জনদাবির বিপরীতে সংবিধানের দোহাই : বাস্তবতা ও ফিরে দেখা ইতিহাস

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২৫ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:২৮:৫১ সকাল

সংবিধানের জন্য জনগণ নাকি জনগণের জন্য সংবিধান—মোটা দাগে এ প্রশ্ন আজ মানুষের মুখে মুখে। সরকার সংবিধান হতে এক চুলও না নড়ার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও একই সুরে কথা বলেন। সংবিধান রক্ষার নামে আওয়ামী লীগের এ কঠোর অবস্থান থেকে মনে হতে পারে—উনারা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সকল কাজে এমনকি বেডরুমের মানুষটির সঙ্গেও সংবিধান পড়ে ও মেনে কথা বলেন। আওয়ামী লীগের হঠাত্ এ সংবিধানপ্রীতির মূল উদ্দেশ্য যে কারচুপির নির্বাচন, সেটা রাজনীতিবিমুখ ১০ বছরের স্কুলছাত্রটিও বোঝে।



আদৌ কি সরকার সংবিধান মানছে? মন্ত্রিসভার পদত্যাগ নিয়ে যেটা হয়েছে সেটা কি সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন নয়? সরকারের সংবিধানপ্রীতির মুখোশ খুব নগ্নভাবে খসে পড়ল মন্ত্রিসভার পদত্যাগ নাটকে। বর্তমান সরকার কর্তৃক পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন সংবিধানেরই ৫৮ অনুচ্ছেদের দফা ১ এর ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে—যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগ পত্র প্রদান করেন।’ সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের বক্তব্য অন্য কোনো অনুচ্ছেদ দ্বারা খর্ব বা রহিত করা হয়নি। অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়ে এই অনুচ্ছেদই প্রাধান্য পাবে।

সংবিধানের দোহাই : বাস্তবতা ও ফিরে দেখা ইতিহাস

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কিভাবে সংবিধানে সংযোজিত হলো সে ইতিহাস জানতে একটু পেছনে তাকাতে হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৪ আওয়ামী লীগ, জামায়াত আলাদা সমাবেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয় সরকার তার অবস্থানে অনড় থাকায় ২৮ ডিসেম্বর বিরোধী দলের ১৪৭ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগপত্র পেশ করে ২৩ ফেব্রুয়ারি স্পিকার তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণযোগ্য নয় বলে রুলিং দেন। ১৯৯৫ সালের ১৯ জুন বিরোধী সংসদ সদস্যদের পর পর ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিতি পূর্ণ হয়। এতে সংসদে তাদের আসন শূন্য হবে কি-না এ বিতর্কে সরকারি দল ও স্পিকারের মাঝে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। প্রেসিডেন্ট সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ চাইলে সুপ্রিমকোর্ট আসন শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন ১৪২টি শূন্য আসনে ১৭ সেপ্টেম্বর উপ-নির্বাচনের ঘোষণা দেয় পরে বন্যার কারণে উপনির্বাচনের তারিখ ১৫ ডিসেম্বর ধার্য করা হয় কিন্তু বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। তারা সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা ৩২ ঘণ্টা হরতাল পালন করে ৬ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা আবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন।

হরতাল আর অবরোধের ফলে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরম দুরবস্থার মুখোমুখি হয়। সরকার ২৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয় এবং সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিরোধী দলগুলোর প্রতিরোধের মুখে ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়। ৩ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার ঘোষণা দেন।

সরকার ২১ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে উত্থাপন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত বাংলাদেশের সংবিধানের এয়োদশ সংশোধন আইন, ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশনে ২৬৮-০ ভোটে পাস হয়। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হচ্ছে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কিভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধান হতে বিলুপ্ত হয়েছে সেটাও সচেতন মহলের অজানা নয়।

আজ বাংলাদেশের সব সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে-

যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে সেটাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করেছিল, নির্বাচনকালীন সে সরকার ব্যবস্থার প্রতি সরকারের এখন এত অনীহা কেন? ক্ষমতাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা হতেই কি সরকারের এই অবস্থান? তবে কি জনমতের প্রতি সরকারের আস্থা নেই? ২০০৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে কেন আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি? অভিযোগ করা হয়েছিল-বিচারপতি কে এম হাসান বিএনপিপন্থী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিতো শুধু আওয়ামীপন্থীই নন, আপনি খোদ আওয়ামী লীগের প্রধান। কোন ভরসায় এখন বিএনপি আপনার অধীনে নির্বাচনে যাবে? সংবিধানতো ঐশী বাণী নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। এ পর্যন্ত ১৫ বার সংশোধিত হয়েছে। তাহলে জনগণের চাওয়া অনুযায়ী ষোড়শ সংশোধনী করা যাবে না কেন ? নির্দলীয় সরকার এর দাবি অসাংবিধানিক বলে সরকার প্রত্যাখ্যান করছে। কিন্তু সরকারের প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকার কি আদৌ সাংবিধানিক?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বলেছিলেন, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবেন। আপনি প্রধানমন্ত্রীত্ব নয়, শান্তি চান। আমরা জনগণ আপনার কথা বিশ্বাস করতে চাই। আমরাও শান্তি চাই। আমাদের প্রত্যাশা আপনি সদিচ্ছার পরিচয় দিয়ে সংলাপে বসে সমাধানে পৌঁছবেন। সমঝোতায় আসুন। সদিচ্ছা থাকলে আপনার ও বিরোধীদলের দুটি প্রস্তাব সমন্বয় করেও সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব। বন্ধ হোক হানাহানি, সমঝোতা ও শান্তিই জনগণের একান্ত কাম্য।

বিষয়: রাজনীতি

১৭৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File