ইতিহাসের খোঁজে মুর্শিদাবাদ শহরে (ভ্রমণ)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৬ নভেম্বর, ২০১৫, ০৮:৪১:২৭ রাত
গত পর্বের লিংকঃ [url href="http://www.bdfirst.net/blog/blogdetail/detail/1980/ohidul/70350#.VjyrNG6mGBc" target="_blank" মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে (ভ্রমণ)[/url]
খোশবাগ হতে ফিরলাম একই পথে, ভাগিরথী নদী পাড়ি দিয়ে। কারণ হাজারদুয়ারি, ইমামবাড়া ও আরো কিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখতে হলে আপনাকে আবারো লালবাগ সদরঘাট আসতে হবে। হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়া একই স্থানে। লালবাগ হতে টুকটুক (রিচার্জেবল ব্যাটারী চালিত বাহন যা আমাদের দেশে অটো নামে পরিচিত) ভাড়া করলাম। পর্যটক বুঝতে পারলে টুকটুক এর ড্রাইভার কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দাবি করে বসে। হাজারদুয়ারী, ইমামবাড়া, মীরজাফরের প্রাসাদ ও আরো কয়েকটি স্পটভিজিট এর জন্য আমার কাছে ১২০০ রুপি ভাড়া চেয়েছিল। পরে মাত্র ১৫০ টাকায় রাজি হয়েছে। আমি আগে তথ্য নিয়ে গিয়েছিলাম বলে ঠকি নি।
আমার স্মার্ট টুকটুক ড্রাইভার।
মুর্শিদাবাদ শহরের সেরা আকর্ষণ হাজারদুয়ারি । ১৮৩৭ সালে নবাব নাজিম হুমায়ুন খাঁয়ের জন্য ৮০ ফুট উঁচু তিনতলা গম্বুজওয়ালা এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়। মূলত এর দরজা সংখ্যা এক হাজার হওয়ার দরুণ এমন নামকরণ। আদপে ৯০০টি দরজা হলেও আরও ১০০টি কৃত্রিম দরজা রয়েছে প্রাসাদে। এজন্যই নাম হাজারদুয়ারি। প্রাচীন মুর্শিদাবাদের স্মৃতি নিয়ে অপরূপ গথিকশৈলীর এই প্রাসাদ এখন মিউজিয়াম। আক্ষরিক অর্থেই এ এক ঐতিহাসিক জাদুঘর। নীচের তলায় রয়েছে তৎকালীন নবাবদের ব্যবহৃত প্রায় ২৭০০টি অস্ত্রশস্ত্র। যার মধ্যে আলিবর্দি ও সিরাজের তরবারি এমনকী যে ছুরিকা দিয়ে মহম্মদি বেগ সিরাজকে খুন করেছিল তা পর্যন্ত রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। এই সুরম্য বিশাল রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে দেখা যায় রুপোর সিংহাসন যেটি ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানি ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার। ১৬১টি ঝাড়যুক্ত বিশাল ঝাড়বাতির নীচে সিংহাসনে বসে নবাব দরবার পরিচালনা করতেন। মন্ত্রণাকক্ষের লুকোচুরি আয়না, দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত বিশ্ববিখ্যাত সব ঘড়ি, মার্শাল, টিশিয়ান, রাফায়েল, ভ্যান ডাইক প্রমুখ ইউরোপীয় শিল্পীর অয়েল পেন্টিং, প্রাচীন সব পাথরের মূর্তি হাজারদুয়ারিকে বিখ্যাত করে তুলেছে। ত্রিতলে আছে নবাবী আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন সোনা দিয়ে মোড়া কোরাণ শরিফ, অমূল্য পুঁথিপত্র, আইন-ই-আকবরির পান্ডুলিপি সহ অসংখ্য বইয়ের সম্ভার। ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরও কিছু বিশিষ্ট নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এই মিউজিয়ামে। হাজারদুয়ারির চত্বরে রয়েছে ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে জনার্দন কর্মকারের তৈরি ১৮ ফুট লম্বা, আট টন ওজনের ‘জাহানকোষা’ কামান বা বিশ্বজয়ী কামান। এই কামানে একবার তোপ দাগতে ৩০ কেজি বারুদ লাগত বলে জানা যায়। এটি বাচ্চেওয়ালি কামান নামেও পরিচিত।
হাজারদুয়ারির বিপরীতপাশেই অবস্থিত ইমামবাড়া। হাজারদুয়ারির উত্তরে কেল্লার উত্তর সীমানায় ২০৭ মিটার দীর্ঘ এই বৃহত্তম ইমামবাড়া। হাজারদুয়ারি এবং ইমামবাড়ার মধ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণে একটি ঘড়িঘর ও সিরাজউদ্দৌলা নির্মিত ইমামবাড়ার ‘মেদিনা’ বা ‘মদিনা’ অংশটি এখনও বর্তমান। সিরাজউদ্দৌলার এই একটি কীর্তিই এখন অবশিষ্ট রয়েছে।
হাজারদুয়ারি আর ইমামবাড়া দর্শন শেষে চললাম জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ বা নিমকহারাম দেউড়ি দেখতে। হাজারদুয়ারি হতে মাত্র দেড় কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত। পথে পড়লো কাটরা মসজিদ, বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থা। ১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ এটি নির্মাণ করান। কাটরা মসজিদের পেছনেই রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র সমাধি।
উল্লেখ্য যে, মুর্শিদাবাদে নবাবি শাসনের পত্তন হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র আমলে। তাঁর নামেই শহরটির নাম হয় মুর্শিদাবাদ।
জাফরাগঞ্জ দেউড়ি
ইতিহাসের কুখ্যাত বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ও তার কুলাঙ্গার পুত্র এর প্রাসাদকেই বলা হয় জাফরাগঞ্জ বা নিমকহারাম দেউড়ি।
শোনা যায় মিরনের এই প্রাসাদেই সিরাজদ্দৌলা খুন হয়েছিলেন আততায়ী মহম্মদি বেগের হাতে। জাফরাগঞ্জের অর্থ হল বেইমান বা নিমকহারাম দেউড়ি। এই দেউড়িতে আছে ইংরেজদের কাছ থেকে উপঢৌকন পাওয়া দুটি কামান। দেউড়ির বিপরীত দিকে জাফরাগঞ্জ সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছে মীরজাফর ও তার পরিবারের সহস্রাধিক মানুষজন। অদূরে মহিমাপুরে মুর্শিদকুলি-কন্যা আজিমউন্নিষার সমাধি।
এই জাফরাগঞ্জ প্রাসাদে প্রবেশের পূর্বে নামে সুন্দর কারুকাজ করা তোরণ আছে। বর্তমানে মিরজাফরের পুত্র মিরনের বংশধরগণ এখানে বাস করেন। এই প্রাসাদেই মিরনের নির্দেশে সিরাজেদ্দৗলাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল মুহাম্মদী বেগ। এই প্রাসাদেই সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং পলাশির যুদ্ধের পূর্বে মিরজাফর ও ইংরেজদের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
লালবাগ কোর্ট থেকে এক কিমি দক্ষিণে লালবাগ-বহরমপুর সড়কের কিছু পূর্বে মতিঝিল। আলিবর্র্দি খার জ্যেষ্ঠ জামাতা ঘসেটি বেগমের (মেহেরুেন্নসা) স্বামী নবাব নওয়াজেস মহম্মদ খা এই অতি সুদৃশ্য ঝিল এবং তার তীরে ‘সাংহী দালান’ নামে এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এখন তা অবলুপ্ত। নওয়াজেস খা (১৭৫০-৫১) ‘কালা মসজিদ’ নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা মতিঝিল মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদ চত্বরে নওয়াজেস মহম্মদ খা ও সিরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা এক্রামউদ্দৌলার সমাধি রয়েছে।
অামার মুর্শিদাবাদ দেখা শেষ হলো। কিন্তু হৃদয়ে বাড়লো দীর্ঘশ্বাস আর রক্তক্ষরণ। আড়াইশো বছরেরও বেশি পূর্বে বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র ও কূটচালে পরাজিত হলো দেশপ্রেমিক শক্তি, দুইশো বছরের জন্য অস্তমিত হলো স্বাধীনতা সূর্য, বৃটিশ বেনিয়াদের হাতে চলে গেল দেশের শাসনক্ষমতা, নিজদেশেই ভিনদেশী বৃটিশদের হাতে দুই শতাব্দী ধরে নির্যাতিত-নিপীড়িত হলো উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষ। প্রিয় বাংলাদেশ কি আজ ষড়যন্ত্র হতে মুক্ত? না, দেশি বিদেশী অপশক্তি এর চেয়েও কঠিন কঠিন ষড়যন্ত্র করছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্রকারীরা অনেকাংশে সফলও। আমাদের স্বাধীনতা আজ নামমাত্র। আমরা কি প্রস্তুত, আমরা কি সচেতন?
মুর্শিদাবাদ হতে সেদিনই ফিরেছিলাম। বহরমপুর চলে এলাম বিকেল তিনটার আগেই। বহরমপুর হতে শিলিগুড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু সরাসরি কোন ট্রেন সার্ভিস নেই। বাসই ভরসা। দীর্ঘ পথ, তাই এসি গাড়ির সন্ধান করলাম। পেলাম না, আসলে ভারতে আমাদের দেশের মত লং রুটে এসি বাস সার্ভিস এভেইলেবল নয়। শেষ পর্যন্ত রকেট নামে একটি সরকারি বাস এ চড়ে বসলাম বিকেল পাঁচটায়। বাসে চড়ায় একদিক দিয়ে সুবিধা হলো। এই ৬০০ কিমি এরও অধিক রুটটা আমাদের উত্তরবঙ্গের পদ্মানদীর পাঁশঘেষে চলে গিয়েছে।
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ পার হয়ে ঘন্টা তিনেক চলার পর এলো বাংলাদেশের দুঃখ ফারাক্কা বাঁধ। রাত বারোটায় গাড়ি যাত্রাবিরতি করলো মালদা’র একটি হাইওয়ে রেঁস্তোরায়। হাইওয়ে রেঁস্তোরা বলতে যা বুঝায় আসলে তেমন কিছু নয়। আমাদের দেশের মত দৃষ্টিনন্দন হাইওয়ে রেঁস্তোরা চোখে পড়ে নি, আসলে ঐ মানের রেঁস্তোরা ভারতে খদ্দেরের অভাবে চলে কম। খুবই সাধারণ মানের রেঁস্তোরা, ভারতীয়দের উপযোগী। খিদে ছিল বেশ, তাই বাধ্য হয়ে খেতেই হলো।
মজার ঘটনাটি বলে নিই। আমার পাশের সিটের সহযাত্রী শিলিগুড়িতে যাচ্ছেন শ্বশুড়বাড়িতে জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণে। ভদ্দলোক ৮ (আট) পিস রসগোল্লা কিনলেন। ভারতীয়দের কৃপণতার অনেক গল্প শুনেছি, এবার নগদে প্রমাণ মিললো।
যাই হোক, মালদা জেলার পর আসলো ভারতের উত্তর দিনাজপুর জেলা যেটি আমাদের দেশের দিনাজপুর জেলার পাশ দিয়ে।
নিচের লিংকের ম্যাপটি ক্লিক করলে রুটটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবেন।
Click this link
পরদিন সকাল সাতটার মধ্যেই পৌছে গিয়েছিলাম শিলিগুড়ি। আজই বিকেলে রওনা দিতে হবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। কাউন্টারে খবর নিয়ে জানলাম বাস ছাড়তে দেড়ঘন্টা দেরি হবে (১:৩০ টার পরিবর্তে ৩:০০ টা)। কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠলাম, ফ্রেশ হয়ে চার ঘন্টার একটি ঘুম দিলাম। আহ! কি শান্তি। ভ্রমণক্লান্তি মুছে গিয়ে শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। শিলিগুড়ি নাকি কেনাকাটার জন্য ভালো। আনুমানিক তিন কিমি এর মধ্যে থাইল্যান্ড মার্কেট নামে একটি মার্কেট আছে। চলে গেলাম। বেশ কিছু পোশাক পরিচ্ছদ কিনলাম-হ্যাট, সানগ্লাস, কম্বল, শাড়ি, কাশ্মিরী শাল, কসমেটিকস, চকোলেট ইত্যাদি। ইতোমধ্যে হোম সিকনেস খুব করে পেয়ে বসেছে। কখন দেশে পৌছব শুধু সেই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মনের মাঝে। পকেটের টাকায় টান পড়ার পর অবশেষে থামলাম। বিকেল তিনটায় পূর্বনির্ধারিত শ্যামলী পরিবহনের একটি গাড়িতে (এটি চ্যাংড়াবান্দা সীমান্ত পর্যন্ত যাবে, এরপর দুইদেশের কাস্টমস চেকিং শেষে আর একটি গাড়ি) করে রওনা দিলাম।
বিদায় ভারত, বিদায়।।
বিষয়: সাহিত্য
৪০৭৯ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১২০০ রুপি ভারা ১৫০ রুপি দিয়ে শেষ!!! এটাও মনে হয় বেশি হয়েছে। মুর্শিদাবাদ এ কি খেলেন???
লেখায় আরো কিছু সংযোজন হয়েছে। আবার পড়ুন।
ও হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। খোশবাগে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা তাঁর গাছের কয়েকটি পেয়ারা খেতে দিয়েছিলেন।
একটি বিষয় খুব পীড়াদায়ক লেগেছিলো। ভারত সরকার বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে সম্মানের সাথে মর্যাদা দিয়ে তার স্মৃতি সংরক্ষণে যতটা আন্তরিক, তার ছিঁটেফোঁটাও নেই দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলার ক্ষেত্রে।
চমৎকার লিখনী পড়ে অনেক অতীত ইতিহাস জানলাম। ভ্রমণ কাহিনীটি টি খুব উপভোগ্য এবং সুখপাঠ্য হয়েছে।
জাযাকাল্লাহু খাইর!
মন্তব্য করতে লগইন করুন