মেঘ পাহাড়ের শিলং (প্রথম পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৯:৫২:৫১ সকাল

তন্দ্রার মতো লেগে এসেছিলো। হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাস সালাহ-----। মুয়াযযিনের সুললিত কন্ঠে ঘুম ভাংলো। দেখি বাস দাঁড়িয়ে একটি পেট্রোলপাম্পের সামনে। বিশাল গাড়িটির পেটের মাঝে ড্রাইভার, হেলপার, সুপারভাইজার আর যাত্রীসহ আমরা মাত্র দশজন। সপরিবারে একমাত্র আমরাই।

সুপারভাইজার জানালো, গাড়ি এখানে কিছুক্ষণ থামবে। কেউ চাইলে নামতে পারেন। আগের রাতে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছিল। এখন চলছে গুড়ি গুড়ি। তার মাঝেই নামলাম। ফজরের সালাত আদায় করলাম পেট্রোল পাম্প এর নামাজ ঘরেই। একটু পর গাড়ি চলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে আলো আঁধারি কেটে পূব আকাশ ফর্সা হতে লাগলো। আর দুই চোখে ধরা দিচ্ছে মেঘ পাহাড় ঝর্ণার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। না, বিদেশের কোনো দৃশ্য নয়। আমাদের সিলেটের জৈন্তাপুর এটা। টিকেটে কেটেও যারা এ পথে না গিয়ে বিমানের যাত্রী হয়েছেন তাদের জন্য শুধুই আফসোস। এই দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ঝর্ণাগুলির দুরন্ত যৌবন, মেঘের সাথে পাহাড়ের মিতালী আরো ঘনিষ্ঠতর, আরো সুন্দর। এ পথে আগেও এসেছি। কিন্তু এই দৃশ্য তখন দেখা যায় নি। এসি গাড়ির বৃষ্টিস্নাত জানালা ভেদ করে অবাক তাকিয়ে থাকি। কোনো ক্লান্তি আসে না। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের এসব হৃদয়ভুলানো দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে এলাম তামাবিল।

এ পাড়ে তামাবিল, মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ড আর ওপাড়ে ডাউকি। তাড়াতাড়িই চলে এসেছি। তখনো ইমিগ্রেশন অফিস খোলে নি। সুতরাং অপেক্ষা। তেমন ভালো কোনো রেঁস্তোরা নেই এখানে। কোনোমতে উদরপূর্তি করলাম। এদের এখানে মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাও আছে। কিছু চেঞ্জ করলাম।

তামাবিল এর শেষ সীমানায় দেখি ডোবার মতো ছোট একটি জলাশয়। সেখানে ফুটে আছে কয়টি তাজা শাপলা। আহ, কত দিন পর দেখলাম! ইচ্ছে করছে দুটি তুলে এনে উনার মাথায় গুঁজে দেই। কিন্তু কিন্তু এতো লোকের সামনে ঢং করলে তিনি লজ্জা পাবেন।’ ইচ্ছেটা দমন করি। ফুল গাছেই সুন্দর। কিন্তু ততোক্ষণে ছেলে বলে উঠলো- “বাবা, জাতীয় ফুল শাপলা। আমাকে এনে দাও।” সে বাস্তবে দেখেনি। তবে বইতে দেখেছে। সরাসরি দেখে চিনতেও ভুল করে নি। ছেলের আবদার মেটাবো কিনা ইতসস্ত করছি। এমন সময় দেখলাম স্থানীয় একটি কিশোর ছেলে যাচ্ছে ঐপথ দিয়ে। কিছু বলার আগেই সে নিজ হতে দুটি ফুল তুলে এনে আমার ছেলেকে শান্ত করলো।

৮ টায় ইমিগ্রেশন অফিস খুললো। ঘন্টাখানিক সময়ে ঝামেলামুক্তভাবেই শেষ হলো দুই পাড়ের ইমিগ্রেশন। ডাউকি হতে ৯ টায় শুরু হলো আবার যাত্রা। ডাউকি হতে শিলং ৮২ কিমি পথ। তবে পাহাড়ী পথ বলে এই দুরত্ত্ব শেষ করতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা। তবে এ যাত্রা ক্লান্তিহীন। দুইপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কিভাবে যে সময় পার হয়ে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না। এ এক অন্যরকম যাত্রা। ডাউকির সৌন্দর্যের ছিঁটেফোঁটা জাফলং এ এসে দূর হতে দেখা যায়। তবে কাছ হতে সেই সৌন্দর্য শুধু অবাক নয়নে দেখতে হয়। পাহাড়ের অনেক নীচে পিয়াইন নদী এঁকেবেঁকে চলছে। কোথাও পানি গাঢ় নীল কিন্তু স্বচ্ছ আবার কোথাও একটু ঘোলা। এগিয়ে চলছে গাড়ি। বামে পিয়াইন নদী ডানে খাসিয়া পল্লী। এই রুটে প্রাইভেট কার, ট্যুরিস্ট জীপ, বিএসএফ এর সরকারী গাড়ি এসব গাড়িই চলে, ড্রাইভারগুলিও বেশ দক্ষ। বড় গাড়ি খুব একটা চলে না। তাই রাস্তা একটু সংকীর্ণ। বড় গাড়ি বলতে প্রতি সপ্তায় শুধু শ্যামলী পরিবহনের এই গাড়িটিই বৃহস্পতিবার ঢাকা হতে রওনা হয়ে শুক্রবার শিলং যায় আবার সোমবার শিলং হতে ঢাকা। খাসিয়া পল্লীর শিশু কিশোররা ভিড় করে অবাক হয়ে আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা "ব‌াংলা‌দেশী গা‌ড়ি, বাংলা‌দেশী গা‌ড়ি" ব‌লে সুর ক‌রে শ্লোগান দেয়।

পাহাড়ের আঁকেবাঁকে, ঢালুতে খাসিয়া পল্লীর ছোট ছোট ঘরগুলিও বেশ সুন্দর। তার কোনটি প্রাকৃতিক পাথরে তৈরি, কোনোটি ইট সিমেন্টে তৈরি, আবার টিন কাঠের বাড়িও আছে। আমাদের জাফলং, বিছানাকান্দিতে এত পাথরের উৎস কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। কত রংবেরং এর পাথর! কত রকম যে তার ডিজাইন! ছোট বড় নানা রকম পাথর। কোনো কোনোটি এতই বিশাল যে কয়েক তলা সমান উঁচু! কোথাও মাইলের পর মাইল পাথরী পাহাড়। গাড়ি ক্রমেই উপরে উঠছে। শিলং ভূমি হতে দেড় কিমি অর্থাৎ ১৫০০ মিটার উঁচু। পাথর আর পাহাড়ের মিতালী যে এমন ভয়ংকর সুন্দর রূপে ধরা দিতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা সত্যিই কষ্ট। ভারতীয় সময় ১২ টা নাগাদ একটি খাসিয়া পাড়ায় এসে একটি ছিমছাম ছোট রেঁস্তোরার সামনে গাড়ি যাত্রাবিরতি করলো। সবাই নামলো। আমরাও নামলাম। ক্ষিধে নেই তেমন। চিপস, পানি কিনলাম। চা পান করলাম। খাসিয়া পল্লী দিয়ে আসার সময়ে কিছু কিছু বাজারে দেখলাম শুয়োরের মাংস টানানো আছে বিক্রির জন্য। পুরো তিন চার ইঞ্চি পুরো চর্বি দেখেই বুঝে নিলাম, সেসব শুকরের মাংস। তাই অন্য কিছু খাওয়ার ভরসা পাই নি।

বিরতি শেষে গাড়ি আবার চলতে লাগলো। সৌন্দর্যের যে রূপ নতুন করে ধরা দিচ্ছে তাতে আগের সব নস্যি মনে হতে লাগলো। (চলবে--------)

বিষয়: সাহিত্য

১০২২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384764
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দুপুর ০৩:২১
আবু জারীর লিখেছেন : আপনার সাথে সাথে আমরাও শিলং এর পথে। ধন্যবাদ।
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সকাল ০৯:৩৪
317337
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। দীর্ঘদিন পর ব্লগে আসলাম। ব্লগটাকে আবার সক্রিয় করতে আমাদের ভূমিকা রাখা উচিত।
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বিকাল ০৫:৫৭
317367
আবু জারীর লিখেছেন : লেখকদের আসল মজা ব্লগেই। ফেবু একটা চটুল জায়গা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File