কুয়াকাটার পথে (দ্বিতীয় বার) (ভ্রমণ)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:২১:২৭ দুপুর

দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলী ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনেক সময় হৃদয় মনকে বিক্ষিপ্ত অস্থির করে তোলে। হৃদয় তখন মুক্তির পথ খোঁজে, ছুটে যেতে চায় বন বাদাড়ে, নদী সাগরে, অপরিচিত সুন্দরের সাথে পরিচিত হয়ে দুঃখকে ভুলে থাকতে চায় । আমার হৃদয়টাও বিষাদে ভারাক্রান্ত ছিল, একটু রিফ্রেশ হওয়া জরুরী ছিল। জো-টা অবশ্য আমার স্ত্রীই প্রথম তুললেন। আর বেড়াতে আমার বরাবরই ভাল লাগে; সমু্দ্র, বন-বাদাড় হলেতো কথাই নেই। দ্বিতীয়বারের মত কুয়াকাটা ভ্রমণের প্রস্তাবটি তাই সানন্দে লুফে নিলাম। ডিসেম্বরে পর্যটন মৌসুম হওয়ায় ভিড়ের মাঝে স্বস্তি পাওয়া যায় না। তাই ভ্রমণের জন্য নভেম্বরের শুরুটাই সময়োপযোগী বিবেচিত হল।

অফিস হতে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে ১ লা নভেম্বর, ২০১৪ ইং তারিখেই রওনা হলাম সপরিবারে। বাহন লঞ্চ এম.ভি. ইয়াদ। বর্তমানে অত্যাধুনিক বেশ কিছু লঞ্চ সার্ভিস আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। আগেই ডাবল কেবিন বুকিং করা ছিল। বিকেল পাঁচটায় সদরঘাট, ঢাকা হতে বিসমিল্লাহ বলে যাত্রা শুরু হলো।

নদীপথে ভ্রমণ আমি বরাবরই খুব উপভোগ করি। আমাদের বাড়ি হতে নানাবাড়ির দূরত্ব ছিল প্রায় ১৩-১৪ কিমি, পাশাপাশি দুটি থানা। ছোটবেলায় নানাবাড়ি যেতে পথে ডাকাতিয়া নামে একটা নদী ছিল। বর্ষাকালে নদীর পাড় উপচে পানি উঠত। একবারের কথা মনে আছে। বর্ষাকাল হলেও সেদিন ছিল মেঘমুক্ত পূর্ণিমার আকাশ। আব্বা ও ছুটিতে বাড়ি এলেন। সেই ভরা পূর্ণিমায় আমরা নৌকাযোগে নানা বাড়ি গিয়েছিলাম। নদীর পানিতে রুপালি চাঁদের ঝিকিমিকি। সে এক অভূতপূর্ব ও বিরল দৃশ্য! তখন হতেই নদী-নালার প্রতি এক ধরণের টান অনুভব করতাম। শীতকালে এই নদী শুকিয়ে যেত। কালের বিবর্তনে নতুন রাস্তাঘাট হতে থাকে। নদী পথের বিড়ম্বনা এড়াতে নানাবাড়ি যেতে আমাদের যাত্রাপথও পরিবর্তন হয়।

বড় হয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সিএ ভর্তি হলাম। পেশাগত কারণে ২০০২ হতে ২০০৫ এই সময়কালে আমাকে তখন বাংলাদেশ এর আনাচে কানাচে ঘুরতে হয়েছে। প্রায় অর্ধশত জেলা ঘুরে বেড়িয়েছিলাম তখন পেশাগত প্রয়োজনে। বরিশাল, পটুয়াখালি, খুলনা, বাগেরহাট এইসকল জেলায় যেতে হয়েছিল একাধিকবার। নদনদীর অনাবিল সৌন্দর্যে বেশ বিমোহিত হতাম। তখন নদীনালা আর সমুদ্রের প্রতি টানটা আবার খানিকটা বেড়ে গেল।

লঞ্চ বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ছুটে চলছে যাত্রাপানে। কেবিনের সামনে চেয়ার পেতে নদী পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বৈকালিন নাস্তা সহযোগে আড্ডা চলছিল। দিনের দৈর্ঘ্য সংক্ষিপ্ত বলে প্রভাকর মহাশয় খুব দ্রুতই অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা নামল। সারাদিন ভ্রমণ প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বেশ ধকল গেল। তাই এশার নামাজ পড়েই খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। সন্তর্পণে আমার স্ত্রীকেও ডাকলাম। কেবিন খুলে পাশেই পেতে রাখা চেয়ারে পাশাপাশি বসলাম। নীরব নিস্তব্ধ গভীর রাত, আকাশে আধখানা চাঁদ। একটু আধটু মেঘের লুকোচুরির মাঝে হাজারো তারার মেলা। বিশাল নদীতে চাঁদ তারার ঝিকিমিকি প্রতিফলন। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পানি কেটে কেটে সাঁই সাঁই এগিয়ে চলছে লঞ্চ যাত্রাপানে, অবিরত বাতাসের শোঁ শোঁ আর পানির কলকল শব্দ। সে এক অন্য রকম অনুভূতি! এটি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যারা এমন রাতের বেলায় লঞ্চ ভ্রমণ করছেন শুধু তারাই অনুধাবন করতে পারেন এ অজানা অনুভূতি। মাঝে মাঝে দূরে দেখা যাচ্ছে মাছ ধরা ডিঙ্গি নৌকা, ট্রলার। আবার দেখছি হেথায় হোথায় পানির উপর লাইট জ্বলছে। পরে জানলাম এগুলি জেলেদের ইলিশ জালের লাইট। এক স্বপ্নিল আবেশ বুঁদ হয়ে ছিলাম দীর্ঘক্ষণ।

মৃদু স্বরে গুণগুণ করছি-

“ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত,

আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার।

ওগো মায়াবিনী চাঁদ আর ওগো মায়াভরা রাত………”

রাত পেরিয়ে কখন ভোর হল টেরও পেলাম না। দূরে মুয়াজজিনের আযানের সুমধুর ধ্বনি শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম।

ভোরের আলো দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগেই লঞ্চ বরগুনা জেলার পায়রা নদীতে এসে পড়েছে। পুব আকাশে লাল রক্তিম প্রভাকর মহাশয় উঁকি দিল। সে আর এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এত সুন্দর সূর্যোদয়ের দৃশ্য ইতোপূর্বে দেখা হয় নি কখনো। নদীর শান্ত জলে লাল দিবাকরের প্রতিফলন মনোমুগ্ধকর মোহনীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যে দৃশ্য ভুলিয়ে দিতে পারে যে কোন জাগতিক দুঃখ।



৭ টা বাজার পূর্বেই পৌছে গেলাম আমতলী, বরগুনা। লঞ্চ হতে ব্যাগ লাগেজ নিয়ে সকলে নেমে পড়লাম। এবার আমাদের গন্তব্য তালতলী উপজেলার দক্ষিণ গাববাড়িয়া গ্রামে। প্রায় ২৫ কি.মি. দূরত্ব, ব্যাটারী চালিত একটি অটোরিক্সা ভাড়া করলাম। এই গ্রামে বাস করেন ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতা হারানো বাংলা, বিহার, উড়িশ্যার ভাগ্যাহত শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার এক বংশধর।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার একমাত্র মেয়ের নাম ছিল জোহরা ওরফে কুদসিয়া বেগম। জোহরার এক পুত্র ও চার কন্যা। পুত্রের নাম শমসের আলী খান। কন্যাদের নাম সরযুনিসা, আমাতুন নিসা, সাকিনা ও আমাতুল মাহদী। কন্যা সরযুনিসাকে বিয়ে করেন মীর মোজাফফর আলী খানের (মীর মদন) কনিষ্ঠ ও ১১ তম ছেলে আল্লামা শিহাবউদ্দীন যিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, মীর মদন ও তাঁর ১০ পুত্র পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের কমান্ড ভেঙ্গে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন। শিহাব উদ্দীন তখন শিশু ছিলেন বিধায় যুদ্ধে যাওয়া হয়নি এবং পরবর্তীতে পড়াশানা করতে বাগদাদ চলে যান। মির্জা শিহাবউদ্দীনের ছেলে জয়নাল আবেদীন, তাঁর ছেলে আবদুর রহমান খান খলীফা, খলীফার ছেলে মির্জা মওলানা ইয়াছিনুর রহমান ও উনার ছেলে মির্জা মওলানা মজিবর রহমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মির্জা মওলানা মজিবর রহমান আমার শ্বশুড়।

খান্দানের বাইরে বিয়ে হয়েছিল জোহরার একমাত্র পুত্র শমসের আলী খানের দৌহিত্রী ফাতেমা বেগমের মেয়ে উলফুন্নেসার, মুর্শিদাবাদের সুলতান আমির মির্জার সাথে। তাদের পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা। এক পুত্রের বংশধর সৈয়দ আহমদ মির্জার তিন পুত্র ওয়াসেক আলী মির্জা, ইশতিয়াক মির্জা ও ইমতিয়াজ মির্জা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এরা সবাই খুলনাতেই আছেন। ছোটখাটো চাকরি করছেন কালেক্টরেটে।

শমসের আলী খান এর একমাত্র পুত্র লুৎফে আলী। ১৮৩৩ সালে তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হন একমাত্র কন্যা ফাতেমা। তাঁর গর্ভে জন্ম নেন তিন কন্যা লতিফুন্নেসা, হাশমত আরা বেগম ও উলফুন্নেসা। ফাতেমা বেগম মারা যান ১৮৭০ সালে। হাশমত আরা বেগমের বিয়ে হয় বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান কুখ্যাত অত্যাচারী দেবী সিংহের পালনকর্তা মোহাম্মদ রেজা খানের ভাই আহমদ খানের অধস্তন পুরুষ সৈয়দ আলী রেজার সাথে। আলী রেজা ও হাশমত আরা যথাক্রমে ১৮৯৭ ও ১৯৩১ সালে মারা যান। তাদেরর পুত্র জাকি রেজা ও কন্যা তিলা তারা বেগম। জাকি রেজা মুর্শিদাবাদের সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। এই পরিবারের দুর্গতির কথা ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর কর্ণগোচর হলে তিনি ১৯১৩ সালে তৎকালীন বাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেছিলেন জাকিকে একটি ভালো চাকরি দেয়ার জন্য। জাকি রেজার চার পুত্র গোলাম হায়দার মহসিন রেজা, গোলাম আহমদ, গোলাম মর্তুজা, রেজা আলী এবং দুই কন্যা খুরশিদা বেগম ও মুগরা বেগম। এরা দীর্ঘ সময় মুর্শিদাবাদে ছিলেন। চলে আসেন ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। গোলাম হায়দার ও গোলাম আহমদ বদলি হয়ে চলে যান করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোরে। রেজা আলী থেকে যান খুলনা কাস্টমে। গোলাম মর্তুজা যোগ দেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসে। বর্তমানে গোলাম মোর্তজার এক ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ঢাকায় বসবাস করছেন বলে জানা যায়।

নবাবের বংশধরেরা এভাবেই নীরবে নিভৃতে লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

সে যাই হোক। ভ্রমণ ক্লান্তিজনিত কারণে সেদিন বিশ্রাম আর শ্বশুড় বাড়ির আপ্যায়নেই কাটালাম। পরদিন সপরিবারে রওয়ানা হলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে।

গন্তব্য এবার কুয়াকাটাঃ

৩ তারিখে সকালে নাস্তা সেরেই দুটি ভাড়া করা মোটর সাইকেল নিয়ে আমরা সপরিবারে (৬ জনের বহর) রওনা হলাম মূল গন্তব্য কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য যে, গ্যাস না থাকায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সিএনজিচালিত কোন বাহন নেই । স্থানীয়ভাবে চলাচলের উত্তম বাহন হচ্ছে মোটরসাইকেল। এছাড়া ইজিবাইক, ইঞ্জিনচালিত ভ্যান, ভটভটি, করিমন, নসিমন এইসব যানবাহন ও রয়েছে বেশ। মটরসাইকেল কড়ইবাড়িয়া বাজার পেরিয়ে ছুটে চলছে। এক সময় থামতে হলো নিউপাড়ায়। সামনে অনিন্দ্য সুন্দর একটি নদী।

নদীর নাম আন্ধারমানিকঃ

অসাধারণ সুন্দর একটি নদী এই আন্ধারমানিক। কথিত আছে, পূর্বে এ নদীতে কিছু দামী মনি মুক্তা পাওয়া যেত যেগুলি আঁধার রাতেও জ্বলজ্বল করে জ্বলত। সেই অনুসারে এই নদীর নাম হল আন্ধার মানিক। কুয়াকাটার চাইতে এর সৌন্দর্য্য কম নয়। নদীর মাঝে ও পাড়ে ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ এর সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রলারে করে আমরা আন্ধারমানিক নদী পার হলাম। ক্যামেরায় আন্ধারমানিকের অনেক আকর্ষণ ধারণ করতে ব্যর্থ হলেও কিছুটা নিয়েছি। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দুটি জেলা – বরগুনা ও পটুয়াখালী রূপ বৈচিত্র্যে চিরায়ত গ্রামীণ রূপের বাইরেও অনেক বাড়তি আকর্ষণ আছে। ছোট বড় প্রচুর নদী ও খালের সমাহার এখানে। রাস্তায় একটু পরপর ব্রীজ, কালভার্ট। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জাতীয় প্রচুর উদ্ভিদের সমাহার নদী ও খালের তীরে। আরো আছে গোলপাতা, হোগলা। গোলপাতা দিয়ে সুন্দর ঘরের ছাউনি ছাড়া ও খেজুররসের মত সুমিষ্ট রস পাওয়া যায় গোলগাছ হতে। হোগলা দিয়ে পাটি বুনা হয়। গৃহপালিত পশুর মধ্যে মহিষের প্রাধান্য বেশ চোখে পড়ার মত।





আন্ধারমানিক পার হয়ে এরপর পাখিমারা। পটুয়াখালি জেলা সীমানা এসে গেছে। পথ চলতে চোখে পড়ল মহিষের পাল, গোল বৃক্ষের বাগান, ছোট বড় নানা খাল, সৌদি অর্থায়নে নির্মিত সুদৃশ্য সাইক্লোনসেন্টারসমূহ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও এর তত্বাবধানে নানা ধরনের প্রজেক্ট অফিস। এগিয়ে চলছে আমাদের মটরসাইকেল। পথে আরো দুটি নদী পড়ল। ফেরীতে পার হলুম। আরে, এইতো দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন হোটেল, মোটেল। শোনা যাচ্ছে সাগরের পানির সোঁ সোঁ গর্জন। কুয়াকাটা সৈকতে এসেই গেলাম বলে।

কুয়াকাটা সৈকতেঃ

সকাল এগারোটার মাঝেই আমরা পৌছে গেলাম কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। কুয়াকাটা নামের পেছনে রয়েছে আরাকানীদের এদেশে আগমনের সাথে জড়িত ইতিহাস। ‘কুয়া’ শব্দটি এসেছে ‘কুপ’ থেকে। ধারণা করা হয় ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতারিত হয়ে আরকানীরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। কিন্তু সমুদ্র উপকুল হওয়ায় এখানে নোনা জলের আধিক্য বেশী ছিল। তখন রাখাইনদের মিষ্টি পানির প্রয়যনিতা দেখা দেয়। এ অবস্থায়া তারা নিজেদের প্রয়োজনে একাধিক কুয়া খনন করতে থাকে। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা। এ সৈকতের দৈর্ঘ ১৮ কি.মি.।

ছুটির দিন না হওয়ায় সৈকতে ভীড় খুব কম ছিল। এর আগে পতেঙ্গা, সাগরিকা (জেলেপাড়া বীচ, চট্টগ্রাম), কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকতে একাধিকবার গিয়েছিলাম। তবে কুয়াকাটার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটিই একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখানে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটিই দেখা যায়। সাগরের বিশাল জলরাশি আছড়ে পড়ছে কুলে আর সূর্যের আলোর ঝিকিমিকিতে তাঁর সৌন্দর্য্যের মাত্রা নিতান্ত বেরসিক ব্যক্তির মনেও রোমান্স জাগায়। সাগরপাড়ে লাল কাঁকড়ার শৈল্পিক কারুকার্য্য দেখার মত। আমার তিন বছরের ছেলে মহাখুশী। তাকে ধরে রাখা খুব কষ্ট। সাগরের নোনা জলে পায়ে কাঁদা মাখিয়ে অনেক্ষণ দাপিয়ে বেড়াল বাবা-মায়ের সাথে। চোখে চোখে রাখছিলাম যাতে কোনো বিপদ না ঘটে।

পায়রা নদীতে সূর্যোদয় দেখেছিলাম দুইদিন আগে। আজ কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত দেখব প্রাণভরে। এমনই পরিকল্পনা।





কিন্তু সূর্যাস্ত হতে তো বেশ দেরী! তবে কি এতক্ষণ রোদের মাঝে নোনাজলে দাপিয়ে বেড়াব শুধু। মাথায় প্লান এল-ফাতরার বন যাব যে বনটি সুন্দরবনেরই অংশ।

ফাতরার বন :

কুয়াকাটার অতি সন্নিকটে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার কোলঘেঁষে আন্ধার মানিক নদীর পশ্চিম দিকটায় তাকালের দেখা যাবে এই বনটি। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারের ব্যাবস্থা আছে। এটি সুন্দরবনের একটি অংশ। ফাতরার বনকে সুন্দরবনের উপবন বলা হয়ে থাকে। ফাতরার বনাঞ্চলের আয়তন ৯ হাজার ৯৯০ একর। ফাতরার বন নামে পরিচিত হলেও কাগজে কলমে এটি টেংরাগিরি। এখানে বেশি যে গাছ গুলো আছে তা হল - শাল, সেগুন, ছইলা, কেওড়া, গজারি, হেতাল, গেওয়া, সুন্দরী, বাইন আর জঙ্গলা। ট্রলারে করে গিয়ে নামলেই কিছুদূর হাঁটলেই দেখতে পাবেন ভেতরে সুন্দর ঘাট বাঁধানো একটি পুকুর। ফাতরার বনের আশেপাশে অনেক গুলো খাল রয়েছে। যেমন - চরের খাল, ছোট চরের খাল, ফাইসাখালী, বেহুলার খাল, নিশান বাড়িয়ার খাল, নিদ্রা সখিনার খাল। কিন্তু যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভালো না হওয়াতে পর্যটকরা এগুলো সম্পর্কে জানে না।





ফাতরার বন দেখা শেষে আবার কুয়াকাটা। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে দেখতে এতই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে ক্যামেরায় ক্লিক করতে বেমালুম ভুলে গেলাম সবাই। সৈকত ঘেঁষেই আছে সারি সারি নরিকেল বাগান, ঝাউবন, ইকোপার্ক, বৌদ্ধমন্দির, লাল কাকরার চর, ফাতরার চর, কাউয়ার চর, লেবুর চরসহ বিস্তৃত প্রাকৃতিক পরিবেশ। ফেরার পথে আরো দেখলাম বৌদ্ধ মন্দির, রাখাইন মার্কেট, শুটকী মার্কেট। চার/পাঁচ প্রকার শুঁটকী কিনলাম। আরো কিছু টুকটাক কেনাকাটা করলাম।





পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত বিখ্যাত কুয়াকাটা সৈকতে ঢাকা হতে যাওয়া যায় অনেকভাবেই। তবে আরামদায়ক ভ্রমণ ও নদীপথের সৌন্দর্য্য বোনাস হিসেবে উপভোগ করতে চাইলে লঞ্চই ভরসা। সরাসরি কুয়াকাটার লঞ্চও পাবেন সদরঘাট হতে। কুয়াকাটায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটনের সুব্যবস্থা আছে। পর্যটন কর্পোরেশন এর বহুতল মোটেল আছে সৈকতের খুব নিকটেই। সময় নিয়ে আসলে কুয়াকাটা বীচ হতে যেতে পারেন আরো নানা জায়গায়। বিভিন্ন বেসরকারি পর্যটন সংস্থা ও গাইডদের উদ্যোগে কুয়াকাটার কাছাকাছি অনেক আকর্ষণীয় স্থানে ভ্রমণের সুব্যবস্থা আছে।

এ ট্যুরে মোট ৬ দিন সময় কাটালাম। কুয়াকাটা ছাড়াও বেড়াতে গিয়েছিলাম পায়রা নদীতে। তালতলী বাজারের নিকটে আছে রাখাইন পল্লী। সেখানেও গিয়েছিলাম একদিন। সে গল্প তোলা থাক অন্য একদিনের জন্য ।

বিষয়: সাহিত্য

১৫৮৩ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

377658
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:৩৬
নেহায়েৎ লিখেছেন : মাশা আল্লাহ। সুন্দর বর্ণনা। এম ভি ইয়াদ কোন পর্যন্ত যায় ভাই? আর আন্ধার মানিক নদীতে একটা ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যায় না?
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:৪৩
312995
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এটি আমতলীর লঞ্চ। বরিশাল হতেও প্রায় ১০০ কিমি দূরে। তবে এটি বরিশাল হয়ে যায় না। অন্যরূটে চলে যায়। একদিন পর একদিন ছাড়ে। অন্যদিন অপর একটি লঞ্চ ছাড়ে। প্রায় ১২-১৪ ঘন্টার জার্নি। আমারও খুব ইচ্ছে. আল্লাহ চাহেত একদিন আন্ধারমানিক নদীতে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াবো।
377666
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ০৩:২৩
হতভাগা লিখেছেন : কুয়াকাটাতে গত বছরের অক্টোবরের শেষে গিয়েছিলাম। পূঁজার ছুটি হওয়ায় প্রচুর লোক গিয়েছিল সেখানে । দুইদিন থাকার প্ল্যান নিলেও ছিলাম ১ দিন ।

বিকেলে গাইডদের হোন্ডায় চড়ে একবার পূর্বদিকে, আরেকবার পশ্চিম দিকে গিয়েছি । ভালই লেগেছিল । ফেরার দিন সকালে পশ্চিমদিকে আবারও গিয়েছি যেখান থেকে সুন্দরবনের পূর্বাংশ দেখা যায় । পূর্বদিকটায় গিয়ে বেশ ভাল লেগেছিল , নিরিবিলি এবং প্রচুর গাছপালা এবং সাথে ছোট ছোট খাল।

বাই রোডে গিয়েছিলাম । ৪ টি ব্রীজ ও ৩ টি ফেরি পার হতে হয়েছিল । তার মধ্যে মনে হয় লেবুখালী ছাড়া বাকী দুইটি ফেরি আর চলার কথা না কারণ ব্রীজ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। বরিশাল থেকে লোকাল বাসে কুয়াকাটায় যেতে সময় লেগেছিল ৪ ঘন্টা , ফেরার পথে বিআরটিসি বাস লাগায় ৫ ঘন্টা।

সূর্যোদয় দেখার জন্য পূর্বাংশে যেতে হয় যেটার জন্য মিনিমাম ঘন্টা ঘানেক আগে বের হতে হয় যদি জায়গা মত যেতে চাই । কিন্তু এত অন্ধকারে নিরিবিলি একটা জায়গায় যাওয়া নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ ছিল।

কুয়াকাটায় আরেকটা দিন থাকতে পারলে ভালই লাগতো । গাইডেরা উপজাতি ও বৌদ্ধমন্দিরের কথা বার বার বললেও যাবার ইচ্ছা জাগে নি ।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৪:০৮
313002
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ঠিক বলেছেন। নিরাপত্তা সমস্যাটা রয়েই গেছে এখানে। ফাতরার বনে, সুন্দরবনের ঐদিকে প্রায়ই চুরি ছিনতাই এর খবর শোনা যায়। তবে দলবেঁধে গেলে সমস্যা হয় না। হ্যাঁ, লেবুখালী ফেরী এখনো আছে। বাকীগুলিতে ব্রীজ হয়েছে।
377680
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:১৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার ভ্রমনকাহিনি ও ছবিগুলির জন্য ধন্যবাদ।
আন্ধারমানিক নদী দিয়ে একবার গিয়েছি কিন্তু কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে উপভোগ করা হয়নি এর সেীন্দর্য। কুয়াকাটা একবারই গিয়েছি। তখন এত কিছু ছিলনা কিন্তু প্রাকৃতিক সেীন্দর্য ছিল। একটু আগে নেহায়েত ভাই এর পোষ্ট টা দেখে কষ্ট হয় আমরা উন্নয়ন এর নামে কত সহজে প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে চাই।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকাল ০৯:৫৮
313093
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ঠিক বলেছেন। চট্টগ্রামের ফয়েজলেক এর কথাই ধরেন। ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে ফ্রীতে প্রায় যেতাম। তখন যে মজা আর তৃপ্তি পেতাম এখন পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে গিয়েও সে তৃপ্তি পাওয়া যায় না ফয়েজ লেকে। সব আর্টিফিসিয়াল ব্যাপার স্যাপার।
377681
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:১৬
আবু নাইম লিখেছেন : তালতলীল দক্ষিন গাববাড়িয়া বলতে কোন এলাকা.
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৪:৩৫
313139
আবু নাইম লিখেছেন : পিকে ইস্কুলের কোন পাশে.......
২২ জানুয়ারি ২০১৭ দুপুর ০৩:৪৩
315405
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এক কিমি এর মধ্যে।
377694
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০১:১৩
আকবার১ লিখেছেন : চমৎকার ভ্রমন কাহিনি ,ভাল লেগেছে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকাল ০৯:৫৮
313094
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এটি আমতলী সদর হতে ২৪ কিমি দূরে, কড়ইবাড়িয়া হতে সাড়ে ৬ কিমি পশ্চিমে।
377707
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:০৭
চেতনাবিলাস লিখেছেন : ভালো লাগল | ধন্যবাদ |
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকাল ১০:০৯
313095
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck
377709
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:০৭
চেতনাবিলাস লিখেছেন : ভালো লাগল | ধন্যবাদ |
377812
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:২৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।

অনেক উপভোগ্য একটি ভ্রমণ কাহিনী মাশাআল্লাহ। লিখা ও ছবি সবকিছু মিলিয়ে অনবদ্য।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকাল ০৯:২১
313173
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জাযাকাল্লাহ খাইরান।
377861
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকাল ১১:২২
নকীব কম্পিউটার লিখেছেন : পুরোটা পড়লাম, খুব ভালো লাগলো।
তবে দু:খের বিষয় জীবনে কোথাও বেড়ানো হয়নি।

ভাল লাগল আপনার শ্বশুরের ইতিহাসটা পড়ে।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:৩৯
313183
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আল্লাহ আপনাকে বেড়ানোর ও আল্লাহর নিদর্শনসমূহ স্বচক্ষে দেখার তাওফিক দিন। আমীন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File