দিবস মানেনা মায়ের ভালবাসা

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১২ মে, ২০১৪, ১০:৩৩:২৮ সকাল

বৃষ্টি হচ্ছে রিমঝিম। জানালার ধারে বসে নাদিয়া আপন মনে গুনগুনিয়ে চলছে, "আজি ঝরঝর মুখরও বাদল দিনে, জানিনে...."। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত। সেই সাথে প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টির বেগ ও বাড়ছে ক্রমশ। গানের ছন্দে ছেদ পড়ল।

একটু পর আবার হেমন্তের গানের কলিতে গুনগুন করে নাদিয়া- "এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকেনাতো মন। কাছে যাব কবে পাব, ওগো তোমার নিমন্ত্রণ........"।



গাইতে গাইতে হঠাৎ উদাস হয়ে যায় নাদিয়া, বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, অশ্রুসিক্ত হয় দুই নয়ন। এক সময় তা কপোল বেয়ে পড়ে। তাঁর একান্ত ভালবাসার মানুষটিকেতা নিমন্ত্রণ দিয়ে ফিরিয়ে আনা যাবেনা। সেতো আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে।

নষ্টালজিয়া ভর করল নাদিয়ার মনে। ভালই চলছিল তাদের দিনগুলি। স্বামী আরিফ আর দুই ছেলে নাদিম আর আজিমকে নিয়ে কত সুখের সংসার ছিল। বিলাসিতা না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। আরিফ একটি আইটি কোম্পানীতে সিনিয়র ইন্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিল। কি যে মজার ছিল সেই সব দিন। ছুটির দিনে রাজধানীর দর্শনীয় স্থানসমূহ তারা ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে ঢুঁ মারত আত্মীয় স্বজনের বাসায়ও। আরিফ মাঝে মাঝে অফিস হতে লম্বা ছুটি নিয়ে সপরিবারে চলে যেত কক্সবাজার, রাঙামাটি কিংবা সিলেট। একবারতো ১৪ দিনের ট্যুরে তারা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছিল। হৃদয়ের ফ্রেমে বাঁধা কত শত স্মৃতি যে উঁকি মারে!

মুহূর্তের দূর্ঘটনায় একদিন সব শেষ হয়ে যায়। সে আট বছর আগের কথা। বড় ছেলেটি সবে ক্লাস ওয়ানে। ছোটটি আধো আধো বুলিতে আওড়াত মা মা মামমমা, বা বা কিংবা দা দাদা দা। সে কালো দিনে ও আজকের মত প্রচন্ড ঝড় ছিল। কোথাও কোথাও গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটিও উপড়ে পড়ল। একটু পরেই বাসায় বিদ্যুত চলে গেল। নাদিয়া দুই সন্তানকে নিয়ে বাসায় একা। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। অফিসে ফোন দিয়ে স্বামীকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে বলল। বউপাগলা আরিফ অফিস এর জরুরী কাজ ফেলেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল আর বউকে বলল খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা করতে। কিন্তু সেই খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা আরিফ এর আর খাওয়া হলনা। মহল্লার প্রবেশ মুখে ঝড়ে পতিত বিদ্যুতের একটি তারে জড়িয়ে মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যায়। আরিফ বাসায় ফিরল লাশ হয়ে।

নাদিয়া লাশ দেখে গগনবিদারী একটা চিৎকার দিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল। এরপর আর কোন কান্নাকাটি করেনি। একেবারে বোবা পাথর হয়ে রইল।

নাদিয়ার এই থমকে যাওয়া সময়ে পাশে এসে দাড়ায় তারই গর্ভধারিণী মা।

বলেন, ‌‌‘তোর এই মাকে দেখ। তোর বাবাও তো সেই কবে আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। তোরা তখন বেশ ছোট। আমিতো থেমে থাকিনি। তোদের দিকে চেয়ে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছি। কারো মুখাপেক্ষী হইনি, একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে পথ চলেছি। তোদের উচ্চশিক্ষিত করেছি। খোকা আজ চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। তুইতো আমারি মেয়ে। এছাড়া তুই ও এখন মা। তুই পারবি মা, তোকে পারতেই হবে।’

আরিফ এর অফিস হতে প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটি বাবত লাখ চারেক টাকা পাওয়া গেল। দুই ছেলেকে নিয়ে নাদিয়া চলে এল মায়ের কাছে, অনেক স্মৃতি বিজড়িত তাদের ছোট্ট মফস্বল শহরে, ছেড়ে এল বিশ্বাসঘাতক রাজধানী শহর ঢাকাকে।

নাদিয়া রূপসী ছিল। বিধবা হলেও বয়স এখনো তিরিশ পেরোয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগল। নাদিয়া মুখের উপর সবাইকে না করে দেয়। মা বোঝায়, "তোরতো আর এমন বয়স হয়নি। সারাজীবন পরে আছে। ছেলে দুটি আমার কাছেই থাকবে। তুই রাজী হয়ে যা, মা।"

মায়ের পীড়াপিড়িতে একবার সে বিয়েতে রাজিও হয়েছিল। পাত্র ইতালী প্রবাসী। বয়স ৩৫ এর কোটায়। বিয়ের পর বউকেও নিয়ে যাবে। বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক। বিয়ের তিন দিন আগের ঘটনা। একদিন বড় ছেলে নাদিম স্কুল হতে মারামারি করে ঘরে ফিরল। স্কুলে এক ছেলে তাকে বলেছিল, তোর মায়েরতো বিয়ে হবে এবং বিয়ের পর তোদের রেখে চলে যাবে। নাদিম ক্ষিপ্ত হয়ে ঐ ছেলেকে জোরে এক ঘুসি মেরে বলল, আমার মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবেনা। কেউ নিতে আসলে ঘুসি মেরে তোর মত নাক ফাটিয়ে দিব।

নাদিয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে আর বলে, " আমি মা, তোদের মা। তোদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা, কখনোনা।"

বিয়েতে বেঁকে বসে নাদিয়া।মা বোঝায়- দেখ মা, বিয়ের সব ঠিকঠাক। এখন এমন করিসনা।

নাদিয়া বলে- আমার সময় যখন থমকে গিয়েছিল, তখন আমার পাশে দাড়িয়েছিলে আমার মা, তুমি। তোমার প্রেরণা আর সাহস না পেলে আমি কখনো স্বাভাবিক হতে পারতামনা। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের দিকে চেয়ে তুমিওতো আর বিয়ে করনি। আমিও তো একজন মা। আমার ছেলেদের বাবা নেই। আমি তাদের বাবা হয়ে, মা হয়ে তাদের পাশেই থাকতে চাই। নাদিয়ার আবেগপূর্ণ কথায় মা চুপসে যান, আর পীড়াপিড়ি করেননা। বিয়ে ভেঙে যায়।

বেলা বয়ে যায়। নাদিয়া স্থানীয় হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পায়। শিক্ষকতা, ধর্মকর্ম আর ছেলেদের পড়াশোনা দেখিয়ে দিন কেটে চলছে। বড়ছেলে এবার ক্লাস নাইনের ফার্স্টবয়, নাদিয়ার স্কুলেই। ছোটটি পড়ে থ্রিতে।

নাদিয়া আজ স্কুলে যায়নি, ছুটি নিয়েছিল। খিচুড়ি রান্না করেছে, সাথে ইলিশ ভাজা। ছেলে দুটিই বাবার স্বভাব পেয়েছে। খিচুড়ির মহাভক্ত, সাথে ইলিশভাজা হলেতো কথাই নেই। রান্না শেষ, নাদিম স্কুল হতে ফিরলে একসাথে খাবে সবাই।

এসময় বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি হবে, নাদিয়া আগেই টের পেয়েছিল আবহাওয়ার অবস্থা দেখে। তাই খিচুড়ি ইলিশ রান্না। জানালার ধারে বসে বৃষ্টি উপভোগ করতে চাইল। স্মৃতি তাকে নিয়ে গেল আট বছর আগে। কপোল ভিজে উঠল দুই নয়নের বাঁধভাঙা জলে।

একসময় ঝড় থেমে গেল, বৃষ্টিও। বাসার অনতিদূরেই স্কুল। দশমিনিট পরেই নাদিম চলে এল। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। নাদিয়া কিছু আঁচ করতে পারছিলনা। কান্না লুকাতে চাইল। ছেলে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা আজ বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। সে কি, তুমি কাঁদছ কেন?

নাদিয়া কান্না লুকাতে গিয়ে ছেলেকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দিল। মায়ের আবেগ ছেলেকে ও স্পর্শ করল। সে ও কাঁদছে। পাশে এসে দাড়ালেন নাদিয়ার মা। তার ও চোখে জল। দুই মা, দুই সন্তান-তিনজনের চোখেই জল। তাদের আজকের এ অশ্রু বেদনার নয়, আবেগের, আনন্দের- আনন্দাশ্রু।

বিষয়: সাহিত্য

১৪০০ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

220513
১২ মে ২০১৪ সকাল ১০:৪২
নেহায়েৎ লিখেছেন : আপনার লেখাগুলো অতি আবেগময়! মনে হচ্ছে আপনি অতি আবেগ প্রবণ! মা আসলেই মা প্রতিদিনই মা সব সময়ই মা। মায়ের জন্য বিশেষ কোন দিন নাই।
১২ মে ২০১৪ সকাল ১০:৪৪
168119
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এটি আমার অনেক পুরনো গল্প। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় শিরোনাম বদলে আবার দিলাম। Angel Angel
220520
১২ মে ২০১৪ সকাল ১১:০১
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১২ মে ২০১৪ সকাল ১১:০৩
168126
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : কিন্তু আপনার মন্তব্য আমার ভাল লাগেনি। ব্লগিং আপনার জন্য নয়। <:-P <:-P
220528
১২ মে ২০১৪ সকাল ১১:১১
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : অসম্ভব ভালো লাগলো। মাকে কোনো দিবসে ফেলে ভালোবাসি না। অন্তরে বাহিরে সবসময় মায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাই এই মনে ও দেহে। সুতরাং যারা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে তাদের জন্যই এই দিবস।
১২ মে ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪
168172
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : হুম। মায়ের ভালবাসা অকৃত্রিম, নিখাদ। দিবসে এটাকে সীমাবদ্ধ করা যায়না।
220530
১২ মে ২০১৪ সকাল ১১:১৬
সিটিজি৪বিডি লিখেছেন : মা কোন দিন তার সন্তানদের ফেলে অন্য কোথাও যেতে পারে না..নাদিয়াও পারে নি..........অসাধারন...ভাল লাগল.............
১২ মে ২০১৪ দুপুর ১২:৫৬
168173
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ধন্যবাদ সিটিজি৪বিডি ভাই সুন্দর মন্তব্যের জন্য। তবে বর্তমানে অনেক ব্যতিক্রম আছে। মানুষের মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

(ফেসবুক ইনবক্সে সেদিন এর কয়েকটি ছবি দিবেন। একটি পোস্ট দিব ইনশাল্লাহ)।
220561
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৪৩
egypt12 লিখেছেন : আমার মায়ের জন্য আমার ভালোবাসা সারা বছর থাকবে...দিবসের ফ্রেমে বন্ধী থাকবে না Rose Rose
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৫৩
168192
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আজ দিবসের ফ্রেমে বন্দী করে অকৃত্রিম ভালবাসা গুলিকে কৃত্রিমতার রঙ্গে রাঙ্গানো হচ্ছে।
220587
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০২:৫৬
নকীব কম্পিউটার লিখেছেন : দু জায়গায় চোখে জল এল। সত্যিই ‍সুন্দর ঘটনা।
১। ছেলে দুটিই বাবার স্বভাব পেয়েছে। খিচুড়ির মহাভক্ত,
২। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। নাদিয়া কিছু আঁচ করতে পারছিলনা। কান্না লুকাতে চাইল। ছেলে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা আজ বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। সে কি, তুমি কাঁদছ কেন?

নাদিয়া কান্না লুকাতে গিয়ে ছেলেকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দিল। মায়ের আবেগ ছেলেকে ও স্পর্শ করল।






আমার সন্তানেরা আমার মত আমার পছন্দের খাবারগুলি পছন্দ করে। আমি ওদেরকে কোথাও নিয়ে গেলে আমার পছন্দের খাবার হলেই ওদের চলে। কারণ আমি যা পছন্দ করি, ওদেরও ‍তা।

২৭ মে ২০১৪ দুপুর ১২:৪৯
173823
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ধন্যবাদ নকীব ভাই।Good Luck Good Luck Good Luck
319213
১০ মে ২০১৫ দুপুর ০২:২৮
আব্দুল গাফফার লিখেছেন : Rose Good LuckRoseখুব ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ
319333
১১ মে ২০১৫ রাত ১২:২১
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : মা দিবসে স্ট্যাটাস নাই কেন ?
আমায় একজন বলে , ভাই আপনার আজ কোনো স্ট্যাটাস দেখলাম না ? জানতে চাইলে কোন বিষয়ে সে জবাবে বলে মা দিবস নিয়ে। আমি উনাকে কিছু না বলে শুধু বললাম একটু পর দিচ্ছি দেখে নিয়েন।
মা দিবসে আমি স্ট্যাটাস লিখিনি এটা আসলে আমার ভুল নয়। আজ যে মা দিবস সেটাই লক্ষ্য করিনি। আজ সকালে ও দু বার আম্মার সাথে ফোনে কথা হয়েছে এবং প্রতিদন যেভাবে কথা বলি আজও সেই ভাবে বলেছি। আমার একটু সমস্যা হলেই আম্মাকে বলতে হয়। আমার প্রতিদিনের রুটিন হলো আম্মার সাথে ফোনে কথা বলা। আজ মা দিবসে আমার স্ট্যাটাস আম্মার সাথে বেশি বেশি ফোনে কথা বলবেন প্রবাসীরা মনে শান্তি পাবেন।
১১ মে ২০১৫ দুপুর ১২:২৩
260497
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : Angel Angel Angel
368629
১০ মে ২০১৬ রাত ০৮:১৩
শেখের পোলা লিখেছেন : কোন একটি দিবসে একে বাঁধার কি উপায় থাকতে পারে? একে বাঁধা যায় না, উচিৎও না্। ধন্যবাদ।
১০
370987
০৪ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:০৭
আবু নাইম লিখেছেন : খুবই চমৎকার ও আবেগময়! ভাল লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File