তথ্য সন্ত্রাসের কবলে দেশ, উত্তরণ কবে?
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ১২:৫১:৫৪ দুপুর
দেশে আজ বাকস্বাধীনতা নেই, আছে হলুদ সাংবাদিকতা আর অপসাংবাদিকতার মাধ্যমে তথ্যসন্ত্রাসের মহোত্সব। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের যে গুটিকয়েক মাধ্যম ছিল—দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, সোনার বাংলাদেশ ব্লগ তার সবক’টিই ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের শিকার হয়ে আজ বন্ধ। ফলে তথ্যসন্ত্রাসীদের এখন পোয়াবারো। কোনো ধরনের বাধা ও চ্যালেঞ্জ ছাড়াই স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের গৃহপালিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে হলুদ সাংবাদিক ও তথ্যসন্ত্রাসীদের আস্ফাালন আজ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তথ্যসন্ত্রাসীরা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তথ্যসন্ত্রাসীরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করে। এমনকি সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে তুলে ধরে। ভয়ঙ্কর দেশদ্রোহী শক্তিকে এরা দেশপ্রেমিক হিসেবে চিত্রিত করছে, একইভাবে দেশপ্রেমিককে দেশদ্রোহী হিসেবে তুলে ধরছে। সততাকে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিকে সততা হিসেবে জাহির করে এরা দুর্নীতিকেই উত্সাহিত করে। আজ স্বৈরাচার আর ফ্যাসিজমের অন্ধ সমর্থকে পরিণত হয়েছে নাস্তিক নিয়ন্ত্রিত দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া।
তথ্যসন্ত্রাসের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক। সব যুগেই হলুদ সাংবাদিকতা কম বেশি ছিল। তবে বাংলাদেশে এর প্রকোপ ’৯০-এর পর থেকে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। তথ্যসন্ত্রাসের প্রধান টার্গেট ছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম। মনে পড়ে স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর বিএনপি নিজেরা কোনো মিডিয়া সৃষ্টি না করে সম্পূর্ণ ভিন্নমতের নাস্তিক নিয়ন্ত্রিত একটি জঘন্য দৈনিক পত্রিকার অনুমোদন দেয়ার মতো ভুল করে। অনুমোদন পেয়েই জঘন্য তথ্যসন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে সেই পত্রিকাটি। ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে তাসলিমা নাসরীনের ইসলামকে আক্রমণ করা চরম আপত্তিকর, অশ্লীল ও রুচিহীন লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে থাকে সেই জঘন্য পত্রিকাটি। ঘাদানিকের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডেও নানাবিধ সহযোগিতা দেয়া শুরু করে। তবে কোনো রাখঢাক ছাড়াই সেই পত্রিকার নগ্ন অবস্থান সহজেই জনগণের কাছে ধরা পড়ে যায়। ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বের হওয়া একটি পত্রিকা তথ্যসন্ত্রাসকে শিল্পে রূপ দেয়। প্রথমেই সরাসরি দলীয় অবস্থান না নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মগজধোলাইয়ের পরিকল্পনা নেয় এই পত্রিকাটি। দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় মেকআপ-গেটআপ ও দৃশ্যত তখন সরকারের নানাবিধ অপকর্মের কিছু সমালোচনা করে দ্রুত জনপ্রিয়তাও পায় পত্রিকাটি। ধীরে ধীরে মগজধোলাইয়ের কাজও চলতে থাকে। সুযোগ পেলেই ইসলামপন্থীদের জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী হিসেবে তুলে ধরা হয় বিভিন্ন সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ ও সংবাদে। ইসলামফোবিয়ায় আক্রান্ত আন্তর্জাতিক মহলও তখন এদের আর্থিক ও অন্যান্য সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠে আরও অনেক হলুদ মিডিয়া। সবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিপরীতে সেই বিশেষ দেশের সংস্কৃতিকে নানা কৌশলে প্রমোট করা হয়। যেমন—বৈশাখী সংস্কৃতির নামে শাড়ি আর সিঁদুর পরা রমণীর ছবি, ধুতি পড়া পুরুষের ছবি, রাক্ষস-খোক্কস ও কিম্ভুতকিমাকার জন্তু০জানোয়ারের সহযোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা, শিল্পের নামে দেব-দেবীর মূর্তি ইত্যাদি। নারীর আপত্তিকর ও যৌন উত্তেজক ছবি ছাপিয়ে নগ্নতাকেও উস্কে দেয়া হয়। এভাবে তরুণ প্রজন্মের বিরাট অংশের মগজ ধোলাই করে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়ার কাজটি ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়। এরপর বাকি কাজটা সহজ হয়ে যায়।
একই ধারাবাহিকতায় নজিরবিহীন মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল তথ্যসন্ত্রাসীরা, যে ওয়ান-ইলেভেন দেশকে পিছিয়ে দিয়েছিল কমপক্ষে দুই যুগ। এখন সরকারের নৃশংস গণহত্যাকেও যখন সন্ত্রাস প্রতিরোধ আখ্যা দেয়া হয় কিংবা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ঘটনাকে বলা হয় মধ্যযুগীয় বর্বরতা, তখন ভাবি এটা কি সাংবাদিকতা নাকি গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা। এসব অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সত্য প্রকাশের মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসেন সময়ের সাহসী বীর মাহমুদুর রহমান। তথ্যপ্রমাণসহ একে একে অনেক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস করে যখন জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন মুখোশ খুলে পড়ার ভয়ে প্রমাদ গুনে জন্ডিসাক্রান্ত তথ্য সন্ত্রাসীরা। স্বৈরাচারী সরকারকে লেলিয়ে দেয়া হয় এই দুর্দান্ত কলমসৈনিকের বিরুদ্ধে। তথ্যসন্ত্রাসীদের উস্কানিতে এই কালজয়ী নির্ভীক কলমসৈনিক আজ বাকশালী নির্যাতনের নির্মম শিকার।
এবার বর্তমান সময়ের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। দেশের ৯০ শতাংশ জনগণের সমর্থিত অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য এই দাবিটিকেও সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে আজ হলুদ সাংবাদিকরা। অথচ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও বিচারপতি কেএম হাসানকে নজিরবিহীন মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল একটি হাস্যকর অভিযোগে। তিনি বিএনপির এক নেতার বাসায় নাকি কবে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন, আর যায় কোথায়? প্রমাণ হয়ে গেল তিনি বিএনপিপন্থী। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তো শুধু আওয়ামীলীগ পন্থীই নন, তিনি যে খোদ আওয়ামী লীগের প্রধান। তার অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন হবে এটি কি আদৌ আশা করা যায়? যেখানে গত সাড়ে চার বছরে সরকারি নিয়োগ, পদোন্নতি সর্বত্রই নগ্ন দলীয়করণ প্রাধান্য পেয়েছে, উচ্চ আদালতকেও দলীয়করণের নগ্ন থাবায় কলুষিত করা হয়েছে, দলীয় পুলিশ দিয়ে বিরোধী মতকে মামলা-হামলা দিয়ে নজিরবিহীন হয়রানি এমনকি বিরোধী মতের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, দলীয় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে—সেখানে একই সরকারের অধীন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা অরণ্যে রোদন বৈকি! গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে আরও জোরালো করেছে। সেখানে রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিককে নির্বাচিত করতে হেন কোনো অপকর্ম নেই যেটা সরকার করেনি। হাওর অধ্যুষিত ওই আসনে এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে যেতেই ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। দুর্গম এই আসনের ফলাফল অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঘোষণা করা হয়েছে মাত্র আধা ঘণ্টায়। অন্যদিকে আধুনিক সব যোগাযোগের সুবিধা সংবলিত ৫ সিটি করপোরেশনের ফলাফল পেতে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ মুহিতুল অসীম নির্বাচনের পর তথ্য-প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও মিডিয়ার দলবাজির কারণে সেটা তেমন আলোচনায় আসেনি।
হাতেগোনা যে ক’টি সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম ছিল তার গলা টিপে ফ্যাসিস্ট আচরণের মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করতে চাচ্ছে, চুরি করা অপরাধ নয, চুরির সংবাদ প্রকাশ করাই অপরাধ। আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ করে অনুগত মিডিয়া দিয়ে বৃক্ষনিধনের কথিত গল্প ফেঁদেও কি সরকার গণহত্যার ঘটনা লুকাতে পেরেছে? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন, আল জাজিরা ও ইকোনমিস্টে তথ্য-প্রমাণসহ মতিঝিলের গণহত্যার ঘটনা প্রচারের পাশাপাশি উঠে এসেছে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নামে ইয়েলো জার্নালিজমের নোংরা চিত্র।
এখন প্রয়োজন হলুদ সাংবাদিকতা ও তথ্যসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। গোয়েবলস সৃষ্টি করেও হিটলারের শেষ রক্ষা হয়নি। সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে কলঙ্কমুক্ত করতে হলে বাংলাদেশের মিডিয়া জগেকও নব্য গোয়েবলসের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। তথ্যসন্ত্রাসের নিপাত হয়ে বাকস্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা মুক্তি পাক—এটি আজ সব গণতন্ত্রকামী সচেতন মানুষের একান্তভাবে কাম্য।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2013/08/12/211712#.Ug8b2X_cvDc
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৮৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন