কামানখোলা ও দালালবাজার জমিদার বাড়ি (ভ্রমণ)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ৩০ জুলাই, ২০১৬, ০৪:৪২:৪৮ বিকাল
পারিবারিক কারণে আমাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই লক্ষীপুর যেতে হয়। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচের অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে হাজারো দর্শনীয় স্থান, ঐতিহ্য, ইতিহাসের স্বাক্ষর। লক্ষীপুর জেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে গুবাক তরু আর নারিকেল বাগানের সারি এ জেলাটিকে দিয়েছে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।
আমরা অনেকেই হয়তো ভাবি সয়াবিন শুধু বিদেশ হতে আমদানী হয়। কিন্তু জেনে অবাক হবেন যে, সয়াবিন চাষের জন্য লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, রামগতি বিখ্যাত। দেশের সয়াবিনের উল্লেখযোগ্য যোগান এ অঞ্চল থেকে যায়। গত বছর লক্ষীপুরে প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের চাষ হয়। সেখান থেকে আবাদ পাওয়া গেছে ৯০ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন, যার বাজারমূল্য ৩০০ কোটি টাকার ওপর। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
যেটা বলছিলাম, প্রতিবার লক্ষীপুর আসলে নতুন কোন স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করি। এর আগে গিয়েছিলাম মজু চৌধুরীর হাট, তিতা খাঁ মসজিদ, রায়পুরের হাজীমারা স্লুইসগেট। এবার খোঁজ নিয়ে জানলাম ১০ কি.মি. এর মধ্যেই দুটি বিখ্যাত জমিদার বাড়ি আছে।
সাতসকালে উঠে নাস্তা করে রওয়ানা দিলাম সিএনজিচালিত থ্রী হুইলারে। দালালবাজার সিএনজি স্ট্যান্ড নেমে ভাবলাম নিকটে যেটি আছে সেটিতো আছেই হাতের কাছে। একটু দূরে যেটি আছে সেটি আগে ঘুরে আসি। একটি রিক্সা ঠিক করলাম। রিক্সাওয়ালা সব চিনে জানে বলে নিজেকে খুব জাহির করলো। দুই কি.মি. এর পথ সে পাঁচ কি.মি. ঘুরে এক বিচারপতির বাড়ির সামনে নিয়ে থামলো। বলে এটা হচ্ছে জমিদারবাড়ি। আমিতো তাজ্জব! পরে স্থানীয় এক বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করাতে তিনি সঠিক লোকেশন বলে দিলেন। রিক্সাওয়ালাকে একটু বকাঝকা করে আবার রওয়ানা দিলাম। যাক এবার আর ভুল হয় নি। ঠিকঠাক চলে আসলাম কামানখোলায় অবস্থিত জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ি প্রবেশের আগেই চোখে পড়লো ইংরেজি C (বৃত্তাকারে নয়) অক্ষরের ন্যায় তিনদিক ঘিরে বিশাল দিঘী। বিশাল দিঘী বরাবর রাস্তা পেরিয়ে চতূর্থ রাস্তা দিয়ে বাড়ির প্রবেশ পথ। চতূর্থ রাস্তার ডানপাশে আরো একটি বড় দিঘী। এই দিঘীর প্রান্তে একটি মঠ।
দিঘী আর মঠ দেখে জমিদারবাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে বেশ কিছু পথ হাঁটতে হয়। পথের দুধারে গুবাক তরুর সারি। হাজার হাজার সুপারি গাছ। শুধু সুপারী বিক্রয় করেই বোধহয় এ বাড়ি হতে মাসে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে পথের ডানপাশে আরও একটি বড় পুকুর আছে।
মূলভবনের আগে প্রহরী ও লাঠিয়ালদের জন্য নির্মিত হয়েছে দোতলা আবাসস্থল।
মূল ভবন-
এটি সেই দিঘী যেটি বাড়ির তিন দিকে বেষ্টিত-
(ছবিতে যত ছোট মনে হচ্ছে বাস্তবে তা নয়, বেশ বড়সড়ই)।
ঘাটের পাশে আছে জলটং। বাড়িতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো বেশ কিছু পরিত্যক্ত, অর্ধপরিত্যক্ত ঘর। এর কোনটি হয়তো বা ছিল ঘোড়ার আস্তাবল, কোনটি হেঁসেল, কোনটি হয়তো গুদামঘর। তবে জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে আলাদা করে চেনা মুশকিল।
এ জমিদার বাড়ির ইতিহাস সুলিখিত নয়। ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। শ্রী সুরেশ চন্দ্রনাথ মুজমদার ‘রাজপুরুষ যোগীবংশ’ নামক গবেষনামূলক গ্রন্থে লিখেছেন দালাল বাজারের জমিদার রাজা গৌর কিশোর রায় চৌধুরী ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী থেকে রাজা উপাধি পেয়েছেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা ১৬২৯-১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দালাল বাজার আসেন। তাঁর বংশের প্রথম পুরুষের নাম লক্ষ্মী নারায়ন রায় (বৈষ্ণব) এবং রাজা গৌর কিশোরের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী প্রিয়া। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, লক্ষ্মী নারায়ন রায় বা লক্ষ্মী প্রিয়ার নাম অনুসারে লক্ষ্মীপুরের নামকরণ করা হয়। তবে এ মতের পক্ষে জোরালো সমর্থন নেই।
আরেকটি মত হচ্ছে, সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা আরাকান পলায়নের সময় ১৬২০ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি ধাপা ও শ্রীপুর হয়ে ৯ মে ‘লক্ষ্মীদাহ পরগনা’ ত্যাগ করে ভূলুয়া দূর্গের ৮ মাইলের মধ্যে আসেন। ১২ মে ভূলুয়া দূর্গ জয় করতে না পেরে আরাকান চলে যান। সেই লক্ষ্মীদাহ পরগনা থেকে লক্ষ্মীপুর নামকরণ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণ করেন। লক্ষ্মীপুর শহরের পূর্ব পাশে শাহ সুজার নামানুসারে একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ‘সুজা বাদশা সড়ক’। বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সানা উল্লাহ নূরী ‘সুজা বাদশা সড়ক’ নামে একটি ইতিহাস গ্রন্থও রচনা করেছেন।
সরকারীসূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মী নারায়ন বৈষ্ণব প্রায় ৪ শত বছর পূর্বে কলকাতা থেকে কাপড়ের ব্যবসা করতে দালাল বাজার আসেন। তার উত্তর পুরুষরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক এজেন্সী এবং পরে জমিদারী লাভ করেন। বাণিজ্যিক এজেন্ট হওয়ায় স্থানীয়রা তাদেরকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেনি। তাদের ‘দালাল’ বলে আখ্যায়িত করেন। ১৯৪৬ এ জনরোষের কারণে জমিদারগণ পালিয়ে গেলে তাদের পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ীটি রয়ে যায়। এটি আজ সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের মুখে। দালাল হতেই দালালবাজার এর উৎপত্তি।
অনেকে আবার ধারণা করেন, এটি মূলত মুসলিম জমিদার হতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হস্তান্তর হয়ে হিন্দু মালিকানায় আসে। তবে কোনটিরই সঠিক ভিত্তি বা ইতিহাস নেই।
পরবর্তীতে জমিদার রাজেন্দ্র নাথ দাস পুত্র ক্ষেত্রনাথ দাস ও পৌত্র যদুনাথ দাস এবং যদুনাথ দাসের পৌষ্যপুত্র হরেন্দ্র নারায়ন দাস চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারী করেন। রায়পুর উপজেলায় তাদের জমিদারী ছিল। দালাল বাজারের জমিদারদের সাথে শখ্যতা থাকায় এ জমিদারের বাড়ীর নিকটবর্তী কামান খোলায় ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করে জমিদারী আবাস গড়ে তোলেন। বর্তমানে এটি দেবোত্তর সম্পত্তি। কিছু লোকজন এখানে বসবাস করে যারা নিজেদের জমিদারের পরবর্তী প্রজন্ম বলে পরিচয় দেয়। তবে বেশভূষা, কথাবার্তায় মনে হয় নি।
কামানখোলা জমিদারবাড়ি দেখা শেষে রিক্সায় চেপে চলে আসলে দালালবাজার জমিদারবাড়ি দেখতে।
এভাবেই পরিত্যক্ত, শেওলাপড়া, জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে দালালবাজার জমিদারবাড়ি।
পাঁচ একর সম্পত্তি নিয়ে দালালবাজার জমিদারবাড়ি। মূলত কামানখোলার জমিদারদের নিকটাত্মীয়ই ছিল এরা।
বাড়ীর অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ নৃত্য ও সালিশী কক্ষ তথা ‘আঁধার মানিক’ নামে খ্যাতে কক্ষ নিয়ে নানা মুখরোচক কাহিনী রয়েছে।
বর্তমানে এটির কিছু অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে পুলিশ কনস্টেবলদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা করেছে। বাকিটা দেবোত্তর সম্পত্তি। হঠাৎ বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হওয়ায় দৌড়ে স্কুলের মত লম্বা পুলিশদের আবাসিকের বারান্দায় উঠলাম। এক কনস্টেবল এর বউ দুটি চেয়ার এনে দিল। ধন্যবাদ জানিয়ে বসলাম। ঝড় বৃষ্টি থামার পর ফিরে এলাম। (পরদিন পত্রিকায় পড়লাম -বজ্রপাতে লক্ষীপুরে দুইজন নিহত)।
এরপর খোয়াসাগর দিঘী দেখে ফিরে এলাম।
খোয়া সাগর দিঘী
প্রায় ২৫ একর এলাকা জুড়ে দালাল বাজার সংলগ্ন খোয়া সাগর দিঘী। কুয়াশাকে স্থানীয় ভাষায় ‘খোয়া’ বলা হয়। দিঘীর বিরাট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ফলে এক প্রান্ত দাঁড়িয়ে অন্য প্রান্তে কুয়াশাময় মনে হত বলে এ দিঘীর নাম খোয়া সাগর দিঘী। আনুমানিক ১৭৫৫ সালে জমিদার ব্রজ বলভ রায় মানুষের পানীয় জল সংরক্ষণে এ দিঘীটি খনন করেন। এ দিঘী নিয়ে বহু উপ কথা ছড়িয়ে আছে। সবমিলিয়ে জুমার আগেই ঘুরাঘুরি শেষ করে বাসায় ফিরে এলাম।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা-রায়পুর এর যে কোন বাসে উঠবেন। সাড়ে চার ঘন্টা হতে পাঁচ ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাবেন দালাল বাজার। দালাল বাজার লক্ষীবাজার হতে চার কি.মি. পরেই। ঢাকা হতে রায়পুর যেতে প্রথমে লক্ষীপুর, মাঝে দালালবাজার এবং শেষে রায়পুর। এসি সার্ভিস আছে রয়েল, ভাড়া ৫৫০ টাকা, ননএসি ইকোনো, ঢাকা এক্সপ্রেস-ভাড়া ৩৫০ টাকা, এছাড়া জোনাকী, জননী -ভাড়া ২৫০ টাকা। লঞ্চে চাঁদপুর হয়েও যাওয়া যাবে। চাঁদপুর হতে লক্ষীপুর সিএনজি বা বাসে যাওয়া যায়। দালালবাজার জমিদার বাড়ি দালাল বাজার নেমে হাঁটা দূরত্বেই। আর কামানখোলা ২ কি.মি. এর মধ্যে। রিক্সা নিয়ে যাবেন।
তবে শুধু ভ্রমণের জন্য আসলে এ দুটি জিনিস দেখে পোষাবে না। সাথে অবশ্য দেখতে ভুলবেন না তিতা খাঁ জামে মসজিদ, মটকা মসজিদ, মজু চৌধুরী হাট এবং হাজীমারা স্লুইসগেইট।
মজু চৌধুরীর ঘাট এলাকা, রায়পুর হতে রামগতি সংলগ্ন মেঘনা নদী ইলিশ মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত। সরাসরি রূপালি ইলিশ আহরন, রঙ বেরঙের পালের নৌকা, মেঘনার সুনীল জলবালি, মেঘনা নদীতে সুর্যাস্ত ও সুর্যোদয়ের দৃশ্য ইত্যাদি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে।
বিষয়: সাহিত্য
২৩২২ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই ৯০০০০ মে্টরিক টন (মানে ৯০০০০০০০ লিটার = ৩০০০০০০০০০ টাকা / ৩৩ টাকা প্রতি লিটার) সয়াবিন তেল কোথায় যায় ?
আমরা কিনি প্রায় ৯০ টাকা প্রতি লিটার।
মন্তব্য করতে লগইন করুন