সাড়ে তিন হাত মাটি
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১২ মার্চ, ২০১৪, ১১:২২:১৬ সকাল
গাঁয়ের নাম সাকঁতলা। ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেঁষে গাঁয়ের একটা দৃষ্টিনন্দন দোতলা বাড়ি। বাড়িটির শান শুওকতও বেশ। মাত্র ছয় সাত বছর আগেও বাড়িটি ছিল একটি চারচালা টিনের ঘর। নদী এখানে একেবারেই শান্ত। নদীভাঙ্গন এর কোনো পূর্ব রেকর্ড নেই। তাই নদীর কুল ঘেষে বাড়িটি তৈরি করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি তালেব মজুমদারকে।
পৌষের মিষ্টি রোদে উঠোনে বসে আয়েশ করে খেজুর গুড় দিয়ে চিতই পিঠা খাচ্ছেন তালেব মজুমদার। এ সময় গেইটে ডাক শোনা গেল- মজুমদার সাহেব বাড়ি আছেন?
-রজব আলী, আস ভিতরে আস।
বলতে বলতে রজব আলী উঠোনে এসে দাঁড়ায়। তালেব মজুমদার এর কাজের মেয়েটা মোড়া এনে দেয়।রজব আলী জমির দালাল।উঠতি পয়সাঅলাদের কাছে খুব খাতির তার। থানা পুলিশ হতে শুরু করে ভূমি অফিস, উঠতি মাস্তান সব জায়গায় তার লোক আছে। এসব প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীত দেখিয়ে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারকে বেশ সস্তা দরে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেছে সে তার পছন্দের পার্টির কাছে।তালেব মজুমদার গত পাঁচ ছয় বছরে চার কানিরও বেশি জমি কিনেছেন। কাঠার হিসেবে এর পরিমাণ প্রায় তিনশত কাঠা এবং বিঘার হিসেবে প্রায় পনের বিঘা। জমি কেনা এখন নেশা হয়ে গেছে তার কাছে।
খেজুর গুড় আর পিঠা খেতে খেতে শুধোয় রজব আলী- মজুমদার সাব, ঢালুয়া বাজারে একটা মনমতো জায়গা পাইছি। জমির পরিমাণ ছয় শতাংশ, তিন রাস্তার যে বাঁকটা আছে তার ঠিক কর্ণারে। মার্কেট করার জন্য এর চাইতে ভাল জায়গা এ তল্লাটে আর দ্বিতীয়টি পাইবেননা।
-ও আচ্ছা! ঐটা বায়েরা গ্রামের শরীফ ভূঁইয়ার না? খাটাশটা জমি বেঁচবে নাকি?
- আরে না বেঁচে যাইবো কই? তার পেছনে ঘটক রশিদ মিয়ারে লাগাই দিছি। শরীফ ভূঁইয়ারে ভিমরতিতে ধরছে। বিয়া করবে, তাও যুবতী কইন্না খুঁজে। ব্যাটার ছেলেমেয়েরা সব বিবাহিত, নাতি নাতনী রা বড় হইছে। কিন্তু লুলামি যায়নাই। রশিদ মিয়া কাইল রাইতে পাক্কা খবর দিছে, বুড়ারে কাইত করা গেছে। এ জমি বেঁইচা বুড়া বিয়া করবো। পাত্রী খুব গরীব পরিবারের, তবে অষ্টাদশী সুন্দরী।
-রজব আলী, তোমার ম্যালা বুদ্ধি। এ জন্যই তোমারে আমি পছন্দ করি।
-কিছু হাদীয়া দেন আইজ। হাতটা একটু খালি খালি।
- এ নিয়া চিন্তা কইরোনা। আজ দশ হাজার টাকা নাও। জায়গাটা কিনতে পারলে মোটা অংক পাবা তুমি।
-কোনো টেনশন নিয়েননা। জায়গা এখন আপনার মনে করবেন। টাকা রেডী রাইখেন। আজ কালের মধ্যে বায়না হবে।
হাবীবের মনটা আজ বিশেষ একটা ভালো নেই। কেমন যেন একটা শূণ্যতা, রিক্ততা হৃদয়জুড়ে। গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশী আসাদ ভাই এর বাসায় দাওয়াত ছিলো্। আসাদ ভাইয়ের সাথে নিউইয়র্ক এসেই পরিচয় হয় হাবীবের কর্মসূত্রে। বেশ দিলখোলা মানুষ, দেশী ভাইদের সহায়তায় সবসময় একধাপ এগিয়ে। আসাদ ভাই এর শিক্ষিত সুন্দরী মার্জিত স্ত্রী ও ফুটফুটে দুটি ছেলেমেয়ে। দেখেই নয়ন জুড়ায়। হাবীব এর মনে ও দোলা লাগে। মনের মধ্যে ধূধূ মরুভূমির মতো হাহাকার বয়ে যায়। এমন একটি পরিবারতো তার নিজেরও হতে পারে। মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়িয়েছে, বয়সও তো কম হলোনা। আসাদ ভাই, ভাবীও বিয়ে নিয়ে প্রায়ই বলেন। গতকালতো রীতিমত পাত্রীর সন্ধান দিলেন। হাবীব দীর্ঘশ্বাস গোপন করে প্রস্তাব এড়িয়ে যায়। খুউব খুউব ইচ্ছে করলেও যে উপায় নেই।
হাবীব ডিভি ভিসায় গ্রীনকার্ড পেয়ে আমেরিকা আসে সাত বছর আগে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। এ দেশে এসে অর্থ বিত্তের সন্ধান পায় । কিন্তু অর্থ সুখ দিতে পারেনি তাকে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে হাবীব আমেরিকায় আসে। ভিসা পাওয়ার আগে হাবীব এর বিয়ে প্রায় ঠিক ঠাক। হঠাৎ ভাগ্য পরিবর্তনে বেঁকে বসে তার বাবা তালেব মজুমদার। অনেকটা সিন ক্রিয়েট করেই বিয়ে ভেঙ্গে দেন তিনি। হাবীব এর ব্যাপারটা ভালো লাগেনি মোটেই। কিন্তু বাবার কথার উপর সে কথা বলেনা কখনো। বাবা বলেন- এর চেয়ে ধনী ঘরের মেয়েকে তিনি পুত্রবধু করবেন। বাবার এ ধন লিপ্সাকে হাবীব অপছন্দ করলেও কিছু করার নেই তার। আমেরিকায় এসে ধীরে ধীরে হাবীবের স্বপ্নগুলো ফিকে হতে থাকে। ডলার বেশ কামাই হচ্ছে। কিন্তু বাবার জমি কেনার নেশায় কুলিয়ে উঠতে পারেনা সে। প্রতিবার জমি কেনার আগে বাবা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন-এবারই শেষ। কিন্তু শেষ আর হয়না। গত সাত বছর ধরে তার বাবা তালেব মজুমদার জমি কিনেই যাচ্ছেন। দু হাতে ডলার কামিয়েও কুলাতে পারছেনা হাবীব। চাকরীর পাশাপাশি ট্যাক্সিও চালায় নিউইয়র্কের রাস্তায়। এখানে ট্যাক্সি চালিয়ে প্রচুর পয়সা পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুতেই বাবার চাহিদার সাথে কুলোতে পারেনা হাবীব। নিজেকে এখন সে বাবার ‘মানি মেকিং মেশিন’ ছাড়া আর কিছু ভাবেনা। সাত বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবার দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই বাবা বাগড়া দিয়েছেন জমি কেনার জন্য টাকা চেয়ে। প্রতিবারই তাই যাত্রা বাতিল করতে হয়েছিল।
হাবীব একটু পেছনে তাকায়। কি সুখের দিনগুলো ছিল তাদের। এত অর্থ বিত্ত ছিলনা, মোটামুটি স্বচ্ছলতা ছিল। ঢালুয়া বাজারে বাবার ফার্মেসী ব্যবসা ছিল। হাবীব খুব মিস করে তার প্রিয় মাকে, প্রিয় গ্রামকে, প্রিয় ছোট বোন হামিদা ও একমাত্র ভাগ্নে তমালকে। ছোটবোনটি কেমন আছে এখন, কেমন আছে প্রিয় ভাগ্নে তমাল? খুউব খুউব ইচ্ছে করে মা বাবা, ছোটবোন ভাগ্নেকে একবার কাছ হতে নয়নভরে দেখতে । ডাকাতিয়া নদী যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ছোটবেলায় নৌকায় চড়ে জাল দিয়ে কত মাছ ধরেছে এ নদীতে। শীতের দিনে নদীতে কত রং বেরং এর পাখি আসতো দলবেঁধে। ডিগ্রী পাশ করে বাবার সাথে ফার্মেসী ব্যবসা, ভালোই চলছিল। কিন্তু সর্বনাশা ডিভি ভিসা কেড়ে নিয়েছে তার সর্বস্ব, দিয়েছে শুধু অর্থ। ভাবতে ভাবতে একটু উদাস আনমনা হয়ে যায় হাবীব। চোখের কোণে চিক চিক করে অশ্রু। হঠাৎ বাবার ফোন। ভাবনায় ছেদ পড়ে হাবীব এর। এ কথা সে কথার পর আসল কথা পাড়ে বাবা- মার্কেট করার জন্য খুব জুতসই একটা জায়গা পাওয়া গেছে বাজারে। এ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবেনা কোনোমতে। হাবীব বিরক্ত হলেও বাবাকে বুঝতে দেয়না। ফোনে উচ্চস্বরে মায়ের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে- “তোমার জমি কেনা এবার খেন্ত দেও। আমার ছেলেটাকে দেশে আসতে দেও। সাত বছর আমার ছেলের চেহারা দেখিনি।” তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। হাবীব কিছু বলার আগেই লাইন কেটে দেয় বাবা।
সকাল হতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে আজ। সাঁকতলা গ্রামের মজুমদার বাড়ির শোকে আকাশও যেন কেঁদে চলছে অবিরাম। কয়দিন আগে নিউইয়র্কে হাবীব এর ব্রেইন স্ট্রোক করেছিল, সহকর্মীরা হাসপাতালে নেওয়ার আগেই নিভে যায় জীবন প্রদীপ। গতকাল দেশে এসেছে লাশ, দাফনও হয়ে গেছে। পুত্রশোকে গতকাল হতে মূর্চ্ছা যাচ্ছেন বারবার তালেব মজুমদার। তবে দুষ্টজনেরা বলছে, পুত্রশোকে নয়, সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারানোর শোক ভুলতে পারছেনা তালেব মজুমদার। আর হাবীবের মা? যেন একেবারে নিষ্প্রাণ পাথর! মুখে কোন রা নেই। ফ্যালফ্যাল করে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন সবার দিকে। সে দৃষ্টিতে আছে অনেক অনেক জিজ্ঞাসা যার জবাব নেই কারো কাছে।
বিষয়: সাহিত্য
১৪০৭ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শেষ হবে তার দিন।
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
লোভে পাপ , পাপে মৃত্যু । এই সত্যটাই আপনার লেখায় ফুটে উঠেছে।
সূরা আত তাকাসুর থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। চমৎকার শিক্ষণীয় গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
যাইতে হবে একদিন তোমার সকল কিছুই ছাড়ি!
আপনার এতো সুন্দর ব্লগটির সাথে আমারও দু'য়েকটি ঘটনার উল্লেখ করার লোভ লাগছে। কারণ হচ্ছে এসব বিষয়ে আমার নিজের ব্লগে পোস্ট করলে মানহীন 'চুদুরবুদুর' টাইপের লেখা হওয়ার কারণে পাঠক সংকটে পড়তাম নির্ঘাত। তাই আপনার এখানে---
কেইস স্টাডি-১
জনাব এম. ও. হক। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় পুরণো টিউশনীগুলো সচল রেখে দারিদ্র পরিবারে সামান্য অর্থের যোগান দিয়ে পিতার জীবন সংগ্রামের সঙ্গী। হঠাৎ অসুস্থতার কারণে পিতার মৃত্যু। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ার কারণে পুরো দায়িত্ব কাধের উপর নিয়ে সেই ১৯৯৭ সালে সৌদিয়াতে প্রবাসী জীবন বেচে নেয়া। কিছু দিনের মধ্যেই পরিবারে আর্থিক স্বচ্চলতা এসে গেলো। স্বচ্চলতার সাথে ঢুকে গেলো বিলাসীতাও। বিলাসীতার খেসারত দিয়ে গিয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকলো পরিবারের ব্যায়ভার। জীবন যাত্রার মানেও এসে গেলো অনেক উন্নতী।অথচ এই বিলাসীতা ও জীবন যাত্রার মানে উন্নতি পারিপার্শিক তুলনায় অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও বেমান দেখাচ্ছে অন্যের দৃষ্টিতে। প্রবাস জীবনের পাচঁ বছরের মাথায় ইমিডিয়েট ছোট বোনের বিয়ে দেয়া হল। আরো চার বছর পর দ্বিতীয় বোনের বিয়ে দেয়া হল ধুম দারাক্কা করে অপ্রয়োজনীয় টাকা পয়সা খরচ করে। ইতিমধ্যে মেলা টাকা খরচ করে বাপ দাদার আমলের ঝুপড়ি ঘর ভেঙ্গে আলিশান বাড়ি তৈরী করলেন। আলিশান বাড়ীর বাসিন্দা হওয়ার সুযোগে একমাত্র ছোট ভাই এবং বিয়ে উপযোগী আরো দু'জন ছোট্ট বোনদের রুচিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাদের পরিবর্তিত রুচির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে পেট্ট্রো ডলারের যোগানে আরো গাতি বাড়ালেন। ভাইবোনদের হয়তো অতীতের পারিবারিক দুরাবস্থার কথা স্মরণ করার মত 'গোড়ামী' থেকে উপরে উঠে গেছে ভাব। এ কারণে বিবাহ উপযোগী বোনের জন্য কোন প্রস্তাব আসলে প্রথমেই মাথায় চিন্তা করে "আমরা তো এখন আলিশান দোলতলা বাড়ীর বাসিন্দা।" সুতরাং প্রস্তাব আসতে হবে আমাদেরও উপরের তিনতলাওয়ালা বাসিন্দাদের তরফ থেকে। প্রয়োজনে বয়স পেরিয়ে ত্রিশের কোটায় গিয়ে ঠেকুক। তাতে সমস্যা কি?
এরিমধ্যে কখন যে কখন যে আঠারটি বছর প্রবাস জীবনে কাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু একটি বারের জন্যও দেশের মুখ দেখেননি মিস্টার এম. ও. হক সাহেব। জীবনের ৩৯ টি বসন্ত পার করে দিলেন। আরো কত বছর পর দেশের মুখ দেখেন আল্লাহই ভাল জানেন। তবে আত্মীয় স্বজনদের কাছে মাঝে মধ্যে যোগাযোগ করে নিজের বোনদের বিয়ে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিবেন কে? যাকে বিয়ে দিবেন সে নিজেই যদি অর্জার দিয়ে থাকে আমার জন্য রাজপূত্র ছাড়া অন্য কোন ছেলের প্রস্তাব আনা যাবে না্! এ ছাড়া আরো অনেক কাহিনী আছে যা বর্ণনা করতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে।
কেইস স্টাডি--২
কেইস স্টাডি--৩
কেইস স্টাডি--৪
বিষয়গুলো বর্ণনা করতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তাই অন্যে কোন সময় সুযোগ পেলে আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
খুব ভালো লাগলো।
লাইট হাউজ ব্লগে এ গল্পে হাফিজ সাহেব এর মন্তব্যটি দেখুন প্লিজ। :
শাঁকতলা আমার খালার বাড়ী। আমার বাড়ী নোয়াগ্রাম। বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
লিখাটা সত্যিই চমতকার। বাস্তবধর্মী জীবন থেকে নেয়া ঘটনা।
ধন্যবাদ।
ধোরকড়া বাজার হতে আমার নানার বাড়ি ৩ মিনিট এর পথ। আপনার প্রিয় চিওড়া বাজার
আমার অনেক স্মৃতি বিজড়িত।
ছোটবেলায় নানা বাড়ির যাওয়ার মাধ্যম ছিল নৌকা। সাঁকতলায় এসে নৌকাযোগে বেড়লা ঘাট। এরপর রিক্সা..। একবার আব্বা আম্মা সহ পূর্ণিমা রাতে নৌকা ভ্রমণ করেছিলাম। নদীর পানিতে রুপালি চাঁদের ঝিকিমিকি। অসাধারণ দৃশ্য!(গল্পটি বাস্তব তবে স্থান কাল পাত্র কাল্পনিক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন