আমৃত্যু মায়ের ভালবাসা
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:০২:২৮ সকাল
(২৯ শে এপ্রিল, ১৯৯১ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় এর পটভূমিতে গল্পটি রচিত)
"আমার ছোট্ট বাবুনি,
ঠিক যেন টুনটুনি।
আদর খোঁজে মায়ের কোলে,
হাপ্পি দেয় মায়ের দুই গালে।"
হি হি হি .......। আরিফার হাসি যেন থামতেই চায়না।
মায়ের গলা জড়িয়ে বলে-"মা আবাল বল।"
- মাকে একটা হাপ্পি দাও।
আরিফা মায়ের দুগাল চুমুতে ভরিয়ে দেয়। আর হাসে হি হি হি........। নাহিদা ও মেয়ের টোলপড়া গালে অনেকগুলো চুমু খায়।
- মামনি, বাবা কোতায়?
- দুবাই।
-টুবাই কোতায়?
-বিদেশ।
-বিটেশ কি?
-অনেক দূর।
- আমি বাবা যাব। বাবা হাপ্পি দেব।
-আচছা। এবার মামনিকে একটা ছড়া বলে শোনাও।
- চলুই পাকি, চলুই পাকি।
আমাল কতা শুনছো নাকি।
শুনছোনাতো চলুই পাখি,
ফুলুৎ কলে দেও যে ফাঁকি,
বসছ উলে গাছে। হি হি হি.......
- ভেরি গুড।
- মামনি ভেলি গুড কি?
-ভেরি গুড হচ্ছে খুব ভাল। আরেকটা ছড়া বল।
- আম পাতা জোলা জোলা,
মালব চাবুক চলব ঘোলা।
ওলে বুবু সলে দালা,
আসছে আমাল পাগলা ঘোলা।
মেয়ে র এর উচ্চারণ পারেনা, বলে ল। নাহিদা চেষ্টা করে।
- মামনি বলতো গরু।
-গলু
-ঘর
-ঘল
- গররররররররররর
-গলললললল
নাহিদা হাল ছেড়ে দেয়। আরেকটু বড় হলে এমনিতেই শিখে যাবে। মেয়ের খুঁনসুটি, আধো আধো বোলের কথা খুব উপভোগ করে নাহিদা।
আরিফার বয়স সবে সাড়ে তিন বছর। কথা বলে আধো আধো বুলিতে। আরিফার বাবা থাকেন দুবাই। নাম আরিফ। মেয়ে জন্মের পর আর নতুন নাম খুঁজতে হয়নি। বাবার নামের সাথে আ-কার যোগ করে সুন্দর নাম হয়ে গেল-আরিফা।
আরিফার জন্মের সময়টা মনে পড়ে নাহিদার। কেমন ভয় ভয় করছিল। মা তাকে অভয় দিচ্ছিলেন আর দোয়া-কালাম পড়ছিলেন। আরিফ আসতে পারেনি। দুইমাস পর তিন মাসের ছুটিতে আসবে। স্থানীয় ধাত্রীকে খবর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো এসে পৌছেনি। এদিকে শুরু হল বৃষ্টি। কোন ঝড় নেই। তবে বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল সাথে শিলাবৃষ্টি। নাহিদা তীব্র ব্যথায় ছটফট করছে। মা খুব উদ্বিগ্ন, আপন মনে আল্লাহকে ডাকছেন। ধাত্রী মহিলা এখনো আসেনি। তবে আশেপাশের কয়েকজন কৌতুহলী মহিলা আছে। ধাত্রীর আসতে দেরি দেখে এরাই সহযোগিতায় লেগে গেল। নাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে। হঠাৎ ওয়াও ওয়াও শব্দ। কন্যা সন্তান হল নাহিদার। প্রথম সন্তান, সবাই খুব খুশি। কিন্তু নাহিদা এদিকে অচেতন হয়ে পরে আছে। দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর চেতনা এল। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আছে, সাথে তীব্র ব্যথা আর খিঁচুনি। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। মেয়েকে দেখতে চাইল। তার পাশে শুইয়ে দেয়া হল ফুটফুটে নবজাতকটিকে। নাহিদা মুহুর্তে সব ব্যথা ভুলে মেয়ের দিকে তাকিয়েই রইল। এত প্রশান্তি, এত আনন্দ সে জীবনে কখনো অনুভব করেনি। মনে হল, আল্লাহপাক তাকে অনেক বড় একটা পুরস্কার দিয়েছেন। পৃথিবীর কোন কিছুর সাথেই একে বিনিময় করা যাবেনা। নিজের অজান্তেই দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল নাহিদার।
আরিফার জন্মের দুইমাস পর তিন মাসের ছুটিতে এল আরিফ। হাসি খুশিতে ভরপুর দিনগুলো খুব দ্রুতই যেন শেষ হয়ে গেল। বিদায় বেলায় মেয়েকে কোলে নিয়ে কেঁদে দিয়েছিল আরিফ। এরপর আড়াই বছর পর আর একবার এল। ততদিনে মেয়ের বয়স তিন বছর। এবার আরিফ স্ত্রী, কন্যাকে দুবাই নিয়ে যাওয়ার মোটামুটি বন্দোবস্ত করে এসেছে। কয়েকমাস পর ভিসা হয়ে যাবে। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি আরিফ চলে এল। স্ত্রী, কন্যাকে রয়ে গেল বাড়িতে। বাড়ি তাদের কক্সবাজারের টেকনাফ, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে।
২৯ শে এপ্রিল, ১৯৯১ ইং। সকাল হতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নাহিদার মনটা একটু খারাপ হল। বৃষ্টিতেতো বের হওয়া যাবেনা কোথাও। আজ বান্ধবী নূসরাত এর বাড়ি যাবে ভেবেছিল। নাহিদা ও মেয়ের ভিসা এসেছে। ১৫ ই মে ফ্লাইট। যাওয়ার আগে ঘনিষ্ট বান্ধবী আর নিকটাত্মীদের সাথে শেষবারের মত দেখা না করলেই নয়।
বৃষ্টি একটু একটু বাড়ছে। নাহিদা রেডিও অন করল।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বাজছে, " আমি ও পথের মত হারিয়ে যাব, আমিও নদীর মত মিলিয়ে যাব। আসবোনা ফিরে আর, আসবোনা ফিরে কোনদিন, আসবোনা ফিরে কোনদিন...।"
গানটি শুনে নাহিদার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে।
হঠাৎ রেডিওতে ঘোষণা হল আবহাওয়া বার্তা - ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। অজানা আশংকায় কেঁপে উঠল নাহিদার অন্তর। একবার ভেবেছিল বৃষ্টি কমলে মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রামে মামার বাসায় চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি আর থামেনা। সারাদিন বৃষ্টির সাথে হালকা ও মাঝারী দমকা হাওয়া ছিল।
ধীরে ধীরে রাত নামে। নাহিদা মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে। রাত সাড়ে বারোটায় হঠাৎ ভয়ানক শোঁ শোঁ শব্দে নাহিদার ঘুম ভেঙে যায়। মেয়েও জেগে উঠে, ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। প্রকৃতির এমন রুদ্ররূপ নাহিদা আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। প্রচন্ড ভয়ানক গতিতে দমকা হাওয়া বইছে। আশে পাশে ভারি গাছপালা ও বাড়িঘর পতনের তীব্র শব্দ হচ্ছে। মানুষের আহাজারি শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ ঘরের পাশের আম গাছটি বিকট শব্দে পতিত হল। ধেবে গেল ঘরের একপাশ। নাহিদা ঘরে থাকা আর নিরাপদ মনে করলোনা। বের হয়ে এল মেয়েকে কোলে নিয়ে।
ঘর হতে বের হয়েই দেখে কোমর সমান পানি। পানি ভেঙে এগোতে থাকে নাহিদা। অন্ধকারে ঠিকমত কিছু ঠাওর করা যাচ্ছেনা। পানি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে নাহিদা। বড় রাস্তায় এসে জোরে চিৎকার করল, "বাঁচাও, বাঁচাও।" কিন্তু চারদিকে হাজার হাজার মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচি, আহাজারি। সবাই লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে। সে কি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি! নাহিদার চিৎকার পানির ঢেউ আর মানুষের আহাজারিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। আর পা চলেনা নাহিদার। মেয়েটি বুকের মাঝে থরথর করে কাঁপছে। পানি ইতিমধ্যে বুকসমান হয়ে গেছে। হঠাৎ প্রচন্ড পানির স্রোত মেয়েকে কোল হতে ছিটকে নেয়। নাহিদা সর্বশক্তি দিয়ে দ্রতগতিতে ঝাপিয়ে পরে। মেয়েকে উদ্ধার করে আবার খুব শক্ত করে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে। সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে চলে নাহিদা। পানি বেড়ে গলাসমান হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা প্রকান্ড ঢেউ। কিছু বুঝে উঠার আগেই ডুবিয়ে নিয়ে যায় মা-মেয়েকে।
পরদিন সকাল। থেমে গেছে তান্ডব। কিন্তু প্রলয়ংকরী এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস চারপাশে রেখে যায় ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর। হতাহত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ, গবাদি পশু। বিলীন হয় অগণিত ঘরবাড়ি ও গাছপালা। হাজার হাজার লাশের ভিড়ে প্রায় সকল পত্রিকার প্রথম পাতায় ঠাঁই পায় একটি যুগল লাশের ছবি। মায়ের কোলে চিরনিদ্রায় একটি ছোট্ট ফুটফুটে শিশু। মায়ের গলা জড়িয়ে আছে শিশুটি আর মা শিশুটিকে দুইহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। ছবির নিচে ছোট্ট ক্যাপশনে লেখাঃ আমৃত্যু মায়ের ভালবাসা- জীবনে যেমন, মৃত্যুতেও সন্তানকে বুকে আগলে আছেন মা।
বিষয়: সাহিত্য
১৬৫২ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি লিখেছেন অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে, সে রাত এমন হাজারো মর্মস্পর্শী ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে।
আপনার লেখনী চমৎকার, বিশেষ করে গল্পের জন্য। চালিয়ে যান।
লেখার বিষয়ে উৎসাহ দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপু।
মন্তব্য করতে লগইন করুন