বিনা টিকিটে বাস ভ্রমন!
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৪৫:১২ সকাল
প্রবাস জীবনে শুরুতে যে বিষয়গুলো খুব দৃষ্টি আকর্ষন করতো তারমধ্যে একটি ছিলো এদেশের পরিবহন ব্যাবস্হা। বিশাল সাইজের বাসগুলো নির্ধারিত যথাসময়ে প্রতিটি স্টপেজে এসে থামে এবং নির্দিস্ট গন্তব্যে ছুটে চলে যাত্রীদের নিয়ে। প্রতিটি বাস যখন থামে শুধুমাত্র তখনই দরজাগুলো খোলা হয়,সামনের ও পিছনের দরজা দিয়ে যাত্রীরা উঠে এবং মাঝখানের দরজা দিয়ে যাত্রীরা নেমে যায়। প্রচন্ড ভিড়েও খেয়াল করেছি নির্দিস্ট দূরত্ব বজায় রেখেই কোন ধরনের ধাক্কাধাক্কি ছাড়াই সবাই আরোহন এবং অবতরন করেন। মজা লাগত যখন দেখতাম কোন হেল্পার এবং কন্ডাক্টর এর সহযোগিতা ছাড়াই ড্রাইভার সাবলীল ভাবেই গাড়ি চালাতেন।( তখন শুধু আমাদের দেশের বাসগুলোর কথা মনে পড়তো! )
অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, বাসে কোন টিকিট কন্ট্রোলার ছাড়াই সবাই নিজ দায়িত্বে টিকিট কেটে বাসে উঠতো! ওদের সততায় মুগ্ধ হতাম!
প্রথম থেকেই সারার পাপা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কিভাবে টিকিট কিনতে হয়, কিভাবে তা বাসে উঠে মেশিনে পান্চ করতে হয়। সাথে এও বলেছিলেন কখনো যদি আমার কাছে টিকিট না থাকে বা খুচরা পয়সা না থাকে তবু যেন আমি বিনা টিকিটে বাসে না উঠি কেননা এটা অপরাধ এবং কিয়ামতের দিন আমাকে এই বাস কম্পানির মালিক থেকে শুরু করে সবাইকে খুঁজে বের করে এই টিকিটের দাম মিটাতে হবে! আর সেদিনের ভয়াবহ অবস্হা কি হবে সেটাতো জানা আছেই!
আলহামদুলিল্লাহ, দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবনে বসবাস করে এমন কিছু মূল নীতি শিখেছি এবং শিখে চলছি প্রতিনিয়ত এমন ভাবে ভাবার সুযোগ স্বদেশে হয়নি!
আমাদের আশেপাশের বোনদের নিয়ে প্রায়ই চা পানের উদ্দেশ্যে একসাথে বসা হয়। এক বোন উনার কর্মজীবনের কথার ফাঁকে বলছিলেন যে, সেখানে নাকি কিছু মরোক্কান মহিলা আছে যারা নাকি ক্লিন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। আর এরা নাকি এমন যে টয়লেট টিস্যু গুলো পর্যন্ত নিজ বাসায় নিয়ে যায়! উনি আফসোস করে বলছিলেন, দেশে থাকতে ভাবতাম, ওদের ভাষা আরবী, ওরা অনেক ভালো মুসলিম, কিন্তু গুটিকয়েক মরোক্কান ছাড়া বেশীরভাগকেই উনি চোর হিসেবে পেয়েছেন!শুনে সবাই মন খারাপ করলাম শত হলেও মুসলিম বলে কথা!
আমি বললাম আমার সাথে একজন মরোক্কান মহিলার পরিচয় ছিলো, ওর সাথে একদিন বাসে দেখা, দেখলাম ও টিকিট ছাড়াই বাসে চড়েছে, ভাবলাম ও হয়তো ভুলে গিয়েছে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বললো ও নাকি কখনোই টিকিট কিনে না! আমি বললাম, এটা তো গুনাহ হবে! ও হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলো আমার কথা!
এই কথা শুনে আমাদের চা- মজলিসের একজন বোন বললো, উনি নাকি শুধু রমাদ্বানে বাসে চড়লে টিকিট কিনে অন্য সময় বিনা টিকিতে চড়ে! আমি বললাম,শুধু রমাদ্বানেই কি আমরা বেটার মুসলিম হওয়ার ট্রাই করবো? আর অন্য সময় হাফ মুসলিম হাফ চোর?এটা কি ইসলাম এলাউ করে?
উনি বললেন -চোর হতে যাবো কেনো? আমি তো খুব কম বাসে চড়ি!
আমি উনাকে বুঝিয়ে বলার পর উনি তা মেনে নিলেন,বেশী কাজ হলো যখন বললাম এখন ফাঁকি দিচ্ছেন বাস মালিককে কিন্তু কিয়ামতের দিন এই ফাঁকির ভর্তুকি হিসেবে যখন নিজের করা নেক আমল দিয়ে ক্ষতিপূরন দিতে হবে এবং বাস মালিক মাফ না করা পর্যন্ত মাফ পাবেন না তখন কি করবেন? অবশেষে বেচারীও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন!
সপরিবারে ফিরছিলাম এবং বাসে চড়েই। অনেকটুকু পথ আসার পর একটা স্টপেজ থেকে তিনজন ভদ্রলোক উঠলেন। বই পড়ছিলাম, সম্বিত পেলাম সজোরে শুভ রাত্রি সম্বোধনে! তাকিয়ে দেখলাম টিকিট কন্ট্রোলার। মাঝে মাঝে উনারা টিকিট চেক করার জন্য উঠেন বিনা ঘোষনায়। (যেখানে স্বাভাবিকভাবে টিকিটের মূল্য ১ ইউরো ৫০সেন্ট, যদি কন্ট্রোলার চেক করে যাত্রীর নিকট টিকিট না পান তবে জরিমানা হবে ৮০ ইউরো!)
বাসে সবাই নড়ে চড়ে বসলো! আমরা সবমিলিয়ে বাসে যাত্রী ছিলাম প্রায় ১৫ জন, এরমধ্যে ১৩ জনের টিকিট ছিলো আর দুজনের ছিলো না! দূর্ভাগ্যবশত দুজনই মরোক্কান (মুসলিম) !
আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাহ, শ্রেষ্ঠ জাতি। আমাদের আচার-আচরন, কথা- বার্তা, লেন-দেন, বিনয়- নম্রতা সবকিছু দিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য তুলে ধরা উচিত! আর আমরা অনেক ক্ষেত্রেই আরব দেশবাসীদের বা আরবী ভাষীদের আদর্শ মুসলিম মনে করি অথবা শুধু নিয়মিত ধর্মীয় কিছু আচার অনুষ্ঠান মেনে চললেই আদর্শ মুসলিম ভাবি কিন্তু শুধু আরবী ভাষায় কথাবলাই বা কিছু নিয়ম মেনে চলে বলেই একজন আদর্শ মুসলিম হওয়ার জন্য যথেস্ট নয়! বরন্চ আদর্শ মুসলিম হওয়ার জন্য দরকার জ্ঞান! এই জ্ঞানের কারনে পার্থক্য করা যায় মুসলিমদের ক্যাটাগরির!
আমরা প্রতিটা মুসলিম যদি এভাবে চলতে চেষ্টা করি যে, নিয়মিত জ্ঞান অর্জন করি, যতটুকু জানছি মেনে চলার চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু নিজেদের আমল সুন্দর হয় পাশাপাশি ইসলামের সুন্দর নমুনাগুলির প্রচারও হয়!
আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত প্রতিটি অমুসলিম একজন সম্ভাবনাময় মুসলিম অথচ আমাদের আচরনের কারনেই ওরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল একটা ধারনা তৈরী করে নিচ্ছে !
আজকে আমরা যারা মুসলিম কোথায় আমাদের ঈমানের সৌন্দর্য, কোথায় আমাদের কথা আর কাজের মিল! নিজেদের নৈতিক অধ:পতন আর আজকের দুরাবস্হার জন্য কি আমরাই দায়ী নই? আমাদের যেখানে সকলের প্রাপ্যকে সঠিক ভাবে বুঝিয়ে দিবার কথা সেখানে এই সামান্য টিকিট কেনা নিয়ে ধোকবাজির মতো ধৃষ্টতা কোথা থেকে আসে?
বিষয়: বিবিধ
২০১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন