নক্সী কাঁথার মাঠ - আট

লিখেছেন লিখেছেন ঝিঙেফুল ২৪ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:২৯:৪৪ সকাল

"কি কর দুল্যাপের মালো; বিভাবনায় বসিয়া,

আসতাছে বেটীর দামান ফুল পাগড়ী উড়ায়া নারে।"

"আসুক আসুক বেটীর দামান কিছুর চিন্তা নাইরে,

আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটী নারে।

সেই ঘরেতে নাগায়া থুইছি মোমের সস্র বাতি,

বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতী হাতী নারে।"


- মুসলমান মেয়েদের বিবাহের গান

.

বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি,

কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্ , লোক হয়েছে ভারি।

গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি ;

বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি।

কেতাব পড়ার উঠল তুফান ; ---চম্পা কালু গাজী,

মামুদ হানিফ সোনবান ও জয়গুন বিবি আজি ;

সবাই মিলে ফিরছে যেন হাত ধরাধর করি।

কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি।

পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি,

পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি।

.

কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুনছে পেতে কান,

জুমজুমেরি পানি যেন করছে তারা পান!

দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়,

লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখিটির প্রায়।

কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ,

মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ !

স্বপ্ন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে ;

মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে ;

আকাশেরি চাঁদ সূরুজে মুখ দেখে পায় লাজ,

সেই কনেরে চোখের কাছে দেখছে চাষী আজ।

দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে,

রক্ত যাহার জমছে আজো সন্ধ্যা মেঘের গোরে ;

কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান ;

সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান।

.

উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে,

রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে।

কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে,

ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে ;

তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে,

ভাঙ্গা গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে।

বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ ;

সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন।

বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখছে জনে জনে ;

ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠছে রূপার মনে।

ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার "জোড়া জামা" গায়,

তেল-কুচ্-কাচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায়।

.

বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক,

নতুন দুলার রূপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক।

এমন সময় শোর উঠিল--- "বিয়ের যোগাড় কর,

জলদী করে দুলার মুখে পান শরবত ধর।"

সাজুর মামা খটকা লাগায়, "বিয়ের কিছু গৌণ,

সাদার পাতা আনেনি তাই বেজার সবার মন।"

রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি ;

সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আনল তাড়াতাড়ি।

কনের খালু উঠিয়া বলে "সিঁদুর হল ঊনা!"

রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা!

.

কনের চাচার মন উঠে না, "খাটো হয়েছে শাড়ী।"

রূপার চাচা দিল তখন "ইংরাজী বোল ছাড়ি"।

"কিরে বেটা বকিস নাকি?" কনের চাচা হাঁকে,

জালির কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে।

"কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি,

দেখিয়ে দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি!

বেরো বেটা নওশা নিয়ে, দিব না আজ বিয়া ;"

বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া।

বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা,

পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা।

.

মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে,

থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাতেন কুতূহলে।

কনের চাচা বসল বরের চাচার কাছে,

কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে!

মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল ডাকি,

বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি!

.

তার মাঝেতে এমন তেমন হয়নি কিছু গোল,

কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল।

এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে ;

সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে ;

রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর,

হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড় |

ভাবল রূপাই---অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে,

দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে।

.

- জসীমউদ্দীন

বিষয়: বিবিধ

১৬৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File