কালের সাক্ষী কোলকাতা (ভ্রমণ)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২৯ আগস্ট, ২০১৫, ১২:৫৭:৪৬ দুপুর
ব্লগের সমস্যার কারণে পূর্ববর্তী পর্বটি (নিউজলপাইগুড়ি টু কোলকাতা) মুছে গিয়েছে। তার আগের পর্বটির লিংক দিলাম-দার্জিলিং টু শিলিগুঁড়ি টু নিউজলপাইগুঁড়ি
আগের রাতে ট্রেনে ব্যাপক ঘুমিয়েছি। তাই ভ্রমণক্লান্তি বলতে কিছু নেই। তাই সহজে হোটেল না মিলায় সিদ্ধান্ত নিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত কোলকাতায় ঘুরবো এরপর সন্ধ্যার ট্রেনে মুর্শিদাবাদ চলে যাবো এবং সেখানেই হবে রাত্রিযাপন। ট্রেনে ভারতীয় এক ভদ্রলোক হতে কোলকাতা ভ্রমণের সহজ ও বিস্তারিত দিকনির্দেশনা পেলাম, তাতে বুঝলাম সঠিক পরিকল্পনায় কোলকাতা দেখার জন্য ১০/১২ ঘন্টা যথেষ্ট সময়।
যেই ভাবা সেই কাজ। আবার শিয়ালদহ স্টেশনে ফেরত এলাম। ট্রেনে চড়ে বসলাম, গন্তব্য দমদম রেলস্টেশন (২/৩ স্টেশন পরেই)। ট্রেনে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো। আমার বিপরীতে বসেছিলেন প্রৌড় বয়সের একজোড়া দম্পতি, বেশভূষা সম্ভ্রান্ত ঘরেরই মনে হলো।। ভদ্রলোক অসুস্থ, অর্ধচেতন - মনে হলো হঠাৎ কোন দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মহিলাটি হাতপাখা দিয়ে শুধু বাতাস করে যাচ্ছেন, কপালে চিন্তার ভাঁজ আর চোখে চিকচিক করছে অশ্রু। আমি একটু কৌতুহলী হলাম।
জিজ্ঞেস করলাম-কোন সমস্যা?
প্রশ্ন শুনেই মহিলা জোরে কেঁদে দিলেন। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে যা বললেন, তার সারমর্ম হচ্ছে- তারা বাংলাদেশী, খুলনা হতে এসেছেন ভদ্রলোকের চিকিৎসার কাজে। ডাক্তার দেখানো হলো, চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরার পালা। কিন্তু শিয়ালদহ স্টেশনে আসার পর অজ্ঞানপার্টি/পকেটমারের কবলে পড়ে পকেটের সব টাকা পয়সা হারিয়ে ভদ্রলোক নিঃস্ব। এখন বাড়িতে ফেরার ভাড়াও নেই।
তাদের পাসপোর্ট দিতে বললাম। চেক করে নিশ্চিত হলাম, মিথ্যে বলছেন না। আমার কাছে বাড়তি টাকা ছিল। তাদের দেশে ফেরার মত প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে দিলাম। মহিলা খুব করে দোয়া করলেন। আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে বললাম, দেশে নিরাপদে ফিরার পর ফোন করে নিশ্চিত করার জন্য। তাদের নাম্বারও রাখলাম। (তারা অবশ্য আমাকে আর জানানোর প্রয়োজন মনে করেন নি। আমিই ফোন করে জেনেছিলাম যে, তারা নিরাপদেই ফিরেছিলেন দেশে)।
যাই হোক, এরমধ্যে দমদম স্টেশন চলে এল। নেমে আবার ধরতে হবে পাতাল ট্রেন। পাতাল ট্রেন এ করে চলে গেলাম গিরীশচন্দ্রসেন রোড। সেখান হতে রবিবাবুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি দেখতে যাব, এই ছিল প্ল্যান।
শেয়ারট্যাক্সিতে ১০ রুপী দিয়ে একটি মোড়ে নামলাম। সেখান হতে হাতেটানা রিক্সায় করে পৌছে গেলাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি যেটি বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের অন্যান্য শহরগুলিতে প্যাডেলচালিত রিক্সার ব্যবহার থাকলেও কোলকাতায় তীব্র জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য প্রথার প্রতীকিরূপে রয়ে গেছে এখনো হাতে টানা রিক্সা। এ বিষয়টি আমাকে খুব আহত করেছে।
হাতে টানা রিক্সা-
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) এর সামনে-
রবিঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত একটি যাদুঘর আছে এখানে। এছাড়া তেমন কিছু দেখার নেই, তাই ঘন্টাখানেক এর বেশি ছিলাম না।
এরপর একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। কোলকাতায় কিছু নির্দিষ্ট স্থানে প্রিপেইড ট্যাক্সিও মিলে। আগে কাউন্টারে টাকা পরিশোধ করে সিরিয়াল এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ঐ ট্যাক্সিগুলোর গায়ে লেখা থাকে- No Refusal. অর্থাৎ সিটির মধ্যে আপনার গন্তব্য যাই হোক, আপনাকে না করতে পারবে না।
কোলকাতার আভ্যন্তরীণ (সিটির মধ্যে) পরিবহন ব্যবস্থা এক কথায় চমৎকার। পাতাল ট্রেন, ট্রাম, ট্যাক্সি সবকিছুর সুব্যবস্থা। যানজট এক আধটু আছে, তবে ঢাকার তুলনায় খুব কম। ট্রাম হচ্ছে রেলের দুটি বগিসদৃশ একটি গাড়ি। রাস্তায় সমান্তরালে দুটি রেললাইন থাকে। একই রাস্তায় চলছে বাস, ট্যাক্সি, ট্রাম....। রেললাইনের ওপর দিয়ে ট্রাম চলে। তবে গতি থাকে কম, যেকোন প্রয়োজনে সহজে ব্রেক কষা যায়। লোকাল গাড়ির মত যাত্রীদের প্রয়োজনে থামে, যাত্রী উঠানামা করায়। মন্দ নয়, ভালোই।
ট্রাম চলছে রাজপথে-
যাই হোক, আমার ড্রাইভার আমাকে পর্যটক বুঝতে পেরে বাড়তি টিপস দাবি করলো। ৫০ রুপি বাড়তি দেব বলতেই রাজি হয়ে গেল। ট্যাক্সি ধর্মতলা হয়ে আমাকে নিয়ে চললো গন্তব্যের (কয়েকটি স্পট সম্পর্কে চুক্তি হয়েছিল তার সাথে) উদ্দেশ্যে। ধর্মতলায় বিরাট এক সমাবেশে কয়দিন আগেই এসে গেলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মমতার বিশালাকার ছবি, পোট্রেট শোভা পাচ্ছে। চলতে চলতে ঢাকার সাথে পার্থক্যগুলো বুঝার চেষ্টা করছি। অনেক কালের সাক্ষী এই কোলকাতা, মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল এর অনেক কীর্তি, অনেক ইতিহাস এর সাক্ষী এই নগর। ঢাকার মতো আধুনিক হাইরাইজ বিল্ডিং এর সংখ্যা এখানে হাতেগোনা, কিন্তু কার্জন হল, আহসান মঞ্জিল এর মতো ঐতিহাসিক ভবন গুণে শেষ করা যাবে না।
ট্যাক্সি একসময় এল ঐতিহাসিক ক্রিকেট মাঠ ইডেন গার্ডেন। ভিতরে প্রবেশ এর অনুমতি নেই সহজে, তাই বাহির হতে দেখেই স্বাদ মিটাতে হলো।
এরপর এলাম হাওড়া ব্রীজ। অনেক শুনেছিলাম এই ব্রীজের কথা। ঐতিহাসিক এই ব্রীজটির পরিবর্তিত নাম-রবীন্দ্র সেতু। বিশ্বের ব্যস্ততম প্রসারিত খিলান সেতুর মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। গঙ্গা নদীর ওপর আগাগোড়া লোহার কাঠামোয় নির্মিত থামহীন ব্রীজেটির রাজকীয় নির্মানশৈলী ও অবকাঠামো বেশ চিত্তাকর্ষক। ২৭০ ফুট উচু দুইটি মূল স্তম্ভ ও অন্যান্য স্তম্ভসমূহ একে বিশালাকৃতির অবকাঠামোয় রূপ দিয়েছে। হাওড়া ব্রিজ ৭০৫ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৭ ফুট চওড়া। হাওড়া ব্রিজের পরিকাঠামো ২৬,৫০০ টন প্রসারন সাধ্য ইস্পাত দ্বারা নির্মিত, যা দুটি স্তম্ভদ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত। প্রতিটি স্তম্ভ রাস্তার ঊর্ধ্বভাগে ৯০ মিটার জুড়ে অবস্থিত। এটি নির্মাণ করতে দীর্ঘ ৭ বছর সময় লেগেছে। হাওড়ার এই প্রসারিত খিলান সেতুর কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৪৩ সালে। বর্তমানে, হাওড়া ব্রিজ কলকাতার প্রবেশদ্বার স্বরূপ, যেটি এই শহরকে হাওড়া স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করে, যা হল কলকাতার মূল রেলওয়ে স্টেশন ও ভারতের সবথেকে ব্যস্ততম স্টেশন।
হাওড়া ব্রীজ-
হাওড়ার বিপরীতেই রয়েছে আধুনিক হুগলী ব্রীজ। হাওড়া পার হয়ে নদীর তীরঘেঁষে আনন্দভবন-তৃণমূল কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গের সদরদপ্তর। মমতা ব্যানার্জীর বাড়িও নাকি এর কাছাকাছি। হুগলী ব্রীজ পার হয়ে একটু পর চলে এলাম ময়দান। ময়দানে অনেক দর্শনীয় স্পট আছে। ড্রাইভার প্রাচীরঘেঁষে ঘুরিয়ে দেখালো বিখ্যাত “ফোর্ট উইলিয়াম” দুর্গ। এটি এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত নয়।
এরপর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে হলো, কারণ এখানে পার্কিং এর ব্যবস্থা নেই। টিপসসহ ট্যাক্সিভাড়া হলো ২৫০ রুপি। রাজকীয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বেশ দেখার মতো। দারুণ চিত্তাকর্ষক সাদা মার্বলের তৈরী এক স্বপ্নসৌধ যা বৃটিশ সাম্রাজ্যের সবটুকু স্মৃতিচিহ্ন বহন করে । এটা সম্পূর্ণ করতে প্রায় পনের বছর সময় লেগেছিল এবং শিল্প গ্যালারীর উপস্থিতি স্থানটিতে আলাদা সৌন্দর্য যোগ করেছে। এর চারিদিকে আছে বিশাল আয়তনজুড়ে গার্ডেন। তাজমহল দেখিনি, তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে ছবিতে দেখা তাজমহলের মতোই মনে হলো। ভারতসম্রাজ্ঞী মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে নির্মিত স্মৃতিসৌধ এটি।
এর নকশা প্রস্তুত করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন। প্রথমে তাঁকে ইতালিয়ান রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করতে বলা হলেও, তিনি শুধুমাত্র ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রয়োগের বিরোধিতা করেন এবং ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর সঙ্গে মুঘল উপাদান যুক্ত করে মূল সৌধের নকশা প্রস্তুত করেন। ভিনসেন্ট এসচ ছিলেন এই সৌধের অধীক্ষক স্থপতি। সৌধ-সংলগ্ন বাগানটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন লর্ড রেডেসডেল ও স্যার জন প্রেইন। কলকাতার মার্টিন অ্যান্ড কোং সংস্থার উপর নির্মাণকার্যের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল।
কলকাতা ময়দানের দক্ষিণ কোণে অবস্থিত এবং সুরম্য উদ্যান পরিবেষ্টিত শ্বেতপাথরে নির্মিত সুবৃহৎ ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৯০৬ সালে। সৌধটির উদ্বোধন হয় ১৯২১ সালে। সৌধের সর্বোচ্চ গম্বুজে বিউগল-ধারিণী বিজয়দূতীর একটি কালো ব্রোঞ্জমূর্তি রয়েছে। বায়ুপ্রবাহ শক্তিশালী হলে বল-বিয়ারিং যুক্ত একটি পাদপীঠের উপর স্থাপিত মূর্তিটি হাওয়ামোরগের কাজ করে। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি-প্রাক্তনী এ. সি. মিত্র ভিক্টোরিয়ার নির্মাণপ্রকল্পের কার্যনির্বাহী বাস্তুকার।
(কোলকাতা ভ্রমণের বাকী আকর্ষণীয় অংশ থাকছে আগামী পর্বে)।
চলবে----
বিষয়: সাহিত্য
৩০৬৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার দেখায় দেখিলাম
পরান খুলিয়া
সেখানের মানুষদের স্বভাব কি রকম?
আমাদের কাছে বদান্যতা ও কৃতজ্ঞতা বোধ দিন দিন চলে যাচ্ছে। আমিও এ ধরনের বহু বিচিত্র ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম।
কলিকাতা ভ্রমণ ভাল লাগল, সুন্দর উপস্থাপনা। অনেক ধন্যবাদ
জ্বী, মানুষ এক বিচিত্র স্বভাবের প্রাণী। কলিকাতা ভ্রমণ এর বাকী অংশ আগামী পর্বে থাকবে, আপনার আগাম আমন্ত্রণ রইলো।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন