চিম্বুক পাহাড়, শৈলপ্রপাত, সাঙ্গু নদী আর মেঘলা (ভ্রমণ)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৪ অক্টোবর, ২০১৬, ০২:৩৩:৩০ দুপুর

চিম্বুক পাহাড়, শৈলপ্রপাতঃ

নীলগিরি এবং বান্দরবান শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত চিম্বুক পাহাড়। বান্দরবান শহর হতে ২৬ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের অন্যতম উঁচূ শৃঙ্গ চিম্বুক পাহাড় অবস্থিত। চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে বম নৃগোষ্ঠীর গ্রাম দেখতে পাওয়া যায়। অল্প কিছুদূরে ম্রোদের গ্রাম অবস্থিত।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ফুট। চিম্বুক পাহাড়কে ঘিরেই পাহাড়ী মুরুং (ম্রো) জনগোষ্ঠীর বাস। পাহাড়ের চূড়ায় একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। এখান থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখা যায়। চিম্বুক পাহাড়ে উঠতে গিয়েই দেখি হিম হিম ঠান্ডা। আসলে চিম্বুক পাহাড় হচ্ছে মেঘের রাজ্য। সবসময় এখানে কমবেশি মেঘ ভাসতে থাকে সাদা পেজা তুলার মতো। মেঘগুলি শরীরে হিমেল চুমু দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধার্ত থাকায় এবং সময় স্বল্পতার কারণে আমরা ওয়াচ টাওয়ার দেখি নি।







চিম্বুক পাহাড় হতে নেমে আবার চড়লাম গাড়িতে। আধাঘন্টা মতো চলার পর ড্রাইভার আবার ব্রেক কষলো। আরে এ যে সুন্দর একটি উচ্চগতির প্রবাহিত ঝর্ণা! হ্যাঁ, এটিই হচ্ছে বান্দরবানের বিখ্যাত শৈলপ্রপাত। গাড়ি হতে নেমে মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকি শৈলপ্রপাত। কেউ কেউ ঝর্ণার পানিতে অবগাহনে ব্যস্ত। ঝর্ণার ঝিরিপথ ধরে হেঁটে হেঁটে দূরেও চলে যাচ্ছে সাহসী পর্যটকরা দলবেঁধে। আমরা ক্লান্ত ছিলাম, সেদিকে আর গেলাম না। তবে ঝর্ণার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। ছবি তুললাম বেশ।





সারাদিনের ভ্রমণে বেশ ক্লান্ত। শহরে পৌছেই প্রথমে খেয়ে নিলাম জামান রেঁস্তোরায়। এরপর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুই ঘন্টার ঘুম। ঘুম হতে জেগে পরদিনের জন্য ভ্রমণপ্ল্যান করলাম। ঠিক হলো পরদিন শহরটাই ঘুরে দেখবো। আর বিকেলে মেঘলা পর্যটন স্পটে ঘুরে আসবো। রাতের খাবার আর এশার নামায সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

স্বর্ণমন্দির, সাঙ্গু নদী, মেঘলাঃ

পরদিন একটু বেলা করেই বের হলাম। শহরে নাস্তা সেরে প্রথমেই চললাম স্বর্ণমন্দির দেখার উদ্দেশ্যে। বান্দরবান সদর হতে ৮ -১০ কিমি দূরত্বে বালাঘাট নামক স্থানে অবস্থিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম এ উপসনালয় একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটও বটে। এটি “বৌদ্ধ ধাতু জাদী” নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির। তবে নামে স্বর্ণমন্দির হলেও এটি স্বর্ণনির্মিত নয়, সোনালী বর্ণের জন্যই এমন নামকরণ। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্বর্ণমন্দিরটি দেখতে সত্যিই আকর্ষণীয়।





স্বর্ণমন্দির দেখা শেষে আবার শহরে ফিরে এলাম। জামান রেঁস্তোরাতেই সেরে নিলাম দুপুরের খাবার। হোটেলে ফিরলাম একটু ক্লান্তি কাটিয়ে রিফ্রেশ হওয়ার জন্য। ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিলাম। শরীরটা আবার ঝরঝরে হয়ে গেল। বউ এদিকে ক্লান্তিতে বেঁকে বসলো আর একটু ঘুমাবে বলে। বুঝিয়ে নিয়ে রওনা করলাম আবার। এবার গন্তব্য সাঙ্গু নদী দর্শন। পূর্বের অতি উচ্চ মায়ানমারের পর্বতশ্রেণী হতে সাঙ্গু নদী নেমে এসে বান্দরবন শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গিয়েছে। শহরের পূর্ব পাশে পাহাড়ের আঁকেবাঁকে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী দেখতে দারুণ দৃষ্টি নন্দন।





সাঙ্গুর বুকে নুড়ি পাথর মাটি সবই আছে। এছাড়াও আছে বিশাল এক পাথরের রাজ্য। অনেক সময় নদীর দু’পাশে খাড়া অনেক উঁচু পাথুরে পাহাড়ের বিশাল দেয়াল। এগুলো দেখলে প্রকৃতির কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়। বিশাল এই প্রকৃতিতে ফিতার মতো বয়ে চলা নদীতে একটা ছোট ডিংগি ক’জন মানুষ যেন এমনি বিলীন হয়ে যায়। এদের অস্তিত্ত্ব একটা বড় পাথরের অবস্থানের চেয়েও ক্ষুদ্র। বৃষ্টি হলে পাহাড়ী এই নদীতে প্রচন্ড স্রোত থাকে তখন ছোট্ট নৌকাগুলো তাল থামলাতে না পেরে পাথরে ধাক্কা খায় এবং উল্টে যায়। তাই নদী কিছুটা শান্ত হলেই নৌকা চলে। তা না হলে যোগাযোগ বন্ধ থাকে নৌ পথে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা। বেশ সরু এবং এগুলোই এই নদী পথে চলার জন্য আদর্শ। ইঞ্জিনও স্পেশাল এটা থাইল্যান্ড থেকে আসে এবং এই ইঞ্জিন ছাড়া অন্য স্যালো ইঞ্জিনে এই নদীতে চলাচল করা সম্ভব না। নৌকার মাঝি থাকে দু’জন। একজন ইঞ্জিন চালায় অরেকজন নদী অবস্থা দেখে পথ নির্দেশ দেয়। নদী কখনো গভীর কখনো অগভীর। অগভীর জায়গায় স্রোত বেশী। তবে গভীরতা না থাকার কারণে নৌকা আটকে যায়। মাঝে মাঝে দু’একটা নৌকা বাঁধা রয়েছে। লোকজন মাছ ধরে এই নৌকায় চড়ে যাতায়াত করে আশে পাশে। নদীর দু’পাশেই পাহাড়ের কোলঘেঁষে ছোট ছোট জনপদ। নামগুলিও বিচিত্র – ছান্দাগ পাড়া, জিনিয়ং পাড়া, নারিকেল পাড়া, খিবুরী পাড়া, প্রেসিং পাড়া। তবে জনমানুষের দেখা মেলে খুব কম। সকাল হলেই বাইরে চলে যায় সবাই। জুমে কিংবা জীবিকার সন্ধানে। বলে নেয়া ভাল, পাড়াগুলো তেমন ঘন বসতি পূর্ণ নয়, বাঁশের মাচার উপর বাঁশের বেড়া ও টিন বা ছনের পাঁচ ছয়টা ছোট ছোট ঘর নিয়ে ছোট পাড়া। বড় পাড়াগুলোতে দশ বিশটা এধরনের ঘরও আছে। একটা বাড়ী থেকে আরেকটা বাড়ী একটু দূরে দূরে। বাড়ীগুলোতে মুরগী, শুকর ইত্যাদি পোষা হয়। মানুষজন সকাল থেকে সন্ধ্যা জুমে কাজ করে। পাড়াগুলোতে কুকুরের দেখা মেলে। প্রায় প্রত্যেকে একটা করে দা ও পিঠে বাঁশের ঝুড়ি বহন করে। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পর দুরে বেশ বড় বাজার দেখা গেল। অনেক নৌকা বোঝাই হচ্ছে। পাহাড় থেকে আনা কলা, আনারস, আম দিয়ে। দশ টাকা করে আমের কেজি। ছেলে মেয়ে সবাই পিঠে করে আম বয়ে এনে নৌকায় ফেলছে। এগুলো সব থানচি হয়ে বান্দরবান চলে যাবে। একটি নৌকা হতে পাহাড়ী কলা কিনে খেলাম। বেশ সস্তা, ডজন ১০ টাকায়। তবে ভারী মিষ্টি কলাগুলি। নৌকা থেকে এখানে নেমে যেতে হয় কারণ পানি ওপর থেকে নিচে জলপ্রপাতের মত পড়ছে। এখানে নদীর গভীরতা কম পাথর জমে বাঁধের মত হয়ে গেছে। মাঝি খালি নিয়ে এসে নৌকা ঠেলে আবার নদীতে ফেলে। সেখানে পানি বেশ গভীর ও সবুজ। পাহাড়ের উচ্চতা বেশ বেড়ে গেছে অনেক। দু’পাশে এখন বেশ ঘন বন। পাখিদের কিচির মিচির শোনা যায়। ইঞ্জিনের শব্দে তাদের শান্তি নষ্ট হলেই কিচির মিচির শুরুহয়। পাহাড় একদম খাড়া। নদীর মধ্যে বড় বড় পাথরের বোল্ডার। এটা এক বিশাল পাথরের রাজত্ব। প্রায় দুই তিন কিলোমিটার জুড়ে এর অবস্থান। একেকটা পাথর বিশ ত্রিশ ফিটের মত উঁচু। সব মিলে যেন একটা ফ্রেমে বাঁধা দৃশ্য। নৌকায় থাকা ক’টা মানুষ কত ক্ষুদ্র কত তুচ্ছ এই অবস্থান বিশাল প্রকৃতির কোলে। তারপরও আমরা কত বড় মনে করি আমাদের অবস্থানকে। এখানে এলে উদার এই প্রকৃতির বিশালতা মুগ্ধ হওয়ার মত। একটু গা ছমছম করতে লাগলো। পরিবার আছে সাথে তাই আর যাওয়া নিরাপদ মনে করি নি, ফেরত এলাম। সাঙ্গু নদীতে প্রায় দেড় ঘন্টার এ নৌকাভ্রমণ মনের মনিকোঠায় জাগরুক থাকবে আজীবন।

এরপরের গন্তব্য মেঘলা পর্যটন স্পট। বান্দরবান শহরে প্রবেশের ৭ কিমি আগে মেঘলা পর্যটন স্পটের অবস্থান অর্থাৎ বান্দরবন হতে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে এর অবস্থান। নামে যাই হোক, কেউ আবার ভাববেন না এখানে মেঘ ছোঁয়া যায়। আমরা সিএনজি একটি রিজার্ভ করে রওনা হলাম শহর হতে। ২০ মিনিটের মধ্যে পৌছে গেলাম। মেঘলা স্পটটি ভূমি হতে বেশ নীচে। মহাসড়ক হতে নীচের দিকে খাড়া পাহাড় বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয় মেঘলায়। পর্যটকদের সুবিধার্থে মেঘলা পর্যটন স্পটে নীচে নামতে রাস্তার পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় সিড়িঁও। সুন্দর কিছু উঁচু নিচু পাহাড় বেষ্টিত একটি লেককে ঘিরে গড়ে উঠে। ঘন সবুজ গাছ আর লেকের স্বচ্ছ পানি পর্যটককে প্রকৃতির কাছাকাছি টেনে নেয় প্রতিনিয়ত। পানিতে যেমন রয়েছে হাঁসের প্যাডেল বোট, তেমনি ডাঙ্গায় রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। রাঙ্গামাটির মতো এখানে দু’টি ঝুলন্ত ব্রীজ আছে। আর আকাশে ঝুলে আছে রোপওয়ে কার। আরো আছে টয়ট্রেন।







এখানে সবুজ প্রকৃতি, লেকের স্বচ্ছ পানি আর পাহাড়ের চুঁড়ায় চড়ে দেখতে পাবেন ঢেউ খেলানো পাহাড়ী বান্দরবানের নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমরা রোপওয়ে কার তথা ক্যাবল কারে চড়লাম। লেকের পানির উপর দিয়ে ক্যাবল কারের সংক্ষিপ্ত ট্যুর এডভেঞ্চারপূর্ণ। প্যাডেল বোটেও চড়লাম। ভালোই কেটেছিল বিকেল আর সন্ধ্যাটা।

বিষয়: সাহিত্য

২১২১ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378267
০৪ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০৩:১০
নেহায়েৎ লিখেছেন : বান্দরবানের সব কিছু এখনও ঘুরে দেখা হয় নি। অনেক বাকী। যেতে হবে ইনশা আল্লাহ আবার। সময় নিয়ে চলেন আর একবার ট্রেকিং করে আসি।
০৪ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০৩:২১
313480
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ইনশাল্লাহ। সত্যি বলতে কি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জেলা বান্দরবান। নিরাপত্তার কারণে সব স্থানে পর্যটকরা যেতে পারেন না। এরপরও প্রবেশযোগ্য স্পট কাভার করতেও ১৫ দিনের বেশি সময় প্রয়োজন।
378277
০৪ অক্টোবর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:২১
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু পরম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।


অপূর্ণ ভ্রমণ কাহিনীসহ চিত্তাকর্ষক ছবি। এককথায় অনন্য, অনবদ্য।


সুন্দর লিখাটি উপস্থাপনের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
০৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ১২:১৮
313488
সন্ধাতারা লিখেছেন : স্যরি ভাইয়া অপূর্ব লিখতে গিয়ে ভুলবশতঃ অপূর্ণ হয়ে গেছে।
০৫ অক্টোবর ২০১৬ সকাল ১০:৪৯
313494
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জাযাকাল্লাহ খাইরান। ইনশাল্লাহ ভ্রমণ কাহিনী বই আকারে বের করার ইচ্ছে আছে। দোয়া কামনা।
378286
০৪ অক্টোবর ২০১৬ রাত ০৮:২৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার ছবি ও লিখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। বান্দরবন ও সাঙ্গু নদীকে ঘিরে চমৎকার পর্যটন স্পট হতে পারে। বান্দরবন অন্য দুই পার্বত্য জেলা থেকে তুলানামুলক নিরাপদ ছিল। কিন্তু এখন এখানেও সমস্যা।
০৫ অক্টোবর ২০১৬ সকাল ১০:৫৩
313495
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইরান। জী, বান্দরবানে অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানে শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য বলে শোনা যায়। সব জায়গায় পর্যটকদের যাওয়ার ব্যবস্থাও নেই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File