বিদায় কোলকাতা (ভ্রমণ)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৭:৩২ বিকাল
গত পর্বের লিংকঃ কালের সাক্ষী কোলকাতা (ভ্রমণ)
ভিক্টোরিয়া পার্কের নিকটেই ছিল রেসকোর্স ময়দান, আলীপুর চিড়িয়াখানা, বিড়লা প্লাটেরেনিয়াম .......। ইতোমধ্যে আমাকে হোম সিকনেস পেয়ে বসেছে। কবে দেশে ফিরবো এমন একটা তাড়া বোধ করছি মনে মনে। তাই এসব দেখার আর আগ্রহ বোধ করলাম না।
ফিরে চললাম ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম এর উদ্দেশ্যে। পথে পড়লো “রাইটারস বিল্ডিং”। এটি দেখতে আমাদের কার্জন হলের মতো। আগেই বলেছিলাম কোলকাতায় গগনচুম্বী অট্টালিকা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তবে কার্জন হল, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল এর মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা আপনি গুণে শেষ করতে পারবেন না।
রাইটার্স বিল্ডিং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয় ভবন এবং বর্তমানে মূখ্যমন্ত্রীর সরকারী দফতর। ১৭০২ সালে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘকাল একই নামেই এ ভবনটি তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৭৭৬ সালে বাংলায় ব্রিটিশদের প্রকৃত শাসন শুরু হলে কোম্পানির করণিক বা রাইটারদের কাজ বহুবিধ হয়ে যায়। ফলে তাদেরকে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে একিভূত করতে গভর্ণর ওয়ারেন হেস্টিংস একটি নতুন কাঠামো নির্ধারণ করেন। সে সময় থেকেই এ ভবনটি রাইটার্স বিল্ডিং’ নামে পরিচিত হয়। তবে, ১৮০০ সাল পর্যন্ত এ ভবন কোম্পানির করণিকদের আবাসিক ভবনের কাজে ব্যবহূত হয়েছে। ভবনের একাংশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কার্যক্রম শুরু হলে রাইটারদের বাসস্থান স্থানান্তর করা হয়। এরপর রাইটার্স বিল্ডিং ব্রিটিশ উপনিবেশিক রাষ্ট্রের সচিবালয়ে পরিণত হয় এবং উপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রয়োজনের তাগিদে ভবনও পরিসরে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভবন সম্প্রসারনের কাজ হয় সবচেয়ে বেশি ১৮২১, ১৮৩০, ১৮৭১-১৮৮২ এবং ১৮৭৯ সালে। প্রত্যেকবারই মূল ভবনের সঙ্গে নতুন নতুন অংশ সংযুক্ত হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং তার বর্তমান কাঠামো ধারণ করেছে। ভবনের কিছু অংশ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় কার্যালয়ের বড় একটি অংশ বর্তমানে হুগলী নদীর ওপাড়ে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। ধর্মতলার নিকটেই চৌরঙ্গীতে অবস্থান ভারতের সবচেয়ে বড় এই মিউজিয়াম এর।
১৮১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি এর অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম জাদুঘর। যাত্রা শুরুর সময় থেকে সংগ্রহ, বিন্যাস, প্রসার - বহুমাত্রিক পর্যায়সমূহ ফলপ্রসূভাবে এটি অতিক্রম করেছে। প্রথমদিকে এশিয়াটিক মিউজিয়াম হিসেবে পরিচিত এ জাদুঘর পরবর্তীকালে ইম্পেরিয়াল মিউজিয়াম নামে পরিচিতি লাভ করে এবং উপমহাদেশের মধ্যে এ শ্রেণীর সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
প্রায় আট হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ জাদুঘরে শিল্পকলা ও প্রকৃতির বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য সংগ্রহ শিল্পকলা, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদ বিদ্যা এ ছয়টি ভাগে মোট ষাটটি গ্যালারিতে সুসজ্জিত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ সামগ্রী সংরক্ষিত আছে। বহুমুখী এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নানাবিধ সুশৃঙ্খল কার্যক্রম। যার ফলে ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে একে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়।
মিউজিয়ামে লাগেজ রাখার ব্যবস্থা দেখে বেশ খুশি হলাম। ঘন্টাখানেক মিউজিয়ামে কাটিয়ে লাগেজ রেখে বের হয়ে গেলাম। এখন ঝাড়া হাত পা, লাগেজ টানাটানির ঝামেলা নেই, ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারবো। চলে গেলাম সোজা এসপ্লানেড (মার্কেট)। এসপ্লানেড ও নিউমার্কেট হতে টুকটাক কেনাকাটা করলাম। এসব নেয়ার জন্য আরো একটি লাগেজ কেনা লাগলো।
এর মাঝে চোখে পড়লো অতি সুন্দর একটি মসজিদ-টিপু সুলতান শাহী মসজিদ। জোহর নামায আদায় করে নিলাম এখানে। টিপু সুলতান শাহি মসজিদ কলকাতার একটি বিখ্যাত মসজিদ। ১৮৪২ সালে টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ এই মসজিদটি নির্মাণ করান। এটি কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণও বটে।
এরিমাঝে সময় পেরিয়ে বেলা তিনটারও বেশি। খিদেটা জানান দিচ্ছে বেশ। কাছাকাছি কোন মুসলিম রেষ্টুরেন্ট চোখে পড়ছে না। হাতেটানা এক রিক্সায় ওঠে বললাম, কাছাকাছি কোন মুসলিম রেষ্টুরেন্ট এ নিয়ে যাওয়ার জন্য। আধা কিমি এর চেয়েও কম দুরত্ব যাওয়ার পর মিলে গেল রেঁস্তোরা (মুসলিম)। রিক্সাঅলা ভাড়া নিল ১০০ রুপি। বুঝলাম, পর্যটক বুঝতে পেরে বেশি নিল।
কয়েকদিনের সফর হতে বুঝলাম এরা কারো উপকার করার ক্ষেত্রে খুবই কৃপণ। তবে ঠকানোর বেলায় সিদ্ধহস্ত। এর আগে বিপদে পড়েছিলাম দার্জিলিং এ। আইএসডি কল করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় দেশের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। হোটেল এ রিকোয়েস্ট করলাম একটি কল করার জন্য। পে করবো বললাম, তাও দিল না। যোগাযোগ করাটা জরুরী হওয়ায় আরো কয়েকজনকে অনুরোধ করে নিরাশ হলাম। শেষ পর্যন্ত রেঁস্তোরায় একজন বাংলাদেশীর দেখা মিলেছিল। উনাকে রিকোয়েস্ট করতেই হাতের মোবাইল বাড়িয়ে দিলেন (উনারটা রোমিং করা ছিল)।
যাই হোক, রিক্সাভাড়া মিটিয়ে দুপুরের লাঞ্চটা সারলাম মোস্তফা হোটেল নামক একটি রেঁস্তোরায়। এখানকার হিন্দু হোটেলগুলির খাবার অখাদ্য। হিন্দু হোটেল এর সব্জি আর মাছ হালাল হলেও খেতে অত্যন্ত বিস্বাদ। মোস্তফা’র খাবার বেশ জম্পেশ হলো। গরুর গোশত খাওয়া ডাক্তারের নিষেধ ছিল। কিন্তু এত মজা হয়েছিল যে, দুই বাটি গোশত সাবাড় করে দিলাম। আর এই বিদেশ বিঁভুইয়ে, বউতো দেখতে আসছে না গরুর গোশ খাচ্ছি নাকি চিকেন খাচ্ছি। তাই গরুর গোশতের স্বাদ মিস করবো কোন দুঃখে?
মজার ঘটনাটা শেয়ার করি। এক বাটি গোশত শেষ হওয়ার পর, বেয়াড়াকে বললাম থোড়া (আমাদের দেশে যেমন পরেরবার আবার বাড়তি দেয়া হয়) দিতে। বয়স্ক বেয়াড়া আমাকে বলেন, “পানি দিয়ে সুরুয়া বানিয়ে খাও”। মানে আর দেয়ার সিস্টেম নেই। হাহাহা।
খাওয়া শেষে আবার টুকটাক শপিং করলাম। পাঁচটা বাজার পূর্বে চলে গেলাম মিউজিয়াম এ। লাগেজ বুঝে নিয়ে ছুটলাম শিয়ালদহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা ছয়টা চল্লিশ মিনিট এর ভাগিরথী এক্সপ্রেস এর টিকেট নিলাম। গন্তব্য মুর্শিদাবাদের বহরমপুর।
বিদায় কোলকাতা।
(পরের পর্বে থাকছে ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ ভ্রমণকাহিনী)।
বিষয়: সাহিত্য
২৪৫৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার শোনায় ভূল ও হতে পারে।
আপনার ভ্রমন কাহিনী সত্যিই দারুন লাগছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন