বেকার সাংবাদিকের ঈদ ভাবনা ও রজব আলীর টি স্টল

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৫ আগস্ট, ২০১৩, ১০:১৬:৫৩ সকাল

ওমর শরীফের বর্তমান পরিচয় বেকার সাংবাদিক। সিনিয়র রিপোর্টার ছিল একটি জাতীয় দৈনিকের। যেটি বর্তমানে ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের নির্মম শিকার হয়ে বন্ধ। ওমর শরীফের মতোই তার অনেক সাংবাদিক বন্ধুকে মুহূর্তেই বেকার করে দেয় এক কালো রাতের বাকশালী নিপীড়ন। একের পর এক আলোচিত দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস করে দেয়ায় সময়ের সাহসী সম্পাদককেও গ্রেফতার করে পুলিশ। একই পত্রিকায় কর্মরত শরীফের কলিগদের কেউ কেউ নতুন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। তবে হলুদ সাংবাদিকতার সঙ্গে আপস করে অন্য কোনো মিডিয়ায় কেউ যোগ দেয়নি। ওমর শরীফ সাংবাদিকতা ছাড়েনি। পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পর প্রথম তিন মাস সঞ্চয় ভেঙে কষ্ট করে চালিয়ে নিয়েছিল। শেষে বাধ্য হয়ে স্ত্রী শিউলি ও তিন বছরের একমাত্র মেয়ে সায়মাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। শিউলি ধনী পরিবারের সন্তান, আর্থিক কষ্ট সহ্য করতে হয়নি কখনও। কিন্তু বাস্তবতা শিউলি সহজেই মেনে নিয়েছিল। শরীফ এখন মাসপ্রতি একবার গ্রামে যায়, সামান্য কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে আসে স্ত্রী ও বিধবা মাকে। স্থানীয় হাই স্কুলে চাকরিও একটা জুটে শিউলির। সব মিলিয়ে বউ-শাশুড়ি চালিয়ে নেয় কষ্ট করে।

ঈদ শপিং নিয়ে ভাবছে শরীফ। ধার করার স্বভাব নেই শরীফের, তবুও একবার ভেবেছিল এ নিয়ে। কিন্তু ধার করবেই বা কার কাছ থেকে? আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে জড়ানোর ইচ্ছে নেই তার। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে যারা একসময় ঘনিষ্ঠ ছিল তারাও এখন বিপদে পড়ার পর নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। কী জানি আবার কখন ধার-কর্জ চেয়ে বসে। অথচ এসব বন্ধুর পাশে সে দাঁড়িয়েছিল একসময়। হাতে টাকা যা ছিল তা দিয়ে বিধবা মা, স্ত্রী-মেয়ের জামাকাপড় টুকিটাকি আর ২-৩ জন গরিব আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য কেনাকাটার পর আর যা অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে গ্রামে আসা-যাওয়া ও ঈদের আনুষঙ্গিক বাজার হবে। একজোড়া জুতো কেনার খুব প্রয়োজন ছিল, কিন্তু টাকা না কুলানোতে শেষে আর কেনা হয়নি। গতবারের পাঞ্জাবিটা ইস্ত্রি করে চালিয়ে নেবে।

রোজকার মতো সন্ধ্যার পর শরীফ রজব চাচার চা দোকানে বসে। রজব আলী মধ্যবয়স্ক মানুষ। মহল্লার মধ্যে তার চায়ের বেশ সুনাম। পেশায় চা বিক্রেতা হলেও দেশের হাল-হকিকত সম্পর্কে বেশ খোঁজখবর রাখেন।

— কী চাচা মিয়া, কেমন আছেন? চায়ের কাপে দুধ চিনি নাড়তে নাড়তে রজব আলীর জিজ্ঞাসা।

— আলহামদুলিল্লাহ চাচা, আছি ভালোই।

— হুনলাম জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করছে। তাদের গঠনতন্ত্রে নাকি আছে—সকল ক্ষমতার উত্স আল্লাহ।

— ঠিকই শুনেছেন চাচা।

— এজন্য নিবন্ধন বাতিল করতে হবে?

— হুম, এটা নাকি দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

— সাংবাদিক সাব, ‘আমিও তো বিশ্বাস করি বল ক্ষমতার উত্স সর্বশক্তিমান আল্লাহ, যেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাহলে কি আমার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাবে?’ পাশ থেকে একজনের প্রতিক্রিয়া।

— আপনি একা নন, ৯০ ভাগ মুসলমানের মধ্যে মুষ্টিমেয় নাস্তিক বাদে সবার বিশ্বাস—আল্লাহই সব ক্ষমতার উত্স।

— তাহলে তো ৮৫ ভাগ জনগণের নাগরিকত্ব বাতিল করা উচিত, যেহেতু তাদের বিশ্বাস সংবিধানের সঙ্গে মেলে না।

এবার আনিস মাস্টার গলা চড়ায়—আজব কারবার! গণতান্ত্রিক দেশ, অথচ সংবিধানের সঙ্গে জনমত সাংঘর্ষিক। হঠাত্ টেবিল চাপড়ে দাঁড়িয়ে যায় যুবলীগ কর্মী কানা বক্কর। চায়ের কাপ উল্টে পড়ে, একটি গ্লাস নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায়। সবাই একটু হতচকিত হয়ে যায়। চিল্লিয়ে ওঠে কানা বক্কর—একটাও ফালতু কথা কইবেন না কইলাম। এই সরকার কোনো দুর্নীতি করেনি। সব দুর্নীতি করেছে বিএনপির তারেক, কোকো।

ফোঁসফোঁস করতে করতে বের হয়ে যায় কানা বক্কর। খানিকক্ষণ সবাই চুপ। রজব আলীই প্রথম মুখ খোলেন। ‘এই পোলা গত দুই বছর আমার দোকানে বাকি খায়। আইজ পর্যন্ত একটা পয়সা দেয় নাই। একদিন টাকা চাওয়াতে দলবল নিয়ে এসে ভাংচুর করে যায়। কারে বিচার দিমু কন? আল্লাহ যদি বিচার করে।’ রজব আলীর কণ্ঠে হাহাকার।

— চাচা ধৈর্য ধরেন, আর ক’টা দিন। এদের টেম্পার শেষ হয়ে আসছে। আল্লাহ চাহে তো এদের করুণ পরাজয় অপেক্ষা করছে। ৫ সিটি নির্বাচনে কি প্রমাণ হয়নি? সান্ত্বনার সুরে বলে শরীফ।

— সাংবাদিক সাব, তাই যেন হয়। হেরে গিয়েও তো শিক্ষা হয়নি তাদের। কয় নাকি সরকার হারেনি, জনগণ ভুল করছে, জনগণ হারছে। এখন আবার উল্টা গান গায়। তাদের অধীনে নাকি সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তাই তত্ত্বাবধায়ক দেবে না।

রজব আলী অনেকক্ষণ কাস্টমার সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন। এবার মুখ খোলেন—আচ্ছা ঐদিন যে গুলশানে যুবলীগ নেতাকে পাঞ্জাবি, টুপি পরে গুলি করে মারা হলো, তার রহস্যটা কী? এক কাস্টমার জবাব দেন—আরে চাচা, এটা তো পাগলেও বুঝে। সিসিটিভিতে ধরা না পড়লে জামায়াত আর হেফাজতের ওপর দোষ চাপানো হতো।

সবাই একযোগে হেসে ওঠে। ‘আমার তো মনে হচ্ছে, হেফাজতের সমাবেশের দিনও এরকম পাঞ্জাবি-টুপি পরে নাশকতা চালানো হয়েছিল, কোরআন পোড়ানো হয়েছিল হেফাজতকে দায়ী করার জন্য।’—আবারও মুখ খোলেন আনিস মাস্টার।

শরীফ যোগ করে—‘হুম। আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি এবং সোনার বাংলাদেশ ব্লগ বন্ধ করে অনুগত মিডিয়া দিয়ে বৃক্ষনিধনের কথিত গল্প ফেঁদেও কি সরকার শাপলা চত্বরের গণহত্যার ঘটনা লুকাতে পেরেছে? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও তথ্যপ্রমাণসহ মতিঝিলের গণহত্যার ঘটনা প্রচারের পাশাপাশি উঠে এসেছে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নামে ইয়েলো জার্নালিজমের নোংরা চিত্র।’

‘সত্য এমন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যা লুকিয়ে রাখা যায় না। সাময়িকভাবে জনমতকে বিভ্রান্ত করা গেলেও সত্যটা একসময় প্রকাশ হয়ে যায়।’—আনিস মাস্টারের প্রতিক্রিয়া।

‘মিথ্যা তত্ত্বের জনক গোয়েবলসকে দিয়েও হিটলারের শেষ রক্ষা হয়নি। হলুদ সাংবাদিকতা ও তথ্যসন্ত্রাস দিয়ে স্বৈরাচারও টিকতে পারবে না ইনশাআল্লাহ’—দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পায় শরীফের বক্তব্যে।

মসজিদে এসময় এশার নামাজের আজান হয়। শরীফ, আনিস মাস্টার ও আরও কয়েকজন বিল মিটিয়ে রওনা হন মসজিদপানে।

বিষয়: বিবিধ

১৩৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File