সহজ‬ ভাষায় আয়কর (দ্বিতীয় পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:৩২:১১ দুপুর

আয়কর একটি ব্যাপক বিষয়। সম্পূর্ণ আয়কর ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার এ আলোচনার উদ্দেশ্য সাধারণ করদাতাদের কিঞ্চিত উপকার। আয়কর এর মত ব্যাপক বিষয় বিস্তারিত আলোচনা এ স্বল্প পরিসরে রীতিমত অসম্ভবই বটে। সাধারণ করদাতাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরাই আমার লক্ষ্য। বাংলাদেশের আয়কর ব্যবস্থা দুইটি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-Income Tax Ordinance 1984 এবং Income Tax Rules 1984. এছাড়া এর আওতায় আরো আছে Statutory Regulatory Order (SRO) এবং Decisions of Income Tax Cases | প্রতি বছর অর্থ আইনের মাধ্যমে মূল কাঠামো ঠিক রেখে এর আইন ও বিধিসমূহ সংশোধিত হয়।

গতপর্বে আলোচনা করেছিলাম, করযোগ্য আয়, করমুক্ত আয়ের সীমা ও আয়ের খাতসমূহ সম্পর্কে।

এ পর্বে আলোচনা করবো করবর্ষ, আয়বর্ষ , করের হার, ন্যূনতম করের পরিমাণ এবং একজন ব্যাক্তিশ্রেণীর করদাতার মোট আয় নিরুপণ ও করদায় নির্ণয়ের পদ্ধতি একটি সমস্যার সমাধান এর মাধ্যমে।

করবর্ষ ২০১৫-২০১৬ অনুযায়ী ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের করের হারঃ

১। সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণী (মহিলা, ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বর্ষীয়ান নাগরিক ও প্রতিবন্ধী বা অক্ষম করদাতা ব্যতিত) ঃ

আয়ের পরিমাণ কর হার

প্রথম ২,৫০,০০০ টাকা শূণ্য

পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা ১০%

পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা ১৫%

পরবর্তী ৬,০০,০০০ টাকা ২০%

পরবর্তী ৩০,০০,০০০ টাকা ২৫%

অবশিষ্ট আয়ের উপর ৩০%

২। মহিলা ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বর্ষীয়ান নাগরিক এর ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা হবে ৩,০০,০০০ টাকা অর্থাৎ প্রথম ধাপে ২,৫০,০০০ টাকার স্থলে ৩,০০,০০০ টাকা হবে এবং পরবর্তী ধাপসমূহ একই হবে।

৩। প্রতিবন্ধী বা অক্ষম করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা হবে ৩,৭৫,০০০ টাকা ও পরবর্তী ধাপসমূহ একই রূপ হবে।

৪। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা হবে ৪,২৫,০০০ টাকা ও পরবর্তী ধাপসমূহ একই রূপ হবে।

উল্লেখ্য যে, ন্যূনতম করের পরিমাণ ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতাদের জন্য ৫,০০০ টাকা; অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতাদের জন্য ৪,০০০ টাকা এবং সিটি কর্পোরেশন ব্যতীত অন্যান্য এলাকায় অবস্থিত করদাতাদের জন্য ৩,০০০ টাকা।

করবর্ষ ও আয়বর্ষঃ আপনি এখন যে রিটার্ন সাবমিট করতে যাচ্ছেন তার আয়বর্ষ ২০১৪-২০১৫ এবং করবর্ষ ২০১৫-২০১৬। অর্থাৎ আপনি ১ লা জুলাই ২০১৪ ইং হতে ৩০ শে জুন ২০১৫ ইং পর্যন্ত যে আয় করেছেন তার আয়কর রিটার্ন সাবমিট করছেন এখন। আর করবর্ষ হবে আয়বর্ষের পরবর্তী বছর।

আইনের ভাষায় [আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ধারা ২ (৩৫)] আয়বর্ষ হচ্ছে , ‍" The period of twelve months commencing from the first day of July of the relevant year".

একটি সহজ উদাহরণঃ

মনে করি, একজন সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতার ২০১৪-২০১৫ আয়বর্ষে মোট নিরুপিত করযোগ্য আয়ের পরিমাণ ১২,৭৫,৫০০ টাকা। তাহলে উক্ত করদাতার ২০১৫-২০১৬ করবর্ষে প্রদেয় করের পরিমাণ হবে নিম্নরূপঃ

আয়ের পরিমাণ করের হার করের পরিমাণ

প্রথম ২,৫০,০০০ টাকা শূণ্য ০ টাকা

পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা ১০% ৪০,০০০ টাকা

পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা ১৫% ৭৫,০০০ টাকা

অবশিষ্ট ১,২৫,৫০০ টাকা ২০% ২৫,১০০ টাকা

অর্থাৎ মোট প্রদেয় কর= ১,৪০,১০০ টাকা

এবার আর একটি সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একজন মহিলা ব্যক্তিশ্রেণী করদাতার মোট করযোগ্য আয় ও মোট করদায় নিরুপণ পদ্ধতি আলোচনা করা যাক।

সমস্যাঃ

মিসেস ইসলাম একটি কোম্পানীর ফিন্যান্স ম্যানেজার ; ২০১৪-২০১৫ আয়বর্ষে তাঁর আয়ের বিবরণ নিম্নরূপঃ

১। মাসিক মূল বেতন ৫০,০০০ টাকা ;

২। বাড়ি ভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৬০%;

৩। মিসেস ইসলামকে ব্যক্তিগত ও অফিসে ব্যবহারের জন্য কোম্পানি হতে একটি গাড়ি প্রদান করা হয়েছে।

৪। চিকিৎসা ভাতা মাসিক ৪,০০০ টাকা।

৫। তিনি অনুমোদিত প্রভিডেন্ট ফান্ডে মাসিক মূল বেতনের ১০ % জমা করেন এবং তাঁর নিয়োগকর্তাও প্রভিডেন্ট ফান্ডে সমপরিমাণ টাকা জমা দেন।

৬। বছরে তিনি দুইটি উৎসবভাতা পান যার প্রতিটি মূল বেতনের সমান।

মিসেস ইসলাম এর ধানমন্ডিতে একটি দোতলা বাড়ি আছে। নীচতলায় তিনি থাকেন এবং দোতলা ভাড়া বাবত তিনি মাসে ৫০,০০০ টাকা আয় করেন। বাড়িটি দুই মাস খালি ছিল। তিনি উক্ত বছরে ১২,০০০ টাকা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করেছেন এবং উক্ত বাড়ি নির্মাণ এর জন্য ঋণ নেয়ার কারণে ঋণের সুদ (শুধুমাত্র সুদ বা লাভ, সম্পূর্ণ কিস্তি নয়) হিসেবে পরিশোধ করেছেন ২৫,০০০ টাকা।

মিসেস ইসলাম এর অন্য কোন খাত হতে আয় নেই।

উক্ত আয়বর্ষে মিসেস ইসলাম এর বিনিয়োগসমূহ নিম্নরূপঃ

একটি ল্যাপটপ ক্রয় করেন ৫৪,০০০ টাকায়, মাসিক ডিপিএস ৬,০০০ টাকা, সরকারি যাকাত ফান্ডে প্রদান ২০,০০০ টাকা।

২০১৫-২০১৬ করবর্ষে মিসেস ইসলাম এর মোট আয় ও করদায় কত?

সমাধানঃ

করদাতাঃ মিসেস ইসলাম

আয়বর্ষঃ ২০১৪-২০১৫; করবর্ষঃ ২০১৫-২০১৬

মোট আয় নির্ণয়-

মূল বেতন- ...........................৫০,০০০*১২=৬,০০,০০০ টাকা

বাড়িভাড়া ভাতা- ....................= ৬০,০০০ টাকা

৬,০০,০০০*৬০%=৩,৬০,০০০ টাকা

বাদঃ অকরধার্য্য ৩,০০,০০০ টাকা

(মূলবেতনের ৫০% বা মাসিক ২৫,০০০ টাকা হারে-যেটি কম অর্থাৎ ৩,০০,০০০ টাকা)

যাতায়াত সুবিধা....................... ..= ৬০,০০০ টাকা

(গাড়ি পাওয়ায় মূল বেতনের ৫% বা ৩০,০০০ টাকা এবং ৬০,০০০ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেটি মোট আয়ের সাথে যোগ হবে)

চিকিৎসা ভাতা- ৪,০০০*১২=২৪,০০০ টাকা

বাদঃ অকরধার্য্য (সর্বোচ্চ সীমাঃ মূল বেতনের ১০% ও ১০০,০০০ টাকার মাঝে যেটি কম) - = ২৪,০০০ টাকা

অনুমোদিত পি.এফ. এ নিয়োগকর্তার দান.................................= ৬০,০০০ টাকা

মূল বেতনের ১০%

উতসবভাতা ৫০,০০০*২ ..................................................=১,০০,০০০ টাকা

অর্থাত বেতন খাতে মোট আয় = (মূল বেতন ৬,০০,০০০+ বাড়ি ভাড়া ভাতা ৬০,০০০+যাতায়াত সুবিধা ৬০,০০০+ চিকিৎসা ভাতা ০+পি.এফ. ৬০,০০০) টাকা = ৭,৮০,০০০ টাকা

গৃহসম্পত্তি খাতে আয়ঃ

বার্ষিক ভাড়াঃ ৫০,০০০x১২ = ৬,০০,০০০/=

বাদঃ

মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ

(ভাড়ামূল্যের ২৫%, প্রকৃত খরচ যাই হোক না কেন। বাড়িটি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হলে এ হার ৩০%)= ১,৫০,০০০/=

ভূমি উন্নয়ন কর= ১২,০০০/=

ঋণের সুদ = ২৫,০০০/=

শূণ্যতা ভাতা (দু মাস খালি থাকার দরুণ)=

৫০,০০০x২=১,০০,০০০/=

মোট খরচ কর্তন = ২,৮৭,০০০/=

গৃহসম্পত্তি খাতে নীট আয় = ৩,১৩,০০০/=

মিসেস ইসলামের মোট করযোগ্য আয়= (বেতন খাতে ৭,৮০,০০০+গৃহসম্পত্তি খাতে ৩,১৩,০০০) টাকা= ১০,৯৩,০০০ টাকা।

বিনিয়োগ ভাতা নির্ণয়-

অনুমোদিত প্রভিডেন্ট ফান্ডে নিজ ও নিয়োগকর্তার জমা =৬০,০০০*২ = ১,২০,০০০ টাকা

ল্যাপটপ ক্রয় = ৫৪,০০০ টাকা

(১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত অনুমোদিত)

সরকারি যাকাত ফান্ডে প্রদান =২০,০০০ টাকা

ডিপিএস - ৫,০০০*১২...= ৬০,০০০ টাকা

(মাসিক ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত অনুমোদিত)

মোট = ২,৫৪,০০০ টাকা

বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা হচ্ছে ১,৫০,০০০,০০ টাকা বা মোট আয়ের ৩০% এর মধ্যে যেটি কম।

অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিনিয়োগ ভাতার সীমা হবে=১০,৯৩,০০০*৩০% = ৩,২৭,৯০০ টাকা। মিসেস ইসলামের প্রকৃত বিনিয়োগ ২,৫৪,০০০ টাকা সীমার নীচে হওয়ায় পুরোটাই অনুমোদিত।



করদায় নিরুপণ-


প্রথম ৩,০০,০০০ টাকার উপর ......................... = ০ টাকা (মহিলা হওয়ায় করমুক্ত সীমা ৩,০০,০০০ টাকা)

পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকার উপর ১০% হারে =৪০,০০০ টাকা

অবশিষ্ট ৩,৯৩,০০০ টাকার উপর ১৫% হারে................ = ৫৮,৯৫০ টাকা

মোট ১০,৯৩,০০০ টাকা করযোগ্য আয়ের উপর মোট প্রদেয় কর.= ৯৮,৯৫০ টাকা

বাদঃ বিনিয়োগ কর-রেয়াত (২,৫৪,০০০*১৫%) = ৫০,৮০০ টাকা

নীট প্রদেয় কর....................= ৪৮,৯৫০ টাকা

বিষয়: বিবিধ

২১৬৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

342072
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৫৬
নাবিক লিখেছেন : অনেক কিছু জানলাম, ধন্যবাদ।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ০৯:২৭
283579
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
342088
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৪৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সিটি কর্পোরেশন এলাকাগুলিতে ব্যায় বেশি। সেখানে তর কম হওয়া উচিত অথচ সেখানে বেশি!!! মানুষ কর ফাঁকি দিবে না কি করবে।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ০৯:২৭
283580
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : সহমত আপনার সাথে। অনেক বৈষম্য আছে।
342096
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:২৯
আবু জান্নাত লিখেছেন : ধন্যবাদ
342151
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০৪:৫০
শেখের পোলা লিখেছেন : কঠিন বিষয়৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File