বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচনেও তত্ত্বাবধায়কের যৌক্তিকতা প্রমাণিত
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১০ অক্টোবর, ২০১৩, ১২:১৮:৩০ দুপুর
(আজকের দৈনিক আমার দেশ এর সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত আমার এ লেখাটি ব্লগের পাঠকদের জন্য শেয়ার করলাম।)
বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচনের আগে গত ১ অক্টোবর বরগুনা-১ এর এমপি ধীরেন্দ্রনাথ পাথরঘাটার এক জনসভায় দাম্ভিকতার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘হাতপাখা বা যে মার্কায় ভোট দিন, পাস করবে নৌকা মার্কা।’ হলোও তাই। প্রধান বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনেও সরকারদলীয় প্রার্থীকে মাত্র ২০-২৫ দিনের এমপি বানাতে যে ব্যাপক ও নজিরবিহীন কারচুপি ও আনিয়মের আশ্রয় নেয়া হলো, তাতে ৫ বছরের এমপি নির্বাচনের জন্য সংসদ নির্বাচনের কারচুপির মাত্রাটা কত ভয়াবহ হতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী এ প্রসঙ্গে বলেন, যে সরকারের অধীনে একটি উপনির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না, তাদের অধীনে কখনোই একটি জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী শওকত হাসানুর রহমান রিমনকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে স্থানীয় রিটার্নিং অফিসার, অথচ প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ অনুযায়ী সেখানে ভোট গ্রহণ ও গণনায় ব্যাপক কারচুপি এবং অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করি, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচনেও তত্ত্বাবধায়কের যৌক্তিকতা প্রমাণিত এম. ওহিদুল ইসলাম (শ্যামল)
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2013/10/10/220117#.UlZEgFOr20z
এর আগে গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে আরও জোরালো করেছে। সেখানে রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিককে নির্বাচিত করতে হেন কোনো অপকর্ম নেই যেটা সরকার করেনি। হাওর অধ্যুষিত ওই আসনে এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে যেতেই ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। দুর্গম এই আসনের ফলাফল অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঘোষণা করা হয়েছে মাত্র আধা ঘণ্টায়। অন্যদিকে আধুনিক সব যোগাযোগের সুবিধা সংবলিত ৫ সিটি করপোরেশনের ফলাফল পেতে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ মুহিতুল অসীম নির্বাচনের পর তথ্য-প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও মিডিয়ার দলবাজির কারণে সেটা তেমন আলোচনায় আসেনি।
বিএনপির বিরুদ্ধে কথায় কথায় প্রায় দুই যুগ আগের মাগুরা উপনির্বাচনের কারচুপির অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু টাঙ্গাইলের সখিপুর-বাসাইল উপনির্বাচনের কারচুপির কথা বলে না তারা। সাম্প্রতিক কিশেরাগঞ্জ-৪ ও বরগুনা-২ আসনে যে সীমাহীন কারচুপি হয়েছে সেটা দলীয় মিডিয়া ব্যবহার করেও আড়াল করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
তত্কালীন সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজের কথায় কথায় মিডিয়া ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেত। কিন্তু বর্তমান সিইসি যখন প্যাডসর্বস্ব দল বিএনএফকে বিএনপির প্রতীকের অনুরূপ গমের শীষ বরাদ্দ দেয়ার প্রচেষ্টা এবং সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করার জন্য নির্বাচনী প্রচারে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেন, তখন কোনো ষড়যন্ত্রের আলামত খুঁজে পায় না আমাদের মিডিয়াগুলেঅ।
দেশের ৯০ শতাংশ জনগণের সমর্থিত অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য তত্ত্বাধায়কের দাবিটিকেও সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে আজ সরকার। অথচ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও বিচারপতি কেএম হাসানকে নজিরবিহীন মিডিয়া ক্যু-এর মাধ্যমে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল একটি হাস্যকর অভিযোগে। তিনি বিএনপির এক নেতার বাসায় নাকি কবে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন, আর যায় কোথায়? প্রমাণ হয়ে গেল তিনি বিএনপিপন্থী। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তো শুধু আওয়ামী লীগপন্থীই নন, তিনি যে খোদ আওয়ামী লীগের প্রধান। তার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এটি কি আদৌ আশা করা যায়? যেখানে গত সাড়ে চার বছরে সরকারি নিয়োগ, পদোন্নতি সর্বত্রই নগ্ন দলীয়করণ প্রাধান্য পেয়েছে, উচ্চ আদালতকে ও দলীয়করণের নগ্ন থাবায় কলুষিত করা হয়েছে, দলীয় পুলিশ দিয়ে বিরোধী মতকে মামলা-হামলা দিয়ে নজিরবিহীন হয়রানি এমনকি বিরোধী মতের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, দলীয় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেখানে একই সরকারের অধীন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা অরণ্যে রোদন বৈ কি!
সরকারি তরফে দাবি করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের অধীনে সব নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়েছে। এই চরম মিথ্যা দাবিকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিয়েছে হলুদ মিডিয়া। বর্তমান সরকার ক্ষমতাপ্রাপ্তির ঠিক পরপরই উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন এতটাই প্রকাশ্য অনিয়ম হয়েছিল যে, দলকানা সিইসি পর্যন্ত সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর অল্প কিছুকাল পরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল পৌরসভা নির্বাচন, যেখানে প্রকাশ্যে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছিল। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন যার সবক’টিতেই লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে সরকারদলীয় প্রার্থীর। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও লজ্জাজনক হার এড়াতে পারেননি সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা। সরকারের পরাজয়কেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয় হলুদ মিডিয়াগুলো। নির্বাচনকালীন নানা প্রকাশ্য অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করায় উল্টো বিরোধী দলের অভিযোগকেই ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে নানামুখী তত্পরতা চালায় মিডিয়া। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নগ্ন পক্ষপাতিত্ব, ভোট প্রদানে বাধা প্রদান, ভোট গ্রহণে ধীরগতি, বিরোধী দলের এজেন্টদের জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া এবং কালো টাকা, পেশি শক্তি ও প্রশাসনিক শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ঘটনা না ঘটলে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের ব্যবধান আরও বেশি লজ্জাজনক হতো। চসিক নির্বাচনে আমরা দেখেছি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার ও কমিশনের প্রতি মিডিয়ার কত স্তুতিবাক্য, প্রশংসাবাণী। অথচ দেশবাসী দেখেছে রাতভর ফলাফল ছিনতাইয়ের হীন সরকারি প্রচেষ্টা। প্রতিবাদী জনতা রাত জেগে সেই প্রচেষ্টা নস্যাত্ করে দিয়েছিল। কিন্তু যখন ৩০০ আসনে একযোগে নির্বাচন হবে তখন কি সরকারি যন্ত্রের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কারচুপি জনগণ ঠেকাতে পারবে? ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মিডিয়ার পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকার কারণে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনকালীন অনেক ঘটনা জনগণের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিএনপি সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণায় পদে পদে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের অকারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, পুলিশ দিয়ে হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে সবক’টি সিটিতেই। বরিশালে মেয়র প্রার্থী কামালকে লক্ষ্য করে গুলি পর্যন্ত চালিয়েছিল পুলিশ। কামালকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন তার দেহরক্ষী। সন্ত্রাসীদের ভয়ে অনেকেই ভোট প্রদানে বিরত ছিলেন। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের হাতে কালি লাগিয়ে ব্যালটে সিল মারার সুযোগ না দিয়েই বের করে দেয়া হয়, বিপরীতে সরকারদলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থনে মন্ত্রীরা একাধিকবার আইন লঙ্ঘন করলেও কমিশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রশাসন তাদের সব বেআইনি কাজে সহযোগিতা করেছে।
দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ সংঘাত চায় না। তারা চায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা নির্দলীয় যে নামেই ডাকা হোক না, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপযোগী নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই।
বিষয়: বিবিধ
১২৯৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন