঝিঙেফুল ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:৩৭:৩০ রাত
ইঁহাদের পিসতুতো বোন এলোকেশীর অবস্থা ভাল ছিল না। যাদব তাঁহাকে প্রায়ই অর্থসাহায্য করিয়া পাঠাইতেন। কিছুদিন হইতে তিনি তাঁহার পুত্র নরেনকে এইখানে রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইবার ইচ্ছা জানাইয়া চিঠিপত্র লিখিতেছিলেন, এই সময়ে তিনি ছেলে লইয়া উত্তরপাড়া হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার স্বামী প্রিয়নাথ সেখানে কি করিতেন, তাহা ঠিক করিয়া কেহই বলিতে পারে না, দিন-দুয়ের মধ্যে তিনিও আসিয়া পড়িলেন। নরেনের বয়স ষোল-সতের। সে চওড়া পাড়ের কাপড় ফের দিয়া পরিত এবং দিনের মধ্যে আট-দশবার চুল আঁচড়াইত। টেরিটা তাহার বাস্তবিকই একটা দেখিবার বস্তু ছিল।
আজ সন্ধ্যার পর রান্নাঘরের বারান্দায় সকলে একত্রে বসিয়াছেলেন এবং এলোকেশী তাঁহার পুত্রের অসাধারণ রূপ-গুণের পরিচয় দিতেছেলেন।
বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, নরেন, কোন্ ক্লাসে পড় তুমি?
নরেন বলিল, ফোর্থ ক্লাস। রয়েল রিডার, গ্রামার, জিয়োগ্রাফি, এরিথ্মেটিক, আরো কত কি ডেসিমেল্-টেসিমেল্—ও-সব তুমি বুঝবে না মামী।
এলোকেশী সগর্বে পুত্রের মুখের দিকে একবার চাহিয়া বিন্দুকে বলিলেন, সেকি এক-আধখানা বই, ছোটবৌ? বইয়ের পাহাড়; কাল বইগুলো বাক্স থেকে বার করে তোমার মামীদের একবার দেখিও ত বাবা!
নরেন ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা দেখাব।
বিন্দু বলিল, পাস করতে এখনো ত দেরি আছে।
এলাকেশী বলিলেন, দেরি কি থাকত ছোটবৌ, দেরি থাকত না। এতদিনে একটা কেন, চারটে পাস করে ফেলতো। শুধু মুখপোড়া মাস্টারের জন্যই হচ্ছে না। তার সর্বনাশ হোক, বাছাকে সে যে কি বিষ-নজরেই দেখেচে, তা সেই জানে। ওকে কি তুলে দিচ্চে? দিচ্চে না। হিংসে করে বছরের পর বছর একটা কেলাসেই ফেলে রেখেচে।
বিন্দু বিস্মিত হইয়া কহিল, কৈ, এ-রকম ত হয় না!
এলোকেশী বলিলেন, হচ্চে, আবার হয় না! মাস্টারগুলো সব একজোট হয়ে ঘুষ চায়; আমি গরীব মানুষ, ঘুষের টাকা কোথা থেকে যোগাই বল ত?
বিন্দু চুপ করিয়া রহিল। অন্নপূর্ণা আন্তরিক দুঃখিত হইয়া বলিলেন, এমন করে কি কখন মানুষের পিছনে লাগতে আছে? সেটা কি ভাল কাজ? কিন্তু আমাদের এখানে ও-সব নেই। আমাদের অমূল্য ত ফি বছর ভাল ভাল বই প্রাইজ ঘরে আনে, কিন্তু কখ্খন ঘুষটুষ দিতে হয় না।
এই সময় অমূল্য কোথা হইতে আসিয়া আস্তে আস্তে তাহার ছোটমার কোলে গিয়া বসিল। বসিয়াই গলা ধরিয়া কানে কানে বলিল, কাল রবিবার, ছোটমা, আজ মাস্টারমশায়কে যেতে বলে দাও না।
বিন্দু হাসিয়া বলিল, এই যে ছেলেটি দেখচ ঠাকুরঝি, এটি গল্প পেলে আর উঠবে না—কদম, মাস্টারমশায়কে যেতে বলে দে, অমূল্য আজ আর পড়বে না।
নরেন আশ্চর্য হইয়া বলিল, ও কি রে অমূল্য, অত বড় ছেলে, এখনও মেয়েমানুষের কোলে গিয়ে বসিস!
বিন্দু হাসিয়া বলিল, শুধু এই বুঝি? এখনও রাত্তিরে—
অমূল্য ব্যাকুল হইয়া তাহার মুখে হাত-চাপা দিয়া বলিল, ব’লো না ছোটমা, ব’লো না।
বিন্দু বলিল না, কিন্তু অন্নপূর্ণা বলিয়া দিলেন। বলিলেন, এখনো ও রাত্তিরে ছোটমার কাছে শোয়।
বিন্দু বলিল, শুধু শোয়া দিদি, এখনো সমস্ত রাত্তির বাদুড়ের মত আঁকড়ে ধরে ঘুমোয়।
অমূল্য লজ্জায় তাহার ছোটমার বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া রহিল।
নরেন কহিল, ছি ছি, তুই কি রে! তুই ইংরাজী পড়িস?
অন্নপূর্ণা বলিলেন, পড়ে বৈ কি। ইস্কুলে ও ত ইংরাজীই পড়ে।
নরেন বলিল, ইস, ইংরাজী পড়ে! কৈ, ইন্জিন্ বানান করুক ত দেখি? তা আর পারতে হয় না।
এলোকেশী বলিলেন, ও-সব শক্ত শক্ত কথা, ও কি ছেলেমানুষে পারে?
অন্নপূর্ণা বলিলেন, কৈ অমূল্য বানান কর না?
অমূল্য কিন্তু কিছুতেই মুখ তুলিল না।
বিন্দু তাহার মাথাটা একবার বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিল, তোমরা সবাই মিলে ওকে লজ্জা দিলে ও আর কি করে বানান করে?
তারপর এলোকেশীর দিকে চাহিয়া বলিল, ও আমার আসচে বছর পাস দেবে। আমাদের মাস্টারমশাই বলেচেন, ও কুড়ি টাকা জলপানি পাবে। ও সেই টাকা দিয়ে ওর কাকার মত এক জোড়া ঘোড়া কিনবে।
কথাটা সত্য হইলেও পরিহাস-ছলে সবাই হাসতে লাগিলেন।
এলোকেশী বিন্দুকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আমার নরেন্দ্রনাথ শুধু কি লেখা-পড়াতেই ভাল, ও এমনি থিয়েটারে অ্যাক্টো করে যে, লোকে শুনে আর চোখে জল রাখতে পারে না। সেই সীতা সেজে কি-রকমটি করে বলেছিলে, একবার মামীদের শুনিয়ে দাও ত বাবা!
নরেন তৎক্ষণাৎ হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া হাতজোড় করিয়া, উচ্চ নাকিসুরে সুর করিয়া আরম্ভ করিয়া দিল, প্রাণেশ্বর! কি কুক্ষণে দাসী তব—
বিন্দু ব্যাকুল হইয়া উঠিল,—ওরে থাম থাম, চুপ কর, বঠ্ঠাকুর ওপরে আছেন। নরেন চমকিয়া চুপ করিল।
অন্নপূর্ণা ঐটুকু শুনিয়াই মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন, বলিলেন, শুনলেই বা ঠাকুর-দেবতার কথা, এ ত ভাল কথা ছোটবৌ।
বিন্দু বিরক্ত হইয়া বলিল, তবে শোন তুমি ঠাকুর-দেবতার কথা, আমরা উঠে যাই।
নরেন বলিল, আচ্ছা, তবে থাক, আমি সাবিত্রীর পার্ট করি।
বিন্দু বলিল, না।
এই কণ্ঠস্বর শুনিয়া এতক্ষণে অন্নপূর্ণার চৈতন্য হইল যে, ব্যাপারটা অনেক দূরে গিয়াছে এবং এইখানেই তাহার শেষ হইবে না। এলোকেশী নূতন লোক, তিনি ভিতরের কথা বুঝিলেন না, বলিলেন, আচ্ছা এখন থাক। পুরুষেরা বেরিয়ে গেলে সে একদিন দুপুরবেলা হতে পারবে। আহা গান-বাজনাই কি ও কম শিখেচে? দময়ন্তীর সেই কেঁদে কেঁদে গানটি একবার বলিস ত বাবা, তোর মামীরা শুনলে আর ছাড়তে চাইবে না।
নরেন বলিল, এখনি বলব?
রাগে বিন্দুর সর্বাঙ্গ জ্বালা করিতেছিল, সে কথা কহিল না।
অন্নপূর্ণা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, না না, গান-টান এখন কাজ নেই।
নরেন বলিল, আচ্ছা, গানটা আমি অমূল্যকে শিখিয়ে দেব। আমি বাজাতেও জানি। ত্রেকেটে তাক্ বাজনা বড় শক্ত মামী, আচ্ছা, ঐ পেতলের হাঁড়িটা একবার দাও ত দেখিয়ে দিই।
বিন্দু অমূল্যকে উঠিবার ইঙ্গিত করিয়া বলিল, যা অমূল্য ঘরে গিয়ে পড় গে।
অমূল্য মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল, তাহার উঠিবার ইচ্ছা ছিল না, চুপি চুপি বলিল, আরো একটু বোস না ছোটমা।
বিন্দু কোন কথা না বলিয়া তাহাকে তুলিয়া দিয়া সঙ্গে করিয়া ঘরে চলিয়া গেল। সহসা সে কেন যে অমন করিয়া গেল, অন্নপূর্ণা তাহা বুঝিলেন এবং পাছে সঙ্গদোষে অমূল্য বিগড়াইয়া যায়, এই ভয়ে নরেনের এইখানে থাকিয়া লেখাপড়াও যে সে পছন্দ করিবে না, ইহা সুস্পষ্ট বুঝিয়া তিনি উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, বাবা নরেন, তোমার ছোটমামীর সামনে ঐ অ্যাক্টো-ট্যাক্টোগুলো আর ক’রো না। ও রাগী মানুষ, ও-সব ভালবাসে না।
এলোকেশী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ছোটবৌ ও-সব ভালবাসে না বুঝি? তাই অমন করে উঠে গেল বটে।
অন্নপূর্ণা বলিলেন, হতেও পারে। আরো একটা কথা বাবা, তুমি নিজের খাবে-দাবে পড়াশুনা করবে—যাতে মায়ের দুঃখ ঘোচে, সেই চেষ্টা করবে, তুমি অমূল্যর সঙ্গে বেশী মিশো না বাবা। ও ছেলেমানুষ, তোমার চেয়ে অনেক ছোট।
কথাটা এলোকেশীর ভাল লাগিল না। বলিলেন, সে ত ঠিক কথা, ও গরীবের ছেলে, ওর গরীবের মত থাকাই উচিত। তবে যদি বললে ত বলি, বড়বৌ, অমূল্যটিই তোমার কচি খোকা, আর আমার নরেনই কি বুড়ো? এক-আধ বছরের ছোট-বড়োকে আর বড় বলে না। আর ও-কি কখনও বড়োলোকের ছেলে চোখে দেখেনি গা, এইখানে এসে দেখচে? ওদের থিয়েটারের দলে কত রাজা-রাজড়ার ছেলে রয়েচে যে!
অন্নপূর্ণা অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, না ঠাকুরঝি, সে কথা বলিনি, আমি বলচি—
আবার কি করে বলবে বড়বৌ? আমরা বোকা বলে কি এতই বোকা, যে এ কথাটাও বুঝিনে! তবে দাদা নাকি বললেন, নরেন এইখানেই লেখাপড়া করবে, তাই আসা, নইলে আমাদেরও কি দিন চলছিল না!
অন্নপূর্ণা লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিলেন, ভগবান জানেন ঠাকুরঝি, আমি সে কথা বলিনি, আমি বলচি কি, এই যাতে মায়ের দুঃখ-কষ্ট ঘোচে, যাতে—
এলোকেশী বলিলেন, আচ্ছা, তাই, তাই। যা নরেন, তুই বাইরে গিয়ে বস গে, বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশিস নে। বলিয়া ছেলেকে ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া নিজেও চলিয়া গেলেন।
অন্নপূর্ণা ঝড়ের মত বিন্দুর ঘরে ঢুকিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, হাঁ লা, তোর জন্যে কি কুটুম-কুটম্বিতেও বন্ধ করতে হবে? কি করে চলে এলি বল ত?
বিন্দু অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিল, কেন বন্ধ করতে হবে দিদি, আত্মীয়-কুটুম্ব নিয়ে তুমি মনের সুখে ঘর কর, আমি ছেলে নিয়ে পালাই, এই!
পালাবি কোথায় শুনি?
বিন্দু কহিল, যাবার দিন তোমায় ঠিকানা বলে যাব, ভেবো না।
অন্নপূর্ণা বলিলেন, সে আমি জানি। যাতে পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না, সে কি তুই না করেই ছাড়বি? চিরকালটা এই বৌ নিয়ে আমার হাড়মাস জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। বলিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, মাধবকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া আবার জ্বলিয়া উঠিলেন, না ঠাকুরপো, তোমরা আর কোথাও গিয়ে থাক গে, না হয়, ঐ বৌটিকে বিদেয় কর, আমি আর রাখতে পারব না, আজ তা পষ্ট বলে গেলুম, বলিয়া চলিয়া গেলেন।
মাধব আশ্চর্য হইয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি?
বিন্দু বলিল, জানিনে, বড়গিন্নী বলেচে, দাও আমাদের বিদেয় করে।
মাধব আর কিছু বলিল না। টেবিলের উপর হইতে খবরের কাগজটা তুলিয়া লইয়া বহিরের ঘরে চলিয়া গেল।
-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিষয়: বিবিধ
২০০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন