রামাদান ও সিয়াম - উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও ফজীলত
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৪ জুন, ২০১৬, ০৩:৪০:৩৬ দুপুর
ইসলামের পাঁচটি মূলস্তম্ভের অন্যতম একটি হচ্ছে সওম বা রোযা। আমরা প্রায় সবাই জানি, ইসলামের মূল স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি- ঈমান, সালাত, সওম, হজ্ব ও যাকাত।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল, এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝে ভুল ধারণা কাজ করে। তারা ভাবেন, এ পাঁচটি স্তম্ভ পালন করা মানেই ইসলাম পালন সম্পূর্ণ হলো। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সকল স্তরে ইসলামী শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণই হচ্ছে ইসলাম।
একটি উদাহরণ এর মাধ্যমে বলি।
বিল্ডিং নির্মাণ করতে খুঁটি এবং ফাউন্ডেশন/ভিত্তি আগে প্রয়োজন। কিন্তু শুধু ফাউন্ডেশন আর খুঁটি দিলে বিল্ডিং সম্পূর্ণ হয় না। বিল্ডিং এর পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে হলে এর ওয়াল, ছাদ ও দরজা জানালা লাগবে। একইভাবে ঈমান, সালাত, সওম, হজ্ব ও যাকাত-এ পাঁচটি হচ্ছে ইসলামের মূলস্তম্ভ যা বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশনস্বরূপ এবং ইসলামের অন্যান্য বিধান হচ্ছে বিল্ডিং এর দরজা, জানালা, ওয়াল ও ছাদস্বরূপ।
ঈমান ও সালাতের পরই সিয়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন : “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)।
মূলত সিয়াম আল্লাহর পক্ষ হতে অনেক বড় একটি নিয়ামত। এটি যে কত বড় নিয়ামত ও ফজীলতপূর্ণ তা হাদীসে কুদসীতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ( أنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: «قَاَلَ اللَّهُ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ». (خ, م) صحيح
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা বলেন, সিয়াম ব্যতীত বনি আদমের প্রত্যেক আমলই তার জন্য, কারণ তা আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব”।
[বুখারি ও মুসলিম] ।
আরেকটি হাদীসে কুদসীতেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছেঃ “আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন : সে (সায়িম) আমার জন্য তার খাওয়া-দাওয়া, পানীয় পান, কামাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করে, সিয়াম আমারই জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (বুখারী শরীফ) “
আল্লাহপাক স্বয়ং এর প্রতিদান দিবেন। শুধু ৭০ গুণ কেন ৭০০০ গুণ বা ৭ লক্ষ বেশি প্রতিদান দিলেও আল্লাহর ভান্ডারের কমতি হবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৭০ গুণের হাদীসটি দুর্বল।
হাদীসে বলা হয়েছে : রোযা মানুষের জন্য ঢাল স্বরূপ।
যুদ্ধের ময়দানে ঢাল যেমন প্রতিপক্ষের আঘাত কে প্রতিহত করে। রোযাও ঠিক তেমনি আমাদের বাস্তব জীবনে শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে ফিরিয়ে রাখে।
তাই নিছক উপবাস থাকার নাম রোযা বা সিয়াম পালন নয়। সিয়াম হচ্ছে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জন করার প্র্যাকটিস। আল্লাহকে ভয় করে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনসম্ভোগ বর্জন করে ইসলামের অন্যান্য সকল বিধিবিধান পালন করা, সকল অন্যায়, পাপাচার বর্জন করা ও যাবতীয় কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হওয়ার নামই সিয়াম।
হাদীসে সুন্দর ভাবে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যত্তি রোযা রাখা সত্ত্বেও মিথ্যা কথা নিষিদ্ধ কাজ ত্যগ করতে পারলো না, অযথা তার পানাহার বর্জন করে উপবাস থাকার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী )”
রমজান পবিত্র কুরআন অবতীর্ণের মাস। এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ, চিরন্তন, শাশ্বত, সর্বজনীন জীবনবিধান, কল্যাণ ও সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি কুরআনুল কারিম অবতরণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহু সুবাহানাহু তায়ালা বলেন, ‘এই রমজান মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছিল’ (সূরা আল বাকারাহ : ১৮৫)।
রমজানের মধ্যেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’। পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে
‘إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ [٩٧:١]
আমি এটি নাযিল করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে।
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ [٩٧:٢]
তুমি কি জান সে রাতটি কী?
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ [٩٧:٣]
লাইলাতুল কদর’ (মহিমান্বিত রজনী) সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ [٩٧:٤]
সে রাতেই ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ [٩٧:٥]
শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’।
(সূরা কাদর)।
রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস, ধৈর্যের মাস, সহানুভূতির মাস; কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য নামক ষড়রিপু বশীভূত করার মাস। রমজান রহমতের মাস, মাগফিরাতের মাস, দোজখ থেকে নাজাতের মাস।
রমজানের পবিত্রতা বিরোধী সব অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। মানুষের প্রতি বিশেষ করে সমাজের অসচ্ছল-অভাবী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল-দয়ার্দ্র হতে হবে। সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। কারণ এটি ছাড়া (অন্যায়ের প্রতিবাদ) ঈমানই পূর্ণ হয় না। সর্বত্র পাপ ও দুষ্কৃৃতির বদলে পুণ্য ও আল্লাহভীতির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শোষণ ও নির্যাতনমূলক সব কার্যক্রম যেমন- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ভেজাল দেয়া, ধোঁকা-প্রতারণা, মুনাফাখোরি ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে।
আমরা যেন রামাদান হতে সঠিকভাবে সংযম শিক্ষা নিয়ে সারাবছর তা প্র্যাকটিস করতে পারি এবং দরিদ্র অভাবীদের ক্ষুধার কষ্ট যেন আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ আমাদের রামাদানের শিক্ষা সারাবছর পালন করতে পারার তাওফীক দিন। আমীন।
(পাদটীকাঃ ব্লগার গাজী সালাউদ্দীন ভাই রমযান উপলক্ষে ব্লগীয় আয়োজনের একটি সুন্দর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। লেখার বিষয়বস্তুও তিনি ব্লগারদের ঠিক করে দিয়েছেন। আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমাকে বন্টনকৃত নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লিখতে না পারার কারণে। কারণ ঐ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত বলেই মনে করি। তার পরিবর্তে এ ক্ষুদ্রপ্রয়াস)।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৫ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রামাদান ও সিয়াম - উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও ফজীলতের উপর প্রাণবন্ত আলোচনা অনেক সুন্দর হয়েছে মাশাআল্লাহ।
বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপনের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনারা এসে লিখলে, সময় দিলে ব্লগ প্রাণ খুজেঁ পায়।
অনুরোধ রাখার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
আপনি ৫ স্তম্ভ নিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, আমিও ঠিক এভাবেই আমার চাচাতো ভাইকে বুঝিয়েছি। আপনার ভাবনার সাথে আমার ভাবনা দারুণ মিলে গেলো।
রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য সবার উপলব্দিতে আসুক এবং সে অনুযায়ী আমল করুক। এটাই প্রত্যাশা।
জাযাকাল্লাহু খাইর
উদাহরণ সম্বলিত চমৎকার লিখাটির জন্য আন্তরিক শুকরিয়া। আল্লাহ আমাদের আমল করার তৌফিক দিন, আমিন।
অনেককেই দেখা যায়, সিয়ামে সময় কাটানোর জন্য হিন্দি ফিল্ম ও তাস খেলায় ব্যস্ত থাকেন।
আল্লাহ তায়ারা আমাদেরকে সিয়ামের উদ্দেশ্য উপলদ্ধি করার তাওফিক দান করুক।
Click this link
মন্তব্য করতে লগইন করুন