রয়েল ডিসট্রিক্ট, রয়েল ভাষা
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৯:২৯:৩০ সকাল
কী কারণে জানি না, নোয়াখালী জেলাকে Royal District বলে ডাকা হয়। রয়েল ডিস্ট্রিক্ট এর ভাষাটিও কিন্তু রয়েল মানে রাজকীয়।
এ রয়েল ভাষার লোকজন সারাদেশেই কম বেশি আছেন এবং তারা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। বৃহত্তর নোয়াখালী ফেনী, লক্ষীপুর ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত। তবে চাঁদপুর, দক্ষিণ কুমিল্লা এবং উত্তর চট্টগ্রাম বিশেষ করে মিরসরাই এমনকি বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলার লোকেরাও নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলে থাকেন। সুখের কথা (আসলে দুঃখের কথা) কি কৈতাম, জন্মসূত্রে বরিশালের বাসিন্দা হলেও আমার বউ চাকুরী করে নোয়াখালী! সে সূত্রে তিনিও এখন আমার সাথে একটু একটু নোয়াখালী ভাষা ব্যবহার করেন।
তো, এ নোয়াখালী ভাষা সম্পর্কে একটু প্র্যাকটিস হয়ে যাক।
ভাষার ক্ষেত্রে তারা বেশ স্মার্ট। বাংলা আমি শব্দটিকে নোয়াখালী ইংরেজীতে বলা হয় – I (চঁন্দ্রবিন্দু সহযোগে আঁই)। আমাদেরকে বলা হয় আঁঙ্গো, তোমাদের তোঁরগো …….।
“আমি আগামীকাল ঢাকায় যাবো”-এ কথাকে নোয়াখালীর ভাষায় বলা হবে- আঁই কাইল্লা ঢাকা যামু। প, ফ এবং শ আধ্যাক্ষর দিয়ে শুরু শব্দগুলিকে সাধারণত নোয়াখালীতে হ দিয়ে শুরু করা হয়। যেমনঃ পানিকে হানি, পাগলকে হাগল বলা হয়, শাককে বলা হয় হাগ, ফুলকে হুল।
এ নিয়ে দুটি বোনাস গল্প।
এক. এক নোয়াখালীর লোক হাফ টিকেট করে রেলগাড়িতে চড়ে ফেনী হতে ফাজিলপুর গিয়েছেন এবং হোটেলে (রেঁস্তোরায়) দুপুরের ভাত খেয়েছেন। তো ভদ্রলোক তার বন্ধুকে কথাটি শুদ্ধভাবে বলতে গিয়ে বলছে এভাবে- “আমি সেনীর থেকে সাজিলপুর সাফ টিকেটে গিয়েছি এবং ফোটেলে দুপুরে ভাত খেয়েছি।”
দুই. ঢাকায় বসবাসরত এক নোয়াখালীর বন্ধুকে অপর জেলার বন্ধু বলছে, এই তোরা নাকি প কে হ বলিস!
নোয়াখালীর বন্ধু- যেমন?
- যেমন পানিকে বলিস হানি।
- দূর হাগল, এগিন বেগ্গিন মিছা কতা। (মানে দূর পাগল, এগুলো সব মিথ্যা কথা)।
ছোট বাচ্চাকে রাতে ঘুমানোর আগে মা বলেন, ‘প্রস্রাব করে এসে শুয়ে পড়ো’, পাছে আবার বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়। নোয়াখালীর মায়েরা এ কথাটি বলেন এভাবে ‘মুতি আই হুতি থাক’।
সর্বনাম ‘সে’ কে তুচ্ছার্থে বলা হয় হ্যাতে (পুরুষ) এবং হিতি (স্ত্রী)। সম্মান অর্থে আমরা বলি উনি বা তিনি। নোয়াখালীর ভাষায় এটা হচ্ছে হ্যাতেন (পুরুষ) এবং হিতিন (স্ত্রী)।
এক নোয়াখালীর অসভ্য লোক রোজ বউ পেটাতো। বউটাও ছিল মুখরা। স্বামীকে তুই তোকারী করে। এজন্য মাইরটা জুটতো বেশি।
লোকে ছড়া কাটে-
হ্যাতে কইলে চ্যাতে,
ত কয় হ্যাতে।
(মানে তুই বললে রাগে, তারপরও তুই বলে)।
ঝাড়ুকে নোয়াখালীতে বলা হয় হিছা। এ শব্দটি নোয়াখালীতে বহুল ব্যবহৃত। কারো উপর বিরক্ত হলে এ কথার ব্যবহার হয়। যেমন- “হ্যাতেরে হিছা দি হিডি বার করি দে।” মানে হলো, তাকে ঝাড়ুপেটা করে বের করে দাও।
জিজ্ঞাসা অর্থে কী বলতে গিয়ে তারা এক আলিফ যোগ করেন- কীয়া। “তুই এগিন কীয়া কস? তুই হাগলনি কোন!” অর্থাৎ, তুই এসব কী বলিস? তুই পাগল হয়েছিস নাকি!
নোয়াখালীতে ধনী লোক আছেন বেশ। টাকা পয়সাকে তাই তারা এতটা গোণায় ধরেন না। বরং টাকাকে তুচ্ছ করে বলেন টিয়া। পাঁচ টাকাকে তারা বলেন- হাঁস টিয়া।(একটা হাঁস একটা টিয়া)।
এবার নোয়াখালীর ভাষায় একটা চিঠি। স্ত্রী তার প্রবাসী স্বামীকে লিখছে-
ওগো হরানের স্বামী, আন্নে ভালা আছেন্নি?
আইতো বেশি ভালা না। হইর ঘাটে দি হড়ি কাইন্না আঙ্গুল ভাঙ্গি গেছে। টিয়া হইসা কিছু দেন না। চিন্তা দান্ধায় চুল বেগ্গুন উডি গেছে। বেগ্গুনে দেইখলে বেলু কই বোলায়। বড় হোলার লুঙ্গি ছিরি গেছে। হিয্যায় অন স্কুলে যায় না। ছোড হোলা বল খেলতো যাই দাঁত ভাঙ্গি হালাইয়ছে। বড় মাইয়া ভালা ইকগা থ্রিপিসের লাই স্কুলে যায় না। ছোড মাইয়া হইরা বেডা দেখলে আব্বু আব্বু কইয়া বোলায়। আন্নে তাড়াতাড়ি বাড়ীত চলি আইয়েন। আন্নের মা কুত্তারে হিডি লাডি ভাঙ্গি হালাইছে আন্নে আইতে বিদাশী এক্কান লাডি আনিয়েন।
এটা তরজমা আর করলাম না। এতক্ষণ নোয়াখালীর ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে করতে নিশ্চয়ই শিখেছেন কিছুটা। তাই তরজমাটা আপনারাই করে কমেন্টে দিন।
আরো একটি তথ্য দিই। নোয়াখালীর মাইজদীকে বলা হয় জাপান এয়ারপোর্ট। মাইজদী বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। নোয়াখালীর প্রচুর লোক জাপান প্রবাসী। এজন্যই বোধকরি এমন নাম।
তো, যারা এখনো বিয়ে থা করেন নি, সেসব অবিবাহিত পুরুষদের জন্য চুপে চুপে একটা ফ্রী উপদেশ। বিয়ে করলে নোয়াখালী করবেন। নোয়াখালীর মানুষ বেশিরভাগক্ষেত্রে খুব অতিথিপরায়ণ, ধার্মিক। জামাই আদর কাকে বলে নোয়াখালী বিয়ে না করলে বুঝবেন না। আমার তো হাত পা বাঁধা, নাহলে একটা চান্স নিতাম আর কি! সে সুযোগ যখন নাই, তখন আপনাদেরকেই ফ্লোর দিলাম। বোনাস হিসেবে নোয়াখালীর ভাষাটাও শিখতে পারবেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারাও নোয়াখালীতে মেয়ে বিয়ে দিতে পারেন। মেয়ে সুখে থাকবে বলে আশা করা যায়।
আর হ্যাঁ, এতক্ষণ যে নোয়াখালীর এত গুণগান করলাম সবই কিন্তু মুফতে। কেউ আমাকে এজন্য এক কাপ চাও অফার করবে না।
বিষয়: সাহিত্য
৩১৭৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নোয়াখাইল্লা মাডি কাডি বানাই আমরা নুন.
মন্তব্য করতে লগইন করুন