নাস্তিকতাঃ একটি জঙ্গি ও ভ্রান্ত বিশ্বাস (৪র্থ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:৪৫:২৪ দুপুর
নাস্তিকতাবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (চলমান)
জাপান হতে আরম্ভ করে ভারত, মধ্যএশিয়া, মক্কা, মদিনা, ফিলিস্তিন ও কায়রো পর্যন্ত বহু সভ্যতার উত্থান-পতন হয়েছে। এ এলাকা সমূহে বহু নবীর আগমন হয়েছে। ইতিহাসে কোথাও ধর্মের সাথে বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবি, দার্শনিক কিংবা রাজনীতিবিদদের সাথে এমন সংঘাত ঘটে নি, যা পাশ্চাত্যে ঘটেছে। প্রাচ্যে বহু নবীর আগমন ঘটেছে, সেখানে ধর্মের সাথে জাহিলিয়াতের সংঘাত হয়েছে বিজ্ঞানের সংঘাত হয় নি।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী তাঁর Islam and The World বইতে খৃস্টধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে তখনকার সংঘাতময় পরিস্থিতির একটি সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে, “প্রথমদিকে খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে অতঃপর ক্রমান্বয়ে সাধারণভাবে ধর্মের বিরুদ্ধেই বৈরিতা সৃষ্টি হয়ে যায়। যে যুদ্ধ প্রথমদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির পতাকাবাহী ও খৃস্টধর্মের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিল, পরে তা বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘাতের রূপ ধারণ করে। একপক্ষ হয়ে যায় জ্ঞান বিজ্ঞান আর ধর্ম হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। উভয়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ফলে প্রগতিবাদী ও মুক্তবুদ্ধির পতাকাবাহীরা নিজ থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ধর্ম ও বিজ্ঞান এক সাথে অবস্থান করতে পারে না। এজন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণের নিমিত্ত প্রয়োজন হয় ধর্মের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। এদের সামনে যখন ধর্মের নাম উচ্চারিত হত, তখন আকস্মিকভাবে ধর্মীয় প্রতিনিধি ও গীর্জার পুরোহিতদের লোমহর্ষক জুলুম নিপীড়নের ভয়াবহ ছবি তাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। উঠত সেসব নিরপরাধ জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের ছবি, যারা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে ও অসহায় অবস্থায় ঐসব জল্লাদের হাতে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করেছিল। ধর্মীয় সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর নামে ক্রোধব্যঞ্জক চেহারা, রুদ্র ও রুক্ষমূর্তি, অগ্নিঝরা চোখ ও সংকীর্ণ হৃদয়, পাদ্রীদের স্থুলমস্তিষ্ক তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত। ফলে কেবল খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধেই নয় সকল ধর্মের প্রতি ভীতি ও ঘৃণাকে তারা জীবনের মূলনীতি বানিয়ে নেয়।”
এভাবে ইউরোপে নাস্তিকতাবাদ এর উত্থান হয় Secularism তথা ইহজাগতিকতাবাদ নামে। সেকুলারিজমের একমাত্র আরবী পরিভাষা ‘আল লাদিনিয়াহ’ অর্থ ধর্মহীন মতবাদ। প্রথমদিকে খৃস্টধর্মের সাথে বিরোধের কারণে বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবি ও দার্শনিক মহল এ মতবাদের সমর্থক হলেও কালক্রমে সুবিধাবাদী ও লম্পটশ্রেণী এ মতবাদের কট্টর সমর্থক বনে যায়। কারণ ইহজাগতিকতাবাদে কোন ধর্মবিশ্বাসের স্থান নেই, কোন পরকালীন বিশ্বাস নেই, কোন পাপের ভয় নেই।
তবে Secularism নামকরণ হয় আরো অনেক পরে। ল্যাটিন শব্দ ‘Saeculum’ হতে Secularism শব্দটির উৎপত্তি। Saeculum অর্থ যুগ, জেনারেশন। পরিভাষাগত ভাবে এর অর্থ দাঁড়ায়-যা ইহজগত, বর্তমান দুনিয়া ও এই জীবন সম্পর্কিত। সেকুলারিজমের নামকরণ ও সত্ত্বার দিক দিয়ে প্রধান ব্যক্তি হলেন George Jacob Holyoake. ১৮১৭ খৃস্টাব্দে ইংল্যান্ডের বার্কিংহামে তার জন্ম। ১৮৪১ সালে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করলে ব্লাসফেমী আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেল হতে মুক্তি পেয়ে তিনি খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে আরো সোচ্চার হয়ে উঠেন ও ১৮৪৯ সালে সেকুলার সোসাইটি গঠন করেন। ১৮৬৬ সালে এ সোসাইটিতে যোগদান করেন Charles Bradlaugh. এ সময় এ সোসাইটির নামকরণ করা হয় National Secular Society. Charles Bradlaugh এ সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সংগঠনটি পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহে সেকুলার আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়।
ফ্রান্সে সেকুলারিজম Laicism পরিভাষারূপে ব্যবহৃত হয় যার অর্থ ‘অধর্মীয় ব্যবস্থা’। রাষ্ট্র, সমাজ, আইন ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ইত্যাদি থেকে গীর্জার কর্তৃত্বমুক্ত করার জন্য Laicism আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৯০৪ সালে রাষ্ট্রীয় আইন করে পোপের বিচারিক ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে রহিত করা হয়।
Secularism নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক গবেষণা হয়েছে। মনীষীদের গবেষণালব্ধ স্বীকৃত সংজ্ঞাসমূহের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি।
Secularism is an ethical system founded on the principles of natural morality and independent of revealed religion or super naturalism. (Encyclopedia Americana, Volume 24).
-সেকুলারিজম একটি নৈতিক ব্যবস্থা, যা কেবল প্রাকৃতিক নৈতিকতার মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ঐশী সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম বা রহস্যবাদমুক্ত।
Secularism is a code of duty pertaining to this life, founded on consideration purely human, and intended mainly for those who find theology indefinite, inadequate, unreliable or unbelievable. (Holyoake, English Secularism, A Confession of Belief, Chicago 1896).
-সেকুলারিজম এমন একটি কর্তব্য পালন পদ্ধতি, যা শুধু ইহজীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ও কেবলমাত্র মানবীয় বিবেচনার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের জন্য যারা ধর্মতত্ত্বকে অস্পষ্ট, অপূর্ণ, অনির্ভরযোগ্য এবং অবিশ্বাস্য মনে করে।
Secularism means the doctrine morality should be based solely on regard to the well being of mankind in the present life, to exclusion of all consideration drawn from belief in God or future life. (Oxford Dictionary).
-সেকুলারিজম এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদে মানবজাতির ইহজগতের কল্যাণ চিন্তার উপর গড়ে উঠবে এবম এক নৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে থাকবে না কোন ধরনের আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাসভিত্তিক বিবেচনা।
Secular spirit or tendency especially a system of political or social philosophy that reject all form of religious faith.
-সেকুলারিজম এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে।
Secularism মানে কি ধর্মনিরপেক্ষতা?
ধর্মনিরপেক্ষতা সেকুলারিজমের সঠিক বাংলা অনুবাদ নয়। তবে আমাদের দেশে কিছু বুদ্ধিজীবি ও তাদের সমর্থিত সংবাদমাধ্যমগুলি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেকুলারিজমের অনুবাদ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে চালু করেছেন। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানের নিকট সেকুলারিজমের একটি বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার; ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার; ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সকলের নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার-ইত্যাদি মুখরোচক শ্লোগান নিয়ে সেকুলার সমর্থক মিডিয়া ও ব্যক্তিবর্গ এটিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন। বাহ্যিকভাবে ধর্মানুরাগী কিন্তু ধর্মের প্রয়োজনীয় জ্ঞান নেই এমন অসচেতন ব্যক্তিবর্গ সহজেই এদের ফাঁদে পা দেন ও ঈমানহারা হন।
প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ইহজগত ও পরকাল উভয়জগতকে স্বীকার করে। বিপরীতে সেকুলারিজম শুধুমাত্র ইহজগত স্বীকার করে আর পরকালকে অস্বীকার করে। ধর্মীয় ধ্যানধারণা ও ধর্ম হতে সম্পূর্ণ পৃথক মতবাদ হচ্ছে সেকুলারিজম। এ অর্থে এর অনুবাদ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ চলতে পারে।
ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দের মধ্যে ‘নির’ প্রত্যয় যোগ করা হয়েছে। ‘নির’ এর অর্থ ‘নেই’ অর্থাৎ ধর্মের পক্ষে নেই। অর্থাৎ যে ব্যক্তির ধর্মের উপর ভরসা বা নির্ভরতা নেই, সেই হল ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। ধর্মীয় বিশ্বাসের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সৃষ্টিকর্তা, ওহী, আসমানী কিতাব, রিসালাত, আখিরাত, পুনরুত্থান, শেষবিচার, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদির উপর বিশ্বাস স্থাপন থেকে যে ব্যক্তি পৃথক থাকল, সেই হল ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। অতীতে ও বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে সেকুলারিজমের প্রয়োগ হতে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। সেকুলারিজম মানে যে ধর্মহীনতা সেটিও প্রমাণ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে বিদেশে এর প্রয়োগ এর মাধ্যমে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেকুলারিজম ইসলামবিরোধিতা অর্থে ব্যবহৃত ও প্রয়োগ হচ্ছে। কারণটাও সহজে অনুমেয়। ইসলাম যে চ্যালেঞ্জ সেকুলারিজমসহ সকল ভ্রান্ত মতবাদকে দিয়েছে তেমন চ্যালেঞ্জ আর কেউ দিতে পারে নি।
এখন সেকুলারিজমের অনুবাদ ইহজাগতিকতাবাদ, ধর্মহীন মতবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ যাই হোকনা কেন এর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য একই। ইসলাম ধর্মমতে, সেকুলারিজমে বিশ্বাসী কেউ মুসলমান থাকতে পারে কিনা সে বিতর্কে আমি না গিয়ে এর বিচারভার পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পাঠকবৃন্দ এর সঠিক জবাবটাই পাবেন বলে মনে করি।
মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমঃ
তুরস্কে মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম সেকুলারিজমের আমদানী হয় কামাল আতাতুর্ক এর মাধ্যমে। ১৯২২ সালে উসমানী সালতানাতের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে কামাল আতাতুর্ক। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর ঐতিহ্যবাহী ‘খিলাফত ব্যবস্থা’ বিলুপ্তি করে তুরস্ককে সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দেন কামাল আতাতুর্ক। কামাল এর সেকুলার ব্যবস্থায় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা হয়। নোংরা হিংস্র আক্রোশের শিকার হয় ইসলাম ও মুসলমানরা। হাজারো আলেম উলামাকে হত্যা করা হয়। ১৯২৬ সালে ইসলামী আইন বাতিল করে ইউরোপীয় বিভিন্ন আইন চালু করা হয়। আরবী হরফ ও আরবী ভাষায় আযান প্রদান বন্ধ করা হয়। ১৯২৮ সালে আযানের পরিবর্তে তুর্কী ভাষায় ‘তানরে উলুদুর’ ধ্বনি চালু করা হয়। আরবী নামের পরিবর্তে ইউরোপীয় ধারায় নাম রাখতে বাধ্য করা হয়। মহিলাদের বোরখা ও হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়। সকল ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি তার পিতৃপদত্ত নাম মোস্তফা কামাল পাশা হতে ‘মোস্তফা’ শব্দটি এ যুক্তিতে বাদ দেন যে, এটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নামের অংশ ছিল।
তুরস্কে স্কার্ফ পরিধানকারী কোন মহিলা সরকারী চাকুরী করতে পারেন না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও করতে পারতেন না। বর্তমানে তুরস্কের ক্ষমতাসীন Justice & Development Party প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগান এর নেতৃত্বে এ বাধাগুলি অপসারণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে যদিও সাংবিধানিক বিভিন্ন বাধা তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
তিউনিসিয়ায়ও সেকুলারিজমের নামে ইসলামের উপর আঘাত হানা হয়। ১৯৫৬ সালে প্রথম সেকুলার শাসক হাবিব বারগুইবা তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। হাবিব বারগুইবা তার শাসনামলে শ্রমিক-কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেয়ার অজুহাতে রমজান মাসে দুপুর বেলায় অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে দুধের প্যাকেট সরবরাহ করতো। যারাই দুধ খেতে অস্বীকৃতি জানাতো তাদের নাম কালো তালিকাভূক্ত করা হতো। হাবিব বারগুইবা তিউনিশিয়ার কামাল আতাতুর্ক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বারগুইবাও কামাল আতাতুর্কের মতো সেক্যুলার এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি তার ৩১ বছরের শাসনামলে সমাজ থেকে ইসলাম বিতাড়নকে সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। বারগুইবা দাবি করতেন, ইসলাম তিউনিশিয়ার জন্য এক বিরাট হুমকি। এ কারণে তিনি ইসলামী দলগুলোর সদস্যদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন।
বারগুইবা ১৯৮৭ সালে যখন স্মৃতিশক্তি হারানোসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হন তখন বিন আলী পাশ্চাত্যের দিকনির্দেশনায় রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। বিন আলী ক্ষমতায় আসার পর নিজেকে বারগুইবা থেকে আলাদা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরতে এবং জনসমর্থন লাভের জন্য সব ইসলামপন্থীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন ও ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। ওই বিতর্কিত নির্বাচনেও ইসলামপন্থী দলগুলো বেশ ভালো করলে বিন আলী এবং পাশ্চাত্যের সরকারগুলো বিস্মিত হয়ে যায়। ওই নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের মোকাবেলায় সেক্যুলাররা মাত্র তিন শতাংশ ভোট পায়। এ কারণে বিন আলী তার নীতিতে পরিবর্তন আনেন। তিনি ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেন এবং ইসলামী নেতা- কর্মীদের নির্বাসনে ও জেলে পাঠান।
২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে নগরীর একটি সড়কে অবৈধভাবে বসা একটি সবজির দোকান উচ্ছেদ করেন সিটি কাউন্সিল ইন্সপেক্টর ফাইদা হামদি। কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন না তার সেই ছোট্ট পদক্ষেপটির প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যা একসময় জন্ম দিয়েছে বিরাট একটি বিপ্লবের, নাড়িয়ে দিয়েছে সমগ্র আরব বিশ্বকে। যার নাম আরব বসন্ত। আর ছোট্ট সেই ঘটনাটি ঘটেছিল তিউনিসিয়ার সিসি বুওজিদ শহরে।
পাঁচ বছর আগের সেই সময়টিতে ফাইদা হামদি ছিলেন তিউনিসিয়ার ছোট্ট শহর সিদি বুওজিদের একজন কাউন্সিল ইন্সপেক্টর। সবজির দোকান উচ্ছেদের পর দোকানি যুবক এর প্রতিবাদ জানাতে কাউন্সিল অফিসের সামনে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। কয়েক দিন পর মৃত্যু হয় তার। ওই ঘটনার রেশ ধরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দেশটির যুব স¤প্রদায়, যা একসময় রূপ নেয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। পরে সেই জাগরণের রেশ ছড়িয়ে পড়ে পাশের আরব দেশগুলোতে। যাত্রা শুরু হয় আরব বসন্তের। বিন আলীর পতনের পরপরই তিউনিশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে আজান সম্প্রচার শুরু হয়েছে এবং মুসলমানরা প্রকাশ্যে খোলা জায়গায় জামাতে নামাজ আদায় শুরু করেছেন। তিউনিশিয়ার মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও দেশটির স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের দুই স্বৈরশাসক হাবিব বারগুইবা ও বিন আলীর সরকার তাদের অর্ধ শতাব্দীর শাসনালে সব সময় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিস্তার এবং ধর্ম পালনে বাধা তৈরীর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানুষ সুযোগ পেলেই ধর্ম পালনে উদ্যত হয়েছে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশঃ
খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সেকুলারিজম অন্তর্ভুক্ত হয়। অথচ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনপূর্ব ভাষণ কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ও কখনো ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় নি। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল তার ঘোষণায়ও কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ করা হয় নি। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৮ নং ধারার ১ নং উপধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ৩৮ নং ধারায় সকল ধর্মীয় সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের উপর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। ইসলাম ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল, সমিতি, সংগঠন সব নিষিদ্ধ হয়ে যায় আইনত। অথচ কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, বাসদ, ন্যাপ প্রভৃতি বামদল কাজ করতে থাকে কার্লমার্কস, লেলিন, স্টালিন, মাওসেতুং এর আদর্শ বাস্তবায়ন এর জন্য।
নামে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও বাস্তবে তুরস্কের কামাল পাশার মতো ইসলামবিরোধিতা হিসেবেই এটি ব্যবহার হয়। ইসলামের উপর সমস্ত আক্রোশ ঢেলে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম হতে কুরআনের আয়াত “রাব্বি জিদনী ইলমা” মুছে ফেলা হয়। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের মনোগ্রাম হতে মুছে যায় “ইকরা বিইছমি রাব্বিকাললাজি খালাক”। ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ সব স্থান হতে মুছে ফেলার প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায় তখন। ইসলামিক একাডেমি বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে ইসলামিক একাডেমি নতুন নামে চালু করা হয়-‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ নামে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, জাহাঙ্গীর নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ঢাকা ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কবি নজরুল ইসলাম কলেজ। কয়দিন পর ‘ইসলাম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু কবি নজরুল কলেজ। কিন্তু বিপরীতে জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ এসকল নামের কোন পরিবর্তন হয় নি। মসজিদের শহর ঢাকায় সরকারী উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা অসংখ্য মূর্তি স্থাপন করা হয়। মূলত সেকুলারিজমের নামে পৌত্তলিকতার চর্চা চলতে থাকে।
রাজনৈতি পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে সংবিধানের সেকুলার চরিত্রের অবসান হয়। সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহিম” এবং “আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” সংযোজিত হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা উঠে যায়। সংবিধানের ৮ নং ধারা পরির্বতন করা হয় এবং ৩৮ নং ধারা হতে ধর্মীয় নামযুক্ত সংগঠন করার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠে যায়। জনগণ গণভোটের মাধ্যমে এ পরিবর্তন সমর্থন করে।
দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা বসে থাকে না। তারা এদেশকে আবার সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আদাপানি খেয়ে লেগে যায়। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তাদের ষড়যন্ত্র আবার সফল হয়। ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের তাঁবেদার শক্তি বাংলাদেশকে সেকুলার এর নামে পৌত্তলিকতার উর্বর ভূমিতে পরিণত করার সব প্রচেষ্টাই করছে। বর্তমান পরিস্থিতি নতুন করে বলার কিছু নেই। সেকুলারিজমের নামে দেশে এখন কী হচ্ছে তা সচেতন মহল মাত্রই ওয়াকিবহাল।
১২ই এপ্রিল ২০১৫ ইং দৈনিক ইনকিলাবে “আমাদের সন্তানেরা মুসলমান থাকবে তো” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনঃ “প্রাইমারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অমুসলিম শিক্ষকদের গড় হার ৫৮ ভাগেরও বেশি। কোনো কোনো বিদ্যালয়ের ৮৫ ভাগ শিক্ষকই বিধর্মী। একটি শিশু কোমল মন নিয়ে যখন শিক্ষালাভ শুরু করে তখন তার শিক্ষক বা গুরুর ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সে আসক্ত হয়ে পড়ে। তার মিস, ম্যাডাম বা টিচারের ধর্মীয় ভাবধারা, রীতি সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনার প্রভাব শিশুটির উপর পড়বেই। তাহলে মুসলিম শিশুরা ছোটবেলা কী শিখবে? ৭% জনগোষ্ঠীর কৌশলগত নিযুক্তির ফলে আজ তারা প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষকতার পদ দখল করে আছেন। দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সে দেশে শিক্ষাব্যবস্থার ১ম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে বিধর্মী লোকদের লেখা গল্প, কবিতার পরিমাণ ৫৭ থেকে ৮০ ভাগ। এসব লেখার মাধ্যমে ১৫ কোটি মুসলমানের ছাত্রসমাজকে তাদের আত্মপরিচয় ও ধর্মীয় ভাবধারা ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব লেখায় ‘‘নেমন্তন্ন, ভজন, বাবু, প্রসাদ, পূজা, পার্বণ, বৈষ্ণব, চ-ীম-প, প্রায়শ্চিত্ত, ভগবতী, শ্মশান’’ ইত্যাদির ন্যায় বহু বিশেষ অর্থ ও মর্মবোধক শব্দ ব্যবহার করে এবং শিক্ষাঙ্গনে ধর্মীয় সঙ্গীত শ্রবণের উৎসাহ দিয়ে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের নিজ ধর্মবিশ্বাস দুর্বল করে ভিন্ন ধর্মের দিকে (নাউজুবিল্লাহ) ধাবিত করার সূক্ষ্ম প্রয়াস চালানো হচ্ছে। অনেক শিক্ষাঙ্গনে এখন সকল ছাত্রকেই সরস্বতী পূজায় উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। অথচ মুসলমানের জন্য দেব-দেবীর পূজা করা সম্পূর্ণ অবৈধ, হারাম ও শিরক।”
বিস্তারিত রেশ না টেনে আর একটি উদাহরণ দিয়েই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে একটু ধারণা দিচ্ছি।
সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষা ২০১৬ ইং সনের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ ও উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হয়েছে। ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে বলা ছিলঃ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক এমদাদ। ধর্ম-খোদা-রাসূল কিছুই বিশ্বাস করে না। খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে একেবারে বদলে গেলো। পীরের মুরীদ হয়েছে এবং নিয়মিত নামাজ পড়ছে। পীরের ভণ্ডামী ও লোলুপ দৃষ্টি এমদাদের কাছে ধরা পড়লো। মুরীদের সুন্দরী বউকে জোরপূর্বক তালাক পড়িয়ে বিয়ে করেছে। এমদাদ এতে ত্রুব্ধ হয়ে পীরের মেহেদী রঞ্জিত দাড়ি ধরে হেচকা মাটিতে ফেলে দিলো।
(এখানে ইসলামের বিকৃতরূপকে ভন্ডপীরকে ইসলারে প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি অত্যন্ত নোংরা ও জঘন্যভাবে মুসলমানদের অনুভূতিকে আঘাত করা হয়েছে)।
চট্টগ্রাম বোর্ডের প্রশ্নপত্রে ছিলঃ এতিম ফারুককে রাস্তা থেকে শিশু অবস্থায় কুড়িয়ে এনে বড় করেছে গণেশের বাবা। অথচ ফুটবল খেলতে গিয়ে সামান্য কথা কাটাকাটির জের ধরে গণেশকে কুপিয়ে হত্যা করে ফারুক।
এভাবেই সেকুলারিজমের নামে দেশে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে, মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো পৌত্তলিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো হচ্ছে। শুধু তাই নয় প্রশাসনিক সকল স্তর হতে মুসলমানদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে কট্টর হিন্দু মৌলবাদীদের আসন পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। উৎসাহী কেউ সরকারী প্রশাসনের পরিসংখ্যান নিলেই বিষয়টির সত্যতা পাবেন।দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলিও এ কট্টর সাম্প্রদায়িক কর্মে সর্বাত্মক সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহের ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণ ভারতীয় নাগরিককে পুলিশে নিয়োগ দেয়ার ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে।
(চলবে………………)
(তথ্যসূত্রঃ সেকুলারিজম-অধ্যাপক ফজলুর রহমান; Islam and The World, Syed Abul Hasan Ali Nadvi; দৈনিক ইনকিলাব; প্রশ্নপত্র: এইচএসসি বাংলা প্রথম পত্র, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বোর্ড)।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হার্ডকপি কাটাবন পাবেন।
পিডিএফ কপির লিংক দিলাম।
http://www.muslim-library.com/dl/books/English-Islam-And-The-World.pdf
ধর্মবিরোধিরা পৃথিবির ইতিহাসে কখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পায়নি। সবসময় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতা দখল করেছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন