দৃষ্টিভঙ্গি সমাচার
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২২ মার্চ, ২০১৬, ১২:৪৬:৪৫ দুপুর
দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবনটা বদলে যাবে- এমন শ্লোগান আমরা হরহামেশাই শুনি।
কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা আসলে কী?
ইমাম আর সিঁদেল চোরের গল্পটা নিশ্চয় আমরা অনেকেই জানি। একজন ইমাম ভোররাতে পুকুরে গোসল করছেন পবিত্রতা অর্জন করে তাহাজ্জুদ আর ফজর সালাত পড়ার জন্য। অপর পাড়ে গোসল করছে একজন সিঁদেল চোর, কারণ সারারাত চুরি করায় তার গা জুড়ে ময়লা কাদা মাটি। ইমাম সাহেব ভাবছেন-আল্লাহর এক নেক বান্দা অপর পাড়ে গোসল করছেন। সিঁদেল চোরের ভাবনা- এই তল্লাটে দেখি আর একজন সিঁদেল চোর এসেছে, চুরিশেষে আমার মতো গোসল করছে। দু’জন ভিন্ন মানুষ, দু’রকম কাজ, দু’রকম ভাবনা।
একটি গ্লাসে অর্ধেক পানি থাকলে কেউ বলে অর্ধপূর্ণ গ্লাস, কেউবা বলে অর্ধেক খালি গ্লাস। স্রেফ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন একবার একটি সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট লিংকন বললেন, “অর্ধেক আমেরিকান অলস, ভীতু, মূর্খ ও বোকা”। সভায় হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। কী! এত বড় কথা!! প্রেসিডেন্ট এবার কথাটা ঘুরিয়ে বললেন, “ হ্যাঁ, আমি বলতে চাচ্ছি-(বাকি) অর্ধেক আমেরিকান কঠোর পরিশ্রমী, সাহসী, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। এবার তুমুল করতালি। একই কথা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে।
৩৩ বসন্ত আপনার জীবন হতে চলে গেল কিন্তু এখনো জীবনসঙ্গিণী মিলেনি। কারণ, বাসায় বিবাহযোগ্যা ছোটবোন আছে বলে নিজেরটা ভাবার অবসর পান নি। কেউ বলবে, কী স্যাক্রিফাইস! আজকাল এমন ছেলে কয়জন হয়? কেউ আবার ফোঁড়ন কাটবে-কী বদ ছেলে! এখনো বিয়ে থা করে নি। নিশ্চয়ই আকাম কুকাম করে।
এলাকায় গরু জবাই করে গরীবদুঃখীকে খাওয়ালেন। কেউ বলবে- কী দিলদরিয়া মানুষ। এলাকার প্রতি টান আছে, খরচাপাতি করে। কেউবা মন্তব্য করবে- নতুন পয়সা হয়েছে।তাই ঢোল পিটিয়ে জানায়। আরে ভাই ওত পিটিয়োনা, শেষে আবার ভেঙ্গে যাবে।
বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে নগরীর রাস্তাঘাট নদী হয়ে যায়। ঠিকঠাক ঠাওড় করতে না পেরে সিটিকর্পোরেশন এর ম্যানহোলে পড়ে গেলেন। কেউ মজা নিবে, অট্টহাসি দিবে। কেউ আবার দুঃখিত হবে, আপনাকে টেনে তুলবে।
ঐ যে বললাম না, স্রেফ দৃষ্টিভঙ্গি!
দৃষ্টিভঙ্গি অনেকে বদলে ফেলেন, জীবনটা বদলান। আবার অনেকে আছে বদলাতেই পারেন না, দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা নেতিবাচকই থাকে। কপালে ভাঁজ ফেলে, চোখ দুটি বড় করে, ঘাড় বাঁকিয়ে, ভ্রু কুঁচকে, তীর্য্ক দৃষ্টিতে সবকিছু হতে খুঁত বের করবেই সেটা যতই নিখুঁত হোক। তীর্য্ক বাক্যবাণেও জর্জরিত করে তুলবে।
এক লোক সবকিছুতে খুঁত ধরেন। বেয়াইবাড়িতে গিয়েছেন তিনি দাওয়াত খেতে। বেয়াই এর মুদ্রাদোষ এর কথা জানতেন সবাই। তাই বেয়াই যাতে কোন খুঁত ধরতে না পারেন সেজন উত্তমরূপে দশ ব্যঞ্জন রান্না করলেন। মাছ, গোশত, কোরমা, পোলাও, পিঠা-পুলি, দই মিষ্টি, ফল ফলাদি কোন কিছুর কমতি নেই। স্বাদেও হয়েছে অনন্য। খাওয়া দাওয়া শেষে বেয়াই ভ্রু কুঁচকে তীর্য্ক চোখে অগ্নি দৃষ্টি হাঁকিয়ে বললেন, অতি ভালো ভালো নয়, অতি ভালো ভালো নয়।
সবার দৃষ্টিভঙ্গি আমলে নিতে নেই, সব কথাও গায়ে মাখতে নেই। তাহলে গল্পের গাধা হারানোর মতো ঘটনা ঘটবে। এক লোক তার ছেলেসহ একমাত্র গাধার পিঠে চড়ে রওনা দিয়েছে বাজারে। পথিমধ্যে কিছু লোক দেখে বলাবলি করছে, “দেখ দেখ, কি নির্দয় এরা! গাধাটিকে কি কষ্টই না দিচ্ছে, একটা গাধার পিঠে দুইজন চড়ে বসেছে”। লোকটি এবার ছেলেকে গাধার পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর না যেতেই আবার লোকজন বলাবলি করছে, “আজকালকার পোলাপাইন কি বেয়াদব। বাবা হাঁটছে অথচ ছেলেটি দিব্যি গাধার পিঠে বসে আছে। ভালো ছেলে হলে সে হাঁটতো, বাবা গাধার পিঠে চড়তো।” কী আর করা! লোকটি এবার নিজেই চড়ে বসলো গাধার পিঠে, ছেলে চললো রশি হাতে। একটু পর যেতে এক লোক বলে বসলো, “লোকটি কত বেআক্কেল। নিজে আরাম করে গাধায় চড়েছে আর ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছে।” এবার লোকটি আর ছেলেটি দুজনেই হেঁটে চললো গাধার সাথে। খানিকপর এক লোক বললো, “কী বোকা এরা। গাধা থাকতেও হেঁটে যাচ্ছে।” এবার লোকটির মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। একটি বাঁশ জোগাড় করলো। গাধার চার পা উত্তমরূপে বেঁধে মাঝখানে বাঁশ ঢুকিয়ে বাপবেটা গাধাকে কাঁধে নিয়ে চললো। খানিকপর একটি বাঁশের সাঁকো পড়লো নদীর উপর। বাপবেটা গাধা কাঁধে নিয়ে পার হচ্ছিল। পানিতে গাধা নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ভয় পেয়ে পা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে গিয়ে সাঁকো হতো দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে গিয়ে মারাই গেল।
আমার মত যারা ভাড়া থাকেন মানে ভাড়াটিয়া বছর শেষ হলেই তাদের আতন্ক গ্রাস করে।কারণটা সবার জানা। নতুন বছরে ভাড়া বাড়বে। আমার মত ভাড়াটিয়ারা ভাবি, বছর বছর বাড়িভাড়া বাড়ানোর পেছনে যৌক্তিকতা কী? যে বাড়ি বহু বছর আগে তৈরি হয়ে আছে, তারও ইট সিমেন্টের দাম বাড়ে নাকি? সেটাইবা কীভাবে সম্ভব ? কিন্তু বাড়িওয়ালার দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন। বাড়িওয়ালা ভাবেন, “সবকিছুর দাম বাড়ছে। তাহলে আমার খরচও তো বাড়ছে। ইনকাম সোর্স যেহেতু বাড়িভাড়া সেহেতু দিই বাড়িয়ে।” আজকের ভাড়াটিয়া যখন আগামীকাল বাড়ির মালিক হয়, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গিটাও বদলে ফেলেন মানে ফী বছর বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন।
ভাড়াটিয়ার কাছে মনে হয় বছর বছর বাড়িভাড়া বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক; অন্যদিকে বাড়িওয়ালারা মনে করেন ফী বছর যখন দ্রব্যমূল্য বাড়লে, জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ছে সেহেতু বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করাও যৌক্তিক। উভয়পক্ষেই যুক্তির অভাব নেই। বিষয়টি অনেকটা লোকাল বাসের যাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার মতো। যিনি বাসে উঠে বসে আছেন তিনি মনে করেন, ভিতরে কোন স্থান অবশিষ্ট নেই যাত্রী উঠার। আর যে যাত্রী বাদুরঝোলা হয়ে আছেন, তিনি ভাবেন ভিতরে অনেক ফাঁকা, ভিতরের যাত্রীরা একটু চাপলেই হয়।
এভাবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা। এটাই দৃষ্টিভঙ্গি। ইংরেজীতে বলা হয়ঃ Think Positive, talk positive, feel positive. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই বড় একটি যোগ্যতা। দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে ফেলি, জীবনটাকে বদলে দিই।
কেউ হয়তো ভাবছেন, যেটা মন্দ বিষয় যেটা অশোভন, অনৈতিক, অশ্লীল সেটার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আবার কিভাবে হয়? আমি একটু অন্যভাবে বলি। মন্দকে মন্দ বলতে পারা এবং বর্জন করাটাইতো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এর বিপরীত হলে সেটা নেতিবাচক।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৯৮ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই পিকচারটি আর গল্পের সাথে মানানসই। যদিও আরবীতে, তবুও ভাব বুঝতে কষ্ট হবে না।
ধন্যবাদ
আলহামদুলিল্লাহ্, দুই অবস্থাতেই যখন আমাকে পড়তে হয়, তাই কখনো সীটে বসে দাড়ানো যাত্রীদের প্রতি বিরক্তি ভাবটা কখনো আসেনা। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া।
মূদ্রা দোষ নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছি। এটা খুবই জঘন্য, যারই থাকবে, শিগগিরই পরিবর্তন করে নেয়া উচিত।
দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো খুবই দরকার, তবে তার আগে বিশ্লেষণ করা দরকার,আমার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকেও আলাদা হলেও সঠিক ওয়েতে আছে কিনা। যার তার কথায় ধমকে প্রভাবিত হয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে নিজস্বতা বলতে কিছু থাকবেনা।
বস, এত্তো সুন্দর লিখতে পারেন, অথচ ব্লগে লিখেন না!!!!
Think Positive, talk positive, feel positive. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই বড় একটি যোগ্যতা। কথা সত্য হলেও সব সময় না । কিছু কিছু বিষয় বা মানুষ আছে ষে সব বিষয়ে বা মানুষের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখতে হবে ।
দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের যেটার বেশি অভাব সেটা হলো পরমতসহিষ্ঞুতা!
গল্পে গল্পে কখন যে আপনার লেখনীর তলানীতে এসেছি টেরই পাইনি। দারুন লিখেছেন। অফুরন্ত শুভেচ্ছা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন