নিউটনের তৃতীয় সূত্র
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২৩ আগস্ট, ২০১৬, ০২:৫৫:৫০ দুপুর
এক.
ম্যানেজার এর রুমে প্রবেশ করে মাথা চুলকাচ্ছিল সোহেল।
‘কিছু বলতে চান? নিঃসন্কোচে বলে ফেলুন সোহেল সাহেব।’ স্মিত হেসে ম্যানেজার বললেন।
‘জী স্যার। আজ একটার পর ছুটি দরকার ছিল।’
‘ছুটি! কী প্রয়োজনে?’
‘স্যার, আজ আমার ওয়াইফকে নিয়ে বাইরে লাঞ্চ করাবো বলেছিলাম’।
‘বাহ! আদর্শ স্বামী। ওকে, যান আজকের মত। তবে আপনার এ প্র্যাকটিসটা প্রিকোয়েন্টলি হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি মাথায় রাখবেন।'
‘থ্যাংক ইউ স্যার।’
অফিস হতে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে একঘন্টার মধ্যেই সোহেল পৌছে গেল কাঙ্খিত স্থানে। সংসদ ভবন পার্কের পূর্ব পাশে দোতলায় অবস্থিত মধ্যম মানের একটি চাইনীজ রেঁস্তোরা। এ রেঁস্তোরাটির বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য আছে। বিশেষভাবে তৈরি বেশ কয়েকটি বুথ আছে এখানে যেগুলি চারপাশে বাউন্ডারি দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি এবং দুজনের জন্য উপযোগী । বুথে ঢুকলে পুরো দুনিয়া হতে বিচ্ছিন্ন। ভিতরে কে কী করছে তা বাহির হতে কারো বুঝার উপায় নেই। ঘন্টা চুক্তিতে বুথ ভাড়া দেয়া হয়। রেষ্টুরেন্ট এর মূল ব্যবসা এটাই। সাবসিডিয়ারী ব্যবসা হচ্ছে চায়নীজ ফুড।
শায়লা ফোন ধরছে না কেন? একটু অস্থির লাগে সোহেল এর। পরিচিত কেউ দেখলো কিনা আবার! একটু শঙ্কিত হয়। এর মাঝে শায়লার ফোন-‘সরি ডার্লিং।’
‘সরি কেন? হোয়াট হ্যাপেনড?’
‘সাহেব হঠাৎ এসে পড়েছেন। এখন বাসায় ঘুমাচ্ছেন। রিস্ক নিতে চাই না আজ।’
‘ও..’।
‘ডোন্ট ওরি। পরে পুষিয়ে দেব। হিহিহি.....’ শায়লার কামনামাখা হাসি।
দুই.
সোহেল একটি ইন্টারন্যাশনাল এনজিও এর একজন সিনিয়র অফিসার। গত চার বছর যাবত এখানে আছে। মাস ছয়েক হলো এইচআর অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে শায়লা, সুন্দরী লাস্যময়ী তরুণী। শায়লা বিবাহিতা, স্বামী ব্যবসায়ী। প্রায়ই ব্যবসায়িক ট্যুরে দেশ বিদেশ করতে হয় স্বামীকে, স্বামীর কাছ হতে পর্যাপ্ত সময় পায় না। সুযোগ নেয় সোহেল। শায়লাও মুখিয়ে ছিল। তাই সোহেলকে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। গত ছয় মাসে তারা একান্ত সান্নিধ্যে এসেছে অনেকবার। প্রথম প্রথম থ্রী স্টার হোটেলে উঠতো। প্রায়ই অফিস শেষ করে অফিসে কাজের চাপের দোহাই দিয়ে ৩/৪ ঘন্টা হোটেলে কাটিয়ে দুজনে যার যার বাসায় ফিরতো। একসময় এ চাইনীজ রেঁস্তোরা আবিষ্কার করে। কী দরকার হোটেলে উঠার! কখন ধরা পড়ে আবার কেলেঙ্কারী বাঁধে! শায়লাও বেশ পছন্দ করে গোপন কুঠুরীর এ বিশেষ রেঁস্তোরা। সপ্তাহে এক বা দুইদিন আসে তারা। আজ শায়লা ছুটিতে ছিল। প্ল্যান ছিল সোহেল অর্ধবেলা ছুটি নিবে অফিস হতে তারপর দুজন একসাথে লাঞ্চ এবং ........। শায়লা আসে নি, এখনতো সবই গোল্লায় গেল।
‘দুস শালা! দিনটাই মাটি।’ স্বগতোক্তি করে সোহেল।
সময়টা কী করে কাটবে? আজকে বরং বউকে সময় দেয়া যাক, ডালিয়াকে সারপ্রাইজ দিবে আজ। যেই ভাবা সেই কাজ। সিএনজি ডেকে উঠে পড়ে সোহেল। নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবে সোহেল। দুই নারীর রূপসূধা পান করছে কোন বাধা বা সন্দেহ ছাড়াই। সমাজে সে ভদ্রলোক। সুন্দরী স্ত্রী ডালিয়াও বেশ ভাল, তাকে খুব বিশ্বাস করে। মনের মধ্যে একটু খচখচ করে হঠাৎ। বউকে ঠকাচ্ছে সে। এটা কি তবে অপরাধবোধ! মৃদু ঝাঁকুনিতে একটু তন্দ্রামত আসে।
‘তুমি একটা আস্ত লম্পট। ঘরে সুন্দরী বউ রেখে অন্যের বউয়ের সাথে ফস্টিনস্টি! ছিছিছি!! বউয়ের কথা বলে অফিস হতে ছুটি নিয়ে অন্য বেটির সাথে লটর ফটর করতে যাস। লম্পট, তুই লম্পট।’ সোহেলকে কে যেন বলছে। গলার স্বর অবিকল তার নিজের মতো। হঠাৎ হার্ডব্রেক। তন্দ্রাভাব কেটে যায়, কিন্তু লম্পট শব্দটি যেন এখনো কানে বাজছে। নিজেকে একটু অসহায় মনে হয় সোহেল এর। মনে হচ্ছে চতূর্দিক হতে শত শত মানুষ তার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলছে- ‘ঐ যে লম্পট যায়, লম্পট।’
বাসায় এসে ডোরবেল বাজায় না সোহেল, দরজা নকও করে না। বউকে একটু সারপ্রাইজ দেয়া যাক। সন্তর্পণে নিজের কাছে থাকা বাড়তি চাবি দিয়ে অটোলক খুলে পা টিপে টিপে উঁকি দেয় বেডরুমে।
সাপ দেখার মত চমকে উঠে সোহেল। যে দৃশ্য দেখছে তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে, ডালিয়ার ব্যাপারে সে এটা কোনদিন চিন্তাও করতে পারে না। সম্পূর্ণ অনাবৃত দেহের ডালিয়ার উপর উপগত হয়ে আদিম লীলায় মত্ত তিনতলার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে সাব্বির। চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায় সোহেল। মোবাইল বের করে দুই মিনিট ভিডিও করে। ফ্ল্যাশ আর সাউন্ট অফ করে কয়েকটি স্টিল ছবি নেয়। এরপর যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নীরবে বেরিয়ে যায়।
তিন.
ডালিয়া একা একা খুব বোরিং ফীল করে। স্বামী সোহেল প্রায়ই রাত করে বাসায় ফিরে। অফিসের কাজ থাকে নাকি। এসেই ফ্রেশ হয়ে কখনো খেয়ে কিংবা কখনো অফিস হতে খেয়ে এসেছে বলে না খেয়েই বিছানায় ধপাস, ঘুমাতে থাকে নাক ডেকে। ভালমতো কথাও বলা হয় না। ছুটির দিন ছাড়া সোহেল এর একান্ত সান্নিধ্য পাওয়াই যায় না। এমনকি কোন কোন ছুটির দিনেও অফিসের কাজের চাপ আছে বলে বেরিয়ে যায়।
গত কয়েকমাস ধরে একটি নোংরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ডালিয়া। তিনতলার সাব্বির, বয়স হবে ২০/২১! ভার্সিটিতে পড়ে স্যোশলজিতে। সাব্বির এখন ডালিয়ার নিয়মিত বেডপার্টনার। মাঝে মাঝে অপরাধবোধে ভুগে, তার ভাল মানুষ স্বামীকে সে ঠকাচ্ছে! নিজেকে নষ্টা, নোংরা, পতিতা বলে মনে হয়। গা ঘিন ঘিন করে। ভাবে- অনেক হয়েছে, আর নয়। এ নোংরামী হতে বের হতেই হবে। কিন্তু পরদিনই শরীর বিদ্রোহ করে বসে। জৈবিক আকর্ষণে পরাজিত হয় বিবেক। বিবেক যুক্তির উর্ধে্ব উঠে শরীর বলে- লেটস এনজয়।
চার.
এতদিনে গোপন কুঠুরীর সেই বিশেষ রেঁস্তোরার সন্ধান পেয়ে গেছে সাব্বির আর ডালিয়াও। বাসায় ঝুঁকি আছে। ধরা পড়লে কেলেংকারী হয়ে যাবে। সাব্বিরকে নিয়ে ডালিয়া প্রায় নিয়মিতই আসছে এখানে।
তারপর একদিন! পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই! সেদিন ডালিয়া আর সাব্বির রেষ্টুরেন্ট এ ঢুকতে যাবে এমন সময় দেখে একটি বুথের দিকে সুন্দরী এক নারীকে নিয়ে প্রবেশ করছে তার স্বামী সোহেল। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ডালিয়া। পেছন হতে মোবাইলে দুটি ছবি তুলে নিয়ে সাব্বিরকে নিয়ে নীরবেই বেরিয়ে গেল। সোহেল কিছু টের পায় নি। বাসায় ফিরেই সাব্বিরকে নিয়ে মত্ত হলো পুরনো আদিম খেলায়। এই প্রথম ডালিয়ার মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করে নি। তবে অপরাধবোধ কাজ না করলেও নিজেকে ঠিকই নষ্টা আর অপবিত্রা মনে হচ্ছিল।
সোহেল বাসায় ফিরেই দেখে ডালিয়ার অগ্নিমূর্তি! সুন্দরী নারীর সাথে সোহেল এর ছবি দুটি দেখিয়ে প্রশ্ন করে- কে এই মেয়ে?
জবাব দেয়ার আগেই সজোরে চড় মারে সোহেল এর গালে। পাল্টা চড় মারে সোহেল।
‘তুমি যেমন এক নাগর জুটিয়েছ, আমিও তেমনি।’ এই বলে মোবাইলে রক্ষিত ভিডিওটি ওপেন করে দেয় সোহেল। ডালিয়া থ বনে যায়। আর কথা বাড়ায় না, একদন নিশ্চুপ হয়ে যায়।
পাঁচ.
বেলা বয়ে যায়। সোহেল ডালিয়ার সংসারও চলছে নিয়ম মেনে। তবে সেখানে কোন ভালোবাসা নেই। ইতোমধ্যে একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে তাদের। সোহেল বিশ্বাস করে না এটি তার সন্তান। জোর দিয়ে দাবি করার মত মুখও নেই ডালিয়ার। নিজের প্রতি এবং পরস্পরের প্রতি তীব্র ঘৃণা তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে টিকে আছে একটি নীড়। তীব্র এবং জটিল এই ঘৃণা নিয়েই তারা একসাথে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, শারীরিক সান্নিধ্যেও আসছে। সবই চলছে নিয়ম মেনে, শুধু নেই ভালোবাসা- দুটি মনের যোজন যোজন দূরত্ব।
পারস্পরিক বিশ্বস্ততা আর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছিল যে নীড়ের পথচলা আজ সেখানে শুধুই ঘৃণা! ঘৃণা!! ঘৃণা!!!
এ ঘৃণা কি শুধুই তাদের নিজের প্রতি আর পারস্পরিক? নাকি সাব্বির আর শায়লার প্রতি নাকি ঘুণে ধরা এই অসুস্থ নোংরা সমাজব্যবস্থার প্রতি?
বিষয়: সাহিত্য
১৪৫০ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যে যেমন তার জন্য তেমন!!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
ভাল থাকুন...... অনেক শুভেচ্ছা ...
তাও আপনার চোখে পড়লে শব্দগুলি বা বাক্যগুলি নির্দিষ্ট করে বলুন।
যে যেমন, তার জন্য তেমন।
ধন্যবাদ, ভাল লাগল। আশা করি নিয়মিত লিখবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন