নানা বাড়িতে, গ্রীষ্মের ছুটিতে (কিশোর গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৭ মে, ২০১৭, ১২:২৪:৫২ দুপুর
রিফাত আর রওশন দুই ভাই-বোন। রিফাত ক্লাস সিক্সে আর ছোট্ট রওশন পড়ে ক্লাস থ্রীতে। গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুল বন্ধ। তাই আম্মুর সাথে বেড়াতে চলে এল নানার বাড়ি। নানাবাড়ি বেড়ানোর মতো মজা আর কিছুতেই নেই। নানা নানী, মামা মামীর আদরের কথাতো বলাই বাহুল্য। আম, লিচু, কাঁঠাল, কাঁচা তালের শাঁস! একেবারে প্রাকৃতিক, ভেজালমুক্ত। এছাড়া আছে পুকুরে সাঁতারকাঁটা, খেলাধূলা। রওশন সাঁতার জানতো না। গত কয়েকদিনের চেষ্টায় শিখে গিয়েছে। তবে এসবের বাইরেও নানাবাড়ির মূল আকর্ষণ হচ্ছে নানাভাই এর কাছে অসাধারণ সব গল্প শোনা। নানাভাই এর নাম প্রফেসর হাসান জামিল চৌধুরী। বয়স ষাটের কোটায়, পদার্থবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। গ্রামেই এখন বেশিরভাগ সময় কাটে। নানারকম সমাজসেবামূলক এবং বিজ্ঞানচর্চার সংগঠন তৈরি করেছেন। এসব নিয়ে সুন্দর কাটে অবসর জীবন। রিফাতরা বেড়াতে আসার পর নাতি নাতনীদের খুব সময় দিচ্ছেন। প্রতিদিন মাগরিবের সালাত এর পর খোলা উঠোনে নাতি নাতনীদের নিয়ে গল্পে মেতে উঠেন অধ্যাপক সাহেব। নানাভাই এর গল্প মুগ্ধ হয়ে শোনে রিফাত আর রওশন। সেসব গল্পে থাকে জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা, মহাকাশ মহাবিশ্ব, সৃষ্টিরহস্য, মহামানবদের জীবনী, ইতিহাস, ভূগোল আরো কত কী! কঠিন কঠিন কথাগুলি খুব সহজ করে বুঝিয়ে বলেন নানাভাই। গল্পের কোন বিষয়বস্তু পূর্ব নির্ধারিত থাকে না। সাবলীল আলোচনার মাধ্যমেই উঠে আসে নিত্য নতুন বিষয়। তাদের গল্পের আসরের আর একজন সঙ্গী হচ্ছে মামাতো ভাই শিহাব, ক্লাস ফোরে পড়ে সে। গ্রীষ্মের ছুটিতে সেও গ্রামে এসেছে আব্বু আম্মুর সাথে।
আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। প্রায় গোলাকার চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা আর মৃদু বাতাসের মাঝে এক মোহনীয় পরিবেশ। মাঝে মাঝে সাদা কালো মেঘ সাইঁ সাঁই করে উড়ে যায়, চাঁদ আড়াল হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ। আলো আঁধারীতে তখন সৃষ্টি হয় আরেকটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। নানাভাইদের উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে নানাভাইকে মাঝখানে রেখে সবাই গোল হয়ে বসে পড়ে। এগিয়ে চলছে আজকের গল্পের আসর।
গতপরশু নানাদের গাভী একটি বাছুর জন্ম দিয়েছে। কী সুন্দর! দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। রিফাত, রওশন আর শিহাবের এ নিয়ে আনন্দ উৎসাহের শেষ নেই। বাছুরটি তাদের পরম বন্ধু যেন। গত ২ দিন বাছুরদের পিছনেই হেসে খেলে তাদের খেলাধূলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে। আজকের গল্পে সে বাছুরটির কথাই আনলো রিফাত।
-আচ্ছা নানাভাই। গরুর বাছুরটি জন্মের পর হতেই দৌড়ঝাঁপ করতে পারছে, কী সুন্দর খেলছে। কী আশ্চর্য্য! মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। তাহলে একটি মানবশিশু কেন এটা পারে না? একটি মানবশিশুর হাঁটা শিখতে প্রায় ২ বছর লাগে কেন?
নাতির বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নে খুশী হন নানাভাই। আদর করে কাছে টেনে নেন।
-খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছ রিফাত ভাইয়া। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে মানুষকে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন। বুদ্ধিমানরাই চিন্তাভাবনা করে। তুমিও বুদ্ধিমান। আমরা চিন্তাভাবনা করলে আল্লাহর দয়া, তাঁর কুদরত আর নিদর্শনসমূহ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি আল্লাহ কত মহান, কত পরাক্রমশালী, কত অসীম দয়াময়। সূরা আল ইমরান এ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “যারা সবসময় আল্লাহকে স্মরণ রাখে এবং সৃষ্টি জগতের উপর গবেষণা চালায় একমাত্র তারাই উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ তায়ালা অনর্থক ও বিনা উদ্দেশ্যে এ জগত পয়দা করেন নি।(সূরা আল্ ইমরান, আয়াত ১৯১)। তোমার প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে গেলে আল্লাহপাকের সুন্দর একটি কুদরতী নিদর্শন আমরা দেখতে পাই।”
- “বুঝিয়ে বলুন নানাভাই”। নানীর কোলে বসে শুধায় রওশন। পাশে বসে রিফাত আর শিহাবও উৎসুক হয়ে উঠে।
-হ্যাঁ, তাই বলছি। এই যে দেখ, গরুর বাছুর যদি জন্মের পরই হাঁটতে না পারতো তবে একটি বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হতো।
-কীভাবে?– সকলের সমস্বরে জিজ্ঞাসা।
- বাছুরকে কোলে কাঁখে নিয়ে লালনপালন করে বড় করতে হতো।
-“গরু কী তার বাচ্চাকে কোলে নিতে পারে?” প্রশ্ন করে শিহাব।
-এইতো বুঝেছো রহস্যটা কোথায়। পশুর সেই সক্ষমতা নেই বলে তাকে আল্লাহপাক সাধ্যের বাইরে এ বোঝা চাপিয়ে দেন নি। নিজ বাচ্চাকে কোলে নিতে সে অক্ষম বিধায় আল্লাহপাক এমন সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শীতপ্রধান এন্টার্কটিকা অঞ্চলে বাস করে মরুভল্লুক যার ত্বকের নিচে রয়েছে পুরু চর্বির স্তর যার ফলে হিমাংকের নিচের তাপমাত্রাও তাকে কাবু করতে পারে না। আমাদের দেশে শীতকালে প্রচুর বিদেশী পাখি আসে বেড়াতে। সাইবেরিয়ায় প্রচন্ড শীতে টিকতে না পেরে তারা হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসে। মানুষ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও কোন প্রকার যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তির সাহায্য ব্যতীত উড়তে পারে না, অথচ সামান্য পাখি হাজার মাইল কত অনায়াসে উড়ে চলে আসে। সূরা নাহল এ আল্লাহ তায়ালা এ কথাটি বলেছেন এভাবে, “তারা (অবিশ্বাসীগণ) কি দেখে না, পাখি আকাশের শূণ্যমার্গে স্থির হয়ে উড়ে বেড়ায়? তাদেরকে আল্লাহই এভাবে ধরে রেখেছেন আর কেউ নয়। নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” এভাবে পরিবেশ পরিস্থিতি উপযোগী একটি সক্ষমতা দেয়া হয়েছে সকল প্রাণীকূলকে স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকার জন্য। কোন এক মহানিয়ন্ত্রক মহাশিল্পী ছাড়া এই সুন্দর শৈল্পিক পদ্ধতি সম্ভব নয়। আর মহানস্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন সেই মহানিয়ন্ত্রক মহাশিল্পী।
-সুবহানাল্লাহ! সমস্বরে সবাই বলে উঠলো।
- আচ্ছা নানাভাই, আল্লাহ কী সব দেখেন? নানীর কোলে বসে ছোট্টমনি রওশন এর প্রশ্ন।
- হ্যাঁ, আল্লাহ সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা। এমনকি বদ্ধ ঘরে কিংবা অন্ধকারের সব ঘটনাও তিনি জ্ঞাত।
- শিহাব ভাইয়া তাহলে ঠিকই বলেছে। আমি ঐ বাড়ির আংকেলদের গাছের নিচে একটি পাকা আম পেয়ে নিতে গেলাম। শিহাব ভাইয়া বললো, না এটা নিও না। আমি বললাম, কেন কেউতো দেখছে না। শিহাব ভাইয়া বললো, কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখছেন।
- হ্যাঁ, শিহাব ঠিকই বলেছে। আল্লাহ সবই দেখেন এবং সবই জানেন। এমনকি আমাদের মনের গোপন খবরও আল্লাহ জানেন। এজন্য আমাদের উচিত সবসময় ভাল চিন্তা করা, অন্যায় ও অসৎ বা কুচিন্তা পরিহার করা। কুচিনÍা করলে পাপ হয়।
- “পাপ মানে কী?” রওশন এর আবার প্রশ্ন।
- পাপ হচ্ছে মন্দ বা খারাপ কাজ। পাপ কাজ করলে গোনাহ হয় আর ভাল কাজ করলে সাওয়াব হয়। যেই কাজ তুমি প্রকাশ্যে করতে লজ্জাবোধ করবে তাই পাপ। অন্যায় করার পর মন থেকে আপনা আপনিই লজ্জাবোধ হয় , অনুশোচণা হয়। মন্দ কাজের প্রতি এই যে মনের এই বাধা আসে, এটাকে বিবেক বলে। বিবেক হচ্ছে ভালো ও মন্দের চেতনা। এটাকে নৈতিক চেতনা বলা হয়। এটাই আসল মানুষ এবং এটাই মুনষ্যত্ব। অন্য কথায় এটাকে বলে রূহ। মানুষের শরীর তার আসল সত্তা নয়। আসল মানুষ হলো রূহ। মায়ের পেটে মানুষের শরীরটা তৈরি হওয়ার অনেক আগে আসল মানুষটি পয়দা হয়েছে। পয়লা মানুষ হযরত আদম(আঃ) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহতাআলা এর মধ্যে তাঁর রূহ থেকে ফুঁ দিয়ে দিলেন। আল্লাহনিজে যে জিনিসটা ফুঁ দিয়ে দিলেন সেটাই আসল মানুষ। সকল রূহকে একসাথে পয়দা করা হয়েছে। অর্থাৎ সকল মানুষকে একসাথেই সৃষ্টি করা হয়েছে। দুনিয়াতে আল্লাহতায়ালা কাউকে আগে কাউকে পরে পাঠান।
মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে সবাই। নানাভাই এর সাবলীল বর্ণনা ছাড়া সবার মাঝে পিনপতন নীরবত। এর মাঝে পাকা আম আর তালের শাঁস কেটে নিয়ে আসেন ছোটমামা। এজন্য একটু বিরতি।‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাওয়া শুরু হলো। খাওয়া শেষে নানাভাই বললেন-‘আলহামদুলিল্লাহ’।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ মানে কী নানাভাই?-রওশন এর আবার প্রশ্ন।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ অর্থ সকল প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহহচ্ছেন রিযিকদাতা। এজন্য খাওয়াশেষে আল্লাহর প্রশংসা আদায় করে বলতে হয় ‘আলহামদুলিল্লাহ’। খাওয়াসহ যেকোন ভাল কাজের পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হয়।
খাওয়ার বিরতির পর আবার শুরু করেন নানাভাই।
“তাহলে তোমরা বুঝতে পেরেছ-মানুষের দেহসত্তাটি নৈতিক সত্তা নয়; বস্তুসত্তামাত্র। দেহের দাবিগুলিকে কুরআনে নাম দেয়া হয়েছে ‘নাফস’। দেহের দাবি হলো খিদে লাগলে খাবার চাওয়া, পিপাসা লাগলে পানি চাওয়া, যা সুন্দর তা দেখতে চাওয়া, যা শুনতে মিষ্টি তা শুনতে চাওয়া ইত্যাদি। দেহের এসব দাবি পূরণ করা যাবে আল্লাহর বেধে দেয়া শরীয়তের সীমা মেনে। সীমালঙ্ঘন করে দেহের এসব দাবি মানতে গেলেই পাপ হবে, গোনাহ হবে। শয়তান প্রতিনিয়তই আমাদের নফসকে বিবেক তথা রূহের বিরুদ্ধে কাজ করতে প্ররোচণা দেয়। রূহ যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে নফসকে দমন করতে কারে এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। শয়তানের প্ররোচণায় সাড়া দিলে রূহ দুর্বল হয়ে যায় এবং নফসের কাছে পরাজিত হয়ে মন্দ কাজ করে ফেলে। তাই যা করতে গিয়ে বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে হয় তা করা যাবে না।”
হঠাৎ বিদ্যুত চলে গেল। উঠোনের মাঝখানে চলা বড় টেবিল ফ্যানটি বন্ধ হয়ে গেল। তবে সুন্দর ও নির্মল প্রাকৃতিক বাতাসের কারণে কোন সমস্যা হচ্ছে না।
“আচ্ছা নানাভাই, দুনিয়াতে অনেক মানুষ শত অন্যায় চুরি ও পাপ করেও অনেক ভাল আছে। দামি অট্টালিকায় বাস করে, বিলাসী জীবনযাপন করে। আবার অনেক সৎলোক খুব কষ্ট পায়। এমনকি পাপী লোকগুলি সৎলোকদের শাস্তিও দিয়ে থাকে। সৎলোকগুলি জেল জুলুমের শিকার হয়, ফাঁসিও হয় তাদের। পাপীরা পুরস্কার পাচ্ছে আর বিপরীতে পূণ্যবান ঈমানদাররা শাস্তি পাচ্ছেন। এটা কেন হয়?”- প্রশ্ন করলো রিফাত।
“অত্যন্ত দামি ও বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করেছ রিফাত ভাইয়া। নৈতিক চেতনাবোধ থেকেই মানুষ চায় যে, ভাল কাজের ভাল ফল ও মন্দ কাজের মন্দ ফল হোক, হওয়া উচিত। এটাই যুক্তির দাবি, ইনসাফের প্রয়োজন। মানুষের এ নৈতিক সত্তার দাবী পূরণের জন্যই আখিরাত অপরিহার্য। এ দুনিয়া মূলত আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। দুনিয়াতে সবসময় ভাল কাজের ভাল ফল ও মন্দ কাজের শাস্তি পাওয়া যায় না। কিন্তু দুনিয়ার এসব কাজের উপযুক্ত ফল ব্যক্তি আখিরাতে ভোগ করবে। সেদিন কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না। কারণ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক।”
ছোট্টমনি রওশনের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতুহল।
আবারো প্রশ্ন করলো-আচ্ছা নানাভাই, আমরা আল্লাহকে দেখি না কেন?
সবাই নড়েচড়ে বসলো।
নানাভাই বলতে শুরু করলেনঃ খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছে আমাদের রওশনআপু। আল্লাহকে আমরা দেখি না বলেই বিশ্বাস করতে হবে। দেখলে আর বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল না। কারণ চাক্ষুস যা আমাদের সামনে থাকে তা বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই, এমনিতেই তা সত্য। বিশ্বাস মানে কী? যে বিষয়ে আমাদের সরাসরি জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে পরোক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তারই নাম বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া আমাদের জীবন অচল, সবকিছু অচল। এই যে আমরা একটু আগে আম এবং তালের শাঁস খেলাম আমরাতো জানতাম না, সেখানে বিষাক্ত কিছু ছিল কি ছিল না। কিন্তু সেটাতে বিষ নেই এ বিশ্বাস করেই আমরা খেয়েছি। তাই বিশ্বাস ছাড়া খাওয়াই বন্ধ। অসুখ হলে ডাক্তার আমাদের ঔষধ দেন। এ ওষুধে কাজ হবে কি না, তা কি আমরা সরাসরি জানি? বিশ্বাস করেই ওষুধ খেতে হয়। চাষী ফসল হবে বিশ্বাস করেই জমিতে ফসল বুনে। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি সব কিছুতেই অসংখ্য মতবাদ বা থিউরী বিজ্ঞানীরা নিজেরা প্রমাণ না করেই বিশ্বাস করেন। এটমের আকার, চন্দ্র সূর্যের দূরত্ব, আলোর গতি, পৃথিবীর ব্যাস ও পরিধি ইত্যাদি কয়জন প্রমাণ করে বিশ্বাস করেছেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহকে বিশ্বাসের ভিত্তি কী? এ ভিত্তি হচ্ছে দুনিয়ায়, মহাবিশ্বে আল্লাহর হাজারো নিদর্শন। ইতোমধ্যে তার কয়েকটি আমরা আলোচনা করেছি। সূরা আল ইমরানের ১৯০ নং আয়াতে আল্লাহবলেছেন, “নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং দিবারাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানী লোকদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।” এ মহাবিশ্বের বিশালতার কথাই আমরা চিন্তা করি। এই মহাবিশ্ব যে কত বিশাল তা অনুমান বা ধারণা করতেও ব্যর্থ হয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্রহ নক্ষত্র তারকা ছায়াপথ এর সমাহার এই মহাবিশ্ব। আমাদের পৃথিবী দূরে থাক, পুরো সৌরজগতটাই মহাবিশ্বের তুলনায় ধূলিকণাও নয়। শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে বিজ্ঞানীরা কয়েকশ কোটি তারকার সন্ধান পেয়েছেন। বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘মীরা’ নামে একটি তারা আছে যাতে পৃথিবীর মত ৩৯০০ কোটি গ্রহকে ভরে রাখা যায়। এই মহাবিশ্ব যে কত দূর পর্যন্ত ছড়ানো আছে, তা বিজ্ঞানীরা বহু চেষ্টা করেও জানতে পারেন নি। কল্পনা কর, মহাসাগরে ভাসমান জাহাজের মাঝে ০.৫ সে.মি. দৈর্ঘ্যরে একটি পিপড়া। মহাসাগর সম্পর্কে পিঁপড়ার ধারণা বা উপলব্ধি কী হতে পারে? অবশ্য তুলনাটিও মোটেই যথেষ্ট নয়। একটি উদাহরণ দিয়ে মহাবিশ্বের বিশালতা সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা যাক। আমরা জানি, আলোর গতিবেগ হচ্ছে প্রতি সেকেন্ড এ ১,৮৬,২৮৪ মাইল। দূর মহাকাশে এমন জ্যোতিষ্কের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যে তার আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ১৫ কোটি বছর। পৃথিবী হতে তাহলে সেই জ্যোতিষ্কের দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে, ১৫ কোটি বছরকে সেকেন্ডে পরিণত করতে হবে। মানে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করে তাকে আবার ২৪ দিয়ে গুণ করে সেটাকে ৩৬০০ দিয়ে গুণ করলে সেকেন্ড পাওয়া যাবে। এরপর এতগুলি সেকেন্ডকে আবার গুণ করতে হবে ১,৮৬,২৮৪ মাইল দিয়ে। তাহলে আমরা দূরত্বটি বের করতে পারবো।
-সুবহানাল্লাহ! সবাই বলে উঠলো।
-ভাবা যায়? এই মহাবিশ্বের একজন মহানস্রষ্টা থাকবেন না এটা কী করে সম্ভব? আর সেই মহান স্রষ্টাই হলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ।
- আমরা কী বাতাস দেখি?
- না।
- কিন্তু অনুভব করতে পারি। শ্বাস প্রশ্বাসে বুঝতে পারি বাতাসের উপস্থিতি। সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলে আমরাও সহজেই বুঝতে পারবো আল্লাহকে। উপলব্ধি করতে পারবো আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন আল্লাহরাব্বুল আলামীন।
- ঠিক বলেছেন নানাভাই।- রিফাত এর জবাব। শিহাব ও রওশন ও ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
- শুধু মানুষ নয়, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করা ছাড়া কোন জীবের পক্ষেই বেঁচে থাকা অসম্ভব। এমনকি বৃক্ষ, লতা, গুল্ম প্রভৃতি উদ্ভিদও শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করা ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রাণীকুল ফুসফুসের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করলেও উদ্ভিদ করে পাতার সাহায্যে। মানুষসহ সব প্রাণী শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয় এবং শ্বাস ছাড়ার মাধ্যমে শরীরের ভিতরে জমা হওয়া দূষিত কার্বন-ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। অন্যদিকে উদ্ভিদরা পাতার সাহায্যে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে নির্মল অক্সিজেন পরিত্যাগ করে। উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য পারস্পরিক নির্ভর কি সুন্দর এই বাস্তুসংস্থান পদ্ধতি!
- সুবহানাল্লাহ! –সবাই সমস্বরে বলে উঠলো।
-আর সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আল কুরআন। এক মহাগ্রন্থ, মহাবিস্ময়! চৌদ্দশ বছর পরেও পবিত্র কুরআন সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অবিকল থাকবে। কারণ আল্লাহতায়ালা নিজেই বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষণকারী।” এজন্য পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ হাফেজ দ্বারা পুরো কুরআন মুখস্ত করিয়েছেন। মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে কুরআন পাঠ করে। পৃথিবীতে এমন আর একটি গ্রন্থও নেই যেটি এতবেশি সংখ্যক পঠিত হয় এবং এত বেশি সংখ্যক মানুষ সম্পূর্ণ মুখস্ত রেখেছে। আধুনিক বিজ্ঞান কুরআনের কাছে অনেক ঋণী। তবে কুরআন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়, কুরআন হচ্ছে হেদায়াত গ্রন্থ। মানুষকে হেদায়াত করার জন্য মানুষের সহজে বোধগম্য হওয়ার মতো হেদায়াত উপযোগী ভাষায় এটি নাযিল হয়েছে। পবিত্র কুরআনে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলি পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা শতভাগ সত্য বলে প্রমাণ পেয়েছেন।
-“বুঝিয়ে বলুনতো নানাভাই”। রিফাত বলে উঠলো। রিফাত এর প্রশ্নে বাকি সবাইও উৎসুক হয়ে উঠলো।
নানাভাই আবার শুরু করলেন।
-আমরা জানি, সূর্য সৌরজগতের একটি নক্ষত্র এবং চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, মহাবিশ্বে অসংখ্য সৌরজগত আছে। আরো প্রমাণ করেছে, সূর্যের নিজের আলো আছে কিন্তু চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূর্য হতে আলো পেয়ে থাকে চাঁদ। প্রায় ১৪০০ বছর আগে এ কথাটি কুরআন বলেছে। সূরা ফুরকানের ৬১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান স্রষ্টা সেই আল্লাহ যিনি মহাশূণ্য ও সৌরজগতসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে একটি আলোক এবং আর একটি আলোকপ্রাপ্ত চাঁদ সৃষ্টি করেছেন”।
-সবাই বলে উঠলো, সুবহানাল্লাহ!
-একইভাবে সূর্য ও চাঁদ নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। এ বৈজ্ঞানিক সত্য মাত্র কিছুবছর পূর্বে আবিষ্কার হলেও কুরআন বলেছে সেই চৌদ্দশ বছর আগে। রাসূল (সাঃ) ছিলেন উম্মী বা নিরক্ষর। আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ১৪০০ বছর আগে এমন হুবহু ভবিষ্যদ্বাণী করা কিভাবে সম্ভব? এ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ হয়, কুরআন আল্লাহর বাণী এবং আসমানী কিতাব। এমন আরো একটি বৈজ্ঞানিক বিষয় সূরা ফুরকানে বলা হয়েছে, “তিনিই সে সত্তা, যিনি দু’টি স্রোতকে একত্রে মিলিত করেছেন; একটি স্বাদু ও সুপেয় এবং অন্যটি লবণাক্ত ও তিক্ত। অথচ এ দু’য়ের মধ্যে রেখেছেন এক অলঙ্ঘনীয় বাধা-এরা মিশতে পারে না।” নদ-নদী, খাল বিল, ঝরণা, বৃষ্টি হতে সৃষ্ট সুপেয় বা মিঠা পানি এবং পৃথিবীর তিন চতূর্থাংশ বিস্তৃত সাগরের লবণাক্ত পানি। এ দু’য়ের মধ্যে সবসময় মিলন হলেও নদীর পানি লবণাক্ত হচ্ছে না বা সাগরের পানি মিঠা হচ্ছে না। বড় বড় নদীর পানি সাগরে মিশে যায় এবং মোহনার অনতিদূরে এ দু’পানির মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাগ দেখা যায়, যা সর্বদাই বিদ্যমান এবং তা লোপ পায় না। শুধু সাগর-নদী নয়, দু,নদীর স্রোতেও এরূপ স্পষ্ট বিভাগীয় রেখা দেখা যায়। ঢাকার নিকট মেঘনা ও শীতলক্ষা নদীর মধ্যে এরূপ স্পষ্ট রেখা বিদ্যমান। এভাবে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য, পাহাড়, নদ নদী, সমুদ্র, আগ্নেয়গিরি, পৃথিবীর বাইরে সৌরজগত, গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, মহাবিশ্ব সম্পর্কে অসংখ্য নিদর্শন ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে যেগুলি তোমরা বড় হয়ে আরো জানতে পারবে।
-“এত সুস্পষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন মানুষ নাস্তিক হয় নানাভাই?”-শিহাব এর জিজ্ঞাসা।
-কারণ তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। সত্য গ্রহণ করার মানসিকতা তাদের নেই। কূটতর্ক তাদের স্বভাব। পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারায় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-“তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। আর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” লক্ষ কর, এ আয়াতটিও কুরআনের একটি মুযেজা।কারণ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মানসিক রোগের কথা বলছে মাত্র কিছু বছর আগে যেটি কুরআনে বলা হয়েছে ১৪০০ বছর পূর্বে।
- নানাভাই, আলোচনা হতে আমরা বুঝলাম পবিত্র কুরআনে মানুষকে চিন্তা গবেষণা, বিজ্ঞান চর্চার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা জ্ঞান বিজ্ঞানে এত পিছিয়ে কেন?-শিহাব বলে উঠলো।
- দারুণ প্রশ্ন করেছ নানাভাই। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা এবং আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন শুরু হয়েছিল মুসলমানদের হাতেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনাকে বলা হয় চিকিৎসকদের চিকিৎসক। তার রচিত ‘আল কানুন’ গ্রন্থটি এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রসায়নবিজ্ঞানের জনক আল জাবির ইবনে হাইয়ান। জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় ছিল তখন মুসলমানদের নেতৃত্ব। ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হলো মরক্কোর কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। ফাতেমা নামের একজন মুসলিম নারী ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ৯৭০ সালে যখন বিশ্বখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা হয় ইউরোপ ছিল অন্ধকারে আর বর্বরতায় নিমজ্জিত, আমেরিকানরা তখনো ছিল বিশ্বসভ্যতার কাছে অনাবিষ্কৃত। ইউরোপের বুকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টিও স্থাপন করেছিল মুসলমানরা ১১৩০ সালের দিকে স্পেনে, নাম সালমানকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা সেই সে জাতি। মধ্যযুগে কুটকৌশলে মুসলমানদের পরাজিত করে মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞানের গ্রন্থ ও গবেষণা চুরি করে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা। সেই মুসলমানরা আজ কোথায়? আমরা ভুলেই গিয়েছি আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গৌরব। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানরা যখন তাওহীদ এর শিক্ষা ভুলে গিয়ে শিরক বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়লো, সামান্য মতভেদ নিয়ে দলে উপদলে বিভক্ত আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়লো তখন তারা কুরআন হাদীসের নির্দেশনা ভুলে গেল এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় অনীহা এসে গেল। মূলত এসবই মুসলমানদের পতনের কারণ। এ নিয়ে পরে আরেকদিন বলবো ইনশাল্লাহ।
এ সময় মসজিদ হতে মুয়াজ্জিনের আযান ভেসে উঠে-“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার----।” আজকের নানাভাইয়ের গল্পের আসর এখানেই শেষ হল। রওশন ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে নানীর কোলে। আযান শেষে নানাভাই ও সবাই দোয়া পড়লেন। এরপর শিহাব আর রিফাতকে নিয়ে মসজিদে রওনা দিলেন এশার সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে।
বিষয়: সাহিত্য
১৯১৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন