অপারেশন খৈয়াছড়া
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৬:০৪:১১ সন্ধ্যা
না, এটা কোন মিলিটারী অপারেশন ছিল না। তবে দুর্গম, দুর্ভেদ্য, কষ্টসাধ্য এ ট্র্যাকিংকে অপারেশন শব্দটি ছাড়া সংজ্ঞায়িত করা কঠিনই বটে। সুন্দরের সাথে বিপদের একটা সম্পর্ক থাকে। খৈয়াছড়া এমনি এক ভয়াবহ সুন্দর ঝর্ণা।
কোথাও যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন ভ্রমণপাগল আবদুল মাজেদ ভাই। খৈয়াছড়া ঝর্ণার রোমাঞ্চকর গল্প শুনেছিলাম। তাই আমি প্রস্তাব দিলাম খৈয়াছড়া ভ্রমণের। মোটামুটি সবাই একমত হলেন কিন্তু শিডিউল মিলানো যাচ্ছিল না আর। এভাবে কেটে গেল প্রায় একমাস। হঠাৎ সপ্তাহের মাঝখানে পেয়ে গেলাম একটি ছুটি-১৫ই আগস্ট। প্ল্যান চূড়ান্ত হয়ে গেল। ১৪ তারিখ রাতেই হবে যাত্রা শুরু। আমাদের মাঝে সবচেয়ে তরুণ মুজাহিদ হোসাইন সজীবের দোমনা ভাব ছিল। ফোন দিয়ে রাজি করিয়ে ফেললাম। লিংকন বিয়ের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক গবেষণায় ব্যস্ত ছিল বলে অপারগতা প্রকাশ করলো। পরাগ ভাইয়েরও জরুরী কাজ থাকায় মিস করে ফেললেন। ওসমান ভাই চট্টগ্রাম ছিলেন। আমাদের টিমে যোগ দেয়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম হতে। কিন্তু বেরসিক জ্যামে পড়ে শেষ পর্যন্ত বিফল হলেন। পরে টিমে আরো যোগ দিলেন আতাউল্যাহ সাইফ ভাই ও ইসহাক ভাই।
নির্দিষ্ট দিনে রাত সাড়ে বারোটায় চড়ে বসলাম চট্টগ্রামমুখী হানিফ পরিবহনে। বাস ছাড়লো রাত একটায়। তন্দ্রামতো লেগে আসছিল। হঠাৎ সুপারভাইজারের যাত্রাবিরতির ঘোষণা! রাত বাজে চারটা। হাইওয়ে রেঁস্তোরায় একটু চা টা খেলাম, স্থানটি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। আধাঘন্টার বিরতির পর আবার শুরু যাত্রা। আমাদের নামতে হবে মিরসরাই পেরিয়ে ২ কিমি পথ পরে, বড়তাকিয়া বাজারের আগে। একঘন্টার মধ্যেই চলে আসবো বলে আর ঘুমাই নি। না ঘুমানোর দলে তরুণ ট্র্যাভেলার সজীবও ছিল। বাকী সবার নাক ডাকার শব্দ পাচ্ছিলাম বেশ। মিরসরাই পার হতেই সবাইকে ডেকে তুললাম। ২/৩ মিনিট পর নেমে পড়লাম বাস হতে, সময় তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। এখানে একটি কমিউনিটি সেন্টার আছে, নাম মনে পড়ছে না। হাইওয়ে হতে পূর্ব দিকে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে যার শুরুতে খৈয়াছড়া ঝর্ণার একটি সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে। সেখানে সিএনজি পেলাম একটা। এক দেড় কিমি পথ সিএনজিতে যাওয়া যায়। এরপর ট্র্যাকিং শুরু করতে হয়।
আবদুল মাজেদ ভাই একজন গাইড বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। নাম ফখরুল ভাই। তার মোবাইল নাম্বার ০১৮৩০৬৬২১৮২। উনার ভাগিনাও গাইডের কাজ করেন, ভাগিনা তারেক-০১৮৭৪২৩৪৭৮৬। গাইড ফখরুল ভাইয়ের আবার রেঁস্তোরা আছে। রেঁস্তোরায় সকালের নাস্তাটা সেরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম ট্র্যাকিংয়ে। ফখরুল ভাই ব্যস্ত ছিলেন বলে তার ভাগিনা তারেককে দিলেন আমাদের সাথে গাইড হিসেবে। তারেক ছেলেটা খুব সাহসী ও দক্ষ গাইড। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ সুনিপুণ দক্ষতায় দ্রুত পাড়ি দিতে দেখে ইসহাক ভাই তাকে নাম দিয়েছিলেন- শাখামৃগ। হাহাহা।
সুবহানাল্লাহ! অপূর্ব দৃশ্য চারপাশ জুড়ে। শুধু দেখছি আর অভিভূত হচ্ছি। কোথাও পাহাড়ী গাছ গাছালীর ফাঁকে সূর্যকিরণ বিচ্ছূরণ ঘটাচ্ছে।কোথাও সমতল রাস্তা, কোথাও খাড়া পাহাড়, কোথাও বা পাহাড় হতে ঢালু হয়ে নীচে নামতে হয়। কিছু পথ বেশ বিপদসংকুল। গাছের শিকড় ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে খুব সাবধানে চলতে হয়। বৃষ্টি হওয়ায় ঢালু ও খাড়া পথগুলি পার হওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
সবার হাতে পাঁচ ফুট লম্বা লাঠি। পাহাড়ী উঁচু নিচু পথে হাঁটতে লাঠি অনেক সহায়ক। ট্র্যাকিং সহায়ক স্যান্ডেলও নিয়েছি আমরা।
ঝিরিপথ হতে ঘন্টাখানেক চার কিমি এর কষ্টসাধ্য ট্র্যাকিং। বেশ দুর্গম ও পিচ্ছিল পথ। তাই বেশ সাবধানে পথ চলতে হয়। নয়তো স্লিপ করে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। মাঝপথে অবশ্য ছোট ছোট দোকান আছে যেখানে হাল্কা নাস্তা করার মতো রসদ আছে। আমরা অবশ্য সাথেই নিয়েছিলাম বেশ কিছু।
ঝিরিপথ পাড়ি দেয়ার এক পর্যায়ে পেয়ে গেলাম এক দারুণ সৌন্দর্যময় স্বচ্ছ পানির প্রবাহমান ঝর্ণা। সবাই হৈ চৈ করে উঠলাম। এ বুঝি সেই খৈয়াছড়া ঝর্ণা। তবে গাইড তারেক জানালো, এখনও শুরুই হয় নি ঝর্ণা। এটা ঝিরিপথের উপরের দিক! মূল ঝর্ণায় যেতে পাড়ি দিতে হবে আরো বেশ কিছু পথ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক পর্যটক এ স্থানটিকেই মূল খৈয়াছড়া মনে করে দাপাদাপি করে শক্তি ক্ষয় করে এবং অনেকে এখান হতেই ফিরে আসে। বা পরে মূল খৈয়াছড়া গেলেও আর এনার্জি পায় না মজা করার জন্য।
এইতো এসে গেলাম খৈয়াছড়া ঝর্ণা। অনেক উঁচু হতে প্রচন্ডগতিতে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা আছড়ে পড়ছে নীচে। সাদা ফেনীল বুদবুদের উপর সকালের সূর্যকিরণ।আল্লাহু আকবার। অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গেলাম। কতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম জানি না। ‘চলুন উপরে যাই’ – সজীব এর কথায় হুশ এল। এর উপরে আরো নাকি আটটি ঝর্ণা আছে ধাপে ধাপে। খাড়া পাহাড় ধরে রশি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। বিসমিল্লাহ বলে উঠা শুরু করলাম পুরো টিম। বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পাহাড় ট্র্যাকিংয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এটি করতে যাওয়া অনেক বিপদ। মাঝপথে গিয়ে খান ভাই ভেটো দিলেন, “এ বয়সে বউকে বিধবা করতে চাইনা” বলে। আবদুল মাজেদ ভাইও এ মত সমর্থন করলেন। সাথে সাথে বউয়ের প্রতি আমারও নিদারুণ ভালোবাসা জেগে উঠলো। তবে আমাদের দুই তরুণ সহযাত্রী সজীব ও সাঈফ নাছোড়বান্দা। আমাদের দ্বিধাদ্বন্ধের মাঝেই তারা বেশ কিছু পথ এগিয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত তারা সৌন্দর্যের শেষ সীমায় পৌছে গেল। আমাদেরকে বাধ্য হয়ে নামতেই হলো। তবে নামতে গিয়ে দেখি, উঠার চেয়ে নামাটা ঢের বেশি কষ্টসাধ্য!
নেমে আসার পর প্রবাহিত ঝর্ণার পাশে একটি খাড়া পাথরের উপর দাঁড়ালাম। হঠাৎ স্লিপ করে পানিতে চিৎপটাং। পকেটের মোবাইলটাও জলকেলি করলো। আর ঠিক হয় নি সাধের এন্ড্রয়েড মোবাইলটা। দীর্ঘ সময় জলকেলী করে উঠে আসলাম।
বেশ হাঁফিয়ে পড়েছিলাম সবাই। তবে ঝিরিপথের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্ আপনাকে ভুলিয়ে দিবে পথের কষ্টকর ট্র্যাকিং এর ক্লান্তি। বাঁশের সাকো, ক্ষেতের আইল, আঁকাবাকা পাহাড়ী পথ, ছরা, অন্তত ৪টি পাহাড় পেরিয়ে যখন ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে গা ভিজাবে পর্যটক, তখন মনে হবে পথের এই দুরত্ব খুবই সামান্য। শত শত বছর ধরে ঝর্ণার খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ পানির স্পর্শে এখানকার মাটিগুলো পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে গিয়েছে।
এমন সৌন্দর্য ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করে না, তবু যে আসতে হয়। কিন্তু আমাদের দু'জন উপরে উঠে গেছে রিস্ক নিয়ে। তাদের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে ফিরতি পথ ধরলাম। তখন অলরেডি সকাল নয়টা বেজে গেছে! ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের যে আবার নাপিত্তাছড়ার পথ ধরতে হবে। সময় বড় কম! তাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সেই আগের সৌন্দর্যময় পথ ধরে চলে এলাম ফখরুল ভাইয়ের ঘরোয়া হোটেলে। তাই সকাল দশটাতেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম মুরগী, ডাল ভাত আর সব্জি দিয়ে। কষ্টকর ট্র্যাকিংয়ের কারণে সবাই খুব ক্ষধার্ত ছিলাম। তাই হাপুসহুপুস মজা করে খেলাম।
বাংলাদেশের সুন্দরতম প্রাকৃতিক ঝরনাগুলোর মধ্যে খৈয়াছড়া নিঃসন্দেহে অন্যতম একটি। চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের ভেতরে অনিন্দ সুন্দর এই জলপ্রপাতের অবস্থান। একে একে নয়টি বড় ধাপে এই জলপ্রপাত থেকে অনবরত ঝরছে পানি। সৌন্দর্যে ও বিশালতায় উভয়ক্ষেত্রেই এটি বাংলাদেশের অন্য সকল ঝর্ণার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। খৈয়াছড়া এলাকার পাহাড়ে অবস্থান বলে এর নামকরণ করা হয়েছে খৈয়াছড়া ঝর্না ।
খৈয়াছড়া ঝর্ণার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে হৃদয়ে কাব্যের রিনিঝিনি বেজে উঠেছিল। সেটাই তুলে ধরলাম এখানে।
খৈয়াছড়া ঝর্ণা
......................
ঝর্ণা! ঝর্ণা! খৈয়াছড়া ঝর্ণা!
তুমি সুন্দরী, তুমি অনন্যা।
মহাস্রষ্টার এক বিশেষ সৃষ্টি,
তোমার রূপে বিমোহিত দৃষ্টি!
উচ্ছল তরুণী, চপলা কিশোরী
কী দেব উপমা আহা মরি মরি!
তোমার রূপসূধা করেছি পান আকন্ঠ
মিটিয়েছি তৃষ্ঞা।
নিরন্তর গতিশীল কলকল ছলছল ছন্দে
উঁচু উঁচু গিরি বেয়ে উচ্ছল আনন্দে।
চোখেমুঝে ঝরছে আনন্দের বন্যা,
না কি তুমি বইছো পাহাড়ের কান্না?
ঝর্ণা! ঝর্ণা! খৈয়াছড়া ঝর্ণা!
স্বপ্নের সখী বিদ্যুৎপর্ণা
মর্ত্যলোকে আনো স্বর্গের সুধা সুপর্ণা!
শতলোক তোমার তরে দেয় রোজ ধর্ণা।
পূর্ণিমার জ্যোৎস্না, নীল সাগরের ঢেউ,
তোমার তুলনায় নাহি আর কেউ।
তবু আছে অতৃপ্তি, আফসোস,
প্রিয়তমা দেখে নি তোমার রূপ।
তবু প্রিয়াকে দেখাতে চাই না,
কারণ তুমি দুর্গম, দুর্জয়, বন্ধুর,
প্রিয়া আমার রক্তাক্ত হবে,
হোঁচট খাবে তোমার দুর্গম পথে
চলতে গিয়ে আহত হবে।
তোমার রূপে আমি মুগ্ধ বলে
ঈর্ষায় সে জ্বলবে বলে।
দুর্গমপথ পাড়ি দিয়ে এসে
চুমু এঁকে যায়, ভালবেসে যায়,
প্রতিদিন তোমার শত শত প্রেমিককবি।
তুমি কি হৃদয়ে ধারণ করো তাদের ছবি?
বিষয়: সাহিত্য
১৭৭৬ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
http://epaper.prothom-alo.com/view/dhaka/2016-12-13/1
খৈয়াছড়া ঝর্নার পাশেই, মানে মেইনরোডের পশ্চিম পাশে আমার ফুফুর বাড়ি হওয়াতে ছোটবেলায় একবার যাওয়া হয়েছিল। ধরতে পারেন আজ থেকে ১৭/১৮ বছর আগের কথা। তখনো ঝর্না ছিল, কিন্তু এখনকার মত রাস্তাঘাট, হোটেল রেস্তোরা এবং পরিচিতি কিছুই ছিলনা।
খুব খারাফ লাগতেছে যে যদি আমি দেশে থাকতাম, তাহলে হয়তো আপনাদের এই ভ্রমনে আমিও শরীক হতে পারতাম।
আমার বাড়ি থেকে মাত্র ১কিমি দূরে রয়েছে মীরসরাইয়ের সবচয়ে সুন্দর টুরিস্ট স্পট মহামায়া লেক। সেখানে গেলে আরোও বেশি মজা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ইনশাআল্লাহ আমি যখনই দেশে আসি, আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। আপনি আরো অন্যান্য ব্লগার ও ভ্রমণ পিপাসু ভাইদের নিয়ে মিনিমাম ৩ দিনের প্লান নিয়ে আসবেন। আমার বাড়িতে মেহমান থাকবেন, এই তিন দিন আমি আপনাদের সময় দিব। যদি স্বপরিবারে আসেন আরোও বেশি খুশি হবো। আমার ঘরে যথেষ্ট জায়গা আছে।
তিনদিনের কারণ হলো, প্রথম দিন নিয়ে যাবো মহামায়া ন্যাচারাল লেকে, ২য় দিন নিয়ে যাবো মুহুরি প্রজেক্টে তারপরের দিন আবার খৈয়াছড়া ঝর্নাতে নিয়ে যাবো।
এ ছাড়াও ইদানিং ইকোনোমিক জোনে ও সবাই আসতেছে, সেখানেও আপনাদের নিয়ে যাবো। আশাকরি আমার দাওয়াত কবুল করবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন