নারিকেল জিঞ্জিরা (ভ্রমণ)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ০৪:০৭:৪৯ বিকাল
এটি বাংলাদেশের গর্ব, একটি অনিন্দ্য সুন্দর দ্বীপ। যেখানে সাগরের নীল লোনা অথচ স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জল এর ফেনীল ঢেউ আছড়ে পড়ে প্রবালময় সৈকতে। গাঙচিল সেই আনন্দে টুপ টুপ করে অবগাহন করে নীল জলে, আবার পাখা মেলে দেয় আকাশে। যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ত মানুষগুলো পর্যটক হয়ে আসে সারা বছরের দুঃখ কষ্ট ক্লেদ যন্ত্রণা ভুলে একটু মুক্তির আনন্দ পেতে, একটু রোমান্স এর ছোঁয়া পেতে, একটু আনমনা হয়ে যেতে। ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক পড়ে, তুলে নিয়ে যায় স্মৃতিগুলো। নাগরিক জীবনে সে স্মৃতিগুলির রোমন্থন অন্যরকম আনন্দে ভাসিয়ে নেয়। বার বার ফিরে যেতে চায়, ফিরে যাইও বার বার।
প্রথমবার যখন যাই তখন ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাস। সদ্য জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে। মনটা তখন ছিল বেশ বিষন্ন আর চরম অস্থির। একটা গ্লানি কুরে কুরে খাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল পালিয়ে বাঁচি। এ সময় কক্সবাজারে দলবেঁধে অফিস ট্যুর পাঁচদিনের। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু অফিস প্রোগ্রাম বলে এভয়েড করা যাচ্ছিল না। প্রথম দুইদিন হোটেলের সম্মেলনকক্ষেই অফিসের কর্মশালা। আসা যাওয়ায় একদিন আর বাকি দুইদিন ছিল কক্সবাজার সৈকত আর সেন্টমার্টিন দর্শনের শিডিউল।
নির্দিষ্ট দিনে গ্রীনলাইন পরিবহনের বুকিং করা গাড়িতে রাতের বেলায় রওয়ানা দিলাম। প্রায় ৪০ জনের বড় একটি দল। পরিবার নিয়েও যাচ্ছে কেউ কেউ। পরেরদিন সকাল ৯ টায় পৌছলাম কক্সবাজার। সায়মন হোটেলে উঠলাম। সবাই ভ্রমণক্লান্ত কিন্তু আমাদের বুকিং দেয়া কক্ষগুলি তখনো খালি হয় নি। বেলা ১২ টায় খালি হবে। ম্যানেজার সরি বলে গেল। আমরা রিসিপশনের সোফায় বসে ঝিমুতে লাগলাম। একজন বুদ্ধি দিল বসে না থেকে সবাই বীচে চলি। যে কথা সেই কাজ। ব্যাগ লাগেজগুলি রাখার জন্য একটি স্টোররুম পেলাম। সেখানে সব রেখে হৈ রৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার বীচে। ক্লান্তি কোথায় উবে গেল! দুই ঘন্টা দাপাদাপি করে ফিরে এলাম হোটেলে।
ইতোমধ্যে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষগুলি খালি হলো। আমরা হোটেল কক্ষে গিয়ে গোসল ও ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম হোটেলের রেঁস্তোরায়, মেন্যু ছিল সাদাভাত, কোরাল মাছ আর চিকেন। সন্ধ্যা ৭ টা হতে ওয়ার্কশপ শুরু। মাঝখানের সময়টা বিশ্রামের জন্য। লাঞ্চ শেষে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে সবাই ঘুমুতে গেলাম দিনেদুপুরে। কয়েকঘন্টা বেশ ঘুমানো হলো। এরপর সন্ধ্যা হতে রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত একঘেঁয়ে ওয়ার্কশপ। মাঝখানে ডিনারব্রেক ছিল অবশ্য। রাত কাটিয়ে পরদিন সকালের নাস্তার পর আবার শুরু হলো ওয়ার্কশপ। চললো রাত ১২ টা পর্যন্ত। তবে ক্লান্তিকর একঘেঁয়ে ওয়ার্কশপটি শেষদিকে বেশ প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল অংশগ্রহণকারীদের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায়। এছাড়া গল্প, কবিতা, খালি গলায় গান গেয়ে সবাই মাতিয়ে রেখেছিল অনুষ্ঠানকে। দাপ্তরিক কাজ শেষ। এবার পর্যটন পরিকল্পনা। ঠিক হলো আগামীকাল সবাই যার যার মতো কক্সবাজারে ঘুরবে। পরদিন ভোর ছয়টায় রওয়ানা করতে হবে টেকনাফ। সেখান থেকে কেয়ারী সিন্দাবাদ জাহাজে করে সেন্টমার্টিন। কক্সবাজার বীচে পরদিন বেশ হৈ চৈ, লম্ফঝম্ফ চললো। আমি ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার এসেছিলাম কক্সবাজার। পতেঙ্গা বীচ হতে তেমন বেশি পার্থক্য চোখে পড়ে নি। পতেঙ্গা বীচের মতো বড় বড় পাথরের বøক এখানে নেই। তবে হোটেল সী গাল এর সামনের ঝাউবনটাই যা একটু আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে এই সৈকতকে। মনটা পড়ে আছে সেন্টমার্টিনে। কখন যাবো এমন একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। সৈকতে কিছুক্ষণ দাপাদাপি শেষে কক্সবাজার শহরটা একটু ঘুরে দেখলাম। টুকটাক কেনাকাটা করলাম। দুপুরে সবাই খাওয়ার জন্য আবার হোটেলে ফিরে এলাম। ঠিক হলো আজ রাতে সমুদ্র সৈকতে বারবিকিউ উৎসব হবে। আমাদের এক কলিগ বারবিকিউ চুলাও নিয়ে এসেছিলেন সাথে করে।
রাতটা আসলে সত্যিই কেটেছিল বেশ। আকাশে ছিল অর্ধেক চাঁদ। সৈকতে বালুর উপর চুলায় মুরগী বারবিকিউ করে পরোটা দিয়ে খেয়েছিলাম সবাই। দারুণ হয়েছিল। চাঁদের আলো আর জোয়ারের পানি আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে সেদিনের বারবিকিউ উৎসবটি হয়েছিল সত্যিই অনন্য, সারাজীবন মনে রাখার মতো ঘটনা। বারবিকিউ উৎসব শেষে রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা ফিরলাম হোটেলে। আগামীকাল সেন্টমার্টিন যাচ্ছি এ উত্তেজনা নিয়েই ঘুমোতে গেলাম।
ভোর ছয়টায় রওনা করলাম সবাই বাসে করে টেকনাফের উদ্দেশ্যে। আমরা কেয়ারী সিন্দাবাদ এর প্যাকেজ নিয়েছিলাম। হোটেল হতে বাসযোগে টেকনাফ নেয়া, টেকনাফ হতে জাহাজে করে সেন্টমার্টিন, সেখানে অবকাশ হোটেলে রাত্রিযাপন, খাবার দাবার এবং পরদিন আবার কক্সবাজার পৌছানো পর্যন্ত সবকিছু প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত। তখন সম্ভবত এ প্যাকেজটা ছিল ২,৩০০ টাকা। কক্সবাজার হতে টেকনাফ পৌছতে দুই ঘন্টার মতো লেগেছিল। জেটিঘাঁট পার হয়ে কেয়ারী সিন্দাবাদ জাহাজে উঠলাম।
গাইড আমাদের নিয়ে আসনগুলি বুঝিয়ে দিলেন, দোতলায় ছিল আমাদের আসন। ৯ টার দিকে জাহাজ ছাড়লো। একপাশে পাহাড় বেষ্টিত নাফ নদীর সৌন্দর্যের সাথে শাহপরাণ দ্বীপ, উত্তাল সাগরের রূপ, দৃষ্টিসীমার মধ্যে মায়ানমার দেখতে দেখতে পাড়ি দিলাম আড়াই ঘন্টার পথ। সাড়ে এগারোটায় পৌছে গেলাম সবার কাঙ্খিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। জাহাজ হতে নেমে জেটি পেরিয়ে কূলে উঠলাম। এবার হোটেলে যাওয়ার পালা। কয়েকটি রিক্সা ভ্যান ভাড়া করা হলো। জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় আমাদের হোটেলে পৌছে দিল তারা। সব খরচ অবশ্য গাইডই বহন করছেন যিনি কেয়ারী সিন্দাবাদ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি।
সেন্টমার্টিন সম্পর্কে একটু বলে নিই।
মায়ানমার উপকূল হতে মাত্র ৮ কিমি পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্বাংশে এ প্রবাল দ্বীপটির অবস্থান। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এখানে লোক বসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে সাত হাজারেরও বেশি লোক বসবাস করে। দ্বীপের লোকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। পর্যটক ও হোটেল ব্যবসায়ীরাই প্রধানত তাদের কাছ থেকে মাছ কেনেন। এ ছাড়াও দ্বীপবাসী অনেকে নারিকেল, পেজালা এবং ঝিনুক ব্যবসা করে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অনেক ছোটখাট ব্যবসাও গড়ে উঠেছে। তবে হোটেল ও পর্যটনব্যবসায়ীরা ধনিক শ্রেণীর ও তারা দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা নন। এ দ্বীপ শুঁটকী উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। কোরাল, লাক্ষা, ছুরি, লইট্যাসহ নানাজাতের মাছ এখানে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়।
ইতিহাস হতে জানা যায়, প্রথম কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। উল্লেখ্য এরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিতে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো। কালক্রমে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এই দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই চিনতো। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপের বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবি। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলকষ্ঠ এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় 'নারকেল গাছ প্রধান' দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয়অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরীপে এরা স্থানীয়নামের পরিবর্তে খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে।
সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায়এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্ত‚প আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্ট মার্টিন্সের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।
ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তর পাড়া। দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় দক্ষিণপাড়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সঙ্কীর্ণ লেজের মতো এলাকা। এবং সঙ্কীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের ছোট দ্বীপ আছে যা স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা ছেঁড়াদ্বীপ নামে পরিচিত। এটি একটি জনশূন্য দ্বীপ। ভাটার সময় এই দ্বীপে হেটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময়নৌকা প্রয়োজন হয়। এ ছেঁড়াদ্বীপ এর সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনাতীত।
দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। তবে কিছু কিছু বালিয়াড়ি দেখা যায়। এ দ্বীপটির প্রধান গঠন উপাদান হলো চুনাপাথর। দ্বীপটির উত্তর পাড়া এবং দক্ষিণ পাড়া দু’জায়গারই প্রায় মাঝখানে জলাভূমি আছে। এগুলো মিঠা পানি সমৃদ্ধ এবং ফসল উৎপাদনে সহায়ক। দ্বীপটিতে কিছু কৃষি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায়কম।
প্রাণীবৈচিত্র্যঃ
সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১শ ৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১শ ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১শ ৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২শ ৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১শ ২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ, সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।
উদ্ভিদবৈচিত্র্যঃ
দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তা নেই। তবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে কেওড়ার ঝোপ-ঝাড় আছে। দক্ষিণ দিকে কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেয়া, শ্যাওঙা, সাগরলতা, বাইন গাছ ইত্যাদি।
অবকাশ হোটেলে উঠলাম আমরা। ফ্রেশ হয়ে মাছ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম পূর্ব হতে ঠিক করা কেয়ারী সিন্দাবাদ কর্তৃপক্ষের একটি রেস্টুরেন্ট এ। কোরাল মাছটি খেতে বেশ হয়েছিল। লাঞ্চের পর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম দ্বীপ পরিদর্শনে। এক স্থানে দেখলাম বিশাল বিশাল মাছ কেটে শুকাতে দেয়া হয়েছে মানে শুঁটকী তৈরি করা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ‘সমুদ্র বিলাস’ নামে একটি বাড়ি পেলাম, সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর বাড়ি। বাড়ি আহামরি কিছু নয়, তবে সৈকতে ঘেঁষে। দ্বীপে নানাবর্ণের, নানা আকৃতির, নানা ডিজাইনের হাজারো প্রবাল। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল পানি, মাঝে মাঝে সীগালের দলবেঁধে উড়াউড়ি, কেয়া আর কেওড়াবনের ঝোপ, ঝোপের ভিতরে সামুদ্রিক কাছিমের আবাস , নারিকেল গাছের সারি সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। দ্বীপের পূর্বপাশ হতে বামদিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দক্ষিণদিকের কেওড়াবনে এসে পড়লাম। তখন ভাটার সময়। ছেঁড়াদ্বীপটাও দেখা যাচ্ছে। চাইলে হেঁটে পার হওয়া যাবে এখন। কিন্তু আগামীকাল আমাদের শিডিউলে ছেঁড়াদ্বীপ আছে। তাই একা একা আর গেলাম না পরদিন দলবেঁধে যাবো বলে। কেওড়াবন পেরিয়ে একসময় দ্বীপের মাঝখানে লোকালয়ে চলে এলাম। দেখলাম একটি ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। আমি সাইকেল চালাবো বলাতে ৫০ টাকায় ভাড়ায় রাজী হয়ে গেল। নতুন বুদ্ধি মাথায় এলো। দ্বীপের চারিপাশে সাইকেল নিয়ে ঘুরবো। বিসমিল্লাহ বলে রওনা করলাম সাইকেল নিয়ে। বালুময় দ্বীপে এভাবে সাইকেল চালানো সত্যিই কঠিন বিষয়। তবুও চললাম। দ্বীপের চারিদিকে প্রায় তিনভাগ পথ সাইকেল চালালাম, এসময় জোয়ার শুরু হলো। জোয়ারের পানি বাড়ছে দ্রæত, আর নিরাপদ নয়। সাইকেল নিয়ে আবার দ্বীপের ভিতরে চলে এলাম। ছেলেটির নাম্বার নিয়েছিলাম। ফোন দিলাম, স্থানের নাম বললাম। সে এসে সাইকেল নিয়ে গেল। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় দেড়ঘন্টা সাইকেল চালানোর এ অভিজ্ঞতা সত্যিই দারুণ।
ডিনার সারলাম রাত আটটার মধ্যেই। তার আগে কিছু কেনাকাটা করলাম সবাই। বার্মিজ আচার, শাল ও বিভিন্ন হস্তসামগ্রী পাওয়া যায় এখানে। অনেকে শুঁটকীও কিনলো, কারণ এখানকার শুঁটকী বিখ্যাত। ডিনার শেষে আবার দলবেঁধে বীচে। চাঁদের আলোয় দলবেঁধে সেন্টমার্টিন দ্বীপ দর্শন! সবাই বেশ রোমাঞ্চিত। অনেকে হেড়ে গলায় গান ধরলো। তবে কারো কারো গানের গলা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। রাতের সেন্টমার্টিন সত্যিই অন্যরকম। চাঁদের আলোয় তার একরূপ, একরকম অনুভূতি, আবার এর অন্ধকারের নির্জনতাও অন্যরকম উপভোগ্য। দশটার মধ্যে হোটেল এর লাইট বন্ধ হয়ে গেল। সেন্টমার্টিনে বিদ্যুৎসংযোগ নেই। রাত দশটা পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ চলে, এরপর বন্ধ। ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু এলার্ম দিয়ে রাখলাম রাত দুইটায়। রুমমেটকে নিয়ে চলে গেলাম অবকাশ হোটেল এর ছাদে। ভাগ্য ভালোই বলতে হয়। ছাদে দেখি কয়েকটি চেয়ার পাতা আছে। আকাশে চাঁদ নেই, হাজার হাজার তারার মেলা। চেয়ারে বসে আছি। অন্ধকার রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে শুধু শুনছি সাগরের শোঁ শোঁ গর্জন। সে এক ভাষাহীন অনুভূতি! এ অনুভূতির তুলনা হয় না। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানা তায়ালাকে ধন্যবাদ জানালাম এ সুযোগ দেয়ার জন্য। কিভাবে যে কেটে গেল কয়েকঘন্টা সময় টের পেলাম না। মসজিদ হতে আজান শুনতে পেয়ে বুঝলাম ভোর হয়েছে। আর একটু পর হোটেলে ফিরে ফজরের নামায শেষে ঘুমাতে গেলাম আবার।
পরদিন নাস্তা করতে গেলাম সৈকত সংলগ্ন হোটেল ব্লু মেরিন এর রেঁস্তোরায়। সেখানে নিউজিল্যান্ড হতে আগত এক সাংবাদিক দম্পতি পরিবারের সাথে পরিচিত হলাম। বাংলাদেশের নির্বাচন পরিদর্শন করতে এসেছিল তারা। তাদের সাক্ষাতকার নিয়ে মর্মাহত হলাম। মিডিয়ার প্রচারণাটাই তাদের কাছে বাংলাদেশের চিত্র! এর বাইরে তেমন কিছু জানে না। নির্বাচন পরিদর্শন করেছে তারা মূলত ঢাকায়। তারা এটাকে বলছে গণতন্ত্রের উত্তরণ! পর্দার আড়ালের ঘটনাবলীর বিষয়ে তারা তেমন জানে বলে মনে হলো না। নিজের মতো করে তাদের প্রকৃত পরিস্থিতি একটু বুঝানোর চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশ যে একটি গভীর খাদের কিনারে সেটি ব্যাখ্যা করলাম। আমার কথায় তারা একটু নড়েচড়ে বসলো। মহিলা নোটবুক বের করে কিছু পয়েন্ট লিখে নিল। লোকটি আমাকে আরো কিছু প্রশ্ন করলো। সাবলীলভাবেই জবাব দিলাম।
নাস্তাশেষে ট্রলার ভাড়া করে সবাই চললাম ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে। আমাদের টিমে কয়েকজন মহিলা ছিল যারা পরিবারসহ এসেছে। এরা সাঁতার জানতো না বিধায় ভয়ে বেশ হৈ চৈ কান্নাকাটি করেছে। তবে রোজলীন নামে উগান্ডার এক নিগ্রো মেয়ে ছিল। সে খুব উচ্ছসিত। ছেঁড়াদ্বীপে ব্রিটিশদের একটি স্মৃতিচিহ্ন দেখলাম। বড় একটি আয়রন পিলার গেঁথে তার মধ্যে সাংকেতিক কিছু হিসাব নিকাশ। উনুন পেতে তাজা মাছ ফ্রাই করছে কিছু লোক পর্যটকদের জন্য। তরতাজা কাকড়া, লবস্টার দেখলেই জিভে পানি চলে আসে।
এ দ্বীপটি বেশ ছোট, তবে সৌন্দর্যে তুলনাহীন। দ্বীপের বড় অংশ জুড়েই কেওড়া বন। সৈকতের প্রবালগুলি সেন্টমার্টিনের চেয়েও সুন্দর। কয়েকঘন্টা এ ছোট দ্বীপটিতে সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে সেই ট্রলারে করেই আবার ফিরে এলাম। বিকেল সাড়ে তিনটায় আমাদের পাড়ি দিতে হবে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে সেই কেয়ারী সিন্দাবাদ শীপেই। বিদায় নারিকেল জিঞ্জিরা, বিদায় ছেঁড়াদ্বীপ। তোমার রূপসূধা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আবার আসবো, বারবার ফিরে আসবো।
পরের বছর আবার গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমবারের স্মৃতি জাগরুক থাকবে আজীবন। আল্লাহপাক আবার কবে যাওয়ার সুযোগ দিবেন প্রতীক্ষায় আছি।
বিষয়: সাহিত্য
১৭৭১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিডি পরিচালকদের উদাসীনতা দেখে দুঃখ হয় ,কষ্ট লাগে আবার রাগ ও হয় কিন্ত কি করব যাওয়ার তো আর জায়গা নেই ।
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
আমরা গিয়েছিলাম অফ সিজনে ১৫-১৬ এপ্রিল ।
১ রাত থেকেছিলাম ব্লু মেরিনেরই পাদদেশের একটা কটেজে ।
কেয়ারী সিনবাদে পৌছে খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলে যখন বের হলাম তখন কিছুটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম । কারণ এলাকা ঘুরে মনে হয়েছিল যে , আমরা ছাড়া মনে হয় আর কোন পর্যটক নাইট স্টে করছে না (কারণ কেয়ারী সিনবাদ ১২/১২.৩০ টায় এসে বিকেল ৩টায় আবার ফিরে যায়)।
যা হোক , একটা রিকশা ভ্যান ভাড়া করে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঘুরেছিলাম ।
সমুদ্র বিলাস অবকাশ হোটেলের পাশেই । মনে করেছিলাম মাঝারি সাইজের বাড়িই হবে । গ্রামের বাড়িগুলোর মত একান্নবর্তী কয়েকটি বাড়িই দেখলাম মনে হয় । হতাশই হয়েছি।
পরে গিয়েছিলাম দারুচিনি দ্বীপে । খুব ভাল লেগেছিল । তবে গা ছমছম করছিল , কারণ একেবারেই একা , আশে পাশে কোন পর্যটক নেই ।
দারুচিনি দ্বীপ যাবার পথে সেন্ট মার্টিন ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল চোখে পড়েছিল । আমার চোখে সেন্ট মার্টিনের সবচেয়ে সুন্দর বিল্ডিং মনে হয়েছে এটাকে । ট্রিপলেক্স বললেও ভুল হবে না ।
কিন্তু কোন ডাক্তার নেই , কোন নার্স নেই , এমনকি কোন রোগীও নেই । শুধু মাত্র একজন গ্রাম্য ডাক্তার এটাকে চালায় !
ওয়াইফকে বলেছিলাম - চলো আমরা মজা নিতে বলি যে, আমরা ডাক্তার, এখানে নতুন পোস্টিং পেয়ে এসেছি।
আফসোস লেগেছিল যে আমাদের আসলে মাইন্ড সেট হয় না এসব জায়গায় আসতে । সরকারও সেরকম ফ্যাসিলিটিজ আনতে পারে নি কাউকে আকৃষ্ট করতে ।
বেশী অসুস্থ হলে নাকি সাগর পাড়ি দিয়ে মেইন ল্যান্ডে আসতে হয় !
সন্ধ্যের আগেই কটেজে ফিরে এসেছিলাম । সেন্ট মার্টিনে জেনারেটর দিয়ে কাজ চালানো হয় , ইলেকট্রিসিটি থাকে বিকেল সাড়ে ৫ টা হতে রাত এগারোটা / সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ।
আর এজন্যই গরমের সিজনে সেন্ট মার্টিনে তুলনামূলকভাবে লোক কম আসে । যেদিন ফিরে আসবো সেদিন সাগর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কোস্ট গার্ডের ওখানে গিয়েছিলাম । যাবার পথে জেলেদের মাছ ধরে সাগর পাড়ে রাখা দেখেছি । বিরাট লবস্টার ছিল সেখানে ।
কোস্টগার্ডের ইন চার্জের সাথে ঘন্টা খানেক গল্প করি , উনিই আমাদেরকে দেখে ডেকে নিয়েছিলেন । মনে করেছিলাম বোধ হয় নিষেধ করবেন এখানে ঢুকতে । জানালেন উনার কথা , কিভাবে পাচার ঠেকাতে কাজ করেন সেটার কথা ।
একমাত্র উনাদের স্থাপনাতে মনে হয় ২৪ ঘন্টা ইলেকট্রিসিটি থাকে ।
ফেরার আগে ব্লু মেরিনে গিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলি । আসার পর ব্লু মেরিন দেখে আফসোস হয়েছিল যে কেন ওখানে উঠলাম না । পরে দেখলাম যে ওখানে কোন কাক পক্ষীও (পর্যটক)নেই অফ সিজন বলে ।
বিকেলে যখন ফিরে যাচ্ছিলাম তখন নাফ নদীতে ঢোকার মুখে কাল বৈশাখী ঝড়ে পড়েছিলাম । ডেক থেকে নেমে গিয়ে ভেতরে ঢুকে ছিলাম। ঝড়ে পর চারপাশে পরিবেশ বেশ স্বচ্ছ ও মনোরম হয়ে গিয়েছিল । আর নাফ নদীর টেকনাফের পাড়ের দৃশ্যও তো অসাধারণ ।
আমি সবসময়েই বলি - আল্লাহ আমাদেরকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে বিশেষভাবে দিয়েছেন । কিন্তু সেটাকে পরিচর্যা করার কোনই আগ্রহ নেই সংশ্লিষ্টদের ।
বাংলাদেশের পর্যটকদের বেশীর ভাগই যায় কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনে । কক্সবাজারকে বেশ ডেভেলপড করতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্টরা (সাগরপাড়ের দিকে)। সেন্ট মার্টিনের ব্যাপারে সেটা করা যায় খুব সহজেই । প্রথমেই আসবে নিরবিচ্ছিন্ন ইলেকট্রিসিটির কথা । এটা আনতে পারলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার লোকেরা বালি ও ফুকেটের আগে সেন্ট মার্টিনকে চুজ করবে ।
দুঃখের কথা- দিন কয়েক আগে শুনলাম যে কেয়ারী সিনবাদ এর কার্যক্রম নাকি বন্ধ করে দিয়েছে । অথচ এ বছরকে পর্যটন বৎসর হিসেবে ঘোষনা করেছিল সরকার।
আমি মনে করি যে বাংলাদেশের মানুষ যেরকম ভ্রমন পিপাসু হয়ে উঠেছে , সামনের দিন গুলোতে অফ সিজন বলে আর কিছু থাকবে না । একেক জনের ছুটি একেক সময়ে । আবার অনেকেই নিজ পরিবার তথা বন্ধু বান্ধদেরকে নিয়ে যায় , মাস গেদারিং না হলেও সমস্যা হয় না । একেকটা সিজনের একেক রকম মজা । ইদানিং বর্ষার সিজনে মানুষ কক্সবাজার যেতে শুরু করেছে ! আমার কাছে এটাকেই কক্সবাজারে যাবার চমৎকার সময় মনে হয় ।
আমরা শুধু বাংলাদেশীরাই পারি পর্যটন শিল্পকে উপরে উঠাতে । সরকার এক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা সহজ লভ্য ও আরামদায়ক করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে ।
ইন্ডিয়াতে নাকি তাজমহল ভিজিট করতে বিদেশীদের লাগে ৭০০ রুপি আর ভারতীদের লাগে নাকি ৩৫ রুপি !
মন্তব্য করতে লগইন করুন