মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে (ভ্রমণ)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১০ অক্টোবর, ২০১৫, ০৯:১৪:২৭ রাত

পূর্ববর্তী পর্বের লিংকঃ কোলকাতা টু মুর্শিদাবাদ

সকাল আটটা বাজার পূর্বেই বহরমপুর হতে রওনা হলাম মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। বহরমপুর মূলত মুর্শিদাবাদ জেলার সদর দপ্তর। আমাদের দেশের টেম্পুজাতীয় (গ্রামীণ/ম্যাক্সি/লেগুনা) বাহনের মত একধরনের ইঞ্জিনচালিত বাহন আছে, সেটাতে করে চললাম। ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে পৌছে গেলাম একটি স্থানে, নাম সম্ভবত লালঘোনা যা ভাগিরথীর তীরে অবস্থিত। স্থানীয়রা অনেকেই ভাগিরথীকে এখনো গঙ্গা নামেই ডাকে। মূলত ভাগিরথী গঙ্গার একটি শাখানদী। ভাগিরথী নদীর প্রস্থ সেখানে বেশি নয়, পাড়ি দিতে হবে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়।

এই লিংকে গিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার ম্যাপ দেখতে পারবেন। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন-বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুর্শিদাবাদের সীমান্তঘেঁষেই অবস্থিত। উত্তরবঙ্গের দুঃখ ঐতিহাসিক ফারাক্কা বাঁধও মুর্শিদাবাদের উত্তর সীমান্তে মালদা জেলায় অবস্থিত যা চাপাই এর কানসাট হতে বেশ নিকটেই।

https://www.google.com.bd/maps/place/Murshidabad,+West+Bengal,+India/@24.2874422,87.7199405,9z/data=!3m1!4b1!4m2!3m1!1s0x39f97dd3a14e8043:0x701509a66edee7ed

সে যাই হোক, নৌকায় চেপে ভাগিরথী পার হলাম। ঐ পাড়েই যে খোশবাগ! খোশবাগ এর বাংলা অর্থ আনন্দবাগিচা। এখানে শায়িত আছেন নবাব আলীবর্দি খান ও তাঁর দৌহিত্র ভাগ্যহত নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও আরো অনেকে। ভাগিরথী পার হয়ে টুকটুক (ব্যাটারী চালিত ছোট বাহন যা আমাদের দেশে এখন অটো নামে পরিচিত) ভাড়া করলাম খোশবাগ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। একজন বয়স্কা পঞ্চাশোর্ধ মহিলা লিফট চাইলেন। তাকেও নিলাম। কথায় কথায় জানলাম তিনি একজন স্থানীয় স্কুল শিক্ষিকা এবং মোহামেডান (মুসলমান)। বাংলাদেশ হতে এসেছি এবং মোহামেডান জেনে খুব খুশী হলেন। পীড়াপিড়ি করে আমাকে তাঁর গাছের কয়েকটি পেয়ারা দিলেন (খেতে বেশ মজা হয়েছিল)। একদিনের ব্যবধানে একই শহরে তিক্ত ও আনন্দময় দুটি ঘটনা ঘটলো। মহিলার অকৃত্রিম আতিথেয়তায় গতরাতের হোটেল এর তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে আনন্দে মন ভরে গেল।



খোসবাগ ছিল নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের আনন্দ বাগিচা৷ নানা রকমের গোলাপ সুবাসিত করে রাখত এই বাগানের বাতাস৷ সেই খুশবু থেকেই ‘খোসবাগ'৷

খোসবাগ দেখতে গিয়ে একজন গাইডকে সাথে নিয়েছিলাম। অনেক অজানা ইতিহাস তার মুখেও শুনলাম।

ছবিতে ফলক দিয়ে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কবরটিই সিরাজের সমাধি-



এখান থেকে খানিকটা দূরেই পলাশির প্রান্তর৷ ঘসেটি বেগমের ঈর্ষা, মিরজাফরের লোভ, জগত্শেঠের কুচক্রী স্বার্থ বেনিয়া ইংরেজকে এদেশের মসনদে বসতে সাহায্য করেছিল৷ খোসবাগে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাস শুনছিলাম গাইডের কাছে৷ নবাব আলিবর্দি খাঁ আর তাঁর পরিবারের সমাধি এখানে৷ মাঝে দানসা ফকির এবং তার স্ত্রী-ছেলের কবর৷ এই দানসা ফকিরই ধরিয়ে দেয় সিরাজকে রবার্ট ক্লাইভ ও মিরজাফরের হাতে৷ বর্বর ইংরেজরা কিন্তু সেই দানসা ফকিরকে বাঁচিয়ে রাখেনি। নগদ অর্থবিত্তের প্রলোভনে দানসা ফকির পলায়নরত নবাবকে ধরিয়ে দিলেও তাকে ইংরেজরা স্ত্রী ও শিশুসন্তানসহ বর্বর ও নির্মমভাবে হত্যা করে। কারণ ইংরেজরা জানে বিশ্বাসঘাতকদের চরিত্র কখনো বদলায় না, সে পরে ইংরেজদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। এই লোকটি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে সেদিন হয়তো বেঁচে যেতেন নবাব সিরাজ।

খোসবাগের প্রথম সমাধিটি কিন্ত্ত আলিবর্দির নয়৷ প্রথম এখানে সমাধিস্হ করা হয় আলিবর্দির স্ত্রী, সিরাজের দিদিমা সরফুন্ন্সো বেগমকে৷ তার আগে পর্যন্ত খোসবাগ ছিল পুরোপুরি বাগ৷ অবকাশের, অবসরের, পরিবারসহ সুখে আনন্দে কাটানোর এক আশ্রয়৷

ভাগীরথী তখন ছিল খোসবাগের একেবারে সামনে৷ আর ওপারেই সিরাজের প্রাসাদ হীরাঝিল, যা আজ বিলুপ্ত, তলিয়ে গিয়েছে ভাগীরথীর গর্ভে৷ সুযোগ পেলেই বজরায় করে খোসবাগে চলে আসতেন আলিবর্দি খাঁ, সঙ্গে পরিবার, দাসদাসী, দেহরক্ষীরা৷ চলত খানাপিনা, গল্পগাছা৷ সিরাজ ছিলেন তখন উদ্যমী উচ্ছল এক তরুণ।

মুসলিম স্হাপত্যের অনন্য প্রকাশ ঘটেছে খোসবাগে৷ সমাধিগুলি কোথাও দালানের অভ্যন্তরে, কোথাও বাগানে খোলা আকাশের নিচে৷ বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল, ৩৪টি সমাধির মধ্যে মাত্র দুটি হল স্বাভাবিক মৃত্যু–একটি নবাব আলিবর্দি খাঁ, অন্যটি লুত্ফান্ন্সিা৷ বাকি ৩২টিই হত্যাজনিত৷ প্রবেশপথটি খুবই সাধারণ, বাইরে থেকে বোঝার উপায়ই নেই এর অন্দর-মাহাত্ম্য৷ ঢোকার পর দু'দিকে দুটো ছোট কুঠুরি, দরজা-জানালাবিহীন৷ ঢুকেই চোখে পড়বে সবুজের অকৃপণ বিলাস৷ সেই মখমলি সবুজের মাঝখান দিয়ে ইট-বাঁধানো পথ৷ পথ পৌঁছেছে প্রথম যে কক্ষটিতে, সেখানে শুয়ে আলিবর্দির স্ত্রী সরফুন্ন্সো বেগম ও তাঁর দুই কন্যা ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগম৷ আর এক মেয়ে মোমিনা বেগমের সমাধি রয়েছে  মুর্শিদাবাদেরই অন্য এক অংশে৷

এই সমাধিকক্ষ পার হয়ে আর একটু এগোলেই খোলা আকাশের নিচে একসঙ্গে ১৭টি সমাধি৷ ইংরেজ ও মীরজাফর পুত্র মিরনের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা শিকার হয়েছিলেন তারা। এঁরা সকলেই সিরাজের বংশের৷ মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন ঢাকা, মুঙ্গের, পাটনা থেকে সিরাজের সঙ্গে শেষ দেখা করতে৷ দেখা করে আর ফিরতে পারেননি৷ রাতারাতি গুপ্তহত্যায় প্রাণ গিয়েছিল৷ মিরজাফরের প্রাসাদ, যা এখন নমকহারাম দেউড়ি বলেই মুর্শিদাবাদে পরিচিত, সেখানেই ধরা পড়ার পর সিরাজদৌল্লাকে রাখা হয়েছিল৷ পুরো কাণ্ডটির তত্ত্বাবধানে তখন মিরজাফরের ছেলে মিরন৷ সিরাজকে তাঁর শেষ ইচছা জানতে চাওয়ার পর এই আত্মীয়দেরই একবার দেখতে চেয়েছিলেন তিনি৷ সিরাজের কথা রাখেন মিরন৷ তারপরই অবশ্য তাঁর ভিতরের অবিশ্বাস, সন্দেহের পোকাটি নড়ে ওঠে৷ শোনা যায়, খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয় এঁদের৷ ফিরে গিয়ে যাতে সিরাজের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ঘিরে নতুন করে বিদ্রোহ গড়ে তুলতে না পারেন ওঁরা, তাই এই ব্যবস্হা৷ ১৭টির মধ্যে দুটি সমাধি তুলনায় কিছুটা উচচ অবস্হানে৷ কারণ হিসাবে মনে করা হয়, ওঁরা মুঙ্গেরের শাসনকর্তা ছিলেন, তাই এই বাড়তি সম্মান৷

সিরাজ এর ব্যক্তিগত ভৃত্য গোলাম হোসেন ও অন্য দুইজন দেহরক্ষীকে হত্যা ইংরেজদের বর্বরতা কথা আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেয়। সিরাজ এর সহোদর কিশোর মির্জা মেহেদীও মীরজাফর এর পুত্র মিরনের হিংসাত্মক বর্বরতা হতে রেহাই পান নি, হত্যা করা হয়েছিল নির্মম নিষ্ঠুর কায়দায়। পরবর্তীতে নবাবের মাতা আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমকেও বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে হত্যা করেছিল কাপুরুষ মীরন তথা মীর মুহাম্মদ সাদিক আলী খান। মৃত্যুমুহুর্তে মীরনকে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর জন্য বদদোয়া করে যান আমিনা বেগম। মীরন ছিল মীর জাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তাহার জন্ম হইয়াছিল। এই সূত্রে মিরন ছিল আলিবর্দীর বোনপো। মিরন যে অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস ও হীনচেতা ছিল, সে ব্যাপারে কাহারও কোনো সন্দেহ নাই। এই বর্বর মীরনকে ঐতিহাসিকরা তিনটি বিশেষণে বিশেষিত করেছেন-Ferocious ,brutal, marabous ।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল বিশ্বাসঘাত মীরজাফরকে ও তার কুলাঙ্গার পুত্র মীরনের ক্ষেত্রে। জীবদ্দশাতেই পুত্র মীরনের মৃত্যুশোক সইতে হয়েছিল মীরজাফরকে। ইংরেজদের নির্দেশে এই মিরনকে হত্যা করিয়াছে মেজর ওয়ালস। তবে তাহার এই মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানাইয়াছিল। তাহারা বলিয়াছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের (পরে বাদশা শাহ আলম) সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গিয়া পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হন। ইংরেজদের অর্থপুষ্ট মুতাক্ষরীনকার লিখিয়াছেন, মিরনের আদেশে সিরাজের মাতা আমিনা ও মাতৃস্বসা ঘষেটি বেগম জলমগ্ন হওয়ায়, তাহার মৃত্যুকালে মিরনকে বজ্রাঘাতে প্রাণপরিত্যাগের জন্য অভিসম্পাত করিয়া যান। এই জন্য অনুমান করা হয় যে, বজ্রাঘাতেই মিরনের মৃত্যু হইয়াছিল। ইংরেজরা বলিয়াছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরিয়া যায় এবং তাহাতেই তিনি নিহত হন। ফরাসী সেনাপতি লরিস্টনের Jean ঘটনাকে অস্বীকার করিয়াছেন। বরং এই মত পোষণ করেন যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হইয়াছিল। প্রচণ্ড ঝড় আর ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় তাহার তাঁবুতে আগুন লাগাইয়া দেওয়া হয় এবং তাহাকে হত্যা করা হয়। এহা আর কিছুই নহে, আসলে ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। (অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, ভিনসেন্ট এ, স্মিথ।)

মীরজাফর ও জানতেন, মিরনকে ইংরেজরা হত্যাই করে্ছে। কিন্তু কাপুরুষ মীরজাফরের ক্রন্দন ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এ নিয়া বাড়াবাড়ি করলে তার নিজের নবাবী ও জীবনটাও চলে যেতে পারতো। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্ঠরোগে প্রাণত্যাগ করে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর।

বিভিন্ন ইতিহাস হতে জানা যায়, পলাশী যুদ্ধের অন্যান্য খলনায়কদেরও মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল। লর্ড ক্লাইভ, ওয়াটসন, ইয়ারলতিফ, জগৎশেঠ, নন্দকুমার, মুহাম্মদী বেগদের কারোই স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি।







খোশবাগ এর ভিতর একটি মসজিদও ছিল যা বর্তমানে পরিত্যক্ত। আনন্দবাগিচায় (খোশবাগ) এসে মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। কান পেতে যেন একটা মাতম আর হাহাকার শোনা যায় খোশবাগের আকাশে বাতাসে। মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, ঠোঁট কামড়ে আবেগ সংবরণ করলাম।

চলবে----------(পরবর্তী পর্বে এই সিরিজটি শেষ করার আশা রাখছি, সবাইকে আগাম আমন্ত্রণ)।

বিষয়: সাহিত্য

২৮৩৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

345282
১১ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০২:১২
শেখের পোলা লিখেছেন : হাজার দুয়ারীর খবর দিতে ভুল না হয়৷ বর্ণনায় মনে হল যেন দেখেই এলাম৷
১১ অক্টোবর ২০১৫ সকাল ০৯:৫৮
286512
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম। পরবর্তী পর্বে হাজারদুয়ারী, ইমামবাড়া, নিমকহারাম দেউড়ি সবকিছুর বর্ণনা থাকবে ইনশাল্লাহ।
345285
১১ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০২:৩৩
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : চমৎকার বর্ণনা,যে আপনার সাথেই ছিলাম।
ভালো লাগলো ভাইজান।
শুভকামনা থাকলো অবিরত।
১১ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:৫৮
286528
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইরান। পরবর্তী পর্বে আপনাকে আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File