কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কাপ্তাই লেক, রাঙ্গামাটি (ভ্রমণ)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:৫৭:৩২ দুপুর

সেদিন ধরণী সকল সৌন্দর্য্য ঢেলে দিয়েছিল কাপ্তাই লেকে। শীতের বিকেলে রবি বাবুর লালে লাল কিরণ ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল লেকের স্বচ্ছ জলে আর আঁকেবাঁকের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলিতে। পানকৌড়ি সে আনন্দে টুপ টুপ ডুব দিয়ে যাচ্ছিল স্ফটিকের মত স্বচ্ছ লেকের পানিতে।

আর আমি! অভিভূত নয়তে শুধু দেখতে লাগলাম নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য।

বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, ফিরে যাইও বারবার। ইচ্ছে হয় পানকৌড়ির মত দুটি হাতকে ডানা বানিয়ে উড়ে যাই লেকের আঁকেবাঁকে সেই পাহাড়গুলির শীর্ষে, একেবারে চূড়ায়, যেখানে মনে হয় মাথার খুব কাছে আকাশ। নিচে বিপুলা পৃথিবী! তারপর সাঁই করে টুপ টুপ ডুব মারি লেকের স্বচ্ছ পানিতে। আবার উঠে পাহাড় চূড়ায়, আবার টুপ ডুব পানিতে।



২০০৩ সাল। তখন সিএ পড়ি। আমাদের ফার্মের কর্ণধার ছিলেন প্রয়াত জামাল উদ্দীন আহমদ এফসিএ স্যার। বাংলাদেশের প্রথমসারির কয়েকজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এর একজন জামাল স্যার ছিলেন জাঁদরেল একজন রাজনীতিবিদও । প্রেসিডেন্ট জিয়া সরকারের সময় শিল্পমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। (আল্লাহ ভুলত্রুটি ক্ষমা করে স্যারকে বেহেশতবাসী করুন)। স্যারের খুব স্নেহভাজন ছিলাম। ফার্ম নতুন একটি কাজ পেল, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর নিয়ন্ত্রণাধীন কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এর নিরীক্ষা কাজ। ইতোপূর্বে পিডিবির প্রধান কার্য্যালয়সহ কয়েকটি প্রজেক্টে অডিট করেছি বিধায় স্যার এ দীর্ঘ কাজের জন্য আমাকেই টিমলীডার হিসেবে মনোনীত করলেন। নির্দিষ্ট দিনে আমার টিমমেট শাহজাহানকে সাথী করে প্রথমে চট্টগ্রাম চলে গেলাম। চট্টগ্রাম গিয়ে সেখানে একদিন বিশ্রাম নিলাম। পরদিন সকালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট টার্মিনাল হতে রওনা করলাম দু’জনে। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের শেষ। শীতের সকালের হিমেল পরশকে সঙ্গী করে চলছি আমরা বাসযোগে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে। বেশকিছু পথ পেরিয়ে বাস চলছে রাউজান রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ী পথ দিয়ে। ছোট মাঝারী বিভিন্ন পাহাড়ের মাঝে রাউজান রাঙ্গুনিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই মনোরম। ঐতিহাসিকভাবেও এ অঞ্চলটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পীকার, মন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ফজলুল কাদের চৌধুরী। চট্টগ্রাম তথা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষাবিস্তারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। আধুনিক চট্টগ্রামের রূপকারও মূলত তিনি। আজকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রও তাঁরই অমূল্য অবদান।

কাপ্তাই প্রবেশের পূর্বে কয়েক কিমি পথ ভয়াবহ অবর্ণনীয় সুন্দর। বেশ উঁচু পাহাড়ের উপর রাস্তা চলছে এঁকেবেঁকে, উঁচুনিচু হয়ে। তার বাম পাশে আরো বিশালাকার উঁচু পাহাড়, ডানে অনেক নীচুতে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ পানিতে বিচরণ করছে শত শত পাখি। পাহাড়ের আঁকে বাঁকে কিছু লোকালয়ও চোখে পড়ছে। দূর পাহাড়ে দেখা যাচ্ছে ঝর্ণার প্রবাহিত ধারা। শীতের সূর্যের মিষ্টি আলো লেকের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করছে অন্য রকম দৃশ্য। কোথাও কোথাও দুপাশে ঘন জঙ্গল, মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। সবুজে ঘেরা সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎই মনে হবে সামনের রাস্তা বুঝি আকাশে গিয়ে মিশেছে! আবার কখনও শান্ত রাস্তা বাঁক নিয়েছে অজানায়। কেবল রাস্তার প্রেমেও যে পড়া যায় সেটা এখানে না আসলে কেউ বুঝবে না। গাড়ি যদি কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে মুহুর্তেই ডান পাশের গভীর গিরিখাতে ধপাস! ভাবতেই গা শিউরে উঠে! সৌন্দর্যের সাথে ভয় ওতপ্রোতভাবেই জড়িত থাকে।









কাপ্তাই এসে গেলাম। বাস হতে নেমে চললাম আমাদের কাঙ্খিত স্থানে, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রধান গেইটে নাম পরিচয় নিশ্চিত হয়ে লিপিবদ্ধ করে আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিলো তৎকালীন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিডিআর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বলাবাহুল্য, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রজেক্ট এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঙ্গত কারণেই বেশ কঠোর। বেশ বড় একটি এলাকা নিয়ে এ কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রধান ফটক হতে অধুনালুপ্ত তিন চাকার টেম্পুতে করে যেতে হয় ভিতরে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি বা ধনুকের মতো বাঁকানো কাপ্তাই বাঁধটি দেখার মতো।

আমরা রেস্ট হাউজের পূর্ব নির্ধারিত কক্ষে উঠলাম। ব্যাগ লাগেজ রেখে চললাম একাউন্টস অফিসে। রেস্ট হাউজের বেশ নিকটেই একাউন্টস অফিস। তার পাশেই পানি নিয়ন্ত্রণের স্পিল ওয়ে। অন্যান্য কার্যালয়গুলি বেশ দূরে। হিসাব বিভাগের উপপরিচালক ছিলেন প্রৌঢ় বয়সের এক ভদ্রলোক। পরিচয় দিলাম। আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন আমাদের। অফিসিয়াল ফরমালিটিগুলো শেষ করে আমাদের কাজে লেগে গেলাম। কাজ করার জন্য আমাদের একটি কক্ষ দিলেন। চলতে থাকলো সবকিছু নিয়মমতো। কাপ্তাই বাঁধ এবং কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে একটু বলতে হয়। তখন পর্যন্ত এটা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও একমাত্র পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে তখন খরচ পড়তো মাত্র ১১ পয়সা।

প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। জলবিদ্যুতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল অন্যান্য বিদ্যুতের তুলনায় এটি অনেক সস্তা। জলবিদ্যুৎ পড়ন্ত বা স্রোত আছে এমন নদীর পানির চাপকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এটি নবায়নযোগ্য শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। একবার যদি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হয়, খুব কম শক্তি ব্যয়ের মাধ্যমে এটি চালানো যায়। এবং এটা জীবাশ্ম জ্বালানী, যেমন: তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় খুব কম পরিমাণে গ্রীনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে। পানিবিদ্যুৎ পৃথিবীর মোট বিদ্যুতের ২০% এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ৮৮%। তাছাড়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালানী-নির্ভর বিদ্যুৎ থেকে অনেক দীর্ঘস্থায়ী। যেহেতু এটা স্বযংক্রীয়, তাই শ্রমিক খরচও কম পড়ে। তাছাড়া এর নির্মাণ ব্যয়ও তুলনামূলক কম।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ণে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কার্য শুরু হয় ও ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ১৯৬২ সালের শুরুতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধন হলে পরিকল্পিত ৩টি জেনারেটরের মধ্যে ২টিতে উৎপাদিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। প্রতিটি ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আরও দুটি অতিরিক্ত জেনারেটর ১৯৮৭ সালে স্থাপন করা হয়। বর্তমানে যে অনিন্দ্যসুন্দর কাপ্তাই লেক, সেটি এ কর্ণফুলি নদীতে এ বাঁধের ফলেই সৃষ্ট।

কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্পিল ওয়ে-



কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎ শক্তির কারণে বাংলাদেশে শিল্প কলকারখানা স্থাপন ও সম্প্রসারণ গতিশীল হচ্ছে। বিদ্যুতের সহজলভ্যতার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে বিপুল এলাকায় সেচ সুবিধা অর্জন সম্ভব হয়েছ। জলাধারটি চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরসহ আশপাশের অঞ্চলকে বন্যার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করে চলেছে। কাপ্তাই লেককে কেন্দ্র করে যে মৎস্য শিল্প গড়ে উঠেছে তা থেকে বছরে ৭০০ টনেরও বেশি স্বাদুপানির মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। বাঁধের উজানে লেকের স্বচ্ছনীল জলরাশি বিসর্পিল রেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ময় নিসর্গের প্রতিটি প্রান্তর ছুঁয়ে বয়ে চলেছে।

প্রায় দেড়মাস ছিলাম এ কাজে আমরা। কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে গেলাম। যদিও প্রজেক্টের পরিবেশ বেশ সুন্দর, স্পিলওয়ে, কাপ্তাই বাঁধ, বাঁধে দাঁড়িয়ে কাপ্তাই লেক সহ দেখার মতো অনেক কিছুই আছে তবুও দীর্ঘদিন একস্থানে বন্দী। দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছিল। মধ্য জানুয়ারীতে শাহজাহান প্রস্তাব দিল, বস চলেন কাপ্তাই লেক হয়ে রাঙ্গামাটি ঘুরে আসি। প্রস্তাব লুফে নিলাম। ঠিক হলো এ বৃহস্পতিবারের হাফ অফিস শেষে কাপ্তাই লেক হতে বোট নিয়ে রাঙ্গামাটি যাবো। রাতে রাঙ্গামাটি থেকে পরদিন রাঙ্গামাটির দর্শনীয় স্থানগুলি দেখা শেষে ফিরে আসবো।

বৃহস্পতিবার লাঞ্চশেষে আড়াইটার দিকে আমরা কাপ্তাই লেক এর বোটঘাট হতে একটি নৌকা ভাড়া করে রওনা দিলাম রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্য। ছোট বড় পাহাড়ের আঁকেবাঁকে বয়ে চলছে কাপ্তাই হ্রদ। একদম স্বচ্ছ পানি। পানকৌড়ি ডুব দিয়ে মাছ ধরছে সেটিও দেখা যাচ্ছে পানির নীচে স্বচ্ছতার জন্য। পাহাড়ের মাঝে মাঝে লোকালয়। পাহাড়ের অধিবাসীরা এক পাহাড় হতে অপর পাহাড়ে যেতে নৌকা ব্যবহার করে। অনেক স্থানে দুটি পাহাড়ের মাঝে খুব সংকীর্ণ হয়ে বয়ে গিয়েছে হ্রদ। সুন্দর একটি পাহাড়ী লোকালয়ের কাছে এসে মাঝিকে থামতে বললাম। নৌকা ছেড়ে উপরে উঠলাম। একটু এগিয়ে দেখি পাহাড় হতে বয়ে চলছে খুব সুন্দর একটি ঝর্ণা। হাতে নিয়ে পান করলাম সেই পানি, ভারি মিষ্টি। পাহাড়ী নারী পুরুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত, আমাদের গ্রাহ্য করলো না। একজন হতে পাহাড়ী কলা কিনে খেলাম, ভারি মিষ্টি। কিছুক্ষণ পাহাড়ী পাড়াটিতে ঘোরাঘুরি শেষে আবার নৌকায় ফিরলাম। শীতের সময় বলে দুপুর গড়িয়ে দ্রুতই বিকেল নামলো। সূর্য মিষ্টি রোদ ছড়াচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্য লালরাঙ্গা বর্ণ ধারণ করলো। সে আলো লেকের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে তৈরি করেছে এক মোহনীয় পরিবেশ। সে এক অপার্থিক অনুভূতি! ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক ক্লিক। তখন ছিল ম্যানুয়াল ক্যামেরার যুগ। ব্যাটারী, ফিল্ম - অনেক হাঙ্গামা।

সন্ধ্যার একটু আগে পৌছে গেলাম আমরা রাঙ্গামাটি। শহরের কেন্দ্রে একটি হোটেলে উঠলাম, এখন নাম মনে পড়ছে না। রাঙ্গামাটি শহর সন্ধ্যার একটু পরই লোক চলাচল কমে নীরব হয়ে যায়। রাতে তাই দূরে কোথাও যাওয়া হলো না। পরদিন সকালে উঠে প্রথমে গেলাম ঝুলন্ত ব্রীজ দেখতে। দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করেছে পিলারবিহীন এ ব্রীজ। পিলার নেই বলেই এটাকে ঝুলন্ত ব্রীজ বলা হয় যদিও অনেকগুলো মজবুত স্টীলের তার দিয়ে দুই পাহাড়ে গেঁথে এটির ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। এরপর দেখতে গেলাম রাজবন বৌদ্ধবিহার। বৌদ্ধবিহার যেতে ছোট একটি নদী পার হতে হয়ে। এ নদীর ওপাড়ে নিকটেই ভারতের মিজোরাম রাজ্য। বোৗদ্ধবিহার দেখাশেষে চাকমা রাজবাড়ি। নদী পার হতে হলো আবারো।



চাকমা রাজবাড়িটি একসময় বর্তমান কাপ্তাই লেকের মাঝে অবস্থিত ছিল বলে জানা যায়। বাঁধের ফলে লেক সৃষ্ট হওয়ায় রাজবাড়ি স্থানান্তর হয়ে বর্তমান স্থানে আসে।





পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজপ্রথা আইনের পাশাপাশি প্রথাগত আইন প্রচলিত ও বিচারর্য্য। কিন্তু ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা খর্ব হওয়ায় রাজারা এখন অনেকটা নামেই। বলা চলে কাগুজে রাজা। তারপরও এমন তিন রাজার তিন রাজ্য টিকে আছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে। বর্তমানে শান্তিচুক্তির ফলে এখানে বাঙ্গালীদের অধিকার খুবই খর্বিত।

বংশ পরম্পরায় রাজ্য পরিচালিত হয়ে আসে। আনুমানিক ৫৯০ সালের দিকে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন খীসার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে রোয়াং রাজ্য (বর্তমান রামু), অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত), খ্যয়ং দেশ, কাঞ্চননগর (কাঞ্চন দেশ) ও কালজর (কুকিরাজ্য) প্রভৃতি রাজ্য বিজিত হলে বিশাল ‘পার্বত্য রাজ্য’ এর (চাকোমাস) পত্তন ঘটে।

এক সময় ধারা মিয়ার ছেলে মোগাল্যা রাজা হিসেবে সিংহাসন আরোহণ করেন। জুবান খাঁ ও ফতেহ খাঁ নামে তার দুই ছেলে ছিল। মগ জলদস্যুদের সঙ্গে জুবান খাঁর অনেক যুদ্ধ হয়। তার সেনাপতি কালু খাঁ সর্দারের সঙ্গে নবাবদের বড় বড় যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে দুটি বড় কামান দখল করে তারা। সেনাপতি ও রাজার ভাইয়ের নামানুসারে কামান দুটির নাম রাখা হয় কালু খাঁ ও ফতেহ খাঁ। বর্তমানে কামান দুটি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে চাকমা রাজবাড়ীর কাচারীর সামনে রাখা হয়েছে।

ফতেহ খাঁর তিন ছেলে ছিল। তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ছেলে শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এরপর শেরমুস্ত খাঁর ভাইয়ের ছেলে শের দৌলত খাঁ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এভাবে শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে জান বক্স খাঁ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে, তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ছেলে জব্বার খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে, তার মৃত্যুর পর ধরম বক্স খাঁ ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে

------------ এভাবে চলতে থাকে।

১৯৫৩ সালে ত্রিদিব রায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। তিনি পরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সে কারণে তার ছেলে বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায় ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৫১তম রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ৫টি ও রাজস্থলী উপজেলার ৯টি মৌজা বাদে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ২১টি, খাগড়াছড়ি সদরের ১২টি এবং রাঙামাটি জেলার ১৪৪টি মৌজাসহ মোট ১৭৭টি মৌজা নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত। মৌজাগুলোর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন হেডম্যান বা মৌজা প্রধানরা। তারা প্রথাগত নিয়মে সামজিক বিচার-আচারসহ স্থানীয়ভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তিন পার্বত্য জেলায় রাজপ্রথা চালু থাকায় প্রতি বছর আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজনা আদায় করেন তিন সার্কেল প্রধান। তিন পার্বত্য জেলার ভূমি রাজস্ব ঐতিহ্যগত রাজপ্রথার মাধ্যমে হেডম্যানরা আদায় করেন। তারা আদায় করা খাজনার অর্থ জমা করেন পৃথকভাবে সরকার, রাজা এবং হেডম্যানের অংশে।

বিকেলে একরাশ সুখস্মৃতিকে সঙ্গী করে বাসে চড়ে বসলাম কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে। উঁচু পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে বাস ভ্রমণটিও ছিল দারুণ এডভেঞ্চারপূর্ণ। তবে এসবকিছুর উর্ধ্বে সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য ছিল কাপ্তাই লেকের নৌকাভ্রমণ। পরবর্তীতে সেখানে আরো বারবার ছুটে গিয়েছি মোহনীয়, রোমাঞ্চকর, শিহরণ জাগানিয়া, মনোমুগ্ধকর সে অনুভূতির ছোঁয়া পেতে। একবার আমার সবচেয়ে প্রিয় জন্মদাত্রী মা এবং ছোটবোনকে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিয়ের পর গিয়েছিলাম স্ত্রীকে নিয়ে। বন্ধুদের নিয়েও গিয়েছি একাধিকবার। সবাই খুব মুগ্ধ। একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। একবার গিয়ে পরখ করেই দেখুন। আপনারও ছুটে যেতে মন চাইবে বারবার।



(তথ্যসূত্রঃ ঐতিহাসিক তথ্যাবলী নেয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লিখিত বিভিন্ন আর্টিকেল হতে)।


বিষয়: সাহিত্য

২৭৮৮ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378718
১৫ অক্টোবর ২০১৬ বিকাল ০৪:৩৫
স্বপন২ লিখেছেন : ভালো লাগলো / অনেক ধন্যবাদ / পিলাচ
১৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ০৯:০৯
313701
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এ একটি বিষয় এক ফ্লাডিং করা কি ঠিক হচ্ছে ভাই?!
378722
১৫ অক্টোবর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:১৩
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. Wonderful pictures, memories n description mashallah.
১৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ০৯:০৮
313700
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : Salam apu. Zajakallah khair.
378732
১৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ১১:১৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ। কাপ্তাই তে দেখার অনেক কিছু আছে। এখন নেীবাহিনির তত্বাবধানে লেক এর ভিতর একটা পার্ক হয়েছে। নিরাপদ ও সুন্দর। চাকমা রাজারা মুসলিম ছিলেন না। তারা মোগল দের অধিনস্ত হিসাবে খান উপাধি ও মুসলিম নাম ব্যবহার করতেন।
১৬ অক্টোবর ২০১৬ সকাল ০৯:২৯
313708
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ। সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
378744
১৬ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০২:০৪
আফরা লিখেছেন : ২০০৩ সালের ঘটনা এখন অবশ্যই অনেক কিছু অন্য রকম হয়ে গিয়েছে যেমন আপনার চেহারা ।

ধন্যবাদ ভাইয়া ।
১৬ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০২:৩৫
313716
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : চেহারা বেশি পরিবর্তন হয় নি, একটু মোটা হয়েছি মাত্র। হাহাহা। দেশে আসলে সুযোগ পেলে ঘুরে আসবেন কিন্তু।
378763
১৭ অক্টোবর ২০১৬ সকাল ১১:৪৯
নেহায়েৎ লিখেছেন : সুন্দর ইতিহাসসহ তুলে ধরেছেন ধন্যবাদ। আমি কাপ্তাই কয়েকবার গেছি। তবে জলবিদ্যুৎ এর ওখানে গেছি একবার। তবু দূর থেকে দেখতে হয়েছে।
১৭ অক্টোবর ২০১৬ রাত ০৯:০৩
313736
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : জলবিদ্যুৎ প্রজেক্টটি অনেক সুন্দর ভিতরে। আলহামদুলিল্লাহ, দেড়মাস কাজ করেছিলাম সেখানে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File