নক্সী কাঁথার মাঠ - এগার

লিখেছেন লিখেছেন ঝিঙেফুল ২৭ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:২৪:১৪ সকাল

সাজ সাজ বলিয়ারে শহরে পৈল সাড়া

সাত হাজার বাজে ঢোল চৌদ্দ হাজার কাড়া।

প্রথমে সাজিল মর্দ আহ্লাদি ডগরী,

পাঁচ কাঠা ভূঁই জুইড়া বসে মর্দ এয়সা ভারি।

তারপরে, সাজিল ,মর্দ তুরুক আমানি,

সমুদ্দুরে নামলে তার হৈত আটুঁপানি।

তারপরে সাজিল মর্দ নামে লোহাজুড়ী

আছড়াইয়া মারত সে হাতীর শুঁড় ধরি।

তারপরে সাজিল মর্দ নামে আইন্দ্যা ছাইন্দ্যা,

বাইশ মণ তামাক নেয় তার লেংটির মধ্যে বাইন্ধ্যা।

তারপরে সাজিল মর্দ নামে মদন ঢুলি,

বাইশ মণ পিতল তার ঢোলের চারটা খুলী।

আতালী পাতালী সাজে গগনেরী ঠাটা,

মেঘনাল সাজিয়া আইল তাম তুরুকের বেটা।

তুগুলি মুগুলি সাজে তারা দুই ভাই,

ঐরাবতে সাইজা আইল আজদাহা সেপাই।

বন্দুকি বন্দুকি চলে কামানে কামান,

ময়ূর-ময়ুরী চলে ধরিয়া পয়গাম।



- মহরমের জারী

.

"ও রুপা তুই করিস্‌ কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?

বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে।"

"কি বলিলা বছির মামু?" উঠল রুপাই হাঁক ছাড়িয়া,

আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া।

.

পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে,

বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে!

লম্ফে রুপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা,

ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা।

কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা,

সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া?

বন-গোঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরে গফর-গাঁয়ে,

এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান্‌ গোরের ছায়ে?

'আলী-আলী' হাঁকল রুপাই, হুঙ্কারে তার গগন ফাটে,

হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে।

ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রুপার বাড়ি;

আকাশ হতে ভাঙছে ঠাটা, মেঘে মেঘে লাগছে বাড়ি।

ডাক শুনে তার আস্‌ল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা,

আস্‌ল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আচঁড় দিয়া।

আস্‌ল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পরি,

এক নিমিষে গাঁয়ের লোকে রুপার বাড়ি ফেলল ভরি।

লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে,

এক লাঠিতে একশ লোকের মাথা যে জন আস্‌ল দলে।

দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী,

গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি।

.

গর্জি উঠে গদাই ভুঁঞা, মোহন ভূঁঞার ভাজন বেটা,

যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা।

সব গাঁর লোক এক হল আজ রুপার ছোট উঠান পরে,

নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ খেলানো বাঁশীর স্বরে।

.

রুপা তখন বেড়িয়ে তাদের বলল, "শোন ভাই সকলে,

গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে।"

বছির মামু বলছে খবর - মোল্লারা সব কালকে নাকি;

আধেক জমির ধান কেটেছে, আধেক আজও রইছে বাকি।

"মোদের খেতে ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায়;

আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায়।"

থামল রুপাই - ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া,

নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া।

গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ার লাঠি,

রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি।

.

রুপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, "থাল বাজারে থাল বাজারে,

থাল বাজারে সড়কি ঘুরা হান্‌রে লাঠি এক হাজারে।

হান্‌রে লাঠি-হান্‌রে কুঠার, গাছের ছ্যান আর রাম-দা-ঘুরা,

হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয়রে তোরা।"

"আলী! আলী! আলী!! আলী!!!" রুপার যেন কন্ঠ ফাটি,

ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপ্‌ছে আকাশ কাঁপছে মাটি।

তারি সুরে সব লেঠেলে লাঠির পরে হানল লাঠি,

"আলী-আলী" শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি।

.

আগে আগে ছুটল রুপা - বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে,

কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে

চল্‌ল পাছে হাজার লেঠেল "আলী-আলী" শব্দ করি,

পায়ের ঘায়ে মাঠের ধুলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি।

চল্‌ল তারা মাঠ পেরিয়ে চল্‌ল তারা বিল ডিঙিয়ে

কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে।

চল্‌ল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়,

বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূলি পথ ভরি হায়।

.

দুপুর বেলা এল রুপাই গাজনা চরের মাঠের পরে,

সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে।

লম্ফে রুপা শূন্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে,

থাক্‌ল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে।

মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে,

"আলী! আলী!!" শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে।

হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় "আলী আলী হজরত আলী,"

সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি!

তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান,

"আলী আলী" শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান!

সামনে চেয়ে দেখল রুপা সার বেঁধে সব আসছে তারা,

ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া।

রুপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে,

তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও হটে নানান কলে।

.

এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন,

রুপা বলে, "এমন করে 'কাইজা' করা হয় না কখন।"

.

তাল ঠুঁকিয়া ছুটল রুপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি,

"আলী-আলী-হজরত আলী" কন্ঠ তাদের যায় যে ফাটি।

তাল ঠুঁকিয়ে পড়ল তারা বন-গেঁয়োদের দলের মাঝে,

লাঠির আগায় লাগল লাঠি, লাঠির আগায় সড়কি বাজে।

'মার মার মার' হাঁকল রুপা, - 'মার মার মার' ঘুরায় লাঠি,

ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি।

আজ যেন সে মৃত্যু-জনম ইহার অনেক উপরে উঠে,

জীবনের এক সত্য মহান লাঠির আগায় নিচ্ছে লুটে।

মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে,

মহাকালের বাজছে বিষাণ আজকে ধরার প্রলয় কালে।

নাচে রুপা-নাচে রুপা-লোহুর গাঙে সিনান করি,

মরণরে সে ফেলছে ছুঁড়ে রক্তমাখা হস্তে ধরি।

নাচে রুপা - নাচে রুপা - মুখে তাহার অট্টহাসি,

বক্ষে তাহার রক্ত নাচে, চক্ষে নাচে অগ্নিরাশি।

-হাড়ে হাড়ে নাচন তাহার, রোমে রোমে লাগছে নাচন

কি যেন সে দেখেছে আজ, রুধ্‌তে নারে তারি মাতন।

বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রুপার লোকও ফিরল বহু,

রুপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাস্‌ছে লোহু।

.

- জসীমউদ্দীন

বিষয়: বিবিধ

১২৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File