কুয়াকাটার পথে....
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:৫২:৪০ দুপুর
আমাদের বাড়ি হতে নানাবাড়ির দূরত্ব ছিল প্রায় ১৩-১৪ কিমি, পাশাপাশি দুটি থানা। ছোটবেলায় নানাবাড়ি যেতে পথে ডাকাতিয়া নামে একটা নদী ছিল। বর্ষাকালে নদীর পাড় উপচে পানি উঠত। একবারের কথা মনে আছে। বর্ষাকাল হলেও সেদিন ছিল মেঘমুক্ত পূর্ণিমার আকাশ। আব্বা ও ছুটিতে বাড়ি এলেন। সেই ভরা পূর্ণিমায় আমরা নৌকাযোগে নানা বাড়ি গিয়েছিলাম। নদীর পানিতে রুপালি চাঁদের ঝিকিমিকি। সে এক অভূতপূর্ব ও বিরল দৃশ্য! তখন হতেই নদী-নালার প্রতি এক ধরণের টান অনুভব করতাম। শীতকালে এই নদী শুকিয়ে যেত। কালের বিবর্তনে নতুন রাস্তাঘাট হতে থাকে। নদী পথের বিড়ম্বনা এড়াতে নানাবাড়ি যেতে আমাদের যাত্রাপথও পরিবর্তন হয়।
বড় হয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সিএ ভর্তি হলাম। পেশাগত কারণে ২০০২ হতে ২০০৫ এই সময়কালে আমাকে তখন বাংলাদেশ এর আনাচে কানাচে ঘুরতে হয়েছে। প্রায় অর্ধশত জেলা ঘুরে বেড়িয়েছিলাম তখন পেশাগত প্রয়োজনে। বরিশাল, পটুয়াখালি, খুলনা, বাগেরহাট এইসকল জেলায় যেতে হয়েছিল একাধিকবার। নদনদীর অনাবিল সৌন্দয্যে বেশ বিমোহিত হতাম। তখন নদীনালার প্রতি টানটা আবার খানিকটা বেড়ে গেল। মনে মনে সংকল্প করলুম- বিয়ে যদি করি তবে এই নদী নালার দেশেই করব। মহান আল্লাহ আমার ফরিয়াদ শুনলেন, কিভাবে যেন মিলেও গেল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর (মেয়ের পক্ষে) আমার শ্বশুড়দের আদিনিবাস ভারতে হলেও তিন পুরুষ ধরে বরগুনা জেলার অধিবাসি। যদিও আমার স্ত্রী মির্জা আবিদা পড়াশোনার সূত্রে দীর্ঘ অনেক বছর ঢাকার অধিবাসি। তবে বিয়ের পর নদী সাগর দেখতে যাওয়ার আর অবসর মিলছিলনা সীমাহীন ব্যস্ততার কারণে। একবার গিয়েছিলাম ২০১১ সালে। তখন শ্বশুড় বাড়ির জামাই আদর উপভোগ করতে গিয়ে আর ঘুরে বেড়ানো খুব একটা হলোনা। তবে এবার সুযোগ এসে গেল। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ছুটির সাথে দুইদিন হরতাল ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলে ভালো একটা অবসর পেয়ে গেলাম।
যাত্রা হল শুরুঃ
২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে লঞ্চে যাত্রা শুরু করলাম। আগে থেকে ফোনে কেবিন বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। বিকেল পাঁচটায় লঞ্চ ছাড়ল বরগুনা আমতলীর উদ্দেশ্যে। সাথে নিলাম রান্না করা খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও পানীয়। সময় বাঁচাতে চাইলে বাসেও যাওয়া যায়। সায়েদাবাদ ও গাবতলী হতে সাকুরা পরিবহন ছাড়ে রাত সাড়ে সাতটায়, পৌছে পরদিন ভোর পাঁচটায়। তবে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য লঞ্চই উত্তম। লঞ্চে ঘুম, নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ ও অন্যান্য সুবিধার পাশাপাশি জামাতে নামাজ পড়ার সুন্দর ব্যবস্থাও আছে।
লঞ্চভ্রমণ দারুণ উপভোগ করেছে আমাদের জুনিয়র।
লঞ্চ হতে পরদিন পায়রা নদীতে দেখা সূর্যোদয়ের দৃশ্য ছিল ভাষায় বর্ণনাতীত।
২৭ শে মার্চ সকাল ৮ টার মধ্যে আমরা পৌছে গেলাম বরগুনা জেলার আমতলীতে। সেদিন আর কোথাও বের হইনি। শ্বশুড় বাড়ির আদর আপ্যায়ণ আর বিশ্রামেই কাটিয়ে দিলাম সারাদিন।
গন্তব্য এবার কুয়াকাটাঃ
২৮ শে মার্চ মধ্যাহ্ন ভোজের পরই ভাড়া করা মোটর সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম মূল গন্তব্য কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য যে, গ্যাস না থাকায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সিএনজিচালিত কোন বাহন নেই । স্থানীয়ভাবে চলাচলের উত্তম বাহন হচ্ছে মোটরসাইকেল। এছাড়া ইজিবাইক, ইঞ্জিনচালিত ভ্যান, ভটভটি, করিমন, নসিমন এইসব যানবাহন ও রয়েছে বেশ।
নদীর নাম আন্ধারমানিকঃ
অসাধারণ সুন্দর একটি নদী এই আন্ধারমানিক। কুয়াকাটার চাইতে এর সৌন্দর্য্য কম নয়। ট্রলারে করে আমরা আন্ধারমানিক নদী পার হলাম। ক্যামেরায় আন্ধারমানিকের অনেক আকর্ষণ ধারণ করতে ব্যর্থ হলেও কিছুটা নিয়েছি।
আন্ধারমানিক পার হয়ে এরপর পাখিমারা। পটুয়াখালি জেলা সীমানা এসে গেছে। পথ চলতে চোখে পড়ল মহিষের পাল, গোল বৃক্ষের বাগান, ছোট বড় নানা খাল, সৌদি অর্থায়নে নির্মিত সুদৃশ্য সাইক্লোনসেন্টারসমূহ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও এর তত্বাবধানে নানা ধরনের প্রজেক্ট অফিস। এগিয়ে চলছে আমাদের মটরসাইকেল। পথে আরো দুটি নদী পড়ল। ফেরীতে পার হলুম। আরে, এইতো দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন হোটেল, মোটেল। শোনা যাচ্ছে সাগরের পানির সোঁ সোঁ গর্জন। কুয়াকাটা সৈকতে এসেই গেলাম বলে।
কুয়াকাটা সৈকতেঃ
বেলা তিনটায় আমরা পৌছে গেলাম কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। হরতাল এবং ছুটির দিন না হওয়ায় সৈকতে ভীড় খুব কম ছিল। এর আগে পতেঙ্গা, সাগরিকা (জেলেপাড়া বীচ, চট্টগ্রাম), কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকতে একাধিকবার গিয়েছিলাম। কুয়াকাটা সৈকত এর সৌন্দর্য্য ঐসব বীচের মতো অনেক মনোরম। তবে কুয়াকাটার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটিই একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখানে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটিই দেখা যায়।
সাগরের বিশাল জলরাশি আছড়ে পড়ছে কুলে আর সূর্যের আলোর ঝিকিমিকিতে তাঁর সৌন্দর্য্যের মাত্রা নিতান্ত বেরসিক ব্যক্তির মনেও রোমান্স জাগায়।
সাগরপাড়ে লাল কাঁকড়ার শৈল্পিক কারুকার্য্য-
পায়রা নদীতে সূর্যোদয় দেখেছিলাম আগের দিন। আজ কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত দেখব প্রাণভরে। এমনই পরিকল্পনা। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে দেখতে এতই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে ক্যামেরায় ক্লিক করতে বেমালুম ভুলে গেলাম আমরা দুজনেই।
ফেরার পথে আরো দেখলাম বৌদ্ধ মন্দির, রাখাইন মহিলা মার্কেট, শুটকী মার্কেট। টুকটাক কেনাকাটাও করলাম। শামুক ঝিনুক দিয়ে তৈরি খুব সুন্দর একটি ঝাড়বাতি কিনলো আমার স্ত্রী।
একটি পাখি, দুইটি ডিমঃ
সাগরতীরে গাছ গাছালির ভিড়ে হাঁটছিলাম। একটি নির্জীব কাঠের টুকরোর মত কিছু একটা চোখে পড়ল। গুরুত্ব দিলামনা। হঠাৎ দেখলাম নড়ে উঠল। তাড়াতাড়ি ছবি নিলাম। কাছে যেতেই ফুড়ুৎ। দেখি পড়ে আছে ছোট্ট দুটি ডিম। কিছুটা বড় আকৃতির অদ্ভূত একটা পাখি। খুব একটা উড়তে পারেনা। তাই গাছের বদলে মাটিতেই ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটানোর প্রস্তুতি। তবে মাটিতে কোন শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও রঙ বৈচিত্র্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাঁর গাঁয়ের রঙ। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। মহান আল্লাহর কি অসীম কুদরত!
শেষ কথাঃ
পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত বিখ্যাত কুয়াকাটা সৈকতে ঢাকা হতে যাওয়া যায় অনেকভাবেই। নদীপথের সৌন্দর্য্য বোনাস হিসেবে উপভোগ করতে চাইলে লঞ্চই ভরসা। সরাসরি কুয়াকাটার লঞ্চও পাবেন সদরঘাট হতে। কুয়াকাটায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটনের সুব্যবস্থা আছে। পর্যটন কর্পোরেশন এর বহুতল মোটেল আছে সৈকতের খুব নিকটেই। সময় নিয়ে আসলে কুয়াকাটা বীচ হতে যেতে পারেন আরো নানা জায়গায়। বিভিন্ন বেসরকারি পর্যটন সংস্থা ও গাইডদের উদ্যোগে কুয়াকাটার কাছাকাছি অনেক আকর্ষণীয় স্থানে ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে ফাতরার জঙ্গল যেতে ভুলবেননা। এটি সুন্দরবনের একটি অংশ। কুয়াকাটা হতে যেতে দেড় দুই ঘন্টা লাগে।
বিষয়: বিবিধ
২৯১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন