দিবস না মানা অকৃত্রিম ভালোবাসার রূপ এবং মুদ্রার অপর পিঠের কিছু চিত্র
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৩:০৬:৩২ দুপুর
১। ক্লাস ফাইভে উঠেছি তখন মাত্র। শীতের ভোর রাত্রে আমাকে ঘুম হতে ডেকে তোলা হলো। ফিসফিস করে একজন কানের কাছে বললো, তোমার বোন হয়েছে। আমাকে নিয়ে দেখানো হলো সদ্য জন্ম নেয়া ছোটবোন কে। কি নিষ্পাপ, একদম পুতুলের মত। সুন্দর চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। অদ্ভূত, অসাধারণ এক ভালো লাগায় ভরে গেল মন। পরে বুঝলাম এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা।
২। গৃহশিক্ষক আমাদের বাসায় কোনকালেই ছিল না। এই একমাত্র বোন এবং ছোট ভাই এর পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল আমার হাতেই। তখন খড়িমাটি দিয়ে শ্লেটে লিখে পড়িয়ে শিখালাম বর্ণমালা, এরপর একে একে বানান, শব্দ, উচ্চারণ, বাক্য গঠন.....। কতই বা তখন বয়স! দায়িত্ব পালন নয়, সেটিও ছিল স্রেফ ভালোবাসা।
৩। ক্লাস টেনে পড়ি তখন। সময়টা বর্ষাকাল, একদিন স্কুলে ডি.সি. এসেছেন। সেদিন স্কুলে রওয়ানা হয়েও মাঝপথে ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়ে ভিজে নেয়ে ফেরত এলাম। ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা ডিসি মহোদয়ের প্রশ্নগুলির ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে নি। ফার্স্ট বয় ছিলাম আমি যার উপর স্যারদের অনেক আস্থা ছিল। সেই আমিই কিনা স্কুলে যাই নি। পরদিন ক্লাস টিচার জোড়া বেত দিয়ে আমাকে বেদম মারলেন। এমন মাইর আমি জীবনেও খাই নি। সহপাঠী অনেক ছাত্র ছাত্রীর চোখে দেখলাম টলমল অশ্রু। মেয়েরা কোমল হৃদয়ের হয়, দুইজন কেঁদেই দিল। টের পেলাম সহপাঠীদের ভালোবাসা। অনেক পরে টের পেলাম- ঐ শিক্ষক যে মেরেছিলেন সেটাও প্রিয় ছাত্রের প্রতি ভালোবাসারই অংশ ছিল।
৪। দাদী একটু মুখরা ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৫ তে দাদা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করেই চুপসে গেলেন তিনি। তবে দাদীর প্রতি সবাই ছিল খুব কেয়ারিং। কিছু চাওয়ার আগেই তাঁর সব প্রয়োজন পূরণ করে দিতেন আমার বাবা চাচারা। শহরে খুব বেশি থাকতেন না দাদী। কয়েকদিন থাকলেই গ্রামে যাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতেন। গ্রামে যার বেড়ে উঠা, জীবন যৌবন ব্যয় করা, বৃদ্ধ বয়সেও তার শহর ভালো লাগার কথা নয়।
আমার খুউব শখ ছিল-যখন চাকুরী করবো দাদীকে শহরে এনে সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরবো। শহরের সবচেয়ে বড় মার্কেটে নিয়ে দাদীর খুউব পছন্দের জিনিসগুলো কিনে দিবো।
সেই দাদী ২০০৩ সালে মারা গেলেন হঠাৎ করে। এর আগে কোন মৃত্যু আমাকে এতটা বিচলিত করে নি। বুকের ভিতর হতে কষ্টের দলাগুলি বের হয়ে কান্নায় রূপ নিল। খুউব কষ্ট পেয়েছিলাম দাদীর মৃত্যুতে, স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছিল।
দাদীর মৃত্যুর মত একই রূপ কষ্ট পেয়েছিলাম আমার নানীর মৃত্যুতেও যে নানীর আদর ভালোবাসার শতভাগ পেয়েছিলাম আমরা বড় দুই ভাই। (পাঁচমেয়ের সবচেয়ে ছোট হওয়ার সুবাদে আমার আম্মা বিয়ের পরও থাকতেন বেশি নানীর কাছেই। আমাদের তিন ভাইয়ের জন্মও হয়েছিল নানার বাড়িতে)।
হ্যাঁ, এই কষ্টগুলির নামও ভালোবাসা।
৫। আমাদের একটি বিড়াল ছিল। নামটাও দিয়েছিলাম #মিনি। আমার আম্মার পায়ে পায়ে চলতো। রান্না করার সময় আম্মার একপাশে চুপ করে বসে থাকতো। ঘুমানোর সময় পায়ের কাছে গুঁটিসুটি মেরে সেও শুয়ে থাকতো। শান্তশিষ্ট মিনিকে সবাই খুব আদর করতো। সবাই মজা করে বলতো- আমার মায়ের আরেকটি সন্তান। সেই মিনির ওপর একবার এক প্রতিবেশি তার মাস্তান কুকুরকে লেলিয়ে দিল। খবর পেয়ে যখন গেলাম তখন সব শেষ। রক্তাক্ত মিনির নিথর দেহ পড়ে আছে। একটি অবলা প্রাণীকে বিনা কারণে হত্যা করে সেই প্রতিবেশি কী পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছে জানি না, তবে সেই রাত আমাদের কারো ভালো ঘুম হয় নি।
৬। গভীর রাত। ১০৫ ডিগ্রী জ্বর গায়ে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। স্ত্রী ছাড়া বাসায় আর কেউ নেই। সে কেঁদে কেটে নাকের পানি চোখের পানি একাকার করে ফেলেছে। মাথায় পানি দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম আর ভোর হওয়ার অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত পার করছে আর কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডাকছে। ভোর হওয়ার সাথে সাথে আমাকে নিয়ে সোজা ডাক্তারের কাছে। কী এটা? হ্যাঁ, ‘ভালোবাসা’।
ভাগ্যিস এই ভালোবাসাগুলি দিবস মেনে হয় নি। এই ভালোবাসাগুলি নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়, উইশ করা, গিফট করা আর ফর্মালিটি মেইনটেইন এ সীমাবদ্ধ নয়। এই ভালোবাসাগুলি স্বার্থপরতার অনেক উর্ধে্ব, এই ভালোবাসাগুলি অকৃত্রিম, বিশুদ্ধ। এই ভালোবাসাগুলি না থাকলে থমকে যেত জগত ও জীবন।
(বাবা মায়ের ভালোবাসার কথা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। কারণ কোন উদাহরণ, কোন আবেগ, কোন অনুভূতি দিয়েই সেই ভালোবাসার স্বরূপ প্রকাশযোগ্য নয়)।
#মুদ্রার অপর পিঠের কিছু চিত্রঃ
১। আমার এক চাচার শ্যালক ছিলেন অামার বয়সী, স্বভাবে একটু বখাটে ধরনের। একবার কি একটা ইস্যূতে চাচার ঐ শ্যালক আমাকে বাজে কথা বলেছিল। আমার শিক্ষিত (!) চাচা উল্টো শ্যালক এর পক্ষ নিয়ে আমাকে বেশ মারলেন ঐ বয়সে (তখন আমার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট)।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেলাম!! হ্যাঁ, সেটিও ভালোবাসা ছিল- শ্যালক এর প্রতি দুলাভাই এর ভালোবাসা!! (ঐ চাচার সাথে আমার সম্পর্ক আর কখনো স্বাভাবিক হয় নি)।
২। এক মধ্যবয়সী বিধবা বজ্জাত রমনীর কুনজরে পড়েছিলাম একবার। স্থানীয় স্টুডিওকে টাকা খাইয়ে আমার পাসপোর্ট সাইজ ছবি সংগ্রহ করে তার সাথে নিজের ছবি জোড়া লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার অপচেষ্টা করলো। বজ্জাত রমনীর অপচেষ্টা সফল হলো না। তবে আমি খুউব বিব্রত হলাম, লজ্জিত হলাম। তখন অনুভূতি হয়েছিল- ধরনী ফাঁক হও, আমাকে লুকিয়ে ফেল।
সেটা কি ভালোবাসা ছিল? না, সেটি ছিল এক নষ্টা মহিলার অনৈতিক ও নোংরা কামনার প্রকাশ।
৩। গতকাল অফিসে দেখলাম- বেশিরভাগ ললনা কড়া সাজগোজ এর সাথে খুশবু ছড়িয়ে এসেছে আর টৈ টৈ করে সবাইকে ‘হ্যাপী ভ্যালেন্টাইনস’ বলে শুভেচ্ছা বিলুচ্ছে। আমাকেও এসে বলে, “স্যার, হ্যাপী ভ্যালেন্টাইনস ডে।” আমি প্রতি উত্তর করি না, নির্বিকার থাকি। হয়তো ভাবছে, স্যার আনকালচার্ড।
তা ভাবুকগে! পুঁজিবাদী ভোগবাদীর মার্চেন্টরা সভ্যতার বিকাশের নামে স্রেফ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে যে ভালোবাসাকে কলুষিত করেছে, ভালোবাসার নামে অনৈতিকতা, নোংরামি, অশ্লীলতা আর বেহায়াপনাকে উস্কে দিয়েছে আমি ধিক্কার জানাই সেই ভালোবাসাকে, ধিক্কার জানাই কালচার নামের সেই চরম অসভ্যতাকে, চরম অপসংস্কৃতিকে।
অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় পূর্ণ হোক প্রতিটি জীবন ও জগত।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৯৮ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পারষ্পরিক ভালোবাসা
প্রেমিকা/স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা
নেত্রীর প্রতি ভালোবাসা
টাইগারদের প্রতি ভালোবাসা
টাইগারের ভালোবাসা
নেত্রীর প্রতি ছাত্রলীগের ভালোবাসা
কেমন আছ মা? আমি আপনার ছেলে/মেয়ে অমুক বলছি....!
কিরে মকবুল তুই আজ কলেজে যাসনি? না ভাইয়া আজ কলেজ বন্ধ!!! এভাবেই ভালবাসার প্রকাশ পায়, আজকাল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন